লকডাউন ডায়েরি – ২৪ মে, ২০২০

২৪.‌০৫.‌২০২০। রবিবার

সকাল ৮.‌০০

অ্যালার্ম শুনে ঘুম ভাঙেনি। অ্যালার্ম বেজেছে। কিন্তু তার অনেক আগে থেকে উঠে ঝুম হয়ে বসে আছি বিছানায়। কারণ, এই প্রথম ঘুম ভাঙল মুখে একটা তিতকুটে স্বাদ নিয়ে। একটা ‘ভাল্লাগছে না’ বোধ নিয়ে। শরীরটাও ঠিক জুতের নেই বলে মনে হচ্ছে।

মা–বাবাকে চা দিয়ে এলাম। খুব অস্বস্তির সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, বিস্কুট ফুরিয়ে গিয়েছে। আনতে হবে। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। গত দু’মাসে কখনও এমন হয়নি। যা–ই হোক, সবসময় পজিটিভ থেকেছি। চারপাশটাকে এনার্জাইজ্‌ড করে রাখতে চেষ্টা করেছি। এভারেডি ব্যাটারির মতো। আজ মনে হচ্ছে, ব্যাটারি ফুরোচ্ছে। শরীর–মন দুটোই জবাব দিতে বসেছে। সারাদিন অনেক কাজ আছে। সল্টলেকের বাড়িতে কিছু কাজ পড়ে আছে। পারলে একবার চেতলা যেতে হবে। অফিস যেতে হবে। রবিবার অফিসে বাড়তি চাপও থাকে। কিন্তু কিছু ভাল লাগছে না।

এটা কেন হচ্ছে?‌ আমার কি ডিপ্রেশন হল?‌

যে কোনও বিষয়ে বরাবর ‘গো টু পার্সন’ থেকেছি। পরিবারে এই প্রজন্মে আমি একমাত্র পুত্রসন্তান। ফলে সকলেই এদিকে তাকিয়ে। বৃহত্তর পরিবারের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া, আত্মীয়দের দায়ে–দফায় পাশে গিয়ে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে বকঝকা দিয়ে লোকজনকে লাইনে আনা— সবকিছু আমার ঘাড়ে। তাতে যে খারাপ লেগেছে, তা নয়। বোঝা বলেও মনে হয়নি। কিন্তু আজ সকাল থেকে কেন জানি না, মনে হচ্ছে, ধুস!‌ সব ফালতু। সব বৃথা। শরীর টানছে না। মন সায় দিচ্ছে না।

এটাই কি ডিপ্রেশন?‌

অথচ সারা জীবন মনে হয়েছে ডিপ্রেশন–টিপ্রেশন বাজে বকওয়াস। বিলাসিতা। সারাদিন এত কাজ। এত ব্যস্ততা। ডিপ্রেস্‌ড হওয়ার সময় কোথায়?‌ ইন ফ্যাক্ট, সবসময় চেয়েছি একের পর এক কাজ দিয়ে দিনের সব খাপখোপ ভরে রাখতে। যাতে কখনও বিশ্রাম নেওয়ার, এলিয়ে পড়ার এবং চিন্তা করার সময়টুকুও না থাকে। অন্ধের মতো পারফেকশনকে ধাওয়া করে গিয়েছি। সেটা কপি লেখা হোক বা কাগজ বানানো বা বাড়ি পরিষ্কার করা। প্রয়োজন না হলেও সমস্ত কাজে নিজের ৫০০ পার্সেন্ট দিয়েছি। সবসময় মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করেছি, পজিটিভ থাকতে হবে। পজিটিভ থাকতে হবে। কোনও নেতিবাচকতাকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া চলবে না।

কিন্তু আজ সেগুলোও ভাবতে ইচ্ছে করছে না। নিজের ডিপ্রেশনের কাহিনি বলতে গিয়ে দীপিকা পাড়ুকোন বলেছিল, ‘হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চারদিকটা কেমন ফাঁকা আর অর্থহীন মনে হল। মনে হল, কেন বেঁচে আছি!‌’ আমার মনে বেঁচে থাকা নিয়ে কোনও প্রশ্ন এখনও আসেনি। কিন্তু ফাঁকা আর অর্থহীন লাগতে শুরু করেছে। এটা কি লকডাউন এফেক্ট?‌ নাকি আমপান এফেক্ট?‌ নাকি নিছক সাময়িক ক্লান্তি?‌

সকাল ১০.‌০০

এতক্ষণ চুপটি করে শুয়েছিলাম। ভাল লাগছিল না। এখন মনে হচ্ছে, সেটা করলে চলবে না। কতক্ষণ এভাবে তক্তার মতো পড়ে থাকব?‌ কতদিন ওয়ার্কআউট করা হয় না!‌ ইচ্ছে করে না। দিনের যাবতীয় রুটিন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। লকডাউনের পর থেকে পুরো দিনটা একটা নিটোল বৃত্তের মধ্যে থাকত। গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ সেই বৃত্তটা এলোমেলো করে দিয়েছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছি টুকরো–টাকরাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে জড়ো করে আবার বৃত্তটা তৈরি করার। হচ্ছে না। এটা নেহাত আলস্য নয়। এটা সকাল সকাল উঠে চিরতার জল খাওয়ার মতো অনুভূতি।

আপাতত চেতলা যাই। ক্লান্ত লাগছে। তা–ও যেতে হবে। কাজ আছে।

দুপুর ১২.‌৩০

চেতলা থেকে এইমাত্র ফিরলাম। আসলে চেতলা থেকে নয়। ফিরলাম বিধ্বস্ত দক্ষিণ কলকাতা থেকে। যা সম্ভবত এই আপাত–ডিপ্রেশনের মেয়াদ আরও বাড়িয়ে দিল।

সল্টলেকে থেকে যে রুটে যাই, সেই ইউজুয়্যাল রাস্তা ধরেই গিয়েছিলাম। মা উড়ালপুল ধরে রেসকোর্সের সামনে নেমে বাঁদিকে ঘুরে ডিএল খান রোড হয়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের সামনে থেকে ডানদিকে ঘুরে চেতলা হাট রোডের প্যারালাল রাস্তাটা ধরে সোজা। দেখলাম, সেই রাস্তা জুড়ে এখনও গাছ পড়ে আছে। কোনওক্রমে সরিয়ে গাড়ি চলাচলের পথটুকু করা হয়েছে। তার আগে দেখলাম ‘উত্তীর্ণ’–র সামনে তিনকোনা জমিতে ঝড়ের ছেড়ে যাওয়া চিহ্ন। বিশাল বিশাল গাছ রেলিং–টেলিং দুমড়ে নিয়ে রাস্তার উপর পড়েছে। সেগুলো কাটার কাজ শুরু হয়েছে সবে। পুলিশ আর রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দল কাজ করছে।

অ্যাপার্টমেন্টের লিফ্‌ট বিকল। বৃষ্টির জল পোর্টিকো টপকে এসে লিফ্‌টের খোঁদলে ঢুকে গিয়েছিল। এখনও সেটা বার করা যায়নি। বা বার করা হয়নি। কোম্পানির লোক কবে আসবে, সেজন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। এরপর নিশ্চয়ই ওই জমা জল পচে গন্ধ বেরোবে। তখন হয়তো নিজেদেরই জল বার করতে নামতে হবে।

সিঁড়িতে রণদেবের সঙ্গে দেখা হল। বেচারা মাছ–মাংস বাজার করে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঝুলিয়ে ফিরছে। করুণ হাসি হাসল। আমি করুণতর হাসি ফেরত দিলাম।

বঙ্কু আমায় ডিভোর্স দিয়েছে। লবঙ্গর শরীরটা খারাপ। আমায় দেখে লাফিয়ে কোলে এল বটে। কিন্তু সেই তেজ নেই। বরং ইনস্টু আর ট্রাইপড এখন অনেক বেটার। দুটোই এত ভাল বাচ্চা যে কী বলব!‌ ওদের সঙ্গে বারান্দায় খানিকক্ষণ সময় কাটালাম। বারান্দা থেকেই দেখলাম, রাস্তায় প্রচুর মোটরবাইক চলছে। রবিবারের আড্ডার আসরও বসেছে। বোধহয় এই বোধোদয় হয়েছে যে, করোনাভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হবে। এছাড়া তো আর কোনও উপায়ও দেখছি না।

ভেবেছিলাম বেরিয়ে ডিম কিনব। কিন্তু দোকান বন্ধ। তবে বিস্কুট নিলাম।

ফেরার সময় সাদার্ন অ্যাভিনিউ, লেকের চত্বর হয়ে এলাম। এই জায়গাটা একসময় আমার নিয়মিত বিচরণক্ষেত্র ছিল। গোটা শহরের মধ্যে সাদার্ন অ্যাভিনিউ আমার অন্যতম প্রিয় রাস্তা। এই রাস্তায় যে কত স্মৃতি!‌ অফিস থেকে ফেরার সময় প্রায় রাতেই এই রাস্তা ধরে ফিরতাম। সাড়ে তিনবছর আগে চাকরি ছাড়ার পর বেকার হয়ে টানা দেড়টি মাস প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যায় এই রাস্তা ধরে হেঁটেছি। ইচ্ছে করেই লেক কালীবাড়ির ফুটপাথটায় যেতাম না। ওদিকটায় জনবসতি। তখন লোকজনের কোলাহল ভাল লাগত না। তাই হাঁটতাম লেকের ধারের ফুটপাথ দিয়ে। সেই রাস্তার প্রতিটি গাছ, ফুটপাথের প্রতিটি টাইল আমার চেনা। খারাপ সময়ে ওদের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা হয়েছিল।

সেই সাদার্ন অ্যাভিনিউ এখন পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপের মতো। গাছ সরিয়ে গাড়ি চলাচলের একটা শুঁড়িপথ তৈরি হয়েছে বটে। কিন্তু মনে হচ্ছিল, অরণ্যদেব কমিক্‌সের ফিসফিসে কুঞ্জে ঢুকছি। অথবা অ্যামাজনের রেন ফরেস্টে। দু’পাশে গাছের দেওয়াল, মাথার উপর গাছের ছাদ দিয়ে তৈরি একটা গুহায় ঢুকছে গাড়িগুলো। কত চেনা গাছ উপড়ে গেল শিকড়সুদ্ধ। ভেঙে পড়ল কত পরিচিত মহীরূহ। চিরচেনা রাস্তাটাকে আর চেনা যাচ্ছিল না।

একটা সময় রোজ ভোরে লেকে হাঁটতে যেতাম। ফুল–ফুল হাঁটা নয়। ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবের সামনের ড্রপগেট থেকে পঞ্চাননতলার দিকের ড্রপগেট পর্যন্ত তিনবার যাওয়া। তিনবার আসা। ঘড়ি ঘরে ননস্টপ ৭৫ মিনিট। এতটাই সিরিয়াস ছিলাম যে, বর্ষাকালে ছাতা–মাথায়ও হেঁটেছি। তারপর একদিন মনে হল, ধুস! ‌একা একা হাঁটাটা খুব বোরিং। কোনও লড়াই নেই। প্রতিযোগিতা নেই। হারজিত নেই। তাই দুম করে ছেড়ে দিলাম। তারপর থেকেই ব্যাডমিন্টন শুরু। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে আর লেকে ঢোকা যায় না। আর আমপানের পর যা অবস্থা হয়েছে, তাতে করোনা চলে গেলেও আবার কবে ভিতরে ঢোকা যাবে কে জানে!‌

লেকের পাশের রাস্তা ধরে লেক গার্ডেন্‌স ফ্লাইওভার দিয়ে যেতাম মিলন সঙ্ঘের ইনডোর কোর্টে। ব্যাডমিন্টন খেলতে। সপ্তাহে চারদিন। প্রায় সারাবছর। প্রতিদিন এই রাস্তা ধরে কত মানুষ হাঁটতেন। জগিং করতেন। দেখতে দেখতে মুখচেনা হয়ে গিয়েছিল। সেই রাস্তার অবস্থা চোখে দেখা যায় না!‌ যাওয়ার রাস্তাটা গাছ পড়ে পুরোপুরি বন্ধ। পাশের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। কেউ কি জানে কবে এইসব বাধা সরানো হবে?‌

খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, ঘূর্ণিঝড়ের পর চার–চারটে দিন কেটে গেল!‌ এখনও চারদিকের এই অবস্থা কেন। জানি, নজিরবিহীন বিপর্যয়। জানি, করোনা–সংক্রমণের কারণে কর্মীর সঙ্কট রয়েছে। কিন্তু এগুলো তো অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার কাজ। এসেনশিয়াল সার্ভিস। বিপর্যয়ের সময়েই তো এগুলোর বেশি চালু থাকা দরকার। সাধে কি অধৈর্য হচ্ছেন মানুষ?‌ সাধে কি তাঁরা ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পথ অবরোধ করছেন?‌

তা–ও ঝড়ের চারদিন পর!

দুপুর ১.‌১০

গত কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছে আমপান–কালে সর্বাধিক চর্চিত এবং আলোচিত চরিত্র কে?‌ কান্তি গাঙ্গুলি।

সুন্দরবন কান্তি’দার ঘরবাড়ি। অনেক আগে থেকেই। আয়লার সময় তিনিই উদ্ধারকর্তা ছিলেন। ধুতিটাকে লুঙ্গির মতো করে পেঁচিয়ে, হাফহাতা গেঞ্জি গায়ে আর কাঁধে গামছা নিয়ে আমপানের সময়েও তিনিই এলাকায়।

ঘটনাপ্রবাহ বলছে, আয়লার সময় এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো সত্ত্বেও রায়দিঘি তাঁকে ভোটে জেতায়নি। পরপর দু’বার তিনি হেরেছেন তৃণমূলের দেবশ্রী রায়ের কাছে। যাঁকে এলাকায় দেখা যায় বলে বিশেষ অভিযোগ নেই। কিন্তু কান্তি রাজনীতিকের পরিচিত রাস্তায় হাঁটেননি। ভোটের বিনিময়ে যাঁরা কাজ দেন, এই প্রবীণ তাদের দলে পড়েন না। তাঁকে ভোট দেয়নি মানুষ। ফলে তিনি কঠিন সময়ে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন— এটা কোনও পরিণত রাজনীতিককে মানায় না। কান্তি সেটা জানেন। ফলে ভোটের রেজাল্ট যা–ই হোক, দুর্যোগ, দুর্বিপাকে এবং দরকারে তাঁকে জনতার পাশে দেখা যায়। দেখা যাচ্ছে। এবং তাঁর সেই নীচুগ্রামীণ অথচ সোচ্চার উপস্থিতি রাজ্য জুড়ে এতটাই হিল্লোল তুলেছে যে, আমপান নিয়ে উদাসীন ন্যাশনাল মিডিয়াও কান্তিকে নিয়ে বিস্তারিত স্টোরি করেছে।

ব্যক্তিগতভাবে কান্তিকে আমার বরাবর দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষ চক্রবর্তী বলে মনে হয়েছে। সুভাষ যেমন অনেক সময়েই দলকে অগ্রাহ্য করে এবং আলিমুদ্দিনকে হেলায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে নিজের স্টাইলে চলতেন, কান্তিও তেমনই। বহু বছর আগে একবার তাঁর সঙ্গে সামান্য ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তখন তাঁকে সেকথা বলেওছিলাম। স্বভাবজ বিনয়ে কান্তি হেসে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেও ভিতরে ভিতরে জানতেন, এই অর্বাচীন ভুল কিছু ভাবেনি। সুভাষের মতো দল বিভিন্ন সময়ে তাঁরও রাশ টেনে ধরতে চেয়েছে। আলিমুদ্দিন এবং প্রশাসনের একচ্ছত্র নেতা কান্তির গেঁয়ো এবং মাঠো স্বভাব নিয়ে নাক সিঁটকেছেন। কিন্তু কান্তিকে রোখা যায়নি।

যেমন এই আমপানের সময়েও গেল না। নিজের উদ্যোগে ঘূর্ণিঝড়ের আগে এলাকায় চলে গেলেন। নিজের উদ্যোগে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানালেন, তিনি সাহায্য করতে চান। ঘূর্ণিঝড়ের পর নিজের উদ্যোগে এলাকার মেয়ে–পুরুষদের নিয়ে বাঁধ মেরামতি শুরু করলেন। ভোট–টোট চুলোয় যাক। ৭৭ বছরের প্রৌঢ় আর কখনও ভোটে দাঁড়াবেন কিনা, কে জানে!‌ ভুল লিখলাম, আলিমুদ্দিন জানে। কিন্তু মনে হয় না, সেটা তাঁর লক্ষ্য। তাঁর অনেক বেশি আনন্দ সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে সেই গেঁড়ি গেঁড়ি কালো কালো বাচ্চাদের উন্নয়নে, যাদের কেউ কেউ তাঁকে দূর থেকে বিস্ফারিত নয়নে দেখে। কেউ ‘দাদু–দাদু’ বলে দৌড়ে এসে হাত ধরে ঝুলে পড়ে।

কান্তি গাঙ্গুলি পরোপকার করেন আপন খেয়ালে। যেমন লিরিক কবি কবিতা লেখেন নিজের আনন্দে।

দুপুর ১.‌২৫

সামান্য খেয়ে একটু গড়িয়ে পড়েছিলাম। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে দুটো জিনিস প্রণিধানযোগ্য—

১. দক্ষ সংগঠক মানেই দক্ষ প্রশাসক নয়। সংগঠন করতে গেলে প্রাথমিকভাবে হইহই করে কিছু লোক জোটাতে হয়। তারপর তাদের তুইয়ে–বুইয়ে চলতে হয়। কারণ, সংগঠক জানে, ওই লোকগুলো সরে গেলেই তার ভিত নড়ে যাবে। পক্ষান্তরে, প্রশাসকের ধাতু এবং ধাতটাই আলাদা। তাকে সময়ে সময়ে নির্মোহ এবং নৈর্ব্যক্তিক হতে হয়। তার মধ্যে একটা সেন্স অফ ফেয়ারনেস থাকতে হয়। তাতে কিছু অকাজের লোক তার উপর ক্রুদ্ধ হয়। তার জনপ্রিয় হওয়া হয় না। কিন্তু সামগ্রিক এবং ব্যাপক অর্থে সে বহুজনসুখায় এবং বহুজনহিতায় কাজ করে।

২.‌ রাজনীতিতে কিছু মিথ্যে বলতেই হয়। তার কিছু ক্লাসি এবং শৌখিন মিথ্যে। আর কিছু মিথ্যে ক্লাসলেস এবং চশমখোর। কালক্রমে সব মিথ্যেই ধরা পড়ে। কিন্তু লোকে মনে রাখে, কোন লোকটা কোন টাইপের মিথ্যে বলেছিল। ক্লাসি এবং শৌখিন?‌ নাকি ক্লাসলেস এবং চশমখোর।

দুপুর ‌২.‌৩৮

অফিস যেতে হবে। কিন্তু ইচ্ছে করছে না।

আবার দিলীপ ঘোষকে আটকেছে পুলিশ। আজ পূর্ব মেদিনীপুরে। বলা হয়েছে, তিনি গেলে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হবে। তমলুকের কাছে নন্দকুমারে বাধা পেয়ে আবার টিভি–তে গরম বিবৃতি দিচ্ছেন দিলীপ। গাড়ি থেকে নেমে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার বিলি করেছেন।

তৃণমূল বলছে, দিলীপ শিশুসুলভ আচরণ করছেন। খবরে থাকতে চাইছেন। প্রশ্ন হল, তাঁকে খবরে আনছে কারা?‌

দুপুর ৩.‌৩৫

রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর টুইট করে জানিয়েছে, আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার।

গত কয়েকদিনে করোনাভাইরাসকে প্রায় ভুলেই গিয়েছে কলকাতা। নৈমিত্তিক পরিষেবাহীন দিনযাপনের গ্লানির চোটে সামাজিক দূরত্ব মাথায় উঠেছে শহরের। এই বিদ্যুৎ বিপর্যয় না হলে সম্ভবত জানতেও পারতাম না, কলকাতা শহরে কত মধুমেহ রোগাক্রান্ত অসহায় মানুষের বাস। তাঁদের ইনসুলিন রাখা থাকে রেফ্রিজারেটরে। কারেন্ট না থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেই ইনসুলিন। বিপন্ন মানুষ রাস্তায় বসে পড়ছেন। কেউ মারণ ক্যানসারের রোগী। কারও হার্টের অসুখ। কত কত অসহায় বয়স্ক মানুষ!‌

বিদ্যুৎ ফিরে এলে তাঁরা কি সকলে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর তথা রাজ্য সরকারকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবেন?‌

সন্ধ্যা ৬.‌৩৪

রাজ্য সরকার এবং সিইএসসি–র মধ্যে ঝামেলাটা আরও পাকছে। আজ যেমন ফিরহাদ হাকিম সরাসরিই বলে দিলেন, মানুষের এই দুরবস্থার জন্য সিইএসসি–ই দায়ী!‌

আজ দুপুরে সিইএসসি মিডিয়া ডেকে দাবি করেছে, অধিকাংশ এলাকাতেই নাকি পরিষেবা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে!‌ ভিক্টোরিয়া হাউসের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি। কিছু জায়গায় এখনও পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারিনি। চেষ্টা করছি। আমরা আশাবাদী, মঙ্গলবারের মধ্যে অবস্থা পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে পারব।’

আর ফিরহাদ বলছেন, ‘কোথায় কোথায় গাছ পড়ে থাকার জন্য ওদের অসুবিধা হচ্ছে, সিইএসসি–র কাছে সেই তালিকা চেয়েছিলাম। আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি। আজ ওরা যেটা বলল, যে ওদের লোকের অভাব রয়েছে। সেটা হতে পারে। কিন্তু এই ব্যর্থতা তো সরকারের নয়। সরকার তো বিদ্যুতের টাকা নেয় না। টাকা যারা নেয়, দায়িত্ব তাদের। সমস্যা হয়েছে সিইএসসি–র জন্যই। কিন্তু তবুও তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’

কলকাতার পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে?‌

ফিরহাদ বলছেন, ‘এত গাছ পড়েছে। এগুলো কাটতে চার–পাঁচদিন সময় লাগবে। আমরা প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু একসঙ্গে ৫০ হাজার কর্মীকে এনে তো আর রেখে দেওয়া যায় না। নিশ্চিতভাবেই মানুষের অসুবিধা হচ্ছে। আমরা গাছ কাটতে বা সরাতে পারিনি, তা নয়। অনেক জায়গায় তো পাড়ার ছেলেরাই গাছ সরিয়েছে। এখন বড় রাস্তাগুলোয় গাড়ি চলছে। সেখানে আর কোনও অসুবিধা নেই।’

ফিরহাদকে আজ তুলনায় একটু কম্পোজড লাগল। মনে হল, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ খানিকটা ফিরে পেয়েছেন। কড়া প্রশ্নেও রাগলেন না। নার্ভ ধরে রাখলেন। এ–ও বললেন যে, ‘এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার বা মারপিট করার সময় নয়। মোদিসাহেব কি জানতেন করোনা হবে?‌ আমরাও কি জানতাম?‌ এটা একটা অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। সকলের সাহায্য চাইছি। এখন সকলে মিলে মানুষের সেবায় নামতে হবে।’

ফিরহাদের এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে আসাটা কলকাতাবাসীর পক্ষে যতটা না স্বস্তির, তার চেয়েও বেশি স্বস্তির শাসক তৃণমূলের কাছে। কিন্তু এই প্রত্যাবর্তনের রেসিপিটা কী?‌ কলকাতায় আর্মি নেমে পরিস্থিতি হাতে নিয়েছে বলে?‌ ‌নাকি আজ রমজান মাসের শেষে রাত পোহালে কাল ‘ঈদ–উল–ফিতর’ বলে?‌

সন্ধ্যা ৭.‌০০

আজ নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স একটা ইতিহাস গড়েছে।

আমেরিকায় এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ১ লক্ষের কাছাকাছি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আজ প্রথম পাতা জুড়ে তাঁদের ১,০০০ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে আমেরিকার একনম্বর কাগজ। হেডিং:‌ ‘ইউএস ডেথ্‌স নিয়ার ১০০,০০০, অ্যান ইনক্যালকুলেব্‌ল লস’। ছোট একটা ইন্ট্রো ‘দে ওয়্যার নট সিম্পলি নেম্‌স অন আ লিস্ট। দে ওয়্যার আস’। তারপর আরও একটা ছোট প্যারা। তাতে লেখা, সংখ্যা দিয়ে আমেরিকার উপর করোনার অভিঘাতটা বোঝানো যাবে না। জীবিত মানুষের জীবনও এখন সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে।

পুরো প্রথম পাতায় কোনও ছবি নেই। বিজ্ঞাপন নেই। ছ’টা কলাম জুড়ে শুধু গ্রে এরিয়া। কোনও প্যারাগ্রাফ নেই। অনেকটা ক্লাসিফায়েড অ্যাডের মতো লাগছে। যারা খবরের কাগজে কাজ করি, তারা জানি এটা করতে কী ভয়ানক সাহসের প্রয়োজন। পাশাপাশিই প্রয়োজন অরিজিনাল চিন্তা এবং আউট অফ দ্য বক্স ভাবনার।

আমার কাছে জার্নালিজম মানে অ্যালার্ট থাকা এবং ইমপ্যাক্ট তৈরি করা। নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স আজ গোটা আমেরিকা জুড়ে সেই ইমপ্যাক্ট তৈরি করেছে। ট্রাম্পের দেশ জুড়ে সাড়া পড়েছে এই পেজ ওয়ান নিয়ে। পড়বেই তো। এই না হলে খবরের কাগজ! এই না হলে অভিঘাত!‌

রাত ৮.‌২৭

কাল থেকে সারা দেশে ডোমেস্টিক ফ্লাইট চালু হচ্ছে। ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্ধ্রপ্রদেশ। মহারাষ্ট্র বলেছিল, তারা ৩০ তারিখের আগে মুম্বইয়ে বিমান ওঠানামা করতে দেবে না। আজ তারা বলেছে, কাল থেকে ২৫টা করে বিমান মুম্বইয়ে ওঠানামা করতে পারবে। বেঁকে বসেছিল তামিলনাড়ুও। তবে তাদের সম্পর্কে কিছু আজকের নির্দেশে জানানো হয়নি।

প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গ সরকার অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের কাছে চিঠি লিখে আবেদন জানিয়েছিল, ৩০ তারিখের আগে যেন কলকাতা থেকে এবং ২৮ তারিখের আগে যেন বাগডোগরা থেকে বিমান চালানো না হয়। কেন্দ্রীয় সরকার তার অর্ধেক মেনেছে। তারা বলছে, ২৮ তারিখ কলকাতা এবং বাগডোগরা থেকে বিমান চলবে। অণ্ডাল নামে আরও একটা বিমানবন্দর আছে রাজ্যে। সেটা নিয়ে খুব একটা কনসার্ন দেখা গেল না। তবে ম্যাপে আছে যখন তখন নিশ্চয়ই সেখানেও ২৮ তারিখ থেকেই সরকারিভাবে বিমান পরিষেবা চালু হবে।

রাত ১০.‌৫৭

দেখতে দেখতে দিনটা শেষ হয়ে গেল। তবু মুখের তিতকুটে ভাবটা যাচ্ছে না কিছুতে। কাল সকালে ঘুম ভাঙলে কি অন্যরকম মনে হবে?‌ নাকি এই নিম–বেগুনটা দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে?‌ এরপর কি আমি ক্রমশ খিটখিটে বুড়ো হয়ে যাব?‌ নাকি সূর্যের আলো থেকে লুকিয়ে ঘরের কোনে মুখ গুঁজে বসে থাকব?‌

আমার কি ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে?‌ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে?‌ দু’মাসের লকডাউন পারাবার পাল তুলে পেরিয়ে এসে কি শেষে বাকি সাতদিনের গোষ্পদে ডুবে মরব?‌

এটা কি ডিপ্রেশন?‌ ‌

জীবনটা কি ‌আবার কখনও নিউ ইয়র্ক টাইম্‌সের প্রথম পাতার মতো সাহসী এবং আলাদা হবে? কোনওদিন? ‌‌

2 thoughts on “লকডাউন ডায়েরি – ২৪ মে, ২০২০

  1. সময়টাই হতাশার
    তবে #আবারসবুজকরবো
    সরোবর আর নিজেদেরও
    বিশ্বাস টুকু থাক।
    ভাল থাকুন

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s