লকডাউন ডায়েরি – ৩০ মে, ২০২০

৩০.‌০৫.‌২০২০। শনিবার

সকাল ৮.‌০৬

নটেগাছটি মুড়োল।

ভনিতা না করে সকাল সকাল সোজা কথাটা সোজাভাবে লিখে ফেলি। আজই শেষ ‘লকডাউন ডায়েরি’। অনেকদিন হয়ে গেল। দু’মাসেরও বেশি। লকডাউন জীবনের কার্যত অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। আবার এখন চারদিকে যা দেখছি, তাতে লকডাউন প্রায় উঠেই যেতে বসেছে। ফলে ‘লকডাউন ডায়েরি’ও এখন অপ্রাসঙ্গিক। যেমন ধীরে ধীরে সবকিছুই এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। জীবন, মৃত্যু, জীবিকা, মানুষ— সবকিছুই।

ফলে এই দিনলিপির আর প্রয়োজন নেই।

দ্বিতীয়ত, যে ডায়েরিতে এই রোজনামচা শুরু করেছিলাম, তারও পাতা ফুরিয়েছে। প্রতিদিন সকাল থেকে সেই নোটবুকের পাতায় এন্ট্রি শুরু করতাম (‌যার ছবি আজকের প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে)‌। যখন যা মনে হতো, টাইম দিয়ে লিখে রাখতাম। কখনও নিজের এলোমেলো ভাবনা, কখনও দিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি। স্কুলে থাকতে বাধ্যতামূলকভাবে ডায়েরি লিখতাম। ভাল লাগত। তার পর থেকে কখনও এতদিন ধরে এত ধারাবাহিকভাবে ডায়েরি লিখিনি। এটাকে প্রথমত সেল্‌ফ এক্সপ্রেশন এবং দ্বিতীয়ত একটা শৃঙ্খলা হিসেবে দেখে এসেছি। বাট অল গুড (‌অর ব্যাড)‌ থিংস কাম টু অ্যান এন্ড!‌ সো ডাজ দ্য ‘লকডাউন ডায়েরি’।

আরও একটা কথা। সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। ইন ফ্যাক্ট, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— অন্তর থেকে গভীরভাবে বিশ্বাস করি, জিনিয়াস ইজ অল অ্যাবাউট নোয়িং হোয়্যার টু স্টপ। কোথায় থামতে হবে, সেটা সম্পর্কে সম্যক ধারনা থাকাটাই হল জিনিয়াসের লক্ষণ। নিজের সীমারেখাটা জেনে নেওয়া, চিনে নেওয়াটা খুব প্রয়োজন। জীবনে সবচেয়ে জরুরি হল থামতে জানা। এবং নির্মোহভাবে থামতে জানা। ওই টাইমিংটাই মানুষ হিসেবে, পেশাদার হিসেবে একজনের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য তৈরি করে দেয়।

আর লঘুভাবে বললে, রবি ঠাকুরের সেই গল্পটা—

কোনও এক ফড়ে শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের কাছে এসে রোজ এক ওস্তাদের নাম করে খুব প্রশংসা করে। বক্তব্য, ওস্তাদ দারুণ কালোয়াতি গায়। একবার যদি গুরুদেব শুনে দেখেন। রবীন্দ্রনাথ রোজ শোনেন সেই আর্জি। কিছু বলেন না। ফড়ে রোজ ঘ্যানঘ্যান করে। একদিন সম্ভবত খানিকটা বিরক্ত হয়েই রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ঠিক আছে। কাল নিয়ে এসো তোমার ওস্তাদকে। দেখি কেমন গায় সে।’

ফড়ে মহাখুশি। আভূমি নত হয়ে কুর্নিশ করে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, গুরুদেব পিছন থেকে ডাকলেন, ‘ওহে অমুক, তোমার ওস্তাদ থামতে জানে তো?‌’

ফড়ে গলবস্ত্র হয়ে বলল, ‘আজ্ঞে, ওস্তাদ দারুণ গায় গুরুদেব।’ গুরুদেব বললেন, ‘আহা, তা তো জানি। গাইতে তো জানে। থামতে জানে তো?‌’

অস্যার্থ— থামতে জানতে হয়। সেই সীমারেখা চিনেই আজ থামছে ‘লকডাউন ডায়েরি’।

সকাল ৯.‌০৪

অবশেষে ‘হু’–র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করল আমেরিকা। আজ ঘোষণা করে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ৩,০০০ কোটি টাকা দেয় আমেরিকা। এবার তার কী হবে?‌ ‘হু’–র লোকজন বেতন পাবেন তো?‌ নাকি তাঁদেরও পারিশ্রমিকে কাটছাঁট হবে?‌

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তো বটেই, আমেরিকা এখন উত্তাল প্রকাশ্য রাজপথে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্মীর হাতে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের প্রাণ হারানোর ঘটনার ভিডিও নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগাপাশতলা জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সে বিক্ষোভ হিংসাত্মক। গত সোমবার মিনেসোটায় পুলিশের হাতে প্রকারান্তরে খুনই হন জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। জর্জকে রাস্তায় শুইয়ে তাঁর ঘাড়ে হাঁটু চেপে ধরে শ্বাসরোধ করা হয়েছিল। জর্জ বারবার বলছিলেন, ‘প্লিজ, প্লিজ!‌ আই কান্ট ব্রিদ!‌’ কিন্তু সে আকুতি কানে তোলেনি শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার। বস্তুত, মোবাইল ফোনে সেই দৃশ্যের ছবি তোলা হচ্ছে দেখেও টনক নড়েনি তার। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়েন জর্জ। তিনি নিথর হয়ে যাওয়ার পর হাঁটু সরায় পুলিশ অফিসার। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জর্জকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। তারপরেই ওই পুলিশ অফিসারকে গ্রেফতারের দাবিতে পথে নেমেছে আমেরিকা। লকডাউনের মধ্যেই যেখানে–সেখানে হিংসাত্মক অবরোধ, বিক্ষোভ হচ্ছে। নিন্দার ঝড় উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। টুইটারে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছেন অধুনা প্রাক্তন তথা আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি বলেছেন, ‘এটা স্বাভাবিক যে, অতিমারী এবং আর্থিক সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আমরা যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিকতায় ফিরতে চাইছি। কিন্তু পাশাপাশিই এটাও মনে রাখতে হবে যে, জাতি এবং বর্ণের ভিত্তিতে এক বিরাট সংখ্যক আমেরিকানকে ভিন্নদৃষ্টিতে দেখাটাও আবার সেই স্বাভাবিকতারই অঙ্গ। ২০২০ সালের আমেরিকায় এই বিষয়টা স্বাভাবিক হওয়া উচিত নয়। এটা স্বাভাবিক হতে পারে না। আমরা চাই, আমাদের সন্ততিরা এমন এক দেশে বড় হোক, যা নীতির প্রশ্নে সর্বোত্তম’।

সকাল ৯.‌২২

বিক্ষোভ আরও আছে। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। কাল রাতে সল্টলেকে কলকাতা পুলিশের সশস্ত্র বাহিনীর ফোর্থ ব্যাটেলিয়নের ব্যারাকে আবার বিক্ষোভ–ভাঙচুর হয়েছে। পুলিশ ট্রেনিং স্কুল এবং গড়ফা থানার পর আবার বিক্ষোভ পুলিশকর্মীদের। তাঁদের বক্তব্য, করোনায় আক্রান্ত পুলিশকর্মীদের ব্যারাকে রেখেই চিকিৎসা করানো হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, পিটিএস এবং গড়ফা থানাতেও এই একই ইস্যুতে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন পুলিশকর্মীরা।

পদস্থ অফিসাররা কাল রাতে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। কিন্তু ইউনিফর্মড ফোর্সের মধ্যে মাঝেমধ্যেই এমন বিক্ষোভের ফুলকি ছড়াতে শুরু করলে ভবিষ্যতে তা নিয়ে গভীর চিন্তার অবকাশ থেকে যায়।

সকাল ১০.‌১০

আজ সকাল থেকে মুখে আবার সেই তিতকুটে স্বাদটা ফিরে এসেছে। আবার সেই খারাপ লাগা। আবার সেই অন্তহীন গহ্বরে পড়ে যাওয়ার অনুভূতি। ঘুম থেকে উঠে মনে হচ্ছিল, এই ঘুমটা না ভাঙলেই হতো। কিন্তু সে কি আর আমার হাতে!‌

বেলা ১১.‌২৩

চুপচাপ বসে গত দু’মাসের কথা চিন্তা করছিলাম। আসলে ভাবছিলাম দিনের পর দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে ‘লকডাউন ডায়েরি’ লেখার কথা। আজ যখন ডায়েরির শেষ পাতায় এসে পৌঁছেছি, তখন ফেলে–আসা পাতাগুলোর কথা আরও বেশি করে মনে পড়ছে। যে পাতাগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই লেখা আছে সহকর্মী সনৎ সিংয়ের নাম। পেশাগত বা ব্যক্তিগত কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজে উদ্যোগ নিয়ে রোজ রোজ ডায়েরির কভারের ছবি বেছে দিয়েছে সনৎ। মাঝেমধ্যে যখন আমিও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছি, তখন তাগাদা দিয়েছে। ঠেলা দিয়েছে লেখার জন্য।

বস্তুত, এই ডায়েরি শেষ হবে শুনে যে সবচেয়ে বেশি ক্ষুন্ন, তার নাম সনৎ। ইতিমধ্যেই একাধিকবার আবেদন এসেছে, ‘শেষ করবেন না প্লিজ!‌’ সনৎকে বললাম, নাহ্‌ রে, অল গুড থিংস কাম টু অ্যান এন্ড। ওর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা।

চিরকাল মনে হয়েছে, পাবলিক অ্যাকনলেজমেন্ট করা খুব জরুরি। কারও উপকারের কথা সর্বসমক্ষে স্বীকার করতে খুব বেশি কলজের জোর বা অর্থ লাগে বলে কখনও শুনিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সাধারণত মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কৃপণ থাকে। কেন থাকে জানি না। কাউকে ভাল বলতে কুণ্ঠা কোথায়?‌ কে জানে!‌ নিজেকে সবসময় বলি, যেন খোলামনে উপকারীর ঋণ স্বীকার করতে পারি। যেন অ্যাচিভারের প্রশংসা করতে পারি মুক্তকণ্ঠে।

আরও একজনকে এই ডায়েরিতে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখতে চাই। সপ্তর্ষি ঘটক। কোনও ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। ফেসবুকে গান গাইতে শুনেছি। কিন্তু এমনিতে গলাটাও কোনওদিন শুনিনি। রাতের পর রাত ডায়েরির ছোটখাট টাইপোগ্রাফিক্যাল এরর মেসেঞ্জারে লিখে লিখে জানিয়েছেন সপ্তর্ষি। এমনকী, গতকালও। ভুল আরও অনেকে ধরিয়েছেন। তথ্যগত ভ্রান্তি বা আরও কিছু টাইপো। কিন্তু সপ্তর্ষি অক্লান্ত থেকেছেন। অন্যদের কাছে কৃতজ্ঞতা আছে। কিন্তু সপ্তর্ষির কাছে ঋণের শেষ নেই।

যাঁরা রোজ এই ডায়েরি মন দিয়ে পড়েছেন, ফেসবুক অথবা আমার ব্লগে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কিছু লিখে বা না–লিখে, তাঁদের কাছেও কৃতজ্ঞতা জানানো রইল এই ডায়েরির পাতাতেই। আমপানে নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার পর একজন যেমন মেসেঞ্জারে লিখেছিলেন, কলকাতায় নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলেন না। একটা কাজে ঝাড়খণ্ড গিয়েছিলেন। সেখানে নেটওয়ার্ক পেয়ে প্রথমেই তার আগের তিনদিনের ‘লকডাউন ডায়েরি’ পড়েছেন। ভাবা যায়!‌

এঁদের ঋণ কোনওদিন শোধ করা যাবে না। কিছু কিছু ঋণ শোধ করা যায় না। স্বীকার করা যায় শুধু। এঁদের কাছেও ঋণটুকু স্বীকার করা রইল মাত্র।

বেলা ১১.‌৪৪

হঠাৎ সুভাষ’দার একটা হোয়াট্‌সঅ্যাপ ঢুকল। বিনা ভূমিকায়। বিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলার লিখেছেন, ‘তোমার মতো একজন মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে ভাবলে নিজেকে ধন্য মনে করি। ভাল থেকো। আর ভাল ভাল লেখা লিখে আমাদের সমৃদ্ধ করো।’

বলা বাহুল্য, খুবই লজ্জা পেলাম। লিখলাম, ‘আশীর্বাদ করবেন। ভাল থাকবেন।’

দ্রুত জবাব এল, ‘তোমাকে আশীর্বাদ করব, এ দুঃসাহস আমার নেই। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, সবাই ভাল থাকো। ঈশ্বর সার্থক করুন তোমার জীবন।’

এবার আর কিছু লিখতে পারিনি। জোড়হাতের ইমোজি পাঠিয়ে নিরুত্তর রইলাম। কী বলব!‌ এতটাও কি প্রাপ্য ছিল?‌

দুপুর ১২.৪২

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা স্বপ্ন দেখলাম। অনেকদিন পর।

দেখলাম একটা পুরনো আর লজঝড়ে অ্যাম্বাসেডর গাড়ির পিছনের সিটে বসে আছি। গাড়িটা চলছে। কেউ একজন চালাচ্ছেন। কিন্তু গাড়িটা রাস্তায় চলছে না। চলছে নরেন্দ্রপুরের অভেদানন্দ ভবনের টানা লম্বা বারান্দা দিয়ে। ভবনে আর কোথাও কোনও লোকজন নেই। একেবারে ফাঁকা!‌ গাড়িটা চলছে প্রতিটা বারান্দার এমাথা থেকে ওমাথা। বারান্দা শেষ হয়ে গেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। একতলা থেকে দোতলা। তারপর দোতলা থেকে তিনতলা। আবার নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। আবার বারান্দা পরিক্রমা করছে। কিন্তু ভবন থেকে কখনও রাস্তায় বেরোচ্ছে না।

অভেদানন্দ ভবনের যে তিনতলা জুড়ে গাড়িটা চলাফেরা করছে, তার উল্টোদিকে অদ্বৈতানন্দ ভবন। কিন্তু অনেকটা কাছাকাছি। সেটাও একেবারে ফাঁকা। দুটো বাড়ির মাঝখানে বাস্তবের ঘাসজমিটার বদলে একটা রাস্তা। দু’পাশে চওড়া ফুটপাথ। রাস্তাটা পিচের নয়। কংক্রিটের। বাঁধানো। সেটাও জনমানবহীন।

ওইভাবে গাড়িটা ঘুরল দুপুর পর্যন্ত। তারপর একটা সময়ে একতলার বারান্দায় গাড়িটা থামিয়ে ড্রাইভার আমার দিকে পিছু ফিরে তাকালেন। দেখলাম, একেবারে অচেনা একটা মুখ। তেল চুপচুপে চুল ব্যাকব্রাশ করা। লম্বা জুলপি। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মোটা গোঁফ। চোখে একটা মোটা ফ্রেমের বড় চশমা। ঘোলাটে দৃষ্টি। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি কি এবার একটু খেয়ে আসব?‌ আর খেয়ে এসে কি গাড়ি গ্যারেজ করে দেব?‌’

আমি বললাম, না–না। গাড়ি গ্যারেজ করবেন না এখন। আমায় অফিস যেতে হবে তো!‌ আপনি এখন আমায় এখানে নামিয়ে দিয়ে যান। আমি এই ফুটপাথে বসে আছি। খেয়ে এসে আমায় আবার তুলে নেবেন।

ওইখানেই ঘুমটা ভেঙে গেল। উঠে বসে ভাবার চেষ্টা করলাম, স্বপ্নটার কার্যকারণ কী হতে পারে। মনে হল, লকডাউনের কারণে যে আপাত–বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে, তার সঙ্গে কোথাও একটা নরেন্দ্রপুরের হস্টেলবাসের শৃঙ্খলিত জীবনযাপনের মিলমিশ তৈরি হয়ে স্বপ্নটা দেখেছি। গাড়ি আছে। অথচ ইচ্ছেমতো যাতায়াত করতে পারছি না। হস্টেলের বারান্দার মধ্যে ঘুরপাক খেতে হচ্ছে।

দুপুর ১.‌০০

গত কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছে, করোনাকে প্রশাসন আর সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। আমরা কেউই সিরিয়াসলি নিচ্ছি না। এবার থেকে করোনা আর প্রশাসনের দায়িত্ব হবে না। ব্যক্তিগত দায়িত্ব হয়ে যাবে। ব্যক্তিগতভাবে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করব। হাত ধোওয়া ইত্যাদি নিয়ম মানব। তারপর করোনা হলে হবে। না হলে না হবে।

সকাল থেকে একের পর এক টেক্সট আসছে দেখছি। অমুক ব্র্যান্ড স্টোর খুলে যাচ্ছে। তমুক শো–রুম খুলছে। বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করা হবে। এসব থেকে মনে হচ্ছে, এবার দ্রুত সব খুলে যাবে। দোকান–বাজার খুলবে। শপিং মল খুলবে। সিনেমাহলও খুলবে। খেলাধুলো শুরু হবে। সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে।

শুধু মাঝখান থেকে আরও কিছু লোকের মৃত্যু হবে। আরও কিছু লোক অসুস্থ হবেন। কিন্তু সামগ্রিক ভয়টা আর থাকবে না। ভালই হবে। এখন আর করোনাকে আটকানোর চিন্তা করলে হবে না। সেই সময় পেরিয়ে গিয়েছে। এখন চিন্তা করতে হবে করোনা হলে বাড়িতে কী কী করণীয়। বিলেতের একজন কোভিড–যোদ্ধা নার্স যেমন জানিয়েছেন—

১.‌ প্যারাসিটামল রাখুন।
২. ‌কাশির ওষুধ সঙ্গে রাখুন। যা মিউকাসকে তরল করবে।
৩.‌ মধু এবং লেবু খান।
৪.‌ বুকের জন্য ভিক্স ভেপোরাব মজুত রাখুন।
৫.‌ ভেপার নেওয়া ভাল। প্লেন ভেপার নিন।
৬.‌ অ্যাজমার ইতিহাস থাকলে হাতের কাছে প্রয়োজনীয় ইনহেলার রাখুন।
৭.‌ জল খান। প্রচুর জল খান।
৮.‌ প্রচুর বিশ্রাম নিন। বাড়ি থেকে বেরোবেন না। বাড়িতেও মাস্ক এবং গ্লাভস পরুন।
৯.‌ নিজের শোওয়ার ঘর আলাদা রাখুন। বিছানার লিনেন ধোওয়ার ব্যবস্থা রাখুন। খাবার দিয়ে যেতে বলুন দরজার বাইরে।
১০.‌ আপনার ব্যবহার্য বাথরুমও নিয়মিত সাফ করুন স্যানিটাইজার দিয়ে।

অত্যধিক জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট না হলে এবং ওষুধে কোনও উপশম না হলে তবেই হাসপাতালে যান।

দুপুর ১.‌১৩

ফেসবুক মেসেঞ্জারে নন্দিতা’দি জানালেন, রবীন্দ্র সরোবরে তিনটি ভূপতিত বৃক্ষ আবার খাড়া করা হয়েছে। আবার তাদের পুনর্স্থাপিত করা হয়েছে। কলকাতা পুরসভার সহায়তায় একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ওই তিনটি গাছ আবার তুলে দাঁড় করিয়েছে। এটা সত্যিই ভাল খবর।

দেখেই মনে পড়ে গেল, আজই রবীন্দ্র সরোবরের ক্ষতিগ্রস্ত গাছগুলির পুনর্বাসন নিয়ে কলকাতা পুরসভায় মিটিং ডেকেছেন মুখ্য প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম। বন দফতরের সঙ্গে সেই বৈঠকের আগে তিনটি বৃক্ষ তুলে ধরার এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে ইতিবাচক সঙ্কেত পাঠাবে।

দুপুর ২.‌‌০২

আজ আবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। গতকালও তাঁদের বৈঠক হয়েছিল। মনে করে নিতে সমস্যা নেই যে, এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠক লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়ে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে বটে যে, লকডাউন–৪ জারি আছে ৩১ মে পর্যন্ত। কিন্তু যতদূর মনে পড়ছে, এই লকডাউনের মেয়াদ ছিল ৩০ মে, অর্থাৎ আজ পর্যন্ত। সেক্ষেত্রে আজই পঞ্চমদফার লকডাউনের গাইডলাইন জানানো উচিত কেন্দ্রীয় সরকারের।

প্রসঙ্গত, গতকালই নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় দফার সরকারের প্রথম বছরের মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে। সেই উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী। যেখানে তিনি পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ওডিশায় আমপানের তাণ্ডব নিয়েও কিছু কথা লিখেছেন।

দুপুর ৩.‌‌১২

লকডাউনের সময় আসল হিরো হয়ে দেখা দিয়েছেন হিন্দি ছবির আপাত–ছুটকো অভিনেতা সোনু সুদ। সিক্স প্যাকের অধিকারী সোনুকে সেভাবে কেউ এতদিন পাতে দেননি। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন, তাতে গোটা দেশে ধন্য ধন্য পড়েছে। সেখানেই বলিউডের অনেক হিম্যানের চেয়ে তিনি অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছেন।

সোনু দেখিয়েছেন, তাঁর মানসিক সিক্স প্যাক অনেক বেশি শক্তিশালী এবং জোরাল।

বিকেল ৪.‌২১

হুগলির মাহেশের রথযাত্রা এবার হচ্ছে না বলে জানাচ্ছে টিভি। বলছে, ৬২৪ বছর পর এই প্রথম মাহেশে রথযাত্রা হচ্ছে না। এই রথযাত্রা নাকি গোটা দেশে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ। পুরীর পরেই।

সন্ধ্যা ৬.‌৫১

লকডাউন বাড়ল ৩০ জুন পর্যন্ত। অর্থাৎ, আরও একমাস। তবে কিছু শর্তসাপেক্ষে এবং কিছু শিথিলতা–সহ। যে কারণে একে বলা হচ্ছে ‘আনলক–১’। অর্থাৎ, আরও তালাবন্দি নয়। বরং তালা খোলার প্রথম পদক্ষেপ।

‘আনলক–১’ বলছে, দেশে রাত ৯টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে কার্ফু। যা আগে ছিল সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত। শর্তসাপেক্ষে ধর্মীয় স্থানে ঢোকা যাবে। গতকালই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ১ জুন, সোমবার থেকে ধর্মীয় স্থান খুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তবে বেলুড়মঠ, দক্ষিণেশ্বর এবং তারাপীঠের মন্দির বন্ধ থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন। যেমন অধিকাংশ মসজিদও বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন সেগুলির কর্তৃপক্ষ। ঘটনাচক্রে, কেন্দ্রীয় সরকার আজ জানাচ্ছে, ৮ জুন থেকে শর্তসাপেক্ষে ধর্মীয় স্থান এবং উপাসনাস্থল খুলে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, এ বিষয়ে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তারা সহমত।

এ ছাড়াও, এই পর্বে কনটেনমেন্ট জোনের বাইরে শপিং মল, হোটেল এবং রেস্তোঁরা খুলে দেওয়া হবে। তবে সে বিষয়ে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রোসিডিওর’ বা ‘এসওপি’ ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক।

কিন্তু কনটেনমেন্ট জোনে এইসমস্ত কোনও শিথিলতা থাকবে না। উল্টে সেখানে ৩০ জুন পর্যন্ত লকডাউনে আরও কড়াকড়ি করা হবে। পাশাপাশিই কেন্দ্র বলেছে, তারা কোনও রাজ্যের উপরই কোনও নির্দেশ চাপিয়ে দিচ্ছে না। বিভিন্ন রাজ্য সরকার তাদের এলাকার পরিস্থিতি বিচার–বিবেচনা করে ওই সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করবে। কিন্তু সকলকেই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।

সে কারণেই পঞ্চমদফার এই তথাকথিত লকডাউনকে বলা হচ্ছে ‘আনলক’ পর্যায়ের ‘ফেজ–১’। শিথিলতার পথে প্রথম ধাপ। এটা চলবে একমাস, আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত। ‘আনলক’–এর দ্বিতীয় পর্যায়ে জুলাই মাসে ‘ফেজ–২’তে স্কুল–কলেজ এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তারও পরে ‘ফেজ–৩’ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হবে মেট্রোরেল, সিনেমাহল, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ইত্যাদি চালু করা নিয়ে। অর্থাৎ, যেখানে একসঙ্গে প্রচুর লোকের ভিড় হয়। সাধারণ রেল চালু করার পর পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মেট্রোরেল নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এটা পরিষ্কার যে, গভীর গাড্ডায় পড়ে–যাওয়া দেশের অর্থনীতিকে টেনে তুলে ধরতে এই ‘আনলক’ প্রক্রিয়া। কিন্তু আমজনতা স্বাস্থ্যবিধি ঠিকঠাক না মানলে এই প্রক্রিয়া ব্যুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে।

রাত ১০.‌১০

‘লকডাউন ডায়েরি’–র এটাই শেষ এন্ট্রি। মনে হচ্ছে, কাকতালীয়ভাবে হলেও ডায়েরি শেষের দিনটা উপযুক্ত হয়ে রইল। কারণ, কাল থেকে ‘লকডাউন’–এর বদলে অগ্রাধিকার পাবে ‘আনলক’ প্রক্রিয়া। ফলে এমনিতেই ‘লকডাউন ডায়েরি’–র দিন গিয়াছে। এ এক সুখকর এবং স্বস্তিজনক সমাপতন।

ডায়েরি শেষ করছি দু’টি ইচ্ছে নিয়ে—

এক, যেন আজীবন ‘অপু’ থাকতে পারি। সেই অপু, যে বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি। যে রেলগাড়ি দেখেছিল বিস্ফারিত নয়নে। এমন নয় যে, পৃথিবীতে সেদিনই প্রথমবার রেলগাড়ি চলেছিল। সেদিনই প্রথম সারা পৃথিবী রেলগাড়ি দেখেছিল। কিন্তু অপু সেদিন প্রথম রেলগাড়ি দেখেছিল। তাই তার নয়নে সারা বিশ্বের বিস্ময় ছিল। সে নিজেকে সবজান্তা ভাবেনি। মনে করেনি, ওহ্‌, রেলগাড়ি তো আছেই। ও আর দেখার কী আছে?‌

পল্লবগ্রাহী এক পেশায় থাকতে থাকতে আমাদের মধ্যে এই ভাবটা চলে আসে যে, এ আর এমন কী ঘটনা?‌ এ তো আকছার হয়েই থাকে। বিস্মিত হওয়ার, বিস্ফারিত হওয়ার ক্ষমতা বিসর্জন দিয়ে আমরা নিজেদের সবজান্তা প্রমাণে নিয়োজিত থাকি প্রতিনিয়ত। সম্ভবত তাই ঘটনার মধ্যেকার সূক্ষ্ণ ঘটনা আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। নিজেকে নিজে তাই বারবার বলি, ‘অপু’ থেকো। আজীবন ‘অপু’ থেকো। বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিও না। যেদিন সেই ক্ষমতা হারাবে, সেদিন থেকে তোমার মানুষ হিসেবে, পেশাদার হিসেবে পতন শুরু।

দ্বিতীয়ত, নিজের ভিতরে এক নির্মোহ সন্ন্যাসীকে যেন সর্বদা লালন করতে পারি। গত দু’মাসের লকডাউনে মিনিম্যালিস্ট জীবনযাপন এবং তজ্জনিত শিক্ষা থেকে যেন কখনও ভ্রষ্ট না হই। কোনও বস্তুর সঙ্গে যেন অপরিসীম নৈকট্য না তৈরি হয়। কোথাও যেন বড় কোনও স্টেক তৈরি না হয়। যেন শিরদাঁড়া সোজা রাখতে পারি। পা যেন সর্বদা মাটিতে থাকে। আর মাথা থাকে কাঁধের উপর।

শেষ এন্ট্রির শেষপাতে এই লাইনগুলোও মন্ত্রের মতো বলা থাক—

‘অ্যান্ড আই উড চুজ ইউ;‌
ইন আ হান্ড্রেড লাইফটাইমস,
ইন আ হান্ড্রেড ওয়ার্ল্ডস,
ইন এনি ভার্সন অফ রিয়্যালিটি,
আই উড ফাইন্ড ইউ
অ্যান্ড আই উড চুজ ইউ।’

লকডাউন ডায়েরি – ২৯ মে, ২০২০

২৯.‌০৫.‌২০২০। শুক্রবার

সকাল ৭.‌১৩

মন্ত্রী সুজিত বসু সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত। কাল গভীর রাতে জেনেছিলাম। খারাপই লাগছিল। সুজিত‌’দাই রাজ্যের প্রথম মন্ত্রী, যিনি কোভিড–১৯ সংক্রমণের শিকার হলেন। উপসর্গ না থাকায় বাড়িতেই চিকিৎসাধীন আছেন। মনে করা হচ্ছে, বাড়ির পরিচারক ও পরিচারিকার থেকেই স্বামী–স্ত্রী দু’জনে সংক্রমিত হয়েছেন। ওই পরিচারক এবং পরিচারিকা সম্প্রতি কোভিড পজিটিভ হয়েছিলেন। তবে থ্যাঙ্ক গড, সুজিত’দার দুই সন্তান কোভিড নেগেটিভ।

এর আগে তৃণমূলের বিধায়ক তমোনাশ ঘোষও করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এখনও তিনি হাসপাতালেই আছেন। তমোনাশ আবার শাসকদলের প্রথম বিধায়ক, যিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

সুজিত’দা–তমোনাশ’দা দু’জনকেই ব্যক্তিগতভাবে বহুদিন ধরে চিনি। আশা এবং প্রার্থনা করছি, দু’জনেই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। সুজিত’দাকে ফোন করেছিলাম। খানিকক্ষণ কথা হল। গলা শুনে মনে হল না যে, খুব ঘাবড়ে গিয়েছে বা ওইধরনের কিছু। শুধু একটু বিমর্ষ গলায় বলল, ‘আমি তো সারাদিন ঘুরে বেড়ানো লোক। কোনওদিন ঘরবন্দি থাকিনি। তবে এখন তো কোনও উপায় নেই। ডাক্তারের পরামর্শে বাড়িতে থাকতেই হবে।’

বললাম, ‘সুস্থ হয়ে ওঠো। সাবধানে থেকো। নিজেদের যত্ন নিও।’

সকাল ৮.‌৩৫

জীবনের তিনটে দশক এই পেশায় কাটিয়ে এসে একটা কথা খুব মনে হয়। তবে শুধু এই পেশা বলে নয়, মনে হয় এই ভাবনাটা যে কোনও পেশার ক্ষেত্রেই সত্যি— কাজ করে সত্যিই কিছু হয় না। তার চেয়ে অনেক বড় বিষয় হল জনসংযোগ। পিআর। সম্পর্ক তৈরি করা এবং সেই সম্পর্ক রক্ষা করা।

মিঠুন’দা খুব জোর দিয়ে একটা কথা প্রায়ই বলত, ‘সাফল্য হল ৯০ শতাংশ কপাল আর ভাগ্য। মাত্র ১০ শতাংশ পরিশ্রম আর মেধা।’ ঠিকই। কপাল না থাকলে সাফল্য আসে না। আর কপালটা আমাদের হাতে নেই। কারও হাতেই নেই। অতএব, ভাগ্যে যা আছে সেটাই হবে। দীর্ঘদিনের অধ্যবসায়, চেষ্টা, পরিশ্রম কোনও কাজেই না লাগতে পারে। লাগলেও তার সঙ্গে কাজকর্মের কোনও সম্পর্ক থাকে না। আমরা নিজেদের পরিশ্রমকে গ্লোরিফাই করার জন্য এবং সত্যের জয় সর্বত্র— এটা প্রাণপণে প্রমাণ করার জন্য সেগুলো বলে থাকি। যাতে পরিশ্রমের উপর, অধ্যবসায়ের উপর এবং কাজের উপর আমাদের ভরসা থাকে। মানে, ঠিকঠাক কাজ যাকে বলে। কিন্তু ওটা তো আবার ঠিকঠাক কাজ নয়। ঠিকঠাক কাজ হল নিজেকে ঠিকঠাক, ঠিক সময়ে, ঠিক জায়গায় নিজেকে প্লেস করা।

ঠিকঠাক কাজ হল ওং নম–ওং নম করে ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে ঠিক বিল্বপত্রাঞ্জলিটি দেওয়া। তাতেই সিদ্ধিলাভ।

যত বয়স বাড়ছে, ততই এসব বোধিজ্ঞান লাভ হচ্ছে। কিন্তু এগুলো এই ডায়েরিতে লেখা কি ঠিক হল? ‌হল বোধহয়। এই ডায়েরি তো আসলে আত্মকথন। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলা। আর এই কথাগুলোই নিজে নিজেকে আজকাল বলে থাকি।

সকাল ৯.‌‌৫৩

পরিযায়ী শ্রমিকদের সীমাহীন দুর্দশা। রাস্তায় ধুঁকতে ধুঁকতে মরণ।
কোভিড–১৯ ভাইরাসের ক্রমশ প্রভাব বিস্তার। তজ্জনিত কারণে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি।
চিনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা।
উত্তর ও পশ্চিম ভারত জুড়ে পঙ্গপালের হানা।
অসমে ভূমিকম্প।
উত্তরাখন্ডে দাবানল।
বাংলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
অর্থনীতি গভীর থেকে গভীরতর সঙ্কটে।

চুম্বকে এখন এই হল ভারতবর্ষ! ‌আমার ভারতবর্ষ। আপনার ভারতবর্ষ।

বেলা ১১.‌২৮

বলিউডে শ্যুটিং শুরু করার জন্য নতুন গাইডলাইন দিয়েছে ‘প্রোডিউসার্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়া’। তাতে যা বলা হয়েছে, তাতে মনে হয় না আর অমিতাভ বচ্চন অভিনীত কোনও নতুন ছবি আমরা ভবিষ্যতে দেখতে পাব। কারণ, ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে কারও শ্যুটিং করা আপাতত বারণ। অমিতাভ এখন ৭৭। দ্বিতীয়ত, বলিউডে আর কোনও রোমান্টিক ছবি তৈরি হবে না। কারণ, আলিঙ্গন এবং চুম্বন বারণ।

আরও আছে। শ্যুটিং জোনে আসার আগে সক্কলকে চিকিৎসকের কাছ থেকে কোভিড–ফিট সার্টিফিকেট নিতে হবে। শ্যুটিং চলাকালীনও নিয়মিত করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। শ্যুটিং লোকেশনে মাস্ক এবং ফেস শিল্ড পরতে হবে সকলকে। স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুতে হবে। লোকেশন এবং স্টুডিওর গেট খোলার জন্য পিপিই পরিহিত নির্দিষ্ট কর্মী রাখতে হবে। না–ছুঁয়ে প্রতিনিয়ত দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।

এভাবে কি সিনেমা বা সিরিয়ালের শ্যুটিং সম্ভব?‌ আপাতদৃষ্টিতে তো মনে হচ্ছে সম্ভব নয়। লকডাউনের সময় বড়িতে বসে যেসব জুভেনাইল এবং খেলাচ্ছলমূলক ভিডিও তোলা হচ্ছে, সেগুলো তো আর পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের বিকল্প হতে পারে না!‌ তাহলে কি এই ইন্ডাস্ট্রিটা পৃথিবী থেকে উঠে যাবে?‌ কত কোটি কোটি মানু্য, কত তারকা, কত টেকনিশিয়ান— সকলে বেকার আর অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন?‌ লার্জার দ্যান লাইফ বলে আমাদের জীবনে আর কিছু থাকবে না?‌ জীবনে আর কোনও ‘আইকন’ থাকবে না?‌

এটা ভাবতেও কেমন যেন একটা লাগছে। মনে হচ্ছে, আর কী কী উঠে যাবে জীবন থেকে?‌

প্রসঙ্গত, টলিউডে শ্যুটিং শুরু নিয়ে আগামী ৪ জুন বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানেও প্রোডিউসার্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়ার গাইডলাইন মেনে চলার কথাই বলা হবে নিশ্চয়ই?‌ তাহলে?‌ এভাবে কি শ্যুটিং হয়?‌ বাংলা ইন্ডাস্ট্রির কী হবে?‌

আর সবচেয়ে বড় কথা, খবরের কাগজে পেজ থ্রি রিপোর্টিংয়ের কী হবে?‌ চরিত্রগুলোর কাজ না থাকলে তাদের সম্পর্কে, তাদের কাজ সম্পর্কে কী লেখা হবে?‌ যারা পেজ থ্রি কভারেজ করত, তারা কী করবে?‌ তারা কি মূল নিউজ ডেস্কে বা রিপোর্টিংয়ে চলে আসবে?‌

দুপুর ১২.‌৩১

যাঁরা বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন, ক্যান্সার–আক্রান্ত, গর্ভবতীরা যেন শ্রমিক স্পেশালে যাত্রা না করেন— নির্দেশ দিয়েছে ভারতীয় রেল। বাহ্‌, চমৎকার!‌

গত কয়েকদিনে শ্রমিক স্পেশালে বেশ কয়েকজন পরিযায়ী শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু হয়েছে। তার জেরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নোটিস পাঠিয়েছে রেলমন্ত্রককে। সেই নোটিসের জেরেই তড়িঘড়ি এই নির্দেশিকা রেলের। কিন্তু তাহলে ওই পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফিরবেন কী করে?‌ ট্রেনে না উঠলে কি তারা আবার হাইওয়ে ধরে হাঁটবেন? ‌‌নাকি হাজার হাজার টাকা গুণাগার দিয়ে ট্রাকে চড়ে ফিরবেন?‌ তার কোনও ঠিকানা রেলমন্ত্রকের নির্দেশিকায় নেই।

চমৎকার‌! ‌মাথা ব্যথা হলে মাথাটা কেটে ফেলে দাও। এই হল দাওয়াই। কাটা মুণ্ডুটা কোথায় থাকবে বা‌ সেটা নিয়ে কী করা হবে,‌ তার জবাব দেওয়ার দায় তো আর জল্লাদের নেই!‌

দুপুর ১২.‌৩৫

আগামী ১ জুন থেকে আবার চারমাস আগে থেকে ট্রেনের টিকিট কাটা যাবে। কাটা যাবে তৎকাল টিকিটও। সারা দেশে চলবে ৩০টি বিশেষ রাজধানী এক্সপ্রেস, ২০০টি মেল এক্সপ্রেস এবং ৩০টি শ্রমিক স্পেশাল চলবে। এটাও রেলমন্ত্রকের নির্দেশিকা।

দুপুর ১.‌৪৯

নতুন করে এখন গাছ লাগানো সম্ভব নয়। লাগালেও তা ১০ বা ১৫ বছরের আগে বেড়ে উঠবে না। ফলে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে যাওয়া বড় গাছগুলোকে আবার লাগানো হোক— এই মর্মে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চিঠি লিখেছেন কলকাতা পুরসভার মুখ্য প্রশাসক ফিরহাদ হাকিমকে। চিঠিতে সই আছে লেক গার্ডেন্‌সের সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং অলকানন্দা রায়ের মতো বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী বাসিন্দাদের।

ফিরহাদ বলছেন, এই নিয়ে অলরেডি চর্চা শুরু হয়েছে। গত তিনদিন ধরে লেকের মধ্যে এই নিয়ে সমীক্ষাও চলছে। কাল পুরসভায় বড়সড় মিটিং ডাকা হয়েছে এই বিষয়ে। যদি লেকের মধ্যে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে পড়া গাছগুলিকে আবার পুনঃস্থাপিত করা যায়।

দুপুর ২.‌০২

দিলীপ ঘোষের পর লকেট চট্টোপাধ্যায়। বিজেপি–র সাংসদকে আজ আটকে দেওয়া হল বারুইপুরে। তিনি দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ত্রাণ দিতে যাচ্ছিলেন। পুলিশ লকেটকে আটকে দিয়ে বলেছে, তিনি গেলে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হবে।
নাছোড়বান্দা লকেট প্রায় ২০ মিনিট রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুলিশ–প্রশাসনের সঙ্গে তর্ক করলেন। তারপর ফিরে গিয়ে স্থানীয় বিজেপি দফতরের সামনে অবস্থানে বসলেন। সেখান থেকেও মহিলা পুলিশ গিয়ে হাত ধরে টানাটানি করে তাঁকে উঠিয়ে দিল।

তবে ততক্ষণে হুগলির বিজেপি সাংসদ যতটা সম্ভব টিভি ফুটেজ খেয়ে ফেলেছেন।

বিকেল ৪.‌৪৫

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘এটা বুঝতে হবে। এটা স্প্রেড করে গেছে বেশি। যেহেতু যাতায়াতগুলো বেশি বেড়ে গেছে। এবং যাতায়াতগুলো প্ল্যানিং করে করা হয়। সুতরাং এখন আর কিছু করার নেই। এখন করোনাকে নিয়ে ঘুমোন। করোনাকে পাশবালিশ করে নিন। ঠিক আছে?‌ সরি, আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমরা অনেক কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার হাতে সবকিছু নেই। কিছু করার নেই। আকাশ যেমন আমার হাতে নেই। তেমনই ট্রেনটাও আমার হাতে নেই।’

মুখ্যমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট যে, তিনি করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য মূলত আকাশ এবং রেলপথ খুলে দেওয়াটাই কারণ বলে মনে করছেন। তিনি বলছেন, ‘শ্রমিক এক্সপ্রেসের বদলে কি করোনা এক্সপ্রেস ঢুকিয়ে দিতে চাইছে?‌’

পাশাপাশিই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী সোমবার, ১ জুন থেকে চা বাগান এবং চটকলে পুরোদমে কাজ শুরু হবে।

ওইদিনই, মানে সোমবাকর রাজ্যে সমস্ত ধর্মস্থান খুলে দেওয়া হচ্ছে। তবে সেখানে একসঙ্গে ১০ জনের বেশি জমায়েত করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট ধর্মস্থানকে ওই বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে। ধর্মস্থান নিয়মিত স্যানিটাইজও করাতে হবে। পোর্টালে দেখছি, তিনি বলেছেন, ট্রেনে গাদাগাদি করে যদি এত লোক আসতে পারে, তাহলে মন্দির–মসজিদ খুলতে কী অসুবিধে?‌ বরং এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে মানুষ একটু প্রার্থনা করার সুযোগ পাবে। তাই রবিবার থেকেই মন্দির–মসজিদ খুলে যাবে।

পরক্ষণেই অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী জানান, রবিবার থেকে নয়। কারণ, অনেকদিন ধরে মন্দির–মসজিদ–গুরুদ্বার বন্ধ রয়েছে। কোথাও সাপ–ব্যাং ঢুকে বসে আছে। কোথাও ইঁদুর–বাদুড় ঢুকে আছে। পরিষ্কার করতে অন্তত ৭২ ঘন্টা সময় লাগবে। তাই সোমবার থেকে ধর্মস্থান খোলা হবে।

১ জুন ধর্মস্থান আর ৮ জুন কর্মস্থান। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, আগামী ৮ জুন থেকে রাজ্যে সরকারি ও বেসরকারি সমস্ত দফতরে ১০০ শতাংশ কর্মী নিয়ে কাজ শুরু করা যেতে পারে। যেটা এতদিন ৫০ শতাংশ ছিল।

ওই কর্মীরা কী করে অফিসে আসবেন?‌

মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, রেল এবং মেট্রোলেরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার রাজ্যের নেই। সেটা কেন্দ্র ঠিক করবে। সরকারি–বেসরকারি বাসের পুরষেবা চালু থাকবে। তাতে কোভিড–বিধি মেনে চলাচল করতে হবে।

সন্ধ্যা ৬.৩০

আজই চলে গিয়েছেন ছত্রিশগড়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজিত যোগী। বহুদিন ধরেই ভুগছিলেন।

প্রয়াত জ্যোতিষী বেজান দারুওয়ালা। মৃত্যু হয়েছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে। উনি কি নিজের এই ভবিষ্যৎটা দেখতে পেয়েছিলেন ? কৌতূহল রয়ে গেল।

রাত ৯.২০

দিল্লিতে ভূমিকম্প।কম্পনের মাত্রা রিখটার স্কেলে ৪.৫। বড় ক্ষতির খবর এখনও অবধি আসেনি।

রাত ৯.৩৪

মুখ্যমন্ত্রী টুইট করেছেন। বলেছেন, রাজ্য সরকারি অফিসে কর্মীর সংখ্যা ৫০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ পূর্বঘোষণা মতো ৮ জুন ১০০ শতাংশ কর্মী নিয়ে কাজ শুরু হবে না। তিনি আরও লিখেছেন, ন্যূনতম বাঁধন-সহ লকডাউন চলবে।

রাত ১০.‌২০

আজ প্রথম সজ্ঞানে এবং স্বচক্ষে একটি পুরোদস্তুর পিপিই কিট দেখলাম। এখন বিভিন্ন অ্যাপে অর্ডার করলে বাড়িতে দিয়ে যাচ্ছে। প্যাকেজ অনুযায়ী দাম ভ্যারি করছে। ৫০০ থেকে ২,০০০ টাকার মধ্যে।

যেটা আমার হাতে এসে পড়ল, সেটা একটু বিস্তারিত। রং সাদা। স্পর্শ সফিস্টিকিটেড এবং পাতলা চটের মতো। তাতে আছে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা কভার–অল স্যুট (মাথায় হুডি আর গলা থেকে উরুসন্ধি পর্যন্ত জিপ। সেটা খুলেই ওর ভিতরে ঢুকতে হয়)‌, জুতোর কভার, ফেস শিল্ড, ফেস মাস্ক, স্টেরাইল গ্লাভস, স্টেরাইল অ্যাপ্রন, বায়ো ওয়েস্ট ব্যাগ, ট্রান্সপারেন্ট গগল্‌স, সার্জিক্যাল ক্যাপ।

পাঁচমিনিটের ‘ডেমো’–তেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। ‌মনে হল, অনেক পাপ করলে এ জিনিস পরে ঘুরতে হয় বা কাজকর্ম করতে হয়। আর মনে হল, কতক্ষণে এটা থেকে বেরোব! চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। টানা আটঘন্টা এই জিনিসের মধ্যে ঢুকে থাকা যে কী অ্যাচিভমেন্ট, আজ বুঝলাম!‌

সঙ্গে বাড়ল ভয়।

ইয়ার্কি নয়, পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে এই পিপিই–ই জাতীয় পোশাক হতে চলেছে।

লকডাউন ডায়েরি – ২৮ মে, ২০২০

২৮.‌০৫.‌২০২০। বৃহস্পতিবার

সকাল ৬.‌১৬

কাল রাতে ডালসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ এবং একমুঠো ভাত আচার দিয়ে মাখিয়ে একটা ঘ্যাঁট খেলাম। মন্দ লাগল না। আসলে বাড়ি ফিরে রান্না করতে করতে খিদেটাই মরে যায়। তখন আর কিছু খেতে ভাল লাগে না। ময়রা যেমন মিষ্টি খায় না। তার মুখে সেই রুচিটাই থাকে না।

আমার অবস্থাও সেই ময়রার মতো। নিজে রাঁধুনির কাজ করতে করতে মুখে আর খাবার রোচে না। মনে হয়, তরিবত করে খাওয়ার কিছু নেই। একটু কালো কফি আর বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পড়ি। এমনিতে আই ওয়াজ নেভার আ ফুডি। এখনও নই। ভবিষ্যতেও হব না। শহরের বিভিন্ন রেস্তোঁরার মেনু শখ করে চেখে দেখার কথাও কখনও মনে হয়নি। আমার ভোজ বলতে বিরিয়ানি বা কেএফসি। খাই স্রেফ পিত্তরক্ষার জন্য। বাকিটা ছোঁচামি করে। এমনিতেই বাঁটুল দি গ্রেটের মতো চেহারা। বেশি জুত করে খেলে অস্থানে–কুস্থানে মেদ জমে আরও বেঢপ অবস্থা হবে।

সেই রিস্ক নেওয়া যায় না!‌

সকাল ৭.‌১০

আজ থেকে কলকাতা আর বাগডোগরা থেকে অন্তর্দেশীয় উড়ান শুরু হল। টানা দু’মাস পর।

সকাল ৮.‌৩০

বর্ষাকালের মতো বৃষ্টি পড়ছে। ঝুপঝুপ করে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া। এমন দিনে তারে বলা যায়..‌। কী বলা যায়?‌

বলা যায়..‌ বানভাসি মানুষের সংখ্যা আরও বাড়ল। আরও ঘরবাড়ি ঝড়ঝঞ্ঝায় ভেঙে পড়ল। আরও অনেক লোকের খাদ্য–বস্ত্র–বাসস্থানের সমস্যা দেখা দিল। আরও বৃষ্টি হতে পারে আগামী কয়েকদিন। আরও মানুষ ভাঙা বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে ত্রাণ সাহায্য চাইবেন। আরও বাড়বে বানভাসি মানুষের সংখ্যা।

এমন দিনে তারে বলা যায়..‌ আমি নিরাপদে আছি। মাথার উপর সুনিশ্চিত ছাদ। ছাদের উপর রাখা ট্যাঙ্কের জল এই সোঁদা আবহাওয়ায় ঠাণ্ডা হয়ে গেলে একটু গিজার চালিয়ে নিলে হয়। উষ্ণ প্রস্রবন নেমে আসে শরীর বেয়ে। ভাবা যায়, আজ আর জামাকাপড় কাচব না। এই জোলো বাতাসে শুকোবে না। আনন্দ এবং বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবা যায়, এই ওয়েদারে বাড়িতে খিচুড়ি বানানো গেলে বেশ হতো। আচ্ছা, খিচুড়ির সঙ্গে যদি ডিমভাজা করা যায়?‌ নাকি তার বদলে একটু ঝুরুঝুরু আলুভাজা রাখব?‌

বলা যায়..‌ কাল রাতের প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে তিনটি জেলায় মৃত্যু হয়েছে চারজনের। আহত সাতজন।

এমন দিনে তারে বলা যায়..‌ এই করোনা এবং ঘূর্ণিঝড়ের দোধার তলোয়ারের উপর দাঁড়িয়েও আমি কিন্তু দিব্যি আছি। বৃষ্টিঝরা দিনে অপলকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিসর্গ দেখছি। দিব্যি রোজ অফিস করছি। খাচ্ছি–দাচ্ছি আর বগল বাজাচ্ছি।

সকাল ১০.‌৪৪

গতকাল রাতে সাধন পাণ্ডেকে শো–কজ করেছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। যা থেকে বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূল সাধনের বিষয়টাকে হাল্কাভাবে দেখছে না। পুরোপুরি ইগনোর করছে না। শীর্ষনেতৃত্ব ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন দেখার, সাধন এই শো–কজের কী জবাব দেন এবং কবে দেন। দুঃখপ্রকাশ করেন?‌ নাকি নিজের অবস্থানে অনড় থাকেন। সাধনের ঘনিষ্ঠদের দাবি, অবস্থান থেকে নড়বেন না তিনি।

দুটো বিষয়ে কৌতূহল হচ্ছে—

১.‌ সাধন কি আগামী বিধানসভা ভোটে তাঁর কন্যা শ্রেয়ার জন্য মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রের টিকিট চাইছেন?‌ স্বাস্থ্যের কারণে যদি তিনি নিজে না দাঁড়ান?‌ সেইজন্যই কি ‌দলের উপর এই পরোক্ষ চাপ তৈরি করছেন?‌ তৃণমূলের অন্দরে একাংশে তেমনই বক্তব্য শোনা গেল। যদিও এর কোনও আনুষ্ঠানিক সমর্থন মেলেনি। এসব খবরের আনুষ্ঠানিক সমর্থন মেলেও না।
২.‌ টেকনিক্যালি সুদীপ কি সাধনকে শো–কজ করতে বা তাঁর বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন?‌ কারণ, তৃণমূলে একটি শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি আছে। এসব ক্ষেত্রে যাবতীয় যা ব্যবস্থা ওই কমিটিই নিয়ে থাকে। যা এক্ষেত্রে হয়নি। বিষয়টি কি সাধন দলের অন্দরে তুলতে পারেন?‌ বিশেষত এখন যখন দল তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েই ফেলেছে, তখন তিনিও কি আর চুপ করে বসে থাকবেন?‌ দেখা যাক।

দুটো তথ্য—

১.‌ ঘনিষ্ঠমহলে সাধন জানিয়েছেন, তিনি এখনই শো–কজের জবাব দিচ্ছেন না। শনিবার নাগাদ জবাব দিতে পারেন। আপাতত তিনি ত্রাণ বিলি নিয়ে ব্যস্ত আছেন।
২.‌ ফোন করে দেখলাম সাধনের মোবাইলের কলার টিউন বলছে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’।

দুপুর ১২.‌৩২

পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাল রাতে হাওড়া এসে পৌঁছেছে কয়েকটি ট্রেন। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া এবং হুগলির বাসিন্দা শ্রমিকদের হাওড়ায় নামিয়ে ট্রেনটি রওনা দিয়েছে মালদহ এবং তারপর নিউ জলপাইগুড়ির দিকে। উত্তরবঙ্গের শ্রমিকরা সেখানে নামবেন। কলকাতায় পৌঁছনো শ্রমিকদের বাসে করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার।

নবান্নের ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, সরকারের শীর্ষমহল এই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে গভীর উদ্বেগে রয়েছে। কারণ, ইতিমধ্যেই খবর পৌঁছেছে ওই শ্রমিকদের একাংশ চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় নেমে পড়ছেন। তারপর তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন কে জানে!‌ যাঁরা মাঝপথে নামছেন, তাঁদের মধ্যে করোনা–পরিবাহী কেউ আছেন কিনা, তা–ই বা কে জানে!‌ কে তাঁদের কোয়ারেন্টিনে পাঠাবে?‌ কীভাবে পাঠাবে?‌

পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে মুখ খুলেছেন সনিয়া গান্ধী। বলেছেন, ‘গত দুমাস ধরে শ্রমিকদের দুরবস্থা দেখছে গোটা দেশ। কেন্দ্রীয় সরকারকে বলছি, খাজানার তালা খুলুন। শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান।’

কর্ণাটক সরকার তাদের রাজ্যে ট্রেন–বাস–বিমানে করোনা–কবলিত পাঁচটি রাজ্য থেকে আগত নাগরিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে দিল। ওই পাঁচ রাজ্য হল মহারাষ্ট্র, গুজরাত, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান। যা মনে হচ্ছে, এরপর অন্যান্য রাজ্যও এই পথে হাঁটতে পারে। তারাও রাজ্য নির্দিষ্ট করে সেখান থেকে নাগরিকদের আগমন নিষিদ্ধ করতে পারে। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গ সেই পথে হাঁটলে তো এতগুলো ট্রেন এখানে ঢোকেই না!‌

তাহলে কি দেশের মধ্যে চলাচলেও রাজ্য–নির্দিষ্ট এক অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি হতে চলেছে?‌

দুপুর ১২.‌৫২

কাল থেকেই ওই ছবিটা তাড়া করছে। কাল আর ডায়েরিতে লিখিনি। আজ বিভিন্ন কাগজে বেরিয়েছে ছবিটা। বিহারের মুজফ্‌ফরপুর স্টেশনে অনাহারে মরে পড়ে আছে মা। ঘুমিয়ে আছে ভেবে চাদরে টান মেরে তাকে জাগানোর চেষ্টা করছে উলোঝুলো চেহারার একরত্তি শিশু। সে জানেও না, মা আর ইহলোকে নেই।

কাগজে দেখছি, সোমবার শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে গুজরাত থেকে একদল শ্রমিক মুজফ্‌ফরপুর স্টেশনে পৌঁছেছিলেন। ওই ট্রেনেই বোন ও তাঁর স্বামীর সঙ্গে কাটিহার যাচ্ছিলেন বছর তেইশের এক মহিলা পরিযায়ী শ্রমিক। সঙ্গে দু’টি শিশু। জল আর খাবার না পেয়ে তীব্র গরমে ট্রেনেই মৃত্যু হয় ওই মহিলার। মুজফ্‌ফরপুরে ট্রেন ঢুকলে দেহটি স্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হয়। ঢেকে দেওয়া হয় কাপড় দিয়ে। শবদেহ ঢাকা দেওয়া ওই কাপড় ধরেই টানছিল শিশুটি।

ওই শিশুটি কি ওই মৃত তরুণীরই সন্তান? ‌খবরে বলছে, ওই তরুণীর সঙ্গে দুটি শিশু ছিল। যদি তা–ই হয়, তাহলে তারা কোথায় গেল?‌ মৃত মা’কে ফেলে তারা কি সেই ট্রেনেই চলে গেল কাটিহার?‌ নাকি একটি শিশুকেও স্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল মায়ের মরদেহের সঙ্গে?‌ অন্য শিশুটি তাহলে কোথায় গেল?‌ মনে হচ্ছিল, ছবির শিশুটিই কি মাতৃহারা?‌ নাকি সে স্টেশনে এঁটোকাঁটা খেয়ে ঘুরে–বেড়ানো আলাদা এক অনাথ?‌

এমন কত প্রশ্ন, এমন কত যে দৃশ্য রোজ ঘুরেফিরে আসে দুঃস্বপ্নের মতো!‌ ছবিগুলো নিয়ে হিল্লোল ওঠে। দু–একদিন আলোচনা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক এবং বিস্ময়ের ঝড় ওঠে। কমেন্ট হয়। শেয়ার হয়। তারপর কী হয় কেউ জানে?‌

মুজফ্‌ফরপুরের ভাইরাল ভিডিও নিয়ে আজ রাজনীতির কারবারিরা ঝগড়া করতে মাঠে নেমে পড়েছেন। কিন্তু ওই শিশুটি কে ছিল?‌ কেউ জানে?‌ ছবি তোলার পর মাতৃহারা শিশুর কী হল, কেউ খোঁজ রেখেছে?‌ কেউ জানে তার পরিচয়?‌

অপারগতা মার্জনীয়। কিন্তু আমার চোখে পড়েনি।

দুপুর ১.‌০০

বিজেপি–র মুখপাত্র সম্বিত পাত্রকে করোনার উপসর্গ–সহ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। আবার প্রমাণ হল, করোনা সাম্যবাদী। সে কাউকে ছাড়ে না। বিশেষজ্ঞরা কি সাধে বলছেন, পৃথিবীর কেউ করোনা থেকে রেহাই পাবে না। কারও ক্ষেত্রে বোঝা যাবে। কারও যাবে না।

দুপুর ১.‌৩১

লকডাউন বাড়ছে। তেমন ইঙ্গিতই স্পষ্ট। নিউজ পোর্টাল বলছে, আজ ভিডিও কনফারেন্সে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব নাকি কেন্দ্রের ক্যাবিনেট সচিবকে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য সরকার এখনই লকডাউন তুলতে চাইছে না। তারা লোকাল ট্রেনও চালাতে চায় না এখনই। তাতে সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

এতদ্বারা মনে হচ্ছে, লকডাউন ৪–এর পর এবার লকডাউন ৫ আসছে। শোনা যাচ্ছে, আগামী রবিবার ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে আরও দু–সপ্তাহ লকডাউন বাড়ানোর কথা ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী। ইতিমধ্যেই আরও কিছু রাজ্য লকডাউন বাড়ানোর আর্জি জানিয়েছে।

যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে, করোনার মতো লকডাউনও আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেল। ধাপে ধাপে কিছু ছাড় হয়তো থাকবে। দেওয়াও হবে। কিন্তু ঝপ করে পূর্ণাঙ্গ লকডাউন তোলা হবে না। লকডাউনের মতো সিদ্ধান্ত ঝপ করে, স্বল্প নোটিসে মানুষের জীবনে নামিয়ে আনা যায়। কিন্তু সেভাবে সেটা তুলে নেওয়া যায় না। তাই এই অনিচ্ছুক বিবাহ চলতে থাকে। চলতেই থাকে।

দুপুর ২.‌৫৫

রোজ অফিসে বেরোনর আগে এই সময়টায় অনেক হাজিবাজি চিন্তা মাথায় আসে। যেমন এখন মনে হচ্ছে, এরপর থেকে বিত্তের শ্রেণি নির্ণয় করবে স্বাস্থ্যখাতে তার খরচ। সেই অনুযায়ী নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেণি ঠিক হবে। বাড়ি–গাড়ি আর স্বচ্ছলতার সূচক থাকবে না। যারা ভাল হাসপাতালে থাকতে পারবে, সেখানে চিকিৎসা করানো অ্যাফোর্ড করতে পারবে, তারা হবে উচ্চবিত্ত। তার পরের ধাপগুলোও সেভাবেই চিহ্নিত হবে। যেমন, কেউ নিজের খরচে পিপিই কিনতে পারলে তাকে রাখা হবে উচ্চ থেকে মধ্যবিত্তের ব্র্যাকেটে। যারা পারবে না, তারা হবে নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত।

এরপর বড়লোক আর গরিব চেনা যাবে তার স্বাস্থ্যবিমার বার্ষিক প্রিমিয়ামের অঙ্ক দিয়ে।

বিকেল ৫.‌০০

সুপ্রিম কোর্ট এক অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে জানিয়ে দিল, পরিযায়ী শ্রমিকদের থেকে কোনওভাবেই ট্রেনের ভাড়া নেওয়া যাবে না। ভাড়ার টাকা ভাগাভাগি করে দিতে হবে দুই রাজ্যকে। যে রাজ্য থেকে তারা যাচ্ছে এবং যে রাজ্যে গিয়ে পৌঁছচ্ছে। যে রাজ্য থেকে যাত্রা শুরু হচ্ছে, সেই সরকারকে শ্রমিকদের জন্য খাবার, পানীয় জল এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যতদিন না তারা যাত্রা শুরু করছে। আর যাত্রা শুরুর পর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে রেল কর্তৃপক্ষকে।

বিকেল ৫.‌১২

উপ্‌স!‌ চেতলায় গোলমাল। এলাকার একটা কমিউনিটি হলে নাকি ববি কোয়ারেন্টিন সেন্টার তৈরি করতে গিয়েছিল। খবর পেয়েই লোকজন রাস্তায় নেমে পড়েছে। তুমুল বিক্ষোভ চলছে। ব্যাপক হল্লা। ভূমিপুত্রকে ঘটনাস্থলে আসতে হয়েছে পরিস্থিতি সামলাতে। কলকাতা পুরসভার মুখ্য প্রশাসক বলছেন, ‘কোনও কোয়ারেন্টিন সেন্টার করা হচ্ছে না। দুটো পরিবার গাছ কাটতে এসেছে। তারা সারাদিন কাজের পর রাতে এসে এখানে থাকছে। ঘুমোনর জন্য।’

পাশাপাশিই ববির অভিযোগ, দু–একজন লোক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোয়ারেন্টিন সেন্টার গড়ার কথা রটিয়ে দিয়েছিল। তারা ঘোলা জলে মাছ ধরতে চায়।

বিকেল ৫.‌৩২

বাসে উঠলেই ১৪ টাকা। সেই টাকায় ২ কিলোমিটার। তার পর থেকে প্রতি কিলোমিটারে ৫ টাকা। এমনই প্রস্তাব আজ দিয়েছে বেসরকারি বাসমালিকদের সংগঠন। অর্থাৎ, ৩ কিলোমিটার গেলে ১৯ টাকা। ৪ কিলোমিটারে ২৪ টাকা।

এই প্রস্তাব কি মানবে রাজ্য সরকার?‌ দেখা যাক।

সন্ধ্যা ৬.‌৩৭

গত কয়েকদিন ধরে বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে এই সময়টায় একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসছে। সাধারণত অচেনা নম্বর ধরি না। না ধরলে আর খুব একটা একই নম্বর থেকে ফোন আসে না। কিন্তু এই নম্বরটা থেকে আসছে। প্রায় রোজই। কৌতূহল হল। অগত্যা ‘ট্রু কলার অ্যাপ’ নামিয়ে নম্বরটা ফেললাম। দেখলাম লেখা আছে ‘সুব্রত মুখার্জি’।

বলে কী?‌ তাই নাকি?‌ সটান ফোন ঘোরালাম এবং সেই পরিচিত খোনা গলা ভেসে এল। সুব্রত’দাই বটে। এবং তিনি উচ্ছ্বসিত— ‘আরে অনিন্দ্য!‌ তোমায় তো রোজ ফোন করি। তুমি তো ধরছোই না! কতদিন কথা হয় না তোমার সঙ্গে।‌’

অচেনা নম্বর ধরি না, এটা সুব্রত’দাকে বলার মতো তালেবর এখনও হইনি। অতএব আমতা আমতা করে বললাম, আসলে আপনার এই নম্বরটা জানা ছিল না। আপনার দুটো নম্বর সেভ করা আছে আমার কাছে। কিন্তু এটা সেভ করা ছিল না। সুব্রত’দা বলল, ‘ঝড়ের পর সব ফোন ডাউন। তাই এই নম্বরটা নিয়েছি।’ তারপর কিছুক্ষণ সুখদুঃখের কথা হল। সুব্রত’দার সঙ্গে কথা বললে সবসময়েই ভাল লাগে। আজকের মিনিটপাঁচেকও তার ব্যতিক্রম হল না। দেখলাম, ঘরবন্দি থাকলেও স্পিরিটটা একই আছে। ঠিক হল, একদিন যাব। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আড্ডা দিয়ে আসব।

রাত ৮.‌৩০

গত ২৪ ঘন্টায় রাজ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪৪ জন। সাম্প্রতিককালে একদিনে সবচেয়ে বেশি। মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। রাজ্যে করোনায় মৃতের সংখ্যা আপাতত ২৯৫।

রাত ১০.০৫

পশ্চিমবঙ্গ সরকার লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে কোনওভাবেই কোনও মতামত কোথাও ব্যক্ত করেনি। রাজ্য এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তও নেয়নি। এ বিষয়ে যে খবর ঘুরছে, তা অসত্য। গসিপ। টুইট করে এইমাত্র জানাল রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর।

রাত ১০.‌৩৩

বিকেলের পর রোদ উঠেছিল। ফলে মনে হয়, কাল থেকে আর মেঘলা আকাশ থাকবে না। রোদ উঠবে আবার।

ডায়েরি বন্ধ করতে করতে আবার মনে হল মুজফ্‌ফরপুর স্টেশনের সেই খুদেটার কথা। কোথায় গেল সে?‌ কার কাছে?‌ তাকে কি কোনও হোমে পাঠানো হল?‌ কেউ তাকে বাড়ি নিয়ে গেল?‌ সে কি এখনও হারা উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই স্টেশনেরই আনাচে–কানাচে?‌ নাকি কেউ তাকে কাঁধে তুলে নিয়েছে পরিবারের কাছে পৌঁছে দেবে বলে?‌ তার ভাগ্যে কি জুটেছে কোনও বজরঙ্গী ভাইজান?

নাহ্‌, পথের শিশুকে কাঁধে তোলার মতো বজরঙ্গী ভাইজানদের দেখা শুধু সিনেমাতেই পাওয়া যায়।

লকডাউন ডায়েরি – ২৭ মে, ২০২০

২৭.‌০৫.‌২০২০। বুধবার

সকাল ৮.‌৫৪

সকাল থেকে গুমোট আবহাওয়া। গাছের পাতায় নট নড়নচড়ন। ঘাম হচ্ছে খুব। সঙ্গে মাথাটাও টিপটিপ করছে। আজ কি ঝড়বৃষ্টি হবে?‌

আজ থেকে কলকাতার রাস্তায় আবার অটো চলাচল শুরু হল। একটা অটোয় সর্বাধিক দু’জন যাত্রী নেওয়া যাবে। চালক–সহ তিনজন। যাত্রীরা পিছনে বসবেন। স্বভাবতই কোনও কোনও রুটে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। চারজনের ভাড়া দু’জনের থেকে তুলতে হবে তো। চালকদের হাতে গ্লাভস পরতে হবে। সঙ্গে স্যানিটাইজার রাখতে হবে। যাত্রী এবং চালকদের মুখে মাস্ক বাধ্যতামূলক।

আজ থেকে কলকাতায় সরকারি বাসের সংখ্যাও বাড়ছে। শহর এবং শহরতলিতে আরও ৪০টি রুটে বাস চলাচল শুরু হচ্ছে। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বাস চলবে। ২০ জনের বেশি যাত্রী নেওয়া যাবে না। উত্তরবঙ্গে সরকারি দূরপাল্লার বাস চালু হচ্ছে। পাশাপাশি দক্ষিণবঙ্গেও। বলা হয়েছে, চালক এবং কন্ডাক্টরদের বাধ্যতামূলকভাবে পিপিই পরতে হবে। বাসে ওঠার আগে থার্মাল স্ক্রিনিং এবং স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোওয়া বাধ্যতামূলক।

কাল থেকে কলকাতা এবং বাগডোগরায় বিমান চলাচল শুরু হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের গাইডলাইন মেনে বিমানে সফর করতে হবে। সোমবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিমান চলাচল শুরু হয়েছিল। প্রথমদিনই ৩৯,০০০ যাত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে গতকাল এবং আজ দু’জনের দেহে করোনাভাইরাস মিলেছে। দু’টি বিমানই স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। একটি বিমানের বাকি ৯০ জন যাত্রীর করোনা টেস্ট করা হয়েছে। নেগেটিভ। অন্য বিমানের বাকি যাত্রীদের ১৪ দিনের জন্য হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে।

একদিনে ৩৯,০০০ যাত্রীর মধ্যে মাত্র দু’জনের দেহে করোনা সংক্রমণ পাওয়াটা কি খুশি হওয়ার মতো খবর?‌ আপাতদৃষ্টিতে তা–ই। আবার উল্টোদিক থেকে দেখলে এত সাবধানতার পরেও দু’জনের দেহে সেই সংক্রমণ পাওয়াই গেল!‌ চিনের ইউহান থেকে করোনার সংক্রমণ কিন্তু ছড়িয়েছিল এয়ার ট্রাভেলের কারণেই। ইউহান থেকে ইতালি সরাসরি ফ্লাইট ছিল। সেই উড়ানেই কোভিড–১৯ প্রথম ইতালিতে পৌঁছয়। সেখান থেকে ডালপালা মেলে গোটা ইউরোপে।

সকাল ৯.‌১৩

চারদিক দেখেশুনে মনে হচ্ছে, জীবন আবার চালু হতে শুরু করেছে। তার কী মূল্য চোকাতে হবে, সেটা এখনই জানা নেই। বোঝাও যাচ্ছে না। কিন্তু লোকজনের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। ফলে তারা এবার রোঁয়া ফুলিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। কোভিডের চোখে চোখ রাখতে চাইছে মরিয়ার মতো। তাতে সংক্রমণ কিছু বাড়বে। কিছু লোকের মৃত্যু হবে। কিন্তু অগ্রগমনটা জারি থাকবে। যারা মারা যাবে, তাদের না হয় আমরা ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’ বলে ইতিহাসের মহাফেজখানায় নথিভুক্ত করে রেখে দেব। নাম দেব কোভিড শহিদ।

সকাল ১০.‌৫৮

রাজ্যপাল আবার মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছেন। পরপর তিনটি টুইট করেছেন তিনি। তিনটি লাল পিঁপড়ে।

‘বিদ্যুৎ, জল এবং জরুরি পরিষেবা অবিলম্বে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হোক। কলকাতা–সহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষের যে ভয়ঙ্কর দুর্দশার খবরাখবর পাচ্ছি, তা এত হৃদয়বিদারক যে এখানে না–ই বা বললাম। এখন পরস্পরকে দোষারোপ করা বা বলির পাঁঠা খোঁজা বন্ধ হওয়া দরকার।

‘বরিষ্ঠ মন্ত্রীরা যখন তাঁদের ক্ষোভ জনসমক্ষে নিয়ে আসেন বা বিধায়ক জনরোষের শিকার হন, তখন বাস্তবচিত্রটা বড় বেশি প্রকট হয়ে পড়ে। গ্রামীণ এলাকার অবস্থা এখনও খুবই ভয়াবহ। সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এই এলাকাগুলিকে উপেক্ষা করা যায় না।

‘মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ, সাংবিধানিক রীতি মেনে আমাকে এখনকার বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করান।

ইন্টারেস্টিং হল, তিনটি টুইটই বাংলায় লেখা। উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার— যাতে আমজনতা সেটি পড়তে এবং বুঝতে পারে। পাশাপাশিই, রাজ্যপাল সিইএসসি ইস্যু, সাধন পান্ডের বিস্ফোরণ এবং বিধায়ক খালেক মোল্লার মার খাওয়ার ঘটনাগুলিও টেনে এনেছেন। তবে তৃতীয় টুইটের শেষ বাক্যটি মেনে নবান্ন যে তাঁকে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘অবগত’ করাবে না, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত।

বেলা ১১.‌৩৭

বেলেঘাটা থানার এক আধিকারিক করোনায় আক্রান্ত। তাঁর পরিবারের আরও ৬ জন সদস্যও কোভিড পজিটিভ। সকলেই বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে ভর্তি। পার্ক স্ট্রিটের এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আধিকারিকও করোনায় আক্রান্ত। ব্যাঙ্কের বাড়িটি আপাতত স্যানিটাইজ করা হচ্ছে।

দুপুর ১২.‌২৩

সকাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দুটো ছবি দেখে চমৎকৃত লাগছে। যত দেখছি, তত অবাক হচ্ছি!‌

প্রথম ছবিতে একটি মেয়ে বুকজল ঠেলে এগোচ্ছে। ডানহাতে ধরা নিউজ চ্যানেলের বুম। উপরে লেখা ‘কলকাতা টিভি’। একহাত পিছনে তার ক্যামেরাম্যান। সেও বুকজলে। উঁচু করে ধরা ডানহাতে ভিডিও ক্যামেরা। বাঁ–হাতটি আঁকড়ে ধরে আছে মহিলা সহকর্মীর পিছনে বাড়ানো বাঁ–হাত। যতদূর চোখ যায়, বন্যার ঘোলাজল। ছবিটা মারাত্মক পাওয়ারফুল!‌ শক্তিশালী!‌ দু’জনেই আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু যতবার দেখছি, শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসছে। আশাবাদী লাগছে। মনে হচ্ছে যাক, এখনও জার্নালিজম বেঁচে আছে!‌ বেঁচে থাকুক।

দ্বিতীয় ছবিটিও ‘কলকাতা টিভি’–রই এক রিপোর্টারের। ছিপছিপে চেহারা। শার্ট–ট্রাউজার্স পরা। বিনাদ্বিধায় কোমরজলে নেমে পড়ে জলবন্দি মানুষের সঙ্গে কথা বলছে। তার সঙ্গেও নিশ্চয়ই একজন ক্যামেরাম্যান ছিল।

‘কলকাতা টিভি’–র সঞ্জয় ভদ্রকে ফোন করে জানলাম, প্রথম ছবির দু’জন সুচন্দ্রিমা–কৌশিক। ঘটনাস্থল সুন্দরবনের রাঙাবেলিয়া। দ্বিতীয় ছবির দু’জন দীপ্তিমান–সুবীর। ঘটনাস্থল সুন্দরবনেরই গোসাবা। সঞ্জয়কে বললাম, আমার হয়ে ওদের কুর্নিশ জানাস। ওদের জন্যই এখনও আশাবাদী হওয়া যায়।

রোজকার কাজের পাশাপাশিই চিরকাল বিভিন্ন ইনসিডেন্ট কভার করেছি। ঘটনা, দুর্ঘটনা, বিস্ফোরণ, দুর্যোগ— যা–ই হোক, সবসময় বিশ্বাস করেছি, স্পটে পৌঁছনোর কোনও বিকল্প নেই। তা সে যতই দুর্গম আর দুরূহ যাত্রা হোক। ঘটনাস্থলের যথাসম্ভব কাছাকাছি থাকতে হবে, গ্রাউন্ড জিরোয় পৌঁছতে হবে। এই ছিল আমার পেশাগত জীবনের থাম্বরুল। এখনও তা থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনও কারণ দেখি না। কিন্তু অবাক হয়ে দেখি, বেশিরভাগ পেশাদারের মধ্যে সেই উৎসাহ এবং সংকল্পটা নেই। খারাপ লাগে।

জীবনের সব ক্ষেত্রেই একশ্রেণির লোক শর্টকাটে বিশ্বাস করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যে সফল হয় না, তা–ও নয়। কিন্তু কোথাও একটা গিয়ে তারা আটকেও যায়। বেস ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছয়। কিন্তু শৃঙ্গে আরোহণ করতে পারে না। এই ছেলেমেয়েগুলো চূড়ায় উঠতে পারবে। সেই বিশ্বাস আমার আছে। ওদের এই ছবি পেশার উপরেও আমার আস্থা আর বিশ্বাস ফিরিয়ে দিল।

দুপুর ৩.‌২৩

হাওড়ার বেলুড়ে গাছ কাটতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক দমকলকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে সিইএসসি–র বিরুদ্ধে। ভেঙে পড়া গাছে বিদ্যুৎবাহী তার জড়িয়েছিল। দমকলকে নাকি সিইএসসি–র তরফে বলা হয়েছিল, ওই তারে বিদ্যুৎ নেই!‌

শুনে হতভম্ব লাগছে। মানুষের জীবনকে এভাবে এতটা হেলাফেলায় দেখা যায়?‌ এতটা ক্যাজুয়্যালি?‌ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে যে সংস্থা, তারা জানবে না একটা বিদ্যুৎবাহী তার জীবন্ত অবস্থায় আছে না মৃত?‌ সেই উদাসীনতার জন্য একটি ছেলের প্রাণ চলে যাবে?‌ এত শস্তা মানুষের জীবন?‌

প্রত্যাশিতভাবেই নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আমি শক্‌ড!‌ সিইএসসি–র মিস ইনফর্মেশন ছিল। পুলিশকে বলেছি অবিলম্বে অ্যাকশন নিতে। বলেছি, অ্যারেস্ট করতে হবে।’ মুখ্যমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, মৃত দমকলকর্মীর পরিবারকে এককালীন ১০ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। সঙ্গে পরিবারের একজনকে চাকরি। শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, যিনি এভাবে মারা গেলেন, তাঁর পরিজনরা কি কয়েকঘন্টা আগেও ভাবতে পেরেছিলেন এমন একটা বিপর্যয় নেমে আসছে?‌ টিভি–তে দেখছিলাম, একটা ট্রলিতে করে তড়িদাহত দমকলকর্মীকে হাসপাতালে করিডর দিয়ে ঠেলে ঠেলে প্রায় দৌড়েই নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সহকর্মীরা। যদি বাঁচানো যায়!‌ শেষ চেষ্টা হিসেবে নিজেরাই চেস্ট পাম্প করছিলেন ঘনঘন।

শেষরক্ষা হয়নি। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এই আমাদের রাজ্য। এই আমাদের চারপাশের লোকজন। সিইএসসি–র যে লোকটি ভুল তথ্য দিয়েছিল, তার গলা দিয়ে ডাল–ভাত নামবে এরপর?‌ তার পরিজনেরা তাকে দুয়ো দেবে না?‌ তার জন্য লজ্জিত হবে না?‌ তার মধ্যে কি কোনও অনুতাপ আসবে?‌ একবারও?‌

দুপুর ৩.‌৫০

মহারাষ্ট্র থেকে আগত পরিযায়ী শ্রমিকবাহী ট্রেন নিয়ে গভীর উদ্বেগে মুখ্যমন্ত্রী। আজ রাতেই হাওড়ায় বেশ কয়েকটি ট্রেন পৌঁছনোর কথা। নবান্নে তিনি বলছেন, ‘করোনা তো আমরা কন্ট্রোল করে ফেলেছিলাম। তারপর এখন ট্রেন ঢোকাচ্ছে!‌ রেলমন্ত্রক দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ করছে। গায়ের জোরে সব করছে। এরা আমাকে রাজনৈতিকভাবে ডিস্টার্ব করতে গিয়ে বাংলার সর্বনাশ করছে। এরপর বাংলায় হাজার হাজার করোনা আক্রান্ত হলে কেন্দ্র দায় নেবে তো?‌ প্রধানমন্ত্রী আর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলব, প্লিজ সিরিয়াসলি দেখুন, যাতে করোনা না বাড়ে। সর্বত্র করোনা বাড়ছে। সমস্ত রাজ্যে।’

দীর্ঘ বৈঠকে আরও যা যা বললেন মুখ্যমন্ত্রী, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—

১. ‌কলকাতার গাছের গুঁড়ি সুন্দরবনে নিয়ে গিয়ে নদীতে বাঁধ দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সুন্দরবনের কাছাকাছি যে সমস্ত গাছ ঝড়ে পড়ে গিয়েছে, সেগুলোর গুঁড়িও ট্রলারে করে সুন্দরবনে নিয়ে যাওয়া যায়। ববি (‌ফিরহাদ হাকিম)‌ কলকাতা থেকে আরও কিছু গাছ দিয়ে দেবে।
২.‌ সুন্দরবনের নোনা জলে ধান আর মাছ চাষ হবে। সেই ধানের বীজের নাম হবে ‘নোনা স্বর্ণ’। আর সেখানে যে মাছ হবে, তার নাম হবে ‘নোনা মৎস্য’।

কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কথোপকথন। যা মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি অমিত শাহকে বলেছিলাম, এত টিম পাঠাচ্ছেন পাঠান। আপনার যদি মনে হয়, আমার সরকার পারছে না, আপনি নিজে দায়িত্ব নিন না। সরকার ভেঙে দিন। আপনি করোনাটাকে সামলান। আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে আমি তাঁকে থ্যাঙ্কস জানাচ্ছি। উনি এখানে প্রেজেন্ট নেই। তা–ও বলছি, উনি বলেছিলেন, না–না তেমন তো কিছুই হয়নি। নির্বাচিত সরকার ভেঙে দেব কী করে?‌’

সন্ধ্যা ৬.‌০০

স্কুল বন্ধের মেয়াদ আরও বাড়ল। আপাতত ৩০ জুন পর্যন্ত রাজ্যে সমস্ত স্কুল বন্ধ থাকবে। ঘোষণা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

শিক্ষামন্ত্রী জানাচ্ছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে চিন্তা তো আছেই। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়েও আটটি জেলার বহু স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলায় জেলায় ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের বসবাসের জন্যও বহু স্কুল ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ৩০ জুন পর্যন্ত সমস্ত স্কুল বন্ধ থাকবে।

সন্ধ্যা ৬.‌৩০

ঝড় উঠেছে। প্রবলবেগে। সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গেই শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন হোয়াট্‌সঅ্যাপ ঢুকতে শুরু করেছে টুং–টুং করে। একটাই প্রশ্ন— আবার ঝড়?‌

কারণ, সেদিনও বুধবার ছিল। আজও বুধবার। শঙ্কিত শহরবাসীর আমপানের স্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছে। ট্রমা ফিরে আসছে ভীমবেগে। অফিসের বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, সেদিনের মতো না হলেও আজও চারদিক ঝোড়ো বাতাস আর বৃষ্টিতে ঝাপসা। সেদিন ঝড়ের স্পষ্ট গর্জন শুনেছিলাম। আজ সেটা নেই। আজ একটা ধোঁয়াটে ভাব চারদিকে। সামনের জমিতে একটা মাঝারি সাইজের গাছ মড়মড় করে উপড়ে গেল। অফিসের কোথাও একটা অ্যাসবেস্টসের চাল হাওয়ার চাপে লাফাতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, উড়ে গেলেও যেতে পারে। বৃষ্টির প্রবল ছাঁট আসছে। দাঁড়ানো যাচ্ছে না। কিন্তু এটা ঘূর্ণিঝড় নয়। এটা আমপান নয়। যারা উদ্বিগ্ন হয়ে খবর নিচ্ছিল, তাদের বললাম, এটা ঘূর্ণিঝড় নয়। কালবৈশাখী।

সন্ধ্যা ৬.‌৪৫

ঠিকই ভেবেছিলাম। ঝড় থেমে গিয়েছে। তবে বৃষ্টিটা এখনও পড়ছে। আবহাওয়া দফতর বলছে, ওটা কালবৈশাখীই ছিল। তবে যথেষ্ট জোরাল। হাওয়ার গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৯৬ কিলোমিটার। স্থায়িত্ব ছিল ১ মিনিট। আমপানের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় আরও ৩৭ কিলোমিটার বেশি। এই ঝড়েও অবশ্য কয়েকটি পুরনো বাড়ির অংশ ভেঙে পড়েছে। পাঁচিল ভেঙে পড়েছে কোথাও কোথাও। শোভাবাজারে একটা ম্যাটাডরের উপর গাছ ভেঙে পড়েছে। শহরের আরও কিছু এলাকায় আরও কিছু বড় এবং পুরোন গাছ ভেঙে পড়েছে। দুর্গাপুরে বাজ পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে কলকাতা ও লাগোয়া এলাকায় কারও হতাহত হওয়ার খবর নেই।

ডায়েরিতে এই এন্ট্রিটা করতে করতে মনে হচ্ছে, এই–ই হল ট্রমা!‌ ঝড় শুরু হলেই যা এক ধাক্কায় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে সেই বুধবারে। সম্ভবত ভবিষ্যতে যতবার ঝড় হবে, ততবার আমাদের মনে ঘুরেফিরে আসবে এক বুধসন্ধ্যার বজ্রগর্জন।

রাত ৯.‌৩৫

আমপানের পর আজ অষ্টমদিন। এখনও পুরোপুরি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল না কলকাতা। এখনও শহরের সব জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ফিরে এল না। এখনও সমস্ত শহরবাসী পানীয়জল পেলেন না।

কেন এমন অবস্থা?‌ কেন সম্পন্ন বাড়ির বধূরা রাস্তায় বেরিয়ে এসে পথ অবরোধ করছেন?‌ গত ক’দিন বারবার নিজের মনে এটা ভেবেছি। বিভিন্ন পরিচিত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি। সাধারণ মানুষ, চাকুরে, শিক্ষক–শিক্ষিকা, শিল্পোদ্যোগী, আমলা, উচ্চপদস্থ আইপিএস এবং তাঁদের অধস্তন পুলিশ অফিসার— যাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, তাঁকেই প্রশ্ন করেছি। এটা কেন হল?‌ গত এক সপ্তাহে সেই বিক্ষিপ্ত কথোপকথনের মন্থনের নির্যাস এই লকডাউন ডায়েরিতে লিখে রাখা জরুরি। এর বিচার করবে ভাবীকাল।

১.‌ এ রাজ্যে প্রশাসন বরাবর শাসকের পাশে থেকেছে। শাসকের কথা শুনে চলেছে। শুধু এ রাজ্য কেন, সব রাজ্যেই। প্রশাসন সবসময়েই প্রভুর কথা শুনে চলে। সেটাই দস্তুর। কিন্তু তার মধ্যেও একটা সময়ে পশ্চিমবঙ্গে এমনকিছু অফিসার ছিলেন, যাঁরা এলাকায় নিজের মতো করে কাজ করতেন। তাঁদের সেই স্বাধীনতা ছিল। কাজের পরিসরও ছিল। যে কারণে তখন এমন দৃষ্টান্তও ছিল যে, কোনও অফিসার বদলি হলে এলাকায় হাহাকার পড়ে যেত। লোকজন কান্নাকাটি শুরু করত। যে করে হোক, তাঁকে ধরে রাখার চেষ্টা করত। প্রয়োজনে সরকারের কাছে স্মারকলিপি দিত। এখন তেমন ঘটনা আর দেখা বা শোনা যায় না।

২.‌ যে কোনও বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে লাইফলাইন হল কমিউনিকেশন। যোগাযোগ। যাতে বিপর্যয় হলে অন্তত যোগাযোগটা খোলা থাকে। অথচ আমপানের সময় তেমন কোনও আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। কারও মনে হয়নি, তেমন হলে কলকাতা পুলিশের ট্র্যাফিক অয়্যারলেস সিস্টেমকে কাজে লাগানো যায়। ২০১৫ সালে রিনোভেশন এবং আপগ্রেডেশনের পর ২ থেকে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত যে সিস্টেমকে মোবাইল ফোনের মতো ব্যবহার করা যায়। যে সিস্টেম হ্যাক করা যায় না। ফলে গোপনীয়তাও অটুট থাকে।

ওই অয়্যারলেস সিস্টেম–সহ পুলিশকর্মী, কলকাতা পুরসভা, সিইএসসি এবং ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট দলের সদস্য নিয়ে অনায়াসে ১৫ বা ২০ জনের একেকটি টিম আগে থেকে তৈরি করে রাখা যেত। ঝড়ের পর এলাকা ভাগ করে তাদের দ্রুত কাজে নামানো যেত। তাতে গোটা শহরের মধ্যে একটা আপৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা কাজ করত। এর জন্য বিরাট বৈজ্ঞানিক হওয়ার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় ভূয়োদর্শী হওয়ার। প্রয়োজন হয় ভিশনের।

৩.‌ ঘূর্ণিঝড়ের আগে দমকল, সিইএসসি, মোবাইল সংস্থা, স্বাস্থ্য বা ত্রাণের মতো ‘ইউটিলিটি সার্ভিস’ প্রদানকারী সংস্থা এবং দফতরগুলিকে নিয়ে কোনও বৈঠক হয়নি। অথচ, কলকাতায় দুর্গাপুজোর আগেও বাধ্যতামূলকভাবে ওই বৈঠক প্রতিবছর হয়ে থাকে। জেলাশাসক, পুলিশ সুপারদের নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে ঠিকই। কিন্তু যে ম্যাগনিটিউডের বিপর্যয় ধেয়ে আসার পূর্বাভাস ছিল, তাতে শুধু উপরতলাকে নির্দেশ দিয়ে লাভ হয় না। হয়ওনি।

৪.‌ প্রশাসনের কিছু কিছু নিজস্ব প্রকরণ আছে। যে প্রকরণ বলে, যারা মাঠে নেমে খেলবে, তারা ঠিক আছে। কিন্তু রিজার্ভ বেঞ্চটাকেও তেল খাইয়ে সমানভাবে চাঙ্গা রাখতে হবে। বড় ম্যাচে ফার্স্ট ইলেভেনের প্লেয়ার ফেল করলে যাতে টগবগে বিকল্পকে মাঠে নামানো যায়।

পরিশেষে, রাজনীতিতে মানুষ তাকেই বিশ্বাস করে, যে তাকে রক্ষা করে। প্রোটেক্ট করে। তার মাথায় নিরাপত্তার ছাতাটা ধরতে পারে।

বৃষ্টি এখনও অঝোরধারে ঝরছে। ছাতা ধরার লোক পাওয়া যাচ্ছে না!‌‌

লকডাউন ডায়েরি – ২৬ মে, ২০২০

২৬.‌০৫.‌২০২০। মঙ্গলবার

সকাল ৮.‌০৯

আজও রোদ ওঠেনি। আজও দেদার হাওয়া দিচ্ছে। আজ একটা নতুন দিন। আজ আবার যুদ্ধ শুরু।

একটা শহর একসঙ্গে লড়াই করছে দুটো শত্রুর বিরুদ্ধে। দুটো ফ্যাক্টরের বিরুদ্ধে। ঘূর্ণিঝড় আর অতিমারী। একটা থেকে পরিত্রাণ মিলতে না মিলতেই অন্যটা ঘ্যাঁক করে এসে ধরছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রমাগত ডিসট্রেস কল। ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে টুকরো টুকরো দুঃখদুর্দশার কাহিনি। ছ’দিন কেটে গিয়েছে। এখনও অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ নেই। জল নেই।

অবর্ণনীয় দিনযাপনের কথা শুনে কষ্ট হয়। মাথা ঘুরতে থাকে। ঝকঝকে সকালেও চোখে অন্ধকার নেমে আসে। টেনশন হয়। অসহায় লাগে। কারণ, এর কোনও শেষ দেখতে পাই না। পাচ্ছি না। মনে হয়, বিদ্যুৎ আসবে। পানীয় জলও আসবে। কিন্তু জীবন পরিত্রাণ পাবে না। কারণ, দরজার ওপারে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে কোভিড–১৯।

সকাল ৯.‌১৯

বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হু–হু হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই চন্দ্রবিন্দুর একটা গানের ‘লুপ’–এ পড়ে গেলাম— ‘এই হাওয়া ঝামলে পড়ছে আজ’।

একটা সময় ছিল, যখন রোজ চন্দ্রবিন্দুর গান শুনতাম। ইন ফ্যাক্ট, এখনও ওদের গানের একনিষ্ঠ ভক্ত। এখনও ‘মন’ বা ‘আদরের নৌকো’ শুনে নিই মাঝেমধ্যেই। সেটা বিনা কারণে নয়। প্রথমত, সমস্ত বাংলা ব্যান্ডের বিবিধ ভাঙাগড়ার মধ্যে একমাত্র চন্দ্রবিন্দু তাদের নিজস্ব বাঁধন অটুট রেখে দিয়েছে। দিস ইজ নট আ মিন অ্যাচিভমেন্ট। দ্বিতীয়ত, চন্দ্রবিন্দুর গানে শব্দচয়ন ও শব্দপ্রয়োগের মেধা এবং বুদ্ধি। তার সঙ্গে তীক্ষ্ণ রসিকতাবোধ। অনিন্দ্য, উপল, চন্দ্রিলকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ঠিকই। কিন্তু না চিনলেও বা আলাপ না থাকলেও ওদের কাজের প্রতি মুগ্ধতাটা তৈরি হতো এবং থেকে যেত।

বহুবছর আগে অধুনাপ্রয়াত পৌলোমী সেনগুপ্ত চন্দ্রবিন্দুকে নিয়ে সম্ভবত ‘উনিশ কুড়ি’–তে একটা ফিচার লেখার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিল। আমি তার অনেক আগে থেকেই ওদের গানের ভক্ত। নতুন সিডি বেরোলেই দৌড়ে গিয়ে কিনে ফেলি। বিভিন্ন গান ক্রমাগত ‘লুপ’–এ শুনতে থাকি। গুনগুন করি। তার উপর ভিত্তি করেও লেখাটা নামিয়ে দেওয়া যেত। বুদ্ধিমান লোক সেটাই করত। কিন্তু আমি চিরকালের বিশ্বগেঁড়ে এবং অতি পরিশ্রমে বিশ্বাসী। ফলে আমার মনে হল, ওদের লাইভ অনুষ্ঠান কেমন হয়, লেখার জন্য তার ভাইভটা নিজের চোখে দেখা দরকার। পাটুলির একটা কলেজের সোশ্যালে ওদের অনুষ্ঠানে গেলাম। দেখলাম একটি বুদ্ধিমান বাংলা ব্যান্ড তরুণ প্রজন্মকে কতটা আন্দোলিত করতে পারে!

প্রায় প্রতিটা গান জনতার মুখস্থ। তারা মঞ্চের গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের মতো গেয়ে চলেছে। একটা গান থামার আগে পরের গানের রিকোয়েস্ট চলে আসছে। গোটা কলেজ চত্বর জুড়ে ওই কয়েকঘন্টায় যে এনার্জি তৈরি হয়েছিল, অবিশ্বাস্য!‌ আমার লেখাটাও শুরু হয়েছিল গানের রিকোয়েস্ট দিয়ে। কোন গান, সেটা এখনও মনে আছে— ‘সুইটহার্ট’।

এতবছর চলে গিয়েছে। বাংলা ব্যান্ডের সেই রমরমার দিন আর নেই। ক্যাসেট অবলুপ্ত। সিডি–ও। এখন গান শুনি স্মার্টফোনে। কিন্তু তার মধ্যেও মাঝেমধ্যেই চলে আসে চন্দ্রবিন্দু। যেমন এখন এই সকালে দামাল হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভেসে এল—

‘এই হাওয়া ঝামলে পড়ছে আজ
আর রাস্তাঘাট আলোর মহারাজ।’

দুপুর ১২.‌০৯

টিভি–তে দেখছি রাহুল গান্ধী বলছেন, ভারতে চার দফার লকডাউন পুরোপুরি ফেল করেছে। রাহুলকে কেমন অন্যরকম দেখতে হয়ে গিয়েছে। মাথায় চুল বেড়ে গিয়েছে। মুখটা ছোট দেখাচ্ছে। জ’লাইন বেরিয়ে পড়েছে। আগে যে একটা গ্ল্যাক্সো বেবি মার্কা চেহারা ছিল, সেটাও আর নেই। বয়স্ক লাগছে একটু। পরিণত লাগছে চেহারা ওয়াইজ।অত্যন্ত বিনয়ের রাহুল বলছেন, কংগ্রেসের হাতে দায়িত্ব থাকলে এমন অবস্থা হতো না।

হতো না কি?‌ কে জানে!‌ কংগ্রেস তো একটা সময় টানা প্রায় পাঁচ দশক দেশ শাসন করেছে। সেই সালতামামি যদি গৌরবের হতো, তাহলে আজ কি রাহুলের পৈত্রিক দলের এই দশা হয়?‌

দীর্ঘ তিন দশক এই পেশায় থাকতে থাকতে বিরোধীদের দেখে মনে হয়েছে, বিরোধী হওয়া আসলে খুব সহজ। বিনাবাধায় এবং বিনাদ্বিধায় আলফাল বলা যায় বা করা যায়। শাসক হলে বোঝা যায় কাঁটার মুকুট কোথায় এবং কীভাবে এঁটে বসছে। যুগে যুগে, কালে কালে এটাই হয়ে এসেছে। সোনার পাথরবাটির কথা বলছে জেনেও বিরোধীরা দায়িত্বশীল বিরোধীর ভূমিকা পালন করার কথা বলে এসেছে। একটা সময়ে তারা শাসক হয়েছে। হয়ে যা যা আগে বলে এসেছিল, ঠিক তার উল্টোটা করতে শুরু করেছে। তাদেরও বিরোধী তৈরি হয়েছে। সেই বিরোধীরাও ক্ষমতায় গিয়ে আগের শাসকের মতোই কাজ করতে শুরু করেছে। এ এক আশ্চর্য চক্র। আর সেই দশচক্রের কুম্ভীপাকে আমরা, সাধারণ মানুষ ক্রমাগত লাট খাচ্ছি।

ব্যাডমিন্টনের বন্ধু রাজু ফোন করেছিল। খুবই চিন্তিত। বলল, ‘দাদা, শেয়ার মার্কেট ধসে যাবে। ইট্‌স অন দ্য ভার্জ অফ ক্র্যাকিং ডাউন। কোরামিন দিয়ে ধরে রাখা হচ্ছে। প্রচুর লোক পথে বসবে। শুধু ভারতে নয়, আমেরিকাতেও।’

— এটা কি তোর খবর?‌

‘হ্যাঁ দাদা। এটাই আমার খবর। প্রার্থনা করছি, যাতে আমার খবরটা ভুল হয়।’

দুপুর ১.‌০০

ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে পিছু ফিরে দেখছিলাম। তারপর তাকালাম ভবিষ্যতের দিকে। মনে হল, আমরা কোভিড প্রজন্মের মানুষ হয়ে গেলাম। আমরা, যাদের জীবনটা একটা সময়ে হাজার দুঃখের মধ্যেও ফান লাভিং আর মজার ছিল। যাবতীয় দুশ্চিন্তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া আড্ডা আর বেসুরে গান গাওয়া ছিল। রাস্তার পাশের কফিশপে তুমুল তর্ক ছিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে লং ড্রাইভ ছিল। গাড়িতে জন ডেনভার, কেনি রজার্স, হ্যারি বেলাফন্টে ছিল। বাড়িতে মান্না, দেবব্রত, পীযূষ ছিল।

সেসব কেমন এক লহমায় উধাও হয়ে গেল!‌

মনে হচ্ছিল, এই ক্ষত নিরাময় হতে আরও কয়েকটা প্রজন্ম লেগে যাবে। যেমন হিরোসিমা, নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের পর তার অভিঘাত কাটতে কাটতে কয়েকটা প্রজন্ম চলে গিয়েছে। এখনও তার রেশ পুরোপুরি কাটেনি। আমাদের এই করোনা অভিঘাতও আরও বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে চলবে। আর সেসব প্রজন্মের সূত্রধর হয়ে থাকব আমরা। আমাদের এই প্রজন্ম। আমি আর আমার বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, পরিচিতরা। আমরা— প্রথম কোভিড প্রজন্ম। ইতিহাসে নাম থেকে যাবে।

দুপুর ১.‌২৩

আজকাল প্রায়ই শুনি, ২০২০ সালটা গেলে বাঁচি!‌ তাই?‌ ২০২০ সালটা চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?‌ ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পৃথিবীটা আবার আগের মতো হয়ে যাবে?‌ সব অন্যরকম হয়ে যাবে?‌ আমরা সকলে একটা অন্যরকম আকাশের তলায় বাঁচতে শুরু করব?‌

নাহ্‌। এটা আসলে আমাদের আত্মসান্ত্বনা। নিজেদের মতো করে একটা ডেডলাইন ঠিক করে নেওয়া। কারণ, সামনে কোনও শেষ দেখতে পাচ্ছি না। তাই নিজের মতো করে একটা ক্যালেন্ডার সেট করা আর তারপর নিজেকে ক্রমাগত বলতে থাকা, এই তো। আর কয়েকটা মাস। এই তো, আর কয়েকটা দিন। তারপরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই কাউন্টডাউনটাই এখন আমাদের জীবন। একটা করে দিন যায় আর আমরা নিজেদের বলি, এই বছরটা খুব খারাপ। কিন্তু এই বছরটা কেটে যাবে।

বছর তো কেটে যাবে। যেমন যায়। করোনা–কাল কাটবে কি?‌

দুপুর ২.‌৩২

পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের ১২ জন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আপাতত তাঁরা ভর্তি বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালে।

দুপুর ৩.‌৩০

বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। তাঁর অভিযোগের তির কলকাতা পুরসভার মুখ্য প্রশাসক ফিরহাদ হাকিমের দিকে। প্রবীণ রাজনীতিক বলছেন, ফিরহাদ বিধায়কদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেননি। সাধন তোপ দেগেছেন সিইএসসি–র বিরুদ্ধেও। বলেছেন, ‘কেন একটা সংস্থার মনোপলি থাকবে?‌ কেন প্রতিযোগিতা থাকবে না?‌ সরকারকে এটা চিন্তা করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলা কীভাবে করা হবে, সেটা নিয়ে ফিরহাদ আমাদের কারও সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি। প্রাক্তন মেয়র শোভন চ্যাটার্জিকেও ডেকে কথা বলা উচিত ছিল।’

যার জবাবে ফিরহাদ বলছেন, ‘বাড়িতে বসে অনেক বড় বড় কথা বলা যায়। আমি রাস্তায় নেমে কাজ করছি। সময় লাগবেই। রোম ওয়াজ নট বিল্‌ট ইন আ ডে। এত বড় কাজ একদিনে হয় না। আমরা সব বড় রাস্তা খুলে দিয়েছি। সব বড় রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। ছোট কিছু রাস্তায় এখনও গাছ পড়ে আছে। সেগুলো সরানোর কাজ চলছে।’ খানিক উত্তেজিত গলায় এ–ও বলছেন, ‘সাধনদা নিজে কেন পুরসভায় আসেননি? ওঁর কোনও সাজেশন থাকলে তো পুরসভায় এসেই বলতে পারতেন!‌’‌

প্রশ্ন হল, সাধন কেন আচমকা এই বিস্ফোরণ ঘটালেন?‌ অনেকে বলছেন তিনি চান তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হোক। যাতে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে পারেন। অন্য একাংশের মতে, নিজের এলাকায় ক্ষোভের মুখে পড়ার আশঙ্কায় ধুরন্ধর রাজনীতিক আগেই পাবলিকলি অভিযোগের অভিমুখটা ফিরহাদের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। আর ইতিহাস বলছে, সাধন মাঝেমধ্যেই এমন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে থাকেন। তবে তার মধ্যে বৃহত্তর কোনও পরিকল্পনা থাকে না। বরং অনেক বেশি থাকে স্থানীয় রাজনীতিতে দলের অন্দরে পাঙ্গা নেওয়ার ইচ্ছে।

এবার এটা কোনদিকে যায়, দেখা যাক। বিশেষত আগামী বছর যখন বিধানসভা ভোট।

বিকেল ৪.‌১০

বড় কেলেঙ্কারি!‌ মহারাষ্ট্র থেকে ৪১টি শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন বোঝাই হয়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরছেন রাজ্যে। তাঁদের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। রাজ্য প্রশাসনের কণ্ঠে স্বভাবতই উদ্বেগের সুর। আলাপন’দা অননুকরণীয় ভঙ্গিতে প্রেস ব্রিফিংয়ে ‘মহারাষ্ট্র’ শব্দটা একবারও উচ্চারণ না করে যা বলল, তার মোদ্দা কথা— ‘এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যেভাবে রাজ্যে আসছেন, সেটা যথেষ্ট চিন্তার। রাজ্যের পাবলিক হেল্‌থের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা বিগ ইস্যু এবং বিগ প্রবলেম।’

সবচেয়ে বড় কথা, এই শ্রমিকদের পাঠানোর আগে একবারও রাজ্যের সঙ্গে কোনও আলোচনা করা হয়নি। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে বলেছেন, তিনি নিরুপায়। রেল থেকে তাঁর উপর চাপ দেওয়া হচ্ছে ওই শ্রমিকদের নিজেদের রাজ্যে ফেরত পাঠানোর জন্য। তবে এটাও ঠিক যে, ভারতের কোভিড ক্যাপিটাল মহারাষ্ট্রে যেভাবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে উদ্ধবও চিন্তিত। দেশে মোট আক্রান্তের ৫২ শতাংশ তাঁর রাজ্যে। তিনিই বা কেন সেই বোঝা বইতে যাবেন?‌

এই ৪১টি ট্রেনবাহিত শ্রমিকদের স্টেশনে নামামাত্রই কোয়ারেন্টিনে পাঠানো উচিত। কিন্তু সেই পরিকাঠামো কি আছে এই রাজ্যে?‌ নেই। তাহলে তাঁদের থাকতে হবে হোম কোয়ারেন্টিনে। হোম কোয়ারেন্টিন হল আরেকটি সোনার পাথরবাটি!‌

বিকেল ৫.‌৩২

এডিট মিট থেকে ফিরে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লেও আমার স্নায়ু সজাগ থাকে। এটা আগেও দেখেছি। আজও মনে হল, কোথাও একটা কিছু ঘটছে।

ঝপ করে চোখ খুলে দেখলাম, সামনে দাঁড়িয়ে সনৎ। আমায় চোখ খুলতে দেখে বলল, ‘একটু এদিকে আসুন।’

কোনদিকে?‌!‌

চেয়ার ছেড়ে উঠে দেখলাম, ডিপার্টমেন্টের মাঝ বরাবর চওড়া টেবিলে একটি মনোহর কেক রাখা। উপরে লেখা ‘হ্যাপি বার্থডে টু অনিন্দ্য’। এক লহমায় বহু বছরের পুরনো অপ্রতিভতাটা ফিরে এল। জীবনে কখনও নিজের জন্মদিন নিয়ে পাবলিক মাতামাতি পছন্দ করিনি। বরং কেউ করতে চাইলে সটান পিঠটান দিয়েছি। একবার ‘এবেলা’–র সহকর্মী স্যমন্তক জন্মদিনের কেক আনতে যাওয়ায় প্রথমে খুব বকুনি দিয়েছিলাম। তারপর অফিস ছেড়ে স্রেফ হাওয়া হয়ে গিয়েছিলাম। পরের বছর স্যমন্তক বুদ্ধিমানের কাজ করেছিল। আমায় কিছু না জানিয়ে অন্য সকলের সঙ্গে প্ল্যান করে কেক আনিয়েছিল। সেবার সময়াভাবে এবং রং ফুটে পড়ে যাওয়ায় পালাতে পারিনি। চোখ–টোখ পাকিয়েও সমবেত উচ্ছ্বাসে সায় দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।

কোনওদিন অ্যাটেনশন–সিকার নই। উল্টে কেউ বেশি মনোযোগ দিলে বা আমায় নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের চিন্তা করলে খুবই লজ্জিত এবং বাধো বাধো লাগে। কোনও কিছুর মধ্যমণি হতে ইচ্ছে করে না। বরং অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করি একপ্রান্তে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু নিজের জন্মদিন এমন একটা অকেশন, যেখানে সাইডলাইনে বা রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকার প্রশ্ন নেই। চাই বা না চাই, মাঝখানে থাকতেই হবে!‌ তাই আমি সাধারণত এই দিনটায় খুবই সতর্ক হয়ে, গোপনীয়তা অবলম্বন করে সরু এবং নীচু হয়ে কাটিয়ে দিই। গতকাল রাতেই জুনিয়র সহকর্মী দেবাশিস একটা ভিডিও তৈরি করে পাঠিয়েছিল। কোনও একদিন অফিসে গান গেয়েছিলাম। সেটা রেকর্ড করেছিল ও। সেই গান গাওয়ার ভিডিও এবং তার সঙ্গে কিছু স্টিল ছবি জুড়ে প্যাকেজ। প্যাকেজ হিসেবে দারুণ। কিন্তু আমার পক্ষে বড্ড বিড়ম্বনার। ও–ও সেটা জানত। সে কারণে আমি রেগে যেতে পারি ভেবে ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়েনি দেবাশিস। ঠিকই করেছিল।

ফেসবুক থেকেও বার্থডে ‘হাইড’ করে রেখেছিলাম। যাতে নোটিফিকেশন না যায়। ফলে নিশ্চিন্ত ছিলাম, এবার দিনটা চুপি চুপি কেটে যাবে। যারা এমনিতে মনে রাখে, তারা রাত ১২টা থেকেই মেসেজ পাঠায় বা ফোন করে। নিদেনপক্ষে দিনের দিন সকালে। এবং আমি জানি তারা কারা। প্রত্যেককে আলাদা করে জবাবও দিই। কিন্তু ফেসবুকের কল্যাণে যে শুভেচ্ছার ঢেউ আসা শুরু হয়, তার প্রতিটি আন্তরিক হলেও প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে জবাব দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। পাছে তারা কিছু মনে করে, সেজন্য ইনফর্মেশনটাই লুকিয়ে ফেলা। এটা এই বছরই প্রথম করেছিলাম।

কিন্তু কপালে বিড়ম্বনা থাকলে ঠেকায় কে!‌ দেখলাম, দুপুরের আগে এক স্মার্ট অ্যালেক বন্ধু ফেসবুকের ওয়ালে ‘শুভ জন্মদিন’ জানিয়ে বসেছে। প্রমাদ গুনলাম। জানতাম, এই শুরু হল!‌ ঠিকই জানতাম। তার মধ্যেই স্পোর্টসের হোয়াট্‌সঅ্যাপ গ্রুপে সনৎও শুভেচ্ছা জানিয়ে দিল। দ্বিতীয়বার বিপদঘন্টি বাজল। যার ম্যানিফেস্টেশন হল কিছু আগে সামাজিক দূরত্বকে চুলোর দুয়োরে পাঠিয়ে সাড়ম্বরে কেক–কাটনের মাধ্যমে।

সনৎ, সুতপা, অনির্বাণ, বিপ্লব, দেবাশিস, উত্তম, শুভা’দা, হেমন্ত, অর্ঘ্য, শ্রাবণ, পার্থ, শত্রুঘ্ন, খোকন চলে এল চটপট। বিপ্লব একটা মিষ্টি কলম উপহার দিল। শুভা’দা এক প্যাকেট ক্লাসিক। এটা অবশ্য প্রতিবছরের রিচুয়্যাল। সকলের মাঝখানে খুবই লজ্জা লজ্জা মুখ করে একটা প্লাস্টিকের ছুরি দিয়ে সুতপা আর সনতের আনা কেক কাটলাম। অনির্বাণ তো ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ গানও জুড়ল। তারপর সকলকে কেক খাওয়ানো হল। গ্রুপ ছবি তোলা হল। ব্রীড়াবনত নববধূর মতো সময়টা কাটালাম।

সনৎ অনুযোগ নিয়ে ব্যাখ্যা করল, ‘কেকের উপর অনিন্দ্যদা লেখা নেই কিন্তু। কেন জানেন তো?‌ দোকানের ভিতরে তো ঢুকতে পারিনি। বাইরে থেকে ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছিলাম। কিন্তু দোকানের ছেলেটা অনিন্দ্র লিখেছিল। ওকে বললাম, ভুল হয়েছে। ঠিক করুন। তখন ঠিক করল বটে। কিন্তু শুধু অনিন্দ্য লিখে দিল।’

শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, ওরে!‌ এই কঠিন সময়ে তোরা যে অফিসে আসার পথে গাড়ি ঘুরিয়ে গিয়ে উদ্যোগ নিয়ে এই কাণ্ডটা করেছিস, তাতেই কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসছে। কেকের উপর নামে ‘দাদা’ রইল কি না রইল, তাতে কী যায়–আসে!‌ মনে তো রইল।

সন্ধ্যা ৬.‌১০

সাধনের বিস্ফোরণকে সম্ভবত বেশি গুরুত্ব দেবে না তৃণমূল। অন্তত এখন। কারণ, পুরসভা থেকে বেরোনর মুখে সাধন–প্রশ্নে ফিরহাদ একটা কথাই বলে গেলেন, ‘সাধনদা সুস্থ নন। অসুস্থ। বেচারা কী বলছেন জানি না। ওঁর কথা নিয়ে কিছু বলতে চাইছি না। অসুস্থ মানুষ। কী আর বলব! মন্ত্রী হলেও সব মন্ত্রীই যে সুস্থ, তা তো নয়। ওঁর কথায় অত গুরুত্ব দিচ্ছি না।‌’

রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর গলায় প্রবল সহানুভূতির সুর। কিন্তু ঠাহর করলে বোঝা যায়, একটা দাঁত–চাপা তাচ্ছিল্যও আছে।

সন্ধ্যা ৬.‌৪৮

বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়ায় দক্ষিণ শহরতলির নাদিয়ালে ব্যাপক গোলমাল, পথ অবরোধ, বিক্ষোভ, ভাঙচুর। বেধড়ক মার খেয়েছেন মেটিয়াব্রুজের তৃণমূল বিধায়ক। আপাতত তিনি হাসপাতালে ভর্তি। সিটি স্ক্যান করানো হচ্ছে।

রাত ৮.‌৩৭

ফেসবুকে অফিসের ছবি দিয়েছিলাম। ক্যাপশন:‌ লাভ ইন দ্য টাইম অফ করোনা। যথারীতি ওয়ালে শুভেচ্ছার ঢেউ আসা শুরু হয়েছে। প্রতিটা মেসেজ পড়ছি আর ভাবছি, এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। সকলকে তো জবাবও দিতে পারব না!‌ কেউ কিছু মনে করবেন না তো?‌

কেরিয়ারের গোধূলিবেলায় পৌঁছে এমনিতেই নিজের প্রান্তিক অস্তিত্ব নিয়ে সর্বদা সঙ্কুচিত হয়ে থাকি। মনে হয়, বাকি কর্মজীবনটা সকলের শুভেচ্ছায় ভালয়–ভালয় কাটিয়ে দিতে পারলেই হল। কেউ যেন কিছু মনে না করে। আলাদা করে জবাব দিতে না পারলে কেউ কি অভিশাপ দেবে?‌ কে জানে!‌

রাত ১০.‌৩১

যাহোক করে বিড়ম্বনার দিনটা কেটে গেল। জন্মদিনে রেজোলিউশন–টন কোনওদিন নিইনি। স্রেফ বছরের আরও একটা দিন হিসেবেই দেখেছি। তবে আজ কয়েকটা লাইন মনে মনে বললাম।

জীবনের খুব কঠিন সময়ে এই লাইনগুলো লেখা একটা চিরকুট আমার ওয়ালেটে থাকত। ভাঁজ খুলে দেখতাম না কখনও। কিন্তু জানতাম, লাইনগুলো আছে। খুব কাছাকাছিই আছে। অন্ধকারে মশালের আলোর মতো।

‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা—
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।

সহায় মোর না যদি জুটে, নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।

আমারে তুমি করিবে ত্রাণ, এ নহে মোর প্রার্থনা—
তরিতে পারি শকতি যেন রয়।
আমার ভার লাঘব করি নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
বহিতে পারি এমনি যেন হয়।

নম্রশিরে সুখের দিনে, তোমারি মুখ লইব চিনে—
দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয়।’ ‌

লকডাউন ডায়েরি – ২৫ মে, ২০২০

২৫.‌০৫.‌২০২০। সোমবার

সকাল ৭.‌৫৯

কাল রাতে বাড়ি ফিরে বারান্দা থেকে তোয়ালেটা তুলতে গিয়ে দেখলাম দুর্দান্ত হাওয়া দিচ্ছে। একবার মনে হল, আবার ঝড় আসছে নাকি?‌ তারপর মনে হল, নাহ্‌, তেমন তো কোনও পূর্বাভাস নেই। যে আভাস আছে, সেটা বলছে উত্তরবঙ্গে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হবে। আরও বলছে, সপ্তাহান্তে একটা নিম্নচাপ আসছে। ফলে আবার বৃষ্টি, আবার বাঁধভাঙা, আবার জলবন্দি মানুষ, আবার ভয়, আবার ট্রমা। আর ভাল লাগছে না।

কাল রাতে অফিস থেকে ফিরে ভাল করে স্নান করলাম। একটু ভাল লাগল। ঘটনাচক্রে, কাল রাত থেকে টিভি ফিরে এসেছে। মোবাইল নেটওয়ার্কও আগের চেয়ে বেটার। এগুলো সব পজিটিভ সাইন। জীবন আবার করোনা–ছন্দে ফিরছে মনে হচ্ছে। আশা করি, আজকের দিনটা একটু অন্যরকম যাবে।

৯.‌৪৬

সকাল থেকে রোদ নেই। আজও হাওয়া দিচ্ছে খুব। ইন ফ্যাক্ট, কাল রাতের চেয়েও বেশি গতিতে। কিন্তু এটা ঝড়ের হাওয়া নয়। আমার মতো আরও অনেকে কি ভাবছেন আবার ঝড় আসছে?‌ যেমন ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। কিন্তু আমি এই প্রাচীন প্রবাদে বিশ্বাস করি না। ‌তার একটা সলিড কারণও আছে।

বহুবছর আগে বইমেলায় ‘দেশ’ পত্রিকার বিতর্কসভা কভার করতে গিয়েছিলাম। মোশন সম্ভবত বিয়ে–টিয়ে নিয়ে কিছু একটা ছিল। সেখানে একপক্ষের এক বক্তা কোনও একটা প্রসঙ্গে এই কথাটা বলেছিলেন— ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। বিপক্ষে ছিলেন নকশালপন্থী নেতা অসীম চ্যাটার্জি (‌কাকা)‌। তিনি তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘ওটা গরুদের যুক্তি‌!‌’

কথাটা ভুলিনি। বরং জীবনের বিভিন্ন সময়ে মনে করেছি এবং কাজে লাগিয়েছি। এখনও সেটাই ভাবছি— ওটা গরুদের যুক্তি। এই মনখারাপ, এই কিছু ভাল্লাগছে না–টা গরুদের যুক্তি। আমি গরু নই। আমি গোমাতাও নই।

সকাল ১০.‌১৩

পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ত্রিপুরা ছাড়া আজ সকাল থেকে বাকি রাজ্যে অন্তর্দেশীয় উড়ান চালু হল। চালু হল বটে। কিন্তু বিমানে চড়ার সমস্ত নিয়ম বদলে গিয়েছে—

এয়ারপোর্টে যাত্রীদের আনা–নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে উপযুক্ত গণপরিবহণের বন্দোবস্ত করতে হবে। অথরাইজ্‌ড ট্যাক্সি থাকবে। 

গেটের কাছে যাত্রীদের বোর্ডিং কার্ড স্ক্যান করাতে হবে। 

যাত্রীদের কাছে আরোগ্যসেতু অ্যাপ থাকতেই হবে। না থাকলে তখনই ডাউনলোড করতে হবে। 

বিমানবন্দর কর্মীদের আরোগ্যসেতু অ্যাপের সর্বশেষ স্টেটাস দেখাতে হবে যাত্রীদের। 

১৪ বছরের কমবয়সীদের আরোগ্যসেতু অ্যাপ লাগবে না।

যাত্রীদের মুচলেকা দিতে হবে, তাঁরা কোভিড পজিটিভ নন এবং কোনও কনটেনমেন্ট জোন থেকে আসছেন না। 

কেউ এই সংক্রান্ত কোনও তথ্য ভুল দিলে কঠোর শাস্তি হবে। 

উড়ান ছাড়ার ২ ঘন্টা আগে বিমানবন্দরে পৌঁছতে হবে। 

ব্যাগেজ ট্যাগ অনলাইনে মিলবে। সেটা লাগেজে আটকে দেওয়া হবে।

শুধুমাত্র ওয়েব চেক–ইন করা যাবে। 

বোর্ডিং গেটের কাছে যাত্রীদের সেফটি কিট, মাস্ক, ফেস শিল্ড এবং স্যানিটাইজার সংগ্রহ করতে হবে। 

বিমানের ভিতরে একটিমাত্র হ্যান্ডব্যাগ নিতে দেওয়া হবে। 

চেক–ইন ব্যাগেজও একটিই নেওয়া যাবে। 

‌বিমানের ভিতরে যাত্রীদের যথাসম্ভব কম ল্যাভেটরি / ‌টয়লেট ব্যবহার করতে হবে।

বিমানের মধ্যে টয়লেটে যাওয়ার জন্য লাইন দেওয়া যাবে না। টয়লেটে যাওয়ার সময় শিশু ও বয়স্কদের সঙ্গে মাত্র একজন সঙ্গী থাকতে পারবেন।

বিমানের প্রতিটি আসনে জলের বোতল রাখতে হবে। 

বিমানে কোনও খাদ্যদ্রব্য পরিবেশন করা হবে না। যাত্রীরাও কোনও খাবার নিয়ে বিমানে উঠতে পারবেন না। 

বিমানের ভিতরে খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিন নেওয়া যাবে না। 

বিমান গন্তব্যে অবতরণ করার পর ব্যাগেজ পৌঁছেছে কিনা, তা যাত্রীর মোবাইলে টেক্সট মেসেজ করে জানানো হবে। 

জীবনে প্রথম প্লেনে চড়েছিলাম ১৯৯৩ সালে। মুম্বই বিস্ফোরণ এবং তারপর সঞ্জয় দত্তের গ্রেফতারি কভার করতে যাওয়ার সময়। গিয়েছিলাম অধুনালুপ্ত ‘ইস্ট ওয়েস্ট এয়ারলাইন্‌স’–এ। কথিত ছিল তার মালিক নাকি দাউদ ইব্রাহিম। কিন্তু কোনও সূত্রেই তার কোনও সমর্থন মেলেনি। সেটা নিয়ে খোঁজখবরও করিনি। কারণ খোকা রিপোর্টারের মনে তখন প্রবল উত্তেজনা!‌ প্লেন ছাড়ার তিনঘন্টা আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছেছিলাম। তখন কলকাতা থেকে এত উড়ান চালু ছিল না। ফলে বিমানবন্দর প্রায় ফাঁকা। সিনেমা–টিনেমায় দেখেছিলাম, প্লেনে পেপারব্যাক পড়তে হয়। তাই সেটাও একটা নিয়ে গিয়েছিলাম। ফাঁকা এয়ারপোর্টে খুব মন দিয়ে সেটা পড়ার ভান করতে লাগলাম। আর কাউন্টার খোলামাত্রই গিয়ে একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জানালার ধারে সিট দখল করতে হবে তো।

অফিসের ট্রাভেল ডিপার্টমেন্ট বলেছিল, টিকিট না–ও পাওয়া যেতে পারে। চেষ্টা করছে। তাদের বলেছিলাম, প্লেনের লেজে বেঁধে দিলেও হবে। কিন্তু কলকাতা থেকে আমায় না নিয়ে মুম্বইয়ের উড়ান রওনা হবে না। তবে সিট পাওয়া গিয়েছিল। দরবার করে উইন্ডো সিটটাও নিতে পেরেছিলাম। উড়ানের পুরো সাময়টা শিশুর মতো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। যা খাবার দিয়েছিল, হাভাতের মতো চেটেপুটে খেয়েছিলাম। কিচ্ছু ছাড়িনি।

ওহ্‌ ভি এক দিন থে। ইয়ে ভি এক দিন হ্যায়। জমানা বদল গ্যয়া!‌

সকাল ১০.‌৫০

আজ ইদ–উল–ফিতর।

রমজান মাসের শেষে খুশির ইদ। কিন্তু কোথাও কোনও প্রাণের সাড়া নেই। রেড রোড বা অন্য কোথাও ইদের নমাজ পড়া নেই। কোথাও আনন্দ নেই। আলিঙ্গন নেই। বিরিয়ানি নেই। সিমাই নেই। নমাজ পড়া হচ্ছে বাড়িতে বাড়িতে। ভাবার চেষ্টা করছি, দুর্গাপুজোর সময়টা যদি এইরকম হতো?‌ যদি অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়া হতো বাড়িতে?‌ নতুন জামা পরে বাড়িতেই বসে থাকতে হতো?‌ কেমন লাগত?‌

খানিক আগে পিং করে একটা হোয়াট্‌সঅ্যাপ ঢুকল। চট্টগ্রাম থেকে আসাদভাই পাঠিয়েছে— ইদ মুবারক।

আসাদের সঙ্গে একটা সময় নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ও পুলিশে চাকরি করে। বেশ কয়েকবছর আগে বাংলাদেশ সরকারের অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম কোনও অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়া বাংলাদেশ যাওয়া। সেই প্রথম রাজার হালে চলাফেরা। গাড়ির সামনে পিছনে পাইলট কার আর টেল কার। সঙ্গে ২৪ ঘন্টার পুলিশ এসকর্ট। সেই এসকর্ট টিমেরই সদস্য ছিল আসাদ।

ছিপছিপে চেহারা। বয়সে আমার চেয়ে বেশ খানিকটা ছোট। বাড়ি চট্টগ্রামে। হাতে লোডেড স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। সময়ে সময়ে সেফটি ক্যাচ অন করা থাকত। মুখে ঝকঝকে হাসি। একটা সময় ফুটবল খেলত। ভেবেছিল বড় হয়ে ফুটবলার হবে। পুলিশে চাকরি পেয়ে যাওয়ায় আরও অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের মতো আসাদের ফুটবল–স্বপ্নেরও অপমৃত্যু হল।

দায়িত্ব ছিল এসকর্ট টিমের সকলেরই। কিন্তু আসাদের আমার প্রতি একটা চোরা পক্ষপাতিত্ব ছিল। সেটা বুঝতেও পারতাম। সফরের মধ্যে দু’দিন ধার্য ছিল চট্টগ্রামের জন্য। বাড়ির অত কাছে গিয়েও আসাদ বাড়ি যায়নি। হোটেলের সামনে গাড়িতেই ডিউটিতে ছিল সারা রাত। তার আগে সন্ধ্যায় আমায় নিয়ে গিয়েছিল জিন্‌সের ট্রাউজার্সের হোলসেল মার্কেটে। পরিচিত দোকানে নিয়ে গিয়ে ট্রাউজার্স পছন্দ করিয়ে, দরদাম সেরে সঙ্গে সঙ্গে অল্টার করিয়ে দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছিল। মাত্র ৫০০ বাংলাদেশি টাকার সেই টেরিফিক জিন্‌স পরলে এখনও লোকে জিজ্ঞাসা করে কোথা থেকে কিনেছি!‌ ঘিঞ্জি সেই মার্কেটে আমায় পিছন থেকে দু’হাত দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই আগলে রেখেছিল আসাদ। শুধু সেখানেই নয়, পুরো সফরটা আমার গায়ে গায়ে লেপ্টে ছিল। একটা মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যায়নি। পুলিশ নয়, ভাইয়ের মতো।

হোয়াট্‌সঅ্যাপে জবাব দিলাম। আর মনে মনে জড়িয়ে ধরলাম ওপার বাংলার যুবককে।

ইদ মুবারক, আসাদভাই।

বেলা ১১.‌২০

এখনও কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের দাবিতে পথ অবরোধ আর বিক্ষোভ হচ্ছে। মানুষের তীব্র ক্ষোভ সিইএসসি–র বিরুদ্ধে। টিভি–তে বয়স্ক সব মানুষের কষ্ট চোখে দেখা যায় না। লকডাউনে কাজের লোক আসছে না। অশক্ত শরীর নিয়ে জল টেনে তুলতে হচ্ছে। ঘর পরিষ্কার করতে হচ্ছে। রান্না করতে হচ্ছে। আমার বাড়ির দুই বুড়োবুড়ির দিকে তাকাই। আর ভাবি, ভাগ্যিস!‌

দুপুর ১.‌১৩

আজ থেকে আবার রেগুলার ওয়ার্কআউটে ফিরে গেলাম। অবশেষে। বিকজ আই নিড টু পুল দিস থ্রু। অন্তত ৩০ তারিখ পর্যন্ত ঠিকঠাক কাটাতে হবে। এই পর্যায়ের লকডাউন শেষ হওয়া পর্যন্ত। ৪৫ মিনিট সলিড ঘাম ঝরানো হল। দেখলাম, খুব কষ্ট হচ্ছে না। আসলে সমস্যাটা ছিল মনের। শরীরের নয়। দাঁতে দাঁত চেপে মনটাকে বশে আনতে পেরেছি।

প্ল্যাঙ্ক করতে গিয়ে যখন শেষ ১০ সেকেন্ড সারা দেহ থরথর করে কাঁপতে থাকে, ম্যাটের উপর টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়তে থাকে, তখনও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে যেতে থাকি। প্রাণপণে বশে রাখতে চেষ্টা করি মনকে। মনে হয়, লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। হবেই। ঠিক তেমনই দাঁতে দাঁতে চেপে বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে। হবেই। কাম হোয়াট মে!‌ মনখারাপের কাছে আর আত্মসমর্পণ নয়।

বাবা–মায়ের খাবার তৈরি করতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছি। খানিক নির্বুদ্ধিতা এবং খানিক পাকামির জন্য। হটপ্লেট থেকে খাবারসুদ্ধ পাত্রটা কায়দা করে নামাতে গিয়ে হাতলটা স্লিপ করল। সেটা মাটিতে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে আগুন–গরম পাত্রটাই খপাত করে ধরলাম। আর যায় কোথায়!‌ রাম চিৎকার দিয়েছিলাম। আশপাশের বাড়িও নিশ্চয়ই সচকিত হয়ে উঠেছিল। তবে ফোস্কা পড়তে দিইনি। দ্রুত জলে ধুয়ে টুথপেস্ট লাগিয়ে দিলাম। ছ্যাঁকা খেলে টুথপেস্ট আর কেটে গেলে চিনি— এই হল চালু এবং অব্যর্থ টোটকা। আজকেই শিখলাম।

দুপুর ৩.‌৩৩

অফিসে শুনলাম ঝড়ের দিন নাকি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতেও ঘন্টাচারেক কারেন্ট ছিল না। তারপর সিইএসসি–তে খবর যায়। মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও খবর যায়। দ্রুত বিদ্যুৎ ফেরানো হয়। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতেও দু’দিন আলো ছিল না। সেটা তিনি নবান্নে সেদিন বললেনও। অবাক লাগল যে, তারপরেও সিইএসসি ওঁর বাড়িতে একটা জেনারেটর দিয়ে বিকল্প কোনও ব্যবস্থা করল না?‌ হাজার হোক, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি তো!‌ একটা নিরাপত্তার অ্যাঙ্গলও তো আছে। অবশ্য বলা যায় না, উনি নিজেই হয়তো সেই বিশেষ সুবিধা নিতে রাজি হননি।

যতদূর জানি, একটা সময়ে সিইএসসি–র কাছে কলকাতা শহরের অন্তত ২৬০টি গুরুত্বপূর্ণ নামের তালিকা ছিল। তার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী–সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, টপ সরকারি অফিশিয়াল, হাসপাতাল, ডাক্তার, মিডিয়া প্রতিষ্ঠান এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকদের নাম ছিল। সেসব অবশ্য আর এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রসঙ্গত, সারা দেশের মধ্যে সিইএসসি–র ট্যারিফই নাকি সবচেয়ে বেশি!‌

আরও একটা বিষয় মনে হচ্ছিল। তাঁর পরিচালিত সংস্থা নিয়ে চারদিকে এত ক্রোধ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ। সঞ্জীব গোয়েঙ্কা একবার একটা প্রেস কনফারেন্স করে কিছু বলতে পারলেন না?‌ ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনও আলাপ বা ঘনিষ্ঠতা নেই। একবারের বেশি কথাও হয়নি। কিন্তু দূর থেকে দেখে যথেষ্ট সজ্জন বলেই মনে হয়েছে। খুবই আর্টিকুলেট এবং ভদ্র। মুখে একটা সংক্রামক হাসি লেগে থাকে সবসময়। কোনও অবস্থাতেই সেটা ওঁকে ছেড়ে যায় না।

‘এবেলা’–র অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের মঞ্চে ওঁর সঙ্গে মিনিট দশেকের একটা প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল আমার। শুরুতেই অভীকবাবুর শেখানো প্রশ্নটা করলাম, আপনি তো কলকাতা শহরের সবচেয়ে বড় মুদি?‌

পাঁচতারার ব্যাঙ্কোয়েটে একেবারে সামনের আসনে বসে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তার আশেপাশে রাজনীতিক, ফুটবলার, ক্রিকেটার এবং শহরের পেজ থ্রি সেলিব্রিটিরা। সকলে হাঁ!‌ বলে কী?‌ একটা ইয়ট আর একটা চাটার্ড প্লেনের মালিক নাকি শহরের সবচেয়ে বড় মুদি?‌ ফাংশনের শেষে ডিনারে এক বিখ্যাত গায়ক তো বলেই ফেললেন, ‘‌তুমি পারোও মাইরি!‌ সঞ্জীব গোয়েঙ্কাকে সটান মুদি বলে দিলে?‌’ তাঁকে বললাম, আরে, আমার তো আর ওঁকে ধরে গানের সিডি বার করার স্টেক নেই। অন্য কোনও দাক্ষিণ্যেরও দরকার নেই। অন্তত এখনও পর্যন্ত দরকার হয়নি। আর আমার যা যোগ্যতা, তাতে উনি আমায় ওঁর কোনও সংস্থার চাকরিতেও নেবেন না। কার যেন বাটপাড়ের ভয় থাকে না?‌

গায়ককে যেটা বলিনি, ওটা ছিল একেবারে অভীকবাবুর নিজস্ব স্ট্র্যাটেজি। যে, ব্যাটসম্যান উইকেটে আসামাত্রই গোলার মতো একটা বাউন্সার দাও। সেটা হয় সে মরিয়া হয়ে হুক করার চেষ্টা করবে বা মাথা সরিয়ে ‘ডাক’ করবে। যা–ই করুক, একটু ভেবলে থাকবে। তখন পরপর টকাটক বাকি ডেলিভারিগুলো করতে হবে। দু’ফুট দূরত্বে বসে বুঝতে পারছিলাম, সঞ্জীব মুদি সংক্রান্ত প্রশ্নটি শুনে একটু অবাকই হয়েছেন। ঠিক রিলেট করতে পারছেন না। কিন্তু টসকাচ্ছেনও না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। বললাম, আপনি মুদিই তো। কারণ, আপনি মুদিখানার মালিক। মানে গ্রসারি। মানে স্পেনসার্স।

এবার সঞ্জীব একটু রিল্যাক্সড হলেন। ঝকঝকে দাঁতের হাসিটা ফিরে এল। পরের প্রশ্ন গেল, আপনি কি শহরের সবচেয়ে বড় মুদিই হতে চেয়েছিলেন?‌

এমনিতেই সুপুরুষ। তার উপর সেদিন পিন স্ট্রাইপ্‌ড স্যুটে সঞ্জীবকে লাগছিলও একঘর। সংক্রামক হাসিটা মুখে ধরে রেখেই বললেন, ‘নাহ্‌, শহরের সবচেয়ে বড় মুদি হতে চাইনি। বরং শহরের ঘরে ঘরে আলো জ্বালাতে চেয়েছিলাম। সেটা পেরেছি ভেবেই খুব স্যাটিসফায়েড লাগে।’

অর্থাৎ, সিইএসসি। সেদিনই বুঝেছিলাম, কলকাতা এবং হাওড়ার কিছু অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী এই সংস্থা তাঁর কতটা কাছের। কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও তিনি একবার শহরবাসীর সামনে এসে তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করলেন না?‌ তার বদলে এগিয়ে দেওয়া হল এক মুখপাত্রকে?‌ সংস্থার জনসংযোগ দফতরের অন্যতম শীর্ষকর্তা সাহিত্যিক শংকরকেও তো কোনও বিবৃতি বা ওইধরনের কিছু দিতে দেখা গেল না। অথচ এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে শংকর চ্যাম্পিয়ন। তিনি একাধারে কর্পোরেট এবং কমনম্যান।

কিন্তু সবচেয়ে বেশি ইমপ্যাক্ট হতো সঞ্জীব নিজে কিছু বললে। এই শহরের সঙ্গে তাঁর তো একটা ফুটবল সংক্রান্ত গভীর এবং ঘন সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। যার পোশাকি নাম এটিকে–মোহনবাগান। তিনি তো সে অর্থে শহরের ফুটবলেরও কর্পোরেট মুখ। সেটা বাদ দিলেও তাঁর তো উচিত ছিল নিজের সংস্থার কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো। বহির্বিশ্বের সামনে তাঁদের প্রোটেক্ট করা। তারপর ঘরের মধ্যে না হয়ে ঝেড়ে কাপড় পরাতেন।

বিকেল ৪.‌৩০

সিইএসসি–র সঙ্গে যুদ্ধটা আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন ফিরহাদ হাকিম। তিনি এবার সটান ঘোষণা করলেন, ‘আমি আজ সিইএসসি–কে বলেছি, এনাফ ইজ এনাফ!‌ আপনারা লোকবল বাড়ান। আমরা সব গাছ কেটে ফেলেছি। এবার সেগুলো তুলে নিয়ে ফেলতে হবে। তার জন্য আমাদের খানিকটা সময় লাগছে। ২০০ লরি কাজ করছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ ফেরানোর সঙ্গে কলকাতা পুরসভার কোনও সম্পর্ক নেই।

সেনাবাহিনী তো কাজ করছেই। পাশাপাশি ওডিশা থেকেও ৩০টি টিম এসেছে কলকাতা শহরকে গাছ কেটে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে। প্রতিটি দলে ১০ জন করে সদস্য। তাঁরা ইলেকট্রিক করাত দিয়ে হু–হু করে গাছ কাটছেন। আশা করা যায়, আগামী দু’একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি আয়ত্তে আসবে। সিএইএসসি তো বলেইছে, মঙ্গলবার অর্থাৎ কালকের মধ্যে সর্বত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। হোপফুলি হবে। চারদিকের মানুষের এই কষ্ট আর ভোগান্তিটা গায়ে লাগছে।

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখতে রাজ্যে আসছে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদল। আজই ক্যাবিনেট সচিব রাজীব গৌবা বলেছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সমস্ত রকমের সাহায্য করা হবে।

সন্ধ্যা ৬.‌৫০

ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে গত কয়েকদিন ধরে করোনাভাইরাস সত্যিই পিছনের সারিতে গিয়ে বসেছিল। এই ডায়েরিতেও। আজ কোভিড–ঝাঁপি খুলে দেখছি, সারা দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৪,০০০ ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ১,৪৫,৮৩৮। গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৭,০০০ জন। মৃত্যু হয়েছে ১২৪ জনের।

পশ্চিমবঙ্গে গত ২৪ ঘন্টায় মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। সারা রাজ্যে কোভিডে মৃত এখনও পর্যন্ত ২০৬ জন। তাঁদের মধ্যে কো–মর্বিডিটিতে মৃত্যু হয়েছে ৭২ জনের। রাজ্যে কোভিডে আক্রান্ত এখনও পর্যন্ত ২,১২৪ জন। গত ২৪ ঘন্টায় করোনা–মুক্ত হয়েছেন ৭৫ জন।

রাত ৮.‌০৩

দক্ষিণের গড়ফা থানায় ভাঙচুর। থানায় কর্মরত একজনের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে, এমন খবর থেকেই ক্ষোভ এবং ভাঙচুরের সূত্রপাত। টিভি–তে দেখাচ্ছে, এলাকার মানুষ বলছেন, পুলিশকর্মীরাই নাকি ভাঙচুর চালিয়েছেন থানায়!‌ বিভাগীয় ডেপুটি কমিশনার তদন্তে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি তো দেখলাম স্পিকটি নট!‌

রাত ১০.‌২৮

প্রতিটা দিনই আসলে এক নতুন শিক্ষার দিন। ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কলের লাইনটা মনে রাখব—

দোজ হু হ্যাভ আ ‘হোয়াই’ টু লিভ
ক্যান বিয়ার উইথ অলমোস্ট এনি ‘হাউ’।

আমেন!‌

লকডাউন ডায়েরি – ২৪ মে, ২০২০

২৪.‌০৫.‌২০২০। রবিবার

সকাল ৮.‌০০

অ্যালার্ম শুনে ঘুম ভাঙেনি। অ্যালার্ম বেজেছে। কিন্তু তার অনেক আগে থেকে উঠে ঝুম হয়ে বসে আছি বিছানায়। কারণ, এই প্রথম ঘুম ভাঙল মুখে একটা তিতকুটে স্বাদ নিয়ে। একটা ‘ভাল্লাগছে না’ বোধ নিয়ে। শরীরটাও ঠিক জুতের নেই বলে মনে হচ্ছে।

মা–বাবাকে চা দিয়ে এলাম। খুব অস্বস্তির সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, বিস্কুট ফুরিয়ে গিয়েছে। আনতে হবে। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। গত দু’মাসে কখনও এমন হয়নি। যা–ই হোক, সবসময় পজিটিভ থেকেছি। চারপাশটাকে এনার্জাইজ্‌ড করে রাখতে চেষ্টা করেছি। এভারেডি ব্যাটারির মতো। আজ মনে হচ্ছে, ব্যাটারি ফুরোচ্ছে। শরীর–মন দুটোই জবাব দিতে বসেছে। সারাদিন অনেক কাজ আছে। সল্টলেকের বাড়িতে কিছু কাজ পড়ে আছে। পারলে একবার চেতলা যেতে হবে। অফিস যেতে হবে। রবিবার অফিসে বাড়তি চাপও থাকে। কিন্তু কিছু ভাল লাগছে না।

এটা কেন হচ্ছে?‌ আমার কি ডিপ্রেশন হল?‌

যে কোনও বিষয়ে বরাবর ‘গো টু পার্সন’ থেকেছি। পরিবারে এই প্রজন্মে আমি একমাত্র পুত্রসন্তান। ফলে সকলেই এদিকে তাকিয়ে। বৃহত্তর পরিবারের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া, আত্মীয়দের দায়ে–দফায় পাশে গিয়ে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে বকঝকা দিয়ে লোকজনকে লাইনে আনা— সবকিছু আমার ঘাড়ে। তাতে যে খারাপ লেগেছে, তা নয়। বোঝা বলেও মনে হয়নি। কিন্তু আজ সকাল থেকে কেন জানি না, মনে হচ্ছে, ধুস!‌ সব ফালতু। সব বৃথা। শরীর টানছে না। মন সায় দিচ্ছে না।

এটাই কি ডিপ্রেশন?‌

অথচ সারা জীবন মনে হয়েছে ডিপ্রেশন–টিপ্রেশন বাজে বকওয়াস। বিলাসিতা। সারাদিন এত কাজ। এত ব্যস্ততা। ডিপ্রেস্‌ড হওয়ার সময় কোথায়?‌ ইন ফ্যাক্ট, সবসময় চেয়েছি একের পর এক কাজ দিয়ে দিনের সব খাপখোপ ভরে রাখতে। যাতে কখনও বিশ্রাম নেওয়ার, এলিয়ে পড়ার এবং চিন্তা করার সময়টুকুও না থাকে। অন্ধের মতো পারফেকশনকে ধাওয়া করে গিয়েছি। সেটা কপি লেখা হোক বা কাগজ বানানো বা বাড়ি পরিষ্কার করা। প্রয়োজন না হলেও সমস্ত কাজে নিজের ৫০০ পার্সেন্ট দিয়েছি। সবসময় মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করেছি, পজিটিভ থাকতে হবে। পজিটিভ থাকতে হবে। কোনও নেতিবাচকতাকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া চলবে না।

কিন্তু আজ সেগুলোও ভাবতে ইচ্ছে করছে না। নিজের ডিপ্রেশনের কাহিনি বলতে গিয়ে দীপিকা পাড়ুকোন বলেছিল, ‘হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চারদিকটা কেমন ফাঁকা আর অর্থহীন মনে হল। মনে হল, কেন বেঁচে আছি!‌’ আমার মনে বেঁচে থাকা নিয়ে কোনও প্রশ্ন এখনও আসেনি। কিন্তু ফাঁকা আর অর্থহীন লাগতে শুরু করেছে। এটা কি লকডাউন এফেক্ট?‌ নাকি আমপান এফেক্ট?‌ নাকি নিছক সাময়িক ক্লান্তি?‌

সকাল ১০.‌০০

এতক্ষণ চুপটি করে শুয়েছিলাম। ভাল লাগছিল না। এখন মনে হচ্ছে, সেটা করলে চলবে না। কতক্ষণ এভাবে তক্তার মতো পড়ে থাকব?‌ কতদিন ওয়ার্কআউট করা হয় না!‌ ইচ্ছে করে না। দিনের যাবতীয় রুটিন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। লকডাউনের পর থেকে পুরো দিনটা একটা নিটোল বৃত্তের মধ্যে থাকত। গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ সেই বৃত্তটা এলোমেলো করে দিয়েছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছি টুকরো–টাকরাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে জড়ো করে আবার বৃত্তটা তৈরি করার। হচ্ছে না। এটা নেহাত আলস্য নয়। এটা সকাল সকাল উঠে চিরতার জল খাওয়ার মতো অনুভূতি।

আপাতত চেতলা যাই। ক্লান্ত লাগছে। তা–ও যেতে হবে। কাজ আছে।

দুপুর ১২.‌৩০

চেতলা থেকে এইমাত্র ফিরলাম। আসলে চেতলা থেকে নয়। ফিরলাম বিধ্বস্ত দক্ষিণ কলকাতা থেকে। যা সম্ভবত এই আপাত–ডিপ্রেশনের মেয়াদ আরও বাড়িয়ে দিল।

সল্টলেকে থেকে যে রুটে যাই, সেই ইউজুয়্যাল রাস্তা ধরেই গিয়েছিলাম। মা উড়ালপুল ধরে রেসকোর্সের সামনে নেমে বাঁদিকে ঘুরে ডিএল খান রোড হয়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের সামনে থেকে ডানদিকে ঘুরে চেতলা হাট রোডের প্যারালাল রাস্তাটা ধরে সোজা। দেখলাম, সেই রাস্তা জুড়ে এখনও গাছ পড়ে আছে। কোনওক্রমে সরিয়ে গাড়ি চলাচলের পথটুকু করা হয়েছে। তার আগে দেখলাম ‘উত্তীর্ণ’–র সামনে তিনকোনা জমিতে ঝড়ের ছেড়ে যাওয়া চিহ্ন। বিশাল বিশাল গাছ রেলিং–টেলিং দুমড়ে নিয়ে রাস্তার উপর পড়েছে। সেগুলো কাটার কাজ শুরু হয়েছে সবে। পুলিশ আর রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দল কাজ করছে।

অ্যাপার্টমেন্টের লিফ্‌ট বিকল। বৃষ্টির জল পোর্টিকো টপকে এসে লিফ্‌টের খোঁদলে ঢুকে গিয়েছিল। এখনও সেটা বার করা যায়নি। বা বার করা হয়নি। কোম্পানির লোক কবে আসবে, সেজন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। এরপর নিশ্চয়ই ওই জমা জল পচে গন্ধ বেরোবে। তখন হয়তো নিজেদেরই জল বার করতে নামতে হবে।

সিঁড়িতে রণদেবের সঙ্গে দেখা হল। বেচারা মাছ–মাংস বাজার করে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঝুলিয়ে ফিরছে। করুণ হাসি হাসল। আমি করুণতর হাসি ফেরত দিলাম।

বঙ্কু আমায় ডিভোর্স দিয়েছে। লবঙ্গর শরীরটা খারাপ। আমায় দেখে লাফিয়ে কোলে এল বটে। কিন্তু সেই তেজ নেই। বরং ইনস্টু আর ট্রাইপড এখন অনেক বেটার। দুটোই এত ভাল বাচ্চা যে কী বলব!‌ ওদের সঙ্গে বারান্দায় খানিকক্ষণ সময় কাটালাম। বারান্দা থেকেই দেখলাম, রাস্তায় প্রচুর মোটরবাইক চলছে। রবিবারের আড্ডার আসরও বসেছে। বোধহয় এই বোধোদয় হয়েছে যে, করোনাভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হবে। এছাড়া তো আর কোনও উপায়ও দেখছি না।

ভেবেছিলাম বেরিয়ে ডিম কিনব। কিন্তু দোকান বন্ধ। তবে বিস্কুট নিলাম।

ফেরার সময় সাদার্ন অ্যাভিনিউ, লেকের চত্বর হয়ে এলাম। এই জায়গাটা একসময় আমার নিয়মিত বিচরণক্ষেত্র ছিল। গোটা শহরের মধ্যে সাদার্ন অ্যাভিনিউ আমার অন্যতম প্রিয় রাস্তা। এই রাস্তায় যে কত স্মৃতি!‌ অফিস থেকে ফেরার সময় প্রায় রাতেই এই রাস্তা ধরে ফিরতাম। সাড়ে তিনবছর আগে চাকরি ছাড়ার পর বেকার হয়ে টানা দেড়টি মাস প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যায় এই রাস্তা ধরে হেঁটেছি। ইচ্ছে করেই লেক কালীবাড়ির ফুটপাথটায় যেতাম না। ওদিকটায় জনবসতি। তখন লোকজনের কোলাহল ভাল লাগত না। তাই হাঁটতাম লেকের ধারের ফুটপাথ দিয়ে। সেই রাস্তার প্রতিটি গাছ, ফুটপাথের প্রতিটি টাইল আমার চেনা। খারাপ সময়ে ওদের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা হয়েছিল।

সেই সাদার্ন অ্যাভিনিউ এখন পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপের মতো। গাছ সরিয়ে গাড়ি চলাচলের একটা শুঁড়িপথ তৈরি হয়েছে বটে। কিন্তু মনে হচ্ছিল, অরণ্যদেব কমিক্‌সের ফিসফিসে কুঞ্জে ঢুকছি। অথবা অ্যামাজনের রেন ফরেস্টে। দু’পাশে গাছের দেওয়াল, মাথার উপর গাছের ছাদ দিয়ে তৈরি একটা গুহায় ঢুকছে গাড়িগুলো। কত চেনা গাছ উপড়ে গেল শিকড়সুদ্ধ। ভেঙে পড়ল কত পরিচিত মহীরূহ। চিরচেনা রাস্তাটাকে আর চেনা যাচ্ছিল না।

একটা সময় রোজ ভোরে লেকে হাঁটতে যেতাম। ফুল–ফুল হাঁটা নয়। ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবের সামনের ড্রপগেট থেকে পঞ্চাননতলার দিকের ড্রপগেট পর্যন্ত তিনবার যাওয়া। তিনবার আসা। ঘড়ি ঘরে ননস্টপ ৭৫ মিনিট। এতটাই সিরিয়াস ছিলাম যে, বর্ষাকালে ছাতা–মাথায়ও হেঁটেছি। তারপর একদিন মনে হল, ধুস! ‌একা একা হাঁটাটা খুব বোরিং। কোনও লড়াই নেই। প্রতিযোগিতা নেই। হারজিত নেই। তাই দুম করে ছেড়ে দিলাম। তারপর থেকেই ব্যাডমিন্টন শুরু। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে আর লেকে ঢোকা যায় না। আর আমপানের পর যা অবস্থা হয়েছে, তাতে করোনা চলে গেলেও আবার কবে ভিতরে ঢোকা যাবে কে জানে!‌

লেকের পাশের রাস্তা ধরে লেক গার্ডেন্‌স ফ্লাইওভার দিয়ে যেতাম মিলন সঙ্ঘের ইনডোর কোর্টে। ব্যাডমিন্টন খেলতে। সপ্তাহে চারদিন। প্রায় সারাবছর। প্রতিদিন এই রাস্তা ধরে কত মানুষ হাঁটতেন। জগিং করতেন। দেখতে দেখতে মুখচেনা হয়ে গিয়েছিল। সেই রাস্তার অবস্থা চোখে দেখা যায় না!‌ যাওয়ার রাস্তাটা গাছ পড়ে পুরোপুরি বন্ধ। পাশের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। কেউ কি জানে কবে এইসব বাধা সরানো হবে?‌

খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, ঘূর্ণিঝড়ের পর চার–চারটে দিন কেটে গেল!‌ এখনও চারদিকের এই অবস্থা কেন। জানি, নজিরবিহীন বিপর্যয়। জানি, করোনা–সংক্রমণের কারণে কর্মীর সঙ্কট রয়েছে। কিন্তু এগুলো তো অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার কাজ। এসেনশিয়াল সার্ভিস। বিপর্যয়ের সময়েই তো এগুলোর বেশি চালু থাকা দরকার। সাধে কি অধৈর্য হচ্ছেন মানুষ?‌ সাধে কি তাঁরা ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পথ অবরোধ করছেন?‌

তা–ও ঝড়ের চারদিন পর!

দুপুর ১.‌১০

গত কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছে আমপান–কালে সর্বাধিক চর্চিত এবং আলোচিত চরিত্র কে?‌ কান্তি গাঙ্গুলি।

সুন্দরবন কান্তি’দার ঘরবাড়ি। অনেক আগে থেকেই। আয়লার সময় তিনিই উদ্ধারকর্তা ছিলেন। ধুতিটাকে লুঙ্গির মতো করে পেঁচিয়ে, হাফহাতা গেঞ্জি গায়ে আর কাঁধে গামছা নিয়ে আমপানের সময়েও তিনিই এলাকায়।

ঘটনাপ্রবাহ বলছে, আয়লার সময় এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো সত্ত্বেও রায়দিঘি তাঁকে ভোটে জেতায়নি। পরপর দু’বার তিনি হেরেছেন তৃণমূলের দেবশ্রী রায়ের কাছে। যাঁকে এলাকায় দেখা যায় বলে বিশেষ অভিযোগ নেই। কিন্তু কান্তি রাজনীতিকের পরিচিত রাস্তায় হাঁটেননি। ভোটের বিনিময়ে যাঁরা কাজ দেন, এই প্রবীণ তাদের দলে পড়েন না। তাঁকে ভোট দেয়নি মানুষ। ফলে তিনি কঠিন সময়ে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন— এটা কোনও পরিণত রাজনীতিককে মানায় না। কান্তি সেটা জানেন। ফলে ভোটের রেজাল্ট যা–ই হোক, দুর্যোগ, দুর্বিপাকে এবং দরকারে তাঁকে জনতার পাশে দেখা যায়। দেখা যাচ্ছে। এবং তাঁর সেই নীচুগ্রামীণ অথচ সোচ্চার উপস্থিতি রাজ্য জুড়ে এতটাই হিল্লোল তুলেছে যে, আমপান নিয়ে উদাসীন ন্যাশনাল মিডিয়াও কান্তিকে নিয়ে বিস্তারিত স্টোরি করেছে।

ব্যক্তিগতভাবে কান্তিকে আমার বরাবর দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষ চক্রবর্তী বলে মনে হয়েছে। সুভাষ যেমন অনেক সময়েই দলকে অগ্রাহ্য করে এবং আলিমুদ্দিনকে হেলায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে নিজের স্টাইলে চলতেন, কান্তিও তেমনই। বহু বছর আগে একবার তাঁর সঙ্গে সামান্য ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তখন তাঁকে সেকথা বলেওছিলাম। স্বভাবজ বিনয়ে কান্তি হেসে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেও ভিতরে ভিতরে জানতেন, এই অর্বাচীন ভুল কিছু ভাবেনি। সুভাষের মতো দল বিভিন্ন সময়ে তাঁরও রাশ টেনে ধরতে চেয়েছে। আলিমুদ্দিন এবং প্রশাসনের একচ্ছত্র নেতা কান্তির গেঁয়ো এবং মাঠো স্বভাব নিয়ে নাক সিঁটকেছেন। কিন্তু কান্তিকে রোখা যায়নি।

যেমন এই আমপানের সময়েও গেল না। নিজের উদ্যোগে ঘূর্ণিঝড়ের আগে এলাকায় চলে গেলেন। নিজের উদ্যোগে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানালেন, তিনি সাহায্য করতে চান। ঘূর্ণিঝড়ের পর নিজের উদ্যোগে এলাকার মেয়ে–পুরুষদের নিয়ে বাঁধ মেরামতি শুরু করলেন। ভোট–টোট চুলোয় যাক। ৭৭ বছরের প্রৌঢ় আর কখনও ভোটে দাঁড়াবেন কিনা, কে জানে!‌ ভুল লিখলাম, আলিমুদ্দিন জানে। কিন্তু মনে হয় না, সেটা তাঁর লক্ষ্য। তাঁর অনেক বেশি আনন্দ সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে সেই গেঁড়ি গেঁড়ি কালো কালো বাচ্চাদের উন্নয়নে, যাদের কেউ কেউ তাঁকে দূর থেকে বিস্ফারিত নয়নে দেখে। কেউ ‘দাদু–দাদু’ বলে দৌড়ে এসে হাত ধরে ঝুলে পড়ে।

কান্তি গাঙ্গুলি পরোপকার করেন আপন খেয়ালে। যেমন লিরিক কবি কবিতা লেখেন নিজের আনন্দে।

দুপুর ১.‌২৫

সামান্য খেয়ে একটু গড়িয়ে পড়েছিলাম। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে দুটো জিনিস প্রণিধানযোগ্য—

১. দক্ষ সংগঠক মানেই দক্ষ প্রশাসক নয়। সংগঠন করতে গেলে প্রাথমিকভাবে হইহই করে কিছু লোক জোটাতে হয়। তারপর তাদের তুইয়ে–বুইয়ে চলতে হয়। কারণ, সংগঠক জানে, ওই লোকগুলো সরে গেলেই তার ভিত নড়ে যাবে। পক্ষান্তরে, প্রশাসকের ধাতু এবং ধাতটাই আলাদা। তাকে সময়ে সময়ে নির্মোহ এবং নৈর্ব্যক্তিক হতে হয়। তার মধ্যে একটা সেন্স অফ ফেয়ারনেস থাকতে হয়। তাতে কিছু অকাজের লোক তার উপর ক্রুদ্ধ হয়। তার জনপ্রিয় হওয়া হয় না। কিন্তু সামগ্রিক এবং ব্যাপক অর্থে সে বহুজনসুখায় এবং বহুজনহিতায় কাজ করে।

২.‌ রাজনীতিতে কিছু মিথ্যে বলতেই হয়। তার কিছু ক্লাসি এবং শৌখিন মিথ্যে। আর কিছু মিথ্যে ক্লাসলেস এবং চশমখোর। কালক্রমে সব মিথ্যেই ধরা পড়ে। কিন্তু লোকে মনে রাখে, কোন লোকটা কোন টাইপের মিথ্যে বলেছিল। ক্লাসি এবং শৌখিন?‌ নাকি ক্লাসলেস এবং চশমখোর।

দুপুর ‌২.‌৩৮

অফিস যেতে হবে। কিন্তু ইচ্ছে করছে না।

আবার দিলীপ ঘোষকে আটকেছে পুলিশ। আজ পূর্ব মেদিনীপুরে। বলা হয়েছে, তিনি গেলে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হবে। তমলুকের কাছে নন্দকুমারে বাধা পেয়ে আবার টিভি–তে গরম বিবৃতি দিচ্ছেন দিলীপ। গাড়ি থেকে নেমে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার বিলি করেছেন।

তৃণমূল বলছে, দিলীপ শিশুসুলভ আচরণ করছেন। খবরে থাকতে চাইছেন। প্রশ্ন হল, তাঁকে খবরে আনছে কারা?‌

দুপুর ৩.‌৩৫

রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর টুইট করে জানিয়েছে, আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার।

গত কয়েকদিনে করোনাভাইরাসকে প্রায় ভুলেই গিয়েছে কলকাতা। নৈমিত্তিক পরিষেবাহীন দিনযাপনের গ্লানির চোটে সামাজিক দূরত্ব মাথায় উঠেছে শহরের। এই বিদ্যুৎ বিপর্যয় না হলে সম্ভবত জানতেও পারতাম না, কলকাতা শহরে কত মধুমেহ রোগাক্রান্ত অসহায় মানুষের বাস। তাঁদের ইনসুলিন রাখা থাকে রেফ্রিজারেটরে। কারেন্ট না থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেই ইনসুলিন। বিপন্ন মানুষ রাস্তায় বসে পড়ছেন। কেউ মারণ ক্যানসারের রোগী। কারও হার্টের অসুখ। কত কত অসহায় বয়স্ক মানুষ!‌

বিদ্যুৎ ফিরে এলে তাঁরা কি সকলে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর তথা রাজ্য সরকারকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবেন?‌

সন্ধ্যা ৬.‌৩৪

রাজ্য সরকার এবং সিইএসসি–র মধ্যে ঝামেলাটা আরও পাকছে। আজ যেমন ফিরহাদ হাকিম সরাসরিই বলে দিলেন, মানুষের এই দুরবস্থার জন্য সিইএসসি–ই দায়ী!‌

আজ দুপুরে সিইএসসি মিডিয়া ডেকে দাবি করেছে, অধিকাংশ এলাকাতেই নাকি পরিষেবা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে!‌ ভিক্টোরিয়া হাউসের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি। কিছু জায়গায় এখনও পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারিনি। চেষ্টা করছি। আমরা আশাবাদী, মঙ্গলবারের মধ্যে অবস্থা পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে পারব।’

আর ফিরহাদ বলছেন, ‘কোথায় কোথায় গাছ পড়ে থাকার জন্য ওদের অসুবিধা হচ্ছে, সিইএসসি–র কাছে সেই তালিকা চেয়েছিলাম। আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি। আজ ওরা যেটা বলল, যে ওদের লোকের অভাব রয়েছে। সেটা হতে পারে। কিন্তু এই ব্যর্থতা তো সরকারের নয়। সরকার তো বিদ্যুতের টাকা নেয় না। টাকা যারা নেয়, দায়িত্ব তাদের। সমস্যা হয়েছে সিইএসসি–র জন্যই। কিন্তু তবুও তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’

কলকাতার পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে?‌

ফিরহাদ বলছেন, ‘এত গাছ পড়েছে। এগুলো কাটতে চার–পাঁচদিন সময় লাগবে। আমরা প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু একসঙ্গে ৫০ হাজার কর্মীকে এনে তো আর রেখে দেওয়া যায় না। নিশ্চিতভাবেই মানুষের অসুবিধা হচ্ছে। আমরা গাছ কাটতে বা সরাতে পারিনি, তা নয়। অনেক জায়গায় তো পাড়ার ছেলেরাই গাছ সরিয়েছে। এখন বড় রাস্তাগুলোয় গাড়ি চলছে। সেখানে আর কোনও অসুবিধা নেই।’

ফিরহাদকে আজ তুলনায় একটু কম্পোজড লাগল। মনে হল, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ খানিকটা ফিরে পেয়েছেন। কড়া প্রশ্নেও রাগলেন না। নার্ভ ধরে রাখলেন। এ–ও বললেন যে, ‘এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার বা মারপিট করার সময় নয়। মোদিসাহেব কি জানতেন করোনা হবে?‌ আমরাও কি জানতাম?‌ এটা একটা অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। সকলের সাহায্য চাইছি। এখন সকলে মিলে মানুষের সেবায় নামতে হবে।’

ফিরহাদের এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে আসাটা কলকাতাবাসীর পক্ষে যতটা না স্বস্তির, তার চেয়েও বেশি স্বস্তির শাসক তৃণমূলের কাছে। কিন্তু এই প্রত্যাবর্তনের রেসিপিটা কী?‌ কলকাতায় আর্মি নেমে পরিস্থিতি হাতে নিয়েছে বলে?‌ ‌নাকি আজ রমজান মাসের শেষে রাত পোহালে কাল ‘ঈদ–উল–ফিতর’ বলে?‌

সন্ধ্যা ৭.‌০০

আজ নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স একটা ইতিহাস গড়েছে।

আমেরিকায় এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ১ লক্ষের কাছাকাছি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আজ প্রথম পাতা জুড়ে তাঁদের ১,০০০ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে আমেরিকার একনম্বর কাগজ। হেডিং:‌ ‘ইউএস ডেথ্‌স নিয়ার ১০০,০০০, অ্যান ইনক্যালকুলেব্‌ল লস’। ছোট একটা ইন্ট্রো ‘দে ওয়্যার নট সিম্পলি নেম্‌স অন আ লিস্ট। দে ওয়্যার আস’। তারপর আরও একটা ছোট প্যারা। তাতে লেখা, সংখ্যা দিয়ে আমেরিকার উপর করোনার অভিঘাতটা বোঝানো যাবে না। জীবিত মানুষের জীবনও এখন সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে।

পুরো প্রথম পাতায় কোনও ছবি নেই। বিজ্ঞাপন নেই। ছ’টা কলাম জুড়ে শুধু গ্রে এরিয়া। কোনও প্যারাগ্রাফ নেই। অনেকটা ক্লাসিফায়েড অ্যাডের মতো লাগছে। যারা খবরের কাগজে কাজ করি, তারা জানি এটা করতে কী ভয়ানক সাহসের প্রয়োজন। পাশাপাশিই প্রয়োজন অরিজিনাল চিন্তা এবং আউট অফ দ্য বক্স ভাবনার।

আমার কাছে জার্নালিজম মানে অ্যালার্ট থাকা এবং ইমপ্যাক্ট তৈরি করা। নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স আজ গোটা আমেরিকা জুড়ে সেই ইমপ্যাক্ট তৈরি করেছে। ট্রাম্পের দেশ জুড়ে সাড়া পড়েছে এই পেজ ওয়ান নিয়ে। পড়বেই তো। এই না হলে খবরের কাগজ! এই না হলে অভিঘাত!‌

রাত ৮.‌২৭

কাল থেকে সারা দেশে ডোমেস্টিক ফ্লাইট চালু হচ্ছে। ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্ধ্রপ্রদেশ। মহারাষ্ট্র বলেছিল, তারা ৩০ তারিখের আগে মুম্বইয়ে বিমান ওঠানামা করতে দেবে না। আজ তারা বলেছে, কাল থেকে ২৫টা করে বিমান মুম্বইয়ে ওঠানামা করতে পারবে। বেঁকে বসেছিল তামিলনাড়ুও। তবে তাদের সম্পর্কে কিছু আজকের নির্দেশে জানানো হয়নি।

প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গ সরকার অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের কাছে চিঠি লিখে আবেদন জানিয়েছিল, ৩০ তারিখের আগে যেন কলকাতা থেকে এবং ২৮ তারিখের আগে যেন বাগডোগরা থেকে বিমান চালানো না হয়। কেন্দ্রীয় সরকার তার অর্ধেক মেনেছে। তারা বলছে, ২৮ তারিখ কলকাতা এবং বাগডোগরা থেকে বিমান চলবে। অণ্ডাল নামে আরও একটা বিমানবন্দর আছে রাজ্যে। সেটা নিয়ে খুব একটা কনসার্ন দেখা গেল না। তবে ম্যাপে আছে যখন তখন নিশ্চয়ই সেখানেও ২৮ তারিখ থেকেই সরকারিভাবে বিমান পরিষেবা চালু হবে।

রাত ১০.‌৫৭

দেখতে দেখতে দিনটা শেষ হয়ে গেল। তবু মুখের তিতকুটে ভাবটা যাচ্ছে না কিছুতে। কাল সকালে ঘুম ভাঙলে কি অন্যরকম মনে হবে?‌ নাকি এই নিম–বেগুনটা দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে?‌ এরপর কি আমি ক্রমশ খিটখিটে বুড়ো হয়ে যাব?‌ নাকি সূর্যের আলো থেকে লুকিয়ে ঘরের কোনে মুখ গুঁজে বসে থাকব?‌

আমার কি ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে?‌ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে?‌ দু’মাসের লকডাউন পারাবার পাল তুলে পেরিয়ে এসে কি শেষে বাকি সাতদিনের গোষ্পদে ডুবে মরব?‌

এটা কি ডিপ্রেশন?‌ ‌

জীবনটা কি ‌আবার কখনও নিউ ইয়র্ক টাইম্‌সের প্রথম পাতার মতো সাহসী এবং আলাদা হবে? কোনওদিন? ‌‌

লকডাউন ডায়েরি – ২৩ মে, ২০২০

২৩.‌০৫.‌২০২০। শনিবার

ভোর ৫.‌১৫

কাল রাতে কফি আর ডায়েট চিড়ে দিয়ে ডিনার করেছি। আর কিছু খেতে ভাল লাগছিল না।

রাতে একটা গানের ‘লুপ’–এ ছিলাম। জয়তী চক্রবর্তীর গাওয়া ‘শ্রাবণের ধারার মতো’। সন্ধ্যার পর অফিসে বসে কাজ করতে করতে হেডফোনে গান শুনছিলাম। এটা প্রায়শই করে থাকি। বহুদিনের অভ্যাস। খুব মন দিয়ে কাজ করলে কানে হেডফোন রাখা। টু শাট দ্য আউটসাইড নয়েজ কমপ্লিটলি। তখনই জয়তীর গানটা কানে চলে এল। আর এল তো এলই!‌ বারবার শুনতে লাগলাম। তারপর একটা প্যাড টেনে নিয়ে পুরো গানটা লিখে ফেললাম।

তখনই আবিষ্কার করলাম, গানের একটা লাইনে রবিঠাকুর ‘তৃষা’ শব্দটার পাশাপাশি ‘ভুখ’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। লিখেছেন ‘নিশিদিন এই জীবনের তৃষার পরে, ভুখের পরে।’ অর্থাৎ, ‘তৃষা’–র মতো একটা আপাদমস্তক তৎসম শব্দের পাশাপাশি ‘ভুখ’–এর মতো একটা অকুলীন শব্দ লিখেছেন। কারণ, তাঁকে ‘দুখ’–এর সঙ্গে ছন্দ মেলাতে হবে। ‘ভুখ’ শব্দটাই সেখানে যায়। ‘ক্ষুধা’ বা ‘খিদে’ যায় না। দেখে আশ্বস্ত হলাম। কারণ, আমি অন্ত্যমিলের জয়ে বিশ্বাস করি। আমি হলাম ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’–র আদি এবং অকৃত্রিম পাঠক।

এ তো গেল গানের শব্দ নিয়ে চিন্তা। বাড়ি ফেরার পর বসলাম বিভিন্ন মহিলা গায়কের গাওয়া ‘শ্রাবণের ধারার মতো’ নিয়ে তুলনা করতে। জয়তী, শ্রাবণী সেন এবং অরুন্ধতী হোম চৌধুরি। বারংবার শুনে নিশ্চিত হলাম, এই গানটায় জয়তীই সেরা। গানটা তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‌‘আলো’ ছবিতে গেয়েছিলেন অরুন্ধতী। খুব একটা ভাল লাগল না। শ্রাবণী ভাল গেয়েছেন। খুবই ভাল গেয়েছেন। বলিষ্ঠ উচ্চারণ। যেমন উনি গেয়ে থাকেন।

কিন্তু এই গানটায় সেরা জয়তীই। গলায় একটা সমর্পণ আছে। সেটা ভারী ভাল। ‘একেবারে’ শব্দটাকে জয়তী যেভাবে উচ্চারণ করেছেন সামান্য এলিয়ে, কেয়াবাত!‌ প্লাস অসাধারণ মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট। গানটা ব্যবহৃত হয়েছে ‘শ্রাবণের ধারা’ ছবিতে। দেখছি লেখা আছে মিউজিক আশু–অভিষেক। সেক্ষেত্রে অ্যারেঞ্জমেন্টটাও তাঁদেরই হবে। দারুণ ব্যবহার আছে ভায়োলিন আর বাঁশির। অবিরাম হন্ট করতে থাকে। জয়তীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু যা শুনছি, তাতে মনে হচ্ছে তিনিই এখন অন্যতম শ্রেষ্ঠ। রবি ঠাকুর ওঁর মঙ্গল করুন।

লকডাউন আর ঘূর্ণিঝড়ের এই বিপর্যস্ত সময়ে যখন দক্ষিণবঙ্গ ধ্বস্ত, কলকাতা শহরের বিস্তীর্ণ এলাকায় জল নেই, আলো নেই, তখন একটা গান নিয়ে এতক্ষণ মেতে রইলাম কেন। কারণ, আমি বহির্জগৎকে ডিনায়ালে রাখতে চাইছি।

সকাল ৬.‌১৩

একটু আগে হোয়াট্‌সঅ্যাপে একটা লেখা পেলাম। ফেসবুক থেকে সংগৃহীত। লিখেছেন পলাশ হক নামে একজন। যিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের ইঞ্জিনিয়ার বলে। লেখাটা পড়ে মনে হল, এটাও কোথাও একটা ডকুমেন্টেড থাকা উচিত। দিস ইজ দ্য আদার সাইড অফ দ্য স্টোরি।

পলাশ লিখছেন—

‘যে পোস্টে আর যে ক্যাপাসিটিতেই চাকরি করি না কেন, দিনের শেষে আমি একজন ইমার্জেন্সি এমপ্নয়ি। আমি বিদ্যুৎকর্মী। বিশ্বাস করুন, গত ৪৮ ঘন্টায় আমাদের দপ্তরের কেউ ঘুমোয়নি। আমাদের মোবাইল ভ্যান, রেস্টোরেশন টিম দিনরাত এক করে ফিল্ডে আছে।

‘প্লিজ বুঝুন, দুই ২৪ পরগনা ধ্বংসস্তূপ হয়ে গিয়েছে। ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ জেলা। প্রতি কিলোমিটারে গড়ে ৭টা করে গাছ পড়ে আছে। গুনে শেষ করা যাবে না, এত পরিমাণ ইলেকট্রিক পোল ভেঙে পড়ে আছে সর্বত্র। যেগুলো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোরও বিশাল অংশ ড্যামেজ্‌ড। অগুন্তি জায়গায় ট্রান্সফর্মারে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। এমতাবস্থায় যদি পাওয়ার চার্জ করা হয়, মুড়িমুড়কির মতো মানুষ মরে পড়ে থাকবে। জমা জলে, ছেঁড়া তারে যে পরিমাণ ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্সিডেন্ট হবে, তা ধারনার বাইরে। বাড়ি, ঘরদোর আর ইন্টারনাল অয়্যারিংসের যা ক্ষতি হয়েছে, বাদই দিলাম। এটা ইলেকট্রিক্যাল নেটওয়ার্ক। সাপের ছোবলের মতো ভয়ানক একটা ব্যাপার।

‘রাজ্য জুড়ে এই ভাস্ট ইলেকট্রিক্যাল নেটওয়ার্কটা যেভাবে লন্ডভন্ড হয়েছে, তা আগের জায়গায় রেস্টোর করতে গেলে যতদিন লাগা উচিত, আমরা সকলেই জানি, ততদিন আপনারা দেবেন না। জল, আলো, চার্জ, ইন্টারনেট না–থাকায় অনেকেই অস্থির হয়ে উঠেছেন। স্বাভাবিকও। কিন্তু বুঝুন, যারা কাজ করছে নাওয়াখাওয়া ভুলে, তারাও মানুষ। তাদেরও পরিবার আছে, সংসার আছে এবং লিখে রাখুন, এই রেস্টোরেশন প্রসেসে তাদেরও অনেকে প্রাণ হারাবে। সামান্য ভুলে পোলের মাথায় কাজ করতে করতে ঝরে পড়বে মৃতদেহ। এটা হয়। এটা হয়েই থাকে।

‘ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অফিসে চড়াও হওয়া শুরু হয়েছে। টেবিল–চেয়ার উল্টে মারধর করা হচ্ছে কারেন্ট নেই বলে। মার খাচ্ছে কর্মীরা। ঝড়ে আমার নিজের বাড়িতে এখনও চুরমার হয়ে থাকা কাচ পড়ে আছে সর্বত্র। জল নেই। সেসব অ্যাড্রেস করার সময়ও নেই। আমরা সহামুভূতি চাই না। শুধু এটুকু বুঝুন। সহযোগিতা করুন। পার্শিয়াল চার্জিং শুরু হয়েছে। যুদ্ধকালীন সার্কুলার হয়েছে। ড্রিঙ্কিং ওয়াটার সোর্স, ইরিগেশন সোর্স, হাসপাতাল এবং টেলিকম টাওয়ারের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে।

‘দু–তিনটে দিন একটু কষ্ট করে সহ্য করে নিন। অন্তত নিজেদের স্বার্থে। প্লিজ।

পলাশ ছাড়াও অনির্বাণ বলে সিইএসসি–র এক কর্মীর লেখাও ফেসবুকে শেয়ার করেছে অদিতি। সেটা আরও ডিস্টার্বিং। পড়ে মনে হল, সত্যিই তো। এঁরাও তো পেশাদারই। এঁরাও তো জানপ্রাণ দিয়ে খেটে শহরটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কষ্ট হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে। ঠিকই। কিন্তু এঁরা কেউ তো গিয়ে আমার–আপনার বাড়ির লাইনটা কেটে দিয়ে আসেননি। বরং জোড়ার চেষ্টা করছেন। এঁদের কাজটা তো এঁদের করতে দিতে হবে।

কিন্তু এসব ধর্মের কাহিনি এখন কে আর শুনতে যায়!‌

সকাল ৯.‌৩০

রাহুল গান্ধী কিন্তু এবার সিরিয়াসলি সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছেন! ‌হরিয়ানা থেকে আগত কিছু পরিযায়ী শ্রমিক, যাঁরা হাঁটতে হাঁটতে উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি যাচ্ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি। আজ সকাল ৯টা থেকে রাহুলের ইউটিউব চ্যানেলে সেটা সম্প্রচারিত হল।

রাস্তায় থেবড়ে বসে রাহুল যেভাবে শ্রমিকদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন, তাতে তাঁকে হুবহু অডিও ভিস্যুয়াল চ্যানেলের সাংবাদিক মনে হচ্ছিল। শ্রমিকরা লকডাউনে তাঁদের দুর্দশার কথা জানাচ্ছিলেন রাহুলকে। বিস্তারিত আলাপচারিতা। রাহুল প্রশ্ন করছিলেন, তাঁদের মাসিক রোজগার কত। এভাবে এত কম নোটিসে লকডাউন জারি করা উচিত ছিল কিনা। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের জন্য এ যাবত কী কী করেছে ইত্যাদি।

প্রশ্ন–টশ্ন করার ভঙ্গি একেবারে পেশাদার সাংবাদিকের মতো। তফাত হল, রাহুলকে ওই শ্রমিকদের প্রতিশ্রুতিও দিতে হল। বলতে হল, তিনি যা যা করণীয় করবেন। পেশাদার সাংবাদিকের সেই দায় নেই। পেশাদার সাংবাদিকের সেই দায় থাকে না।

সকাল ১০.‌০৪

ভোডাফোন তো কার্যত দেহ রেখেইছিল। এখন বিভিন্ন দিক থেকে শুনছি, এযারটেলও ঝোলাতে শুরু করেছে। অধিকাংশ গ্রাহক ভাবছএন, জিও–তে মুভ অন করে যাবেন। জিও–তে নাকি একেবারে ল্যান্ডলাইনের মতো পরিষ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানে ভোডাফোন বা এয়ারটেলে কথা বলতে গেলে মিনিটে দু–তিনবার কল ড্রপ করে যাচ্ছে। কারণ, জিও–র অপটিক্যাল ফাইবার গিয়েছে মাটির তলা দিয়ে। ঘূর্ণিঝড় সেখানে দাঁত ফোটাতে পারেনি। পারবে না।

বারবার একটা কথা মনে হয়। কোনও সভ্য এবং আধুনিক শহরের আকাশে কেন তারের জাল থাকবে। কেন সমস্তকিছুর সংযোগকারী তার এতটা এক্সপোজ্‌ড হয়ে থাকবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সেই তার ছিঁড়ে পড়লে গোলমাল তো হবেই। কিন্তু কলকাতার মতো শহরে তো আবার রাস্তা পুরো খুঁড়ে ফেলে ভূগর্ভস্থ কেব্‌ল বিছিয়ে দেওয়া যাবে না। জনতা অত কষ্ট নেবে না। সহ্যও করবে না।

ফলে এখন মাসুল গুনতে হবে। গুনতেই হবে।

বেলা ১১.‌৩৫

দিকে দিকে আবার পানীয় জল আর বিদ্যুতের দাবিতে পথ অবরোধ, বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। কোথাও কোথাও টানা ৭০ ঘন্টা কারেন্ট নেই। রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ মানুষ। পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। বিক্ষোভ হচ্ছে কলকাতায়। বিক্ষোভ হচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও। কোথাও জেনারেটর চালিয়ে ট্যাঙ্কে জল দেওয়ার জন্য ৫০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে। কোথাও লোকাল কোনও হাফ মিস্তিরিকে ধরে বাড়ির আলো–পাখা চালানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। আবার কোথাও এসইবি অথবা সিইএসসি–র লোকজন ফল্ট সারাতে গেলে ঠ্যাঙানি দেওয়া হচ্ছে।

আসলে আমরা কলকাতার বাসিন্দারা তো বটেই, প্রশাসনও ঘূর্ণিঝড়টাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিল বলে মনে হয় না। কারণ, আমরা সবসময় দেখে এসেছি ঝড়ঝাপ্টা যাই–ই হোক, সেটা কলকাতাকে সেভাবে স্পর্শ করে না। আমরা জানি, প্রথমে ওটা সুন্দরবনে হিট করবে। সেখানে কিছু নদীবাঁধ ভাঙবে। বাড়িঘর ভাঙবে। কিছু গ্রাম জলমগ্ন হবে। কিছু প্রাণহানি হবে। তারপর ঝড়টা বাংলাদেশে চলে যাবে।

স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম কলকাতা এত ধ্বংস দেখেছে। এই প্রথম কলকাতাবাসী বুঝতে পেরেছে প্রকৃতির রোষ কাকে বলে!‌ এই প্রথম ধ্বংসের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে আমার–আপনার শহর। এবার আমাদের গায়ে লাগছে।

মুখ্যমন্ত্রী আজ গিয়েছেন আকাশপথে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখতে। তারপর কাকদ্বীপে প্রশাসনিক বৈঠক। দেখছি, সেখানে তিনি বলেছেন, সিইএসসি একটি বেসরকারি সংস্থা। তারা বাম আমল থেকে কলকাতা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে। ফলে এই সরকারের তাদের কিছু বলার নেই। পাশাপাশিই মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, প্রয়োজন হলে দেড়শো জেনারেটর ভাড়া করে সিইএসসি কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করুন। আর বলেছেন, তিনি এবং কলকাতা পুরসভার প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম গত তিন–চারদিন ঘুমোননি।

দুপুর ১২.‌১৩

নেটওয়ার্কের খানিকটা উন্নতি হয়েছে দেখছি। কাল রাতেও মোবাইল হাতে করে ঘরের বিভিন্ন জায়গায় নেটওয়ার্ক খুঁজতে হয়েছে। অথবা বিছানায় শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে একটা পায়ের উপর বিশেষ অ্যাঙ্গলে মোবাইল তুলে ধরে রাখতে হয়েছে। বিভিন্ন কারণে গত কয়েকদিন ধরে ওয়ার্কআউট করা হচ্ছে না। কিন্তু মোবাইলের সিগনাল খুঁজতে গিয়ে যেভাবে দেহ বিভিন্নভাবে বাঁকাতে–চোরাতে হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে শারীরিক কসরত এমনিতেই হয়ে গিয়েছে।

দুপুর ১.‌১০

কলকাতা পুরসভার কমিশনার খলিল আহমেদকে সরিয়ে দেওয়া হল।

গত কয়েকদিন ধরেই ফিরহাদকে একটু অসহিষ্ণু এবং ক্রুদ্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে, চাপটা নিতে পারছেন না। চাপ আছে ঠিকই। গভীর চাপ। একদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড়। ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। কিন্তু বড় প্লেয়ারদের তো বড় চাপ সামলাতে হবেই। গতকাল যেভাবে ফিরহাদ বলে বসলেন, তাঁরা হাতে যাদুদণ্ড নেই, সেটা দেখে মনে হল নার্ভ ধরে রাখতে পারছেন না। তাতে এই শহরের মানুষ তাঁর উপর আরও কুপিত হতে পারেন।

বস্তুত, আজও ফিরহাদ বলেছেন, ‘সাতদিনের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’ পরিস্থিতির সাপেক্ষে এটা সত্যবচন হতে পারে। কিন্তু এখন সে কথা বলার সময় নয়। এখন আগে মানুষকে কনফিডেন্সে নিতে হবে।

কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট বলে, আগে সমস্যাটাকে অ্যাকনলেজ করতে হবে। অ্যাকনলেজ করা মানে কিন্তু অ্যাপোলোজাইজ করা নয়। ক্ষমাপ্রার্থনা নয়। সমস্যা যে আছে, প্রথমেই সেটা স্বীকার করে নেওয়া। মানুষ সেটাই চায়। চায় যে তার সমস্যার কথাটা স্বীকার করা হোক। মানুষ সেই মনোযোগটুকু দাবি করে। তার বদলে যদি বলা হয়, আমি কী করব?‌ বা আমার হাতে তো ম্যাজিক স্টিক নেই!‌ তাহলে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পায়। অতএব প্রথমে বলতে হবে, আই অ্যাম সরি ফর ইয়োর পেইন। আই অ্যাম সরি ফর ইয়োর প্রবলেম। অর্থাৎ, আপনার সমস্যা হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। আপনার যন্ত্রণার জন্য আমি দুঃখিত।

ব্র্যাকেটে, আমার কিন্তু কোনও দোষ নেই। তবে সহানুভূতি আছে।

সেখানে কারও কাছে নতিস্বীকার করার গল্প থাকে না। কিন্তু গোলমালটা অর্ধেকেরও বেশি কমে যায়। সমস্যায় পড়লে মানুষের ধৈর্যচ্যুতি হবেই। তাঁদের সামলাতে হলে আগে তাঁদের কনফিডেন্সে নিতে হবে। নার্ভ হারিয়ে ঝামেলা আরও বাড়িয়ে দিলে মুশকিল।

দুপুর ২.‌১০

দিলীপ ঘোষ এবং বিজেপি কর্মীদের সঙ্গে বৈষ্ণবঘাটার অদূরে ঢালাই ব্রিজে বচসা এবং হাতাহাতি তৃণমূল কর্মীদের। দিলীপের বক্তব্য, তিনি ত্রাণ দিতে যাচ্ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। পুলিশ তাঁকে আটকে দিয়েছে। খবর পেয়ে আসেন বিজেপি কর্মীরা। তাঁদের সঙ্গে তৃণমূলের কর্মীদের হাতাহাতি হয়। দিলীপের বক্তব্য, তাঁর দলের এক কর্মীর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঢালাই ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দিলীপ বলছেন, ‘এই রাজনীতিই যদি করতে হয়, তাহলে আমিও তৈরি আছি!‌ এবার কিন্তু লাশ গুনতে হবে!‌’

দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, দিলীপকে রাস্তায় এভাবে আটকে কেন ফুটেজ খাওয়ার সুযোগ করে দেয় তৃণমূল?‌ তিনি যদি বিনাবাধায় যেখানে যাওয়ার যেতেন এবং ত্রাণ দিয়ে ভালয় ভালয় ফিরে আসতেন, তাহলে কি এই ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ হতো?‌ অথবা দিলীপও কি পাল্টা হুঁশিয়ারি দেওয়ার সুযোগ পেতেন?‌ দিলীপকে আটকে দিয়ে আসলে তাঁকে প্রাসঙ্গিক হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে না তো তৃণমূল?‌

দুপুর ৩.‌১৫

বিজেপি নেতা রাহুল সিন্‌হা সাংবাদিক বৈঠক করে দাবি করছেন, কলকাতায় সেনা নামানো হোক। পাশাপাশিই, পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাল সমস্ত রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বৈঠক করুক প্রশাসন।

এই নজিরবিহীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে সেনা এখনও কেন নামানো হচ্ছে না, সেটা সত্যিই বোঝা যাচ্ছে না। ফৌজের কাছে অনেক উন্নত ইকুইপমেন্ট আছে। ফোর্স আছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা মেনে অধিকাংশ সরকারি দফতরে কর্মীরা আসতে পারছেন না। কিন্তু সেনাবাহিনীর তো ওসব বালাই নেই। তাদের কোনও পিছুটানও নেই। তারা আগুপিছু দেখে না। স্রেফ অন্ধের মতো তীব্র একমুখিতা নিয়ে কাজটা করে দেয়।

বিকেল ৪.‌০০

অবশেষে সেনাবাহিনীকে ডাকল রাজ্য সরকার। এইমাত্র রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর টুইট করে জানিয়েছে।

টুইটে বলা হয়েছে, রেল, বন্দর এবং অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে কর্মী এবং ইকুইপমেন্ট চাওয়া হয়েছে। ঠিক হয়েছে, জরুরি পরিষেবা যথাসম্ভব দ্রুত চালু করার জন্য যৌথ কমান্ডে কাজ করা হবে। জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন রাস্তার গাছ কাটা এবং সরানো শুরু হবে। পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে রাজ্য জনস্বাস্ত্য কারিগরি দফতরকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় জলের পাউচ বিলি করতে। জেনারেটরও ভাড়া করা হচ্ছে অথবা অন্যান্য সংগঠনের কাছ থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে।

বিকেল ৫.‌০৫

কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ধরেছে টিভি। গোলপার্কের বহুতলে দশতলার ছাদে দাঁড়িয়ে তিনি বলছেন, ‘আমি ঘোলা জলে মাছ ধতে নামিনি। কিন্তু কলকাতার এই অবস্থা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। সাতদিন ধরে আমফানের সতর্কবার্তা ছিল। তা সত্ত্বেও এই অবস্থা হল। তাহলে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও একটা গাফিলতি থেকে গিয়েছে। কোথাও না কোথাও ব্যর্থতা ছিল পুরসভার। ওরা হয়তো বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি।’

এখানে একটা ফুটনোট আছে—‌ শোভন কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই ফ্রেমের একপ্রান্তে দেখা গেল বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তারপর যতক্ষণ শোভন কথা বললেন, ততক্ষণই কখনও না কখনও ফ্রেমের কোনও না কোনও প্রান্তে দেখা গেল বৈশাখীকে।

সন্ধ্যা ৬.‌০০

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী। এবং তিনি যথেষ্ট বিরক্ত। যাঁকে কোনও একটা প্রশ্নের জবাবে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আমি কী করব? ‌হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে পারি। নইলে আমার মুন্ডুটা কেটে নিন!‌’

আরও বলছেন, ‘প্রেসের কাছে কি এইটুকু দায়বদ্ধতা আশা করতে পারি না, যে আপনারা সরকারের পাশে দাঁড়াবেন?‌ কিছু কিছু সাংবাদিক আছেন, পার্টি মাইন্ডেড। তাঁরা এগুলো করবেন না!‌’

মানুষের কাছে ধৈর্য ধরার আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, সিইএসসি–র কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সঙ্গে তিনি একাধিকবার কথা বলেছেন। সঞ্জীবের সঙ্গে কথা বলেছেন মুখ্যসচিবও। পাশাপাশিই মুখ্যমন্ত্রী জানাচ্ছেন, রেলকে রাজ্য সরকার অনুরোধ করেছে ২৬ তারিখ পর্যন্ত বিশেষ ট্রেন না চালাতে। কারণ, স্টেশন থেকে লোকজন নিয়ে বাসগুলো গ্রামে ঢুকতে পারবে না। ঝড়ের প্রকোপে সমস্ত রাস্তা ভেঙে গিয়েছে। সেগুলো সারানোর জন্য দু’দিন সময় চাওয়া হয়েছে রেলের কাছে। যা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘তার পরে যাঁরা আসবেন, তাঁদের বাড়িতেই ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। এখন তো শুনছি, ২৫ তারিখ থেকে ডোমেস্টিক ফ্লাইট চালু হবে। আমি চিফ সেক্রেটারিকে বলছি, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানাতে, যাতে এই রাজ্যে ২৫ নয়, ৩০ তারিখ থেকে প্লেন চালানো হয়।’

সন্ধ্যা ৬.‌৩৭

বিদ্যুতের দাবিতে বিজন সেতুতে অবরোধ স্থানীয় মানুষের। কসবাতেও অবরোধ। অন্যদিকে, সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনীকে দেখা যাচ্ছে। তারা ইলেকট্রিক করাত এবং ইউসিবি নিয়ে নেমে পড়েছে গাছ কাটতে। কলকাতায় পরিস্থিতি মোকাবিলায় মোট পাঁচ কলাম সেনা আসছে রাজ্য সরকারের অনুরোধে।তিন কলাম থাকবে শহরে। বাকি দু’কলাম যাবে গ্রামে।

কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা রাজ্যের বর্তমান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলছেন, তাঁরা এখন ক্লান্ত ঘোড়া। তাঁদের চাবুক মারলে হবে না। পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু সময় লাগবে। আরও বলছেন, ‘সাতদিন আগে থেকে পূর্বাভাস ছিল। ফলে পুরো তৈরি হতে সময় পাওয়া গিয়েছিল।’ কিন্তু তার সঙ্গে যেটা বলছেন, সেটা বড় পলিটিশিয়ানের হলমার্ক— ‘মানুষের ক্ষোভ স্বাভাবিক।’

অর্থাৎ, কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্টে মানুষের সমস্যাকে আগে গুরুত্ব দেওয়া।

রাত ৮.‌২৮

সিইএসসি–র সদর দফতর ভিক্টোরিয়া হাউসে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং!‌ সঙ্গে ছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা। তবে সেখানে তিনি বেশিক্ষণ থাকেননি। কিছুক্ষণ থেকে সঞ্জীবের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে বেরিয়ে যান। ঘটনাচক্রে, তার কিছুক্ষণ আগে সিইএসসি–র তরফে সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পরিস্থিতির উন্নতি কবে হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

এর আগে কোনও মুখ্যমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া হাউসে গিয়েছেন বলে মনে করতে পারছি না। যে নজিরবিহীন ঘটনা থেকে স্পষ্ট— বিদ্যুৎহীনতার সমস্যাটা যথেষ্ট ঘোরাল জায়গায় পৌঁছেছে। নইলে মুখ্যমন্ত্রী সিইএসসি–র সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে যেতেন না।

রাত ৮.‌৪৬

আবার বিক্ষোভ বেহালায়। রাস্তায় নেমে এসেছেন সাধারণ মানুষ। বলছেন, নিজেদের পকেট থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করে রাস্তা থেকে গাছ সরিয়েছেন। তারপরেও সিইএসসি আসেনি ফল্ট মেরামত করতে। বিক্ষোভ রাজারহাটে। সেখানে পুলিশকে ঘিরে ধরে তুমুল কটূক্তি চলছে। যা খানিকক্ষণ পরে হেনস্থায় পরিণত হলে খুব এঅবাক হব না।

রাত ১০.‌৪২

দিনের কাজ শেষ। বাড়ি ফিরব এবার। জানি, ফেরার পর যৎসামান্য খাবার খেতে খেতে এবং খাবার খেয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়তে পড়তে টানা তিনদিন পানীয় জল ও বিদ্যুৎ না পেয়ে ক্রুদ্ধ কলকাতার বাসিন্দাদের কথা মনে পড়বে। মনে পড়বে সেই সহ–নাগরিকদের কথা, যাঁরা বাড়িতে মোমবাতি জ্বেলে বসে আছেন ভুতুড়ে অন্ধকারে। বা রাস্তায় নেমে এসেছেন। বিদ্যুতের অভাবে যাঁদের বাড়ির রেফ্রিজারেটর চলছে না। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীবনদায়ী ওষুধ।

মনে পড়বে সুন্দরবনের ধুয়ে–যাওয়া বাঁধের উপর ত্রাণের আশায় হন্যে চেহারাগুলো। মনে পড়বে এলাকার মহিলাদের হাতে হাতে বাঁধ তৈরির ছবি।

খারাপ লাগবে। কিন্তু সেটারও উপায় আছে। ওই মুখগুলোকে পুরোপুরি ডিনায়ালে রাখতে হবে।

আজ রাতে বরং দেশভক্তির গান শুনি?‌

লকডাউন ডায়েরি – ২২ মে, ২০২০

২২.‌‌০৫.‌২০২০। শুক্রবার

সকাল ৮.‌৩৫

কাল অনেক রাতে আকাশে প্লেন ওড়ার আওয়াজ পেয়েছিলাম। মনে হল , আমপানের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে প্রধানমন্ত্রী রাতেই চলে এলেন নাকি?‌ তারপর মনে হল, সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবাহিনী এসেছে। যারা ভিভিআইপি মুভমেন্টের আগে আসে ‘অ্যাডভান্স পার্টি’ হিসেবে। যেমন বাঘের আগে ফেউ।

আবার ফটফটে রোদ্দুর উঠেছে। গরমে দফারফা। কে বলবে, ৪৮ ঘন্টা আগে আকাশের রংটাই অন্যরকম ছিল। কাল অনেক রাতে ঘুমিয়েছি। তাই আজ উঠতে একটু দেরিই হয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে বাবা–মা’কে চা দিলাম। গোটা বাড়িতে ঝরাপাতা পড়ে আছে। হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। মনে হচ্ছে, যথাসম্ভব দ্রুত ঘরগুলো পরিষ্কার করতে হবে। শরীর খিতখিত করছে দেখে। বারান্দায় শুকনো পাতার স্তূপ। দোতলার ড্রয়িংরুমের দরজা বন্ধ থাকলেও যে কী করে এত শুকনো পাতা ভিতরে ঢুকে পড়ল কে জানে!‌

এখনও টিভি ডাউন। তবে নেট একটু একটু কাজ করছে। পুরোপুরি নয়। ভোডাফোন কাজ করছে নিজের ইচ্ছেমতো। যখন ইচ্ছে, থাকছে। যখন ইচ্ছে, যাচ্ছে। কাল রাত পর্যন্তও মোবাইলটা পেপারওয়েটের মতো ছিল। মানে, কাগজ চাপা দিয়ে রাখা ছাড়া যার আর কোনও ইউটিলিটি নেই। এখন অতটা খারাপ অবস্থা নয়। নেট একটু একটু ফিরে আসার পর চারদিক থেকে যা খবর পাচ্ছি, তাতে ঘূর্ণিঝড়ের পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। কলকাতা–সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। পানীয় জল নেই। চারদিকে হাহাকার। তবু রক্ষে, সল্টলেকে বিদ্যুৎ আছে। জলও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তা–ও কোথায় একটা বিরক্তি লাগছে।

করোনার সঙ্গে যুদ্ধে লকডাউন জীবনধারনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোর খামতি ছিল না। বাড়িতে থাকলেও শান্তিতে থাকা যাচ্ছিল। ঘূর্ণিঝড় সেই প্রশান্তি একটানে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। বাড়ির মানুষগুলো এখন রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন। কে জানে কপালে আরও কত ভোগান্তি আছে।

সকাল ৯.‌১৭

যা ভেবেছিলাম!‌ রাজ্যপাল ঠিক উঠে পড়ছেন প্রধানমন্ত্রীর হেলিকপ্টারে। নিজেই আবার সেটা টুইট করে জানিয়ে দিয়েছেন সকাল সকাল। গত তিন দশকের পেশাগত জীবনে বহু সেল্‌ফ প্রমোটার দেখেছি। আমাদের প্রফেশনেও কিছু এমন জিনিয়াস আছেন, যাঁরা নিজেদের প্রমোশনকে শিল্পের পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান রাজ্যপালের কাছে এঁরা সকলে দুগ্ধপোষ্য শিশু। বস্তুত, চাইলে রাজভবনে গিয়ে সাতদিনের ক্র্যাশ কোর্সও করে আসতে পারেন।

এনিওয়ে, যা শুনছি, রাজ্যপাল প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একই কপ্টারে থাকবেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যে রাজ্যপালের বাক্যালাপ হবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। কৌতূহল হচ্ছে কপ্টারের ভিতরে সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট নিয়ে। জনশ্রুতি অথবা রাজভবনের দাবি:‌ প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকেই নাকি রাজ্যপালকে একই কপ্টারে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। হতে পারে।

দু’টি কপ্টার যাচ্ছে দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে। একটিতে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল। দ্বিতীয়টিতে রাজ্য থেকে দুই হাফ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এবং দেবশ্রী চৌধুরী।


আকাশ থেকে পরিস্থিতি দেখাটা যুগে যুগে, কালে কালে হয়ে আসছে। কিন্তু বরাবরই ব্যাপারটা একেবারে প্রতীকী বলে মনে হয়। যা চরাচরে এই বার্তা প্রেরণ করে যে, ঘটনাটা বড়। এবং এই বড় বিপর্যয়ে আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। সিদ্ধান্ত মোটামুটি আগেই নেওয়া থাকে। এবার সেটা ঘোষণা করার আগে তার উপর একটু সরেজমিনে সফরের পোঁচ বুলিয়ে নেওয়া।

ঘটনাচক্রে, এমন কিছু আকাশ–সফরে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রতিবারই দেখেছি, ভিভিআইপি কোলে ম্যাপ নিয়ে তার সঙ্গে মিলিয়ে নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ে দেখছেন। কারণ, এসব ক্ষেত্রে নীচে অগাধ জলরাশি থেকে কোথাও কোথাও জেগে–থাকা উঁচু বাড়ির মাথা বা বাঁধের উপর আশ্রয় নেওয়া দুর্গত মানুষ ছাড়া সচরাচর কিছু দেখা যায় না। মানুষগুলো ভাবেন, আকাশপথে ত্রাণ আসছে। হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। বাচ্চা থেকে বুড়োর মেলে–ধরা প্রত্যাশী কান তাড়া করে ফেরে আকাশযানের রোটর ব্লেডের কানফাটানো শব্দ। তাঁরা জানেন না, ভিভিআইপি কপ্টারে ত্রাণ আসে না। ওই কপ্টারের পেটে ভিভিআইপি–র সঙ্গী মন্ত্রী–অমাত্যরা তাঁকে বোঝাতে থাকেন, কোন এলাকায় কী হয়েছে। ত্রাণ ও পুনর্গঠনে কী বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। মোদ্দা কথায়— ভিভিআইপি–কে কনভিন্স করা।

প্রধানমন্ত্রীর এই সফরও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।

সকাল ১০.‌০০

গাড়িটা এখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। স্টার্ট করলেই ফটফট ফটফট করে একটা আওয়াজ হচ্ছে ক্রমাগত। শস্তার জেনারেটরে যেমন হয়। প্রকৃতিগতভাবে আমি বর্ডারলাইন ওসি। অর্থাৎ, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। একটু ধাক্কা দিলেই চৌকাঠ পেরিয়ে রোগটার ভিতরে ঢুকে পড়ব। ফলে গাড়িতে এই আওয়াজ প্রাণে সইছে না।

প্রমোদকে ফোন করলাম। বলল, ‘চলে আসুন ১১টার সময়। দেখে দিচ্ছি।’ এটা একটা বাড়তি কাজ যোগ হল আজকের মেনুতে। এবং এমন একটা কাজ, যা কতক্ষণ খেয়ে নেবে কেউ জানে না। মনে হচ্ছে না, বাবা–মা’কে ঠিক সময়ে আজ দুপুরের খাবারটা দিতে পারব।

সকাল ১০.‌৩৫

লকডাউনের জেরে শূন্যেরও নীচে নামবে দেশের জিডিপি। সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়ে দিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস।

দুপুর ১.‌৪৫

এই বাড়ি ফিরলাম। এবং হুটোপুটি করে বাবা–মা’কে খেতে দিলাম। তারপর বাড়ির দুটো তলা ঝেঁটিয়ে সাফও করলাম। এরপর ডায়েরিতে এন্ট্রি করে, স্নান করে, নাকেমুখে দুটো গুঁজে অফিসে যেতে একটু দেরিই হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। যাকগে যাক। আমি এমনিতে খুবই ওবিডিয়েন্ট চাকর। মাঝেমধ্যে এক–দু’দিন দেরি হয়ে গেলে নিশ্চয়ই ক্ষমা পাব। এই চাকরবৃত্তি নিয়েও আমার একটা থিওরি আছে। সেটাও এই ডায়েরিতে লেখা থাকা দরকার।

এনিওয়ে, গত কয়েকঘন্টার ‘ইন্ট্রো’ হল গাড়ির সমস্যা মেটানো যায়নি। মেটাতে পারেনি প্রমোদ। ঠিক ১১টায় হাজির হয়েছিলাম নয়াপট্টির গ্যারাজে। সমস্যা শুনে এবং গাড়িটা একচক্কর চালিয়ে প্রমোদকে খুবই নিশ্চিন্ত মনে হল। অতঃপর বনেট খুলে খুটখাট শুরু হল। আমি রাস্তার পাশের একটা রোয়াকে গাছের ছায়ায় বসলাম। এবং পরের দেড়ঘন্টা কখনও বসলাম। কখনও দাঁড়ালাম। বসে বসেই দেখলাম, আকাশে পর পর দুটো এমআই–৬ হেলিকপ্টার উড়ে গেল। সেই দু’টি ঘটনাবহুল হেলিকপ্টার।

গাড়ির পুরনো মবিল বদলে নতুন মবিল ঢালা হল। চারটে স্পার্ক প্লাগ বদলানো হল। কার্বুরেটর খুলে সাফসুতরো করা হল। সেখান থেকেও কিছু সল্টলেকের বালিমিশ্রিত জল বেরোল। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না। মহার্ঘ গাড়ি থেকে শস্তার জেনারেটরের আওয়াজ বেরোতেই লাগল।

অবস্থা দেখে পাশের গ্যারাজের একজন বড় এবং একজন মেজো মিস্ত্রি এলেন। তাঁরা দেখেশুনে রায় দিলেন, ইঞ্জিনের নীচে দু’নম্বর ভাল্‌ভটা বসে গিয়েছে। তাই ওই আওয়াজটা হচ্ছে। আপাতত এই অবস্থাতেই চালাতে হবে। তবে খুব জোরে চালানো যাবে না। ওইভাবে চালাতে চালাতে কপাল ভাল থাকলে ভাল্‌ভ আবার সিধে হয়ে যেতে পারে। নইলে হাফ ইঞ্জিন ডাউন করতে হবে। সে দিনসাতেকের ধাক্কা। কিন্তু গাড়ি ছাড়া তো আমার জীবন অচল। প্রমোদ বলল, ‘লকডাউন উঠলে কোম্পানির ওয়ার্কশপে দিতে পারেন। আমাদের কাছেও দিতে পারেন। যেটা আপনি ভাল বোঝেন। কিন্তু যেখানেই দিন, খর্চা আছে।’

তা আর নেই?‌ কোমরজলে গাড়ি নামিয়ে বিরল প্রজাতির গাধামি করেছি। মাসুল তো দিতেই হবে।

প্রমোদকে বললাম, কত দেব?‌

ছাব্বিশ বছরের সদ্যবিবাহিত যুবক ব্যাজার মুখে বলল, ‘কাজটাই তো হল না স্যর। কী আর টাকা দেবেন?‌ এত খাটাখাটি করলাম। এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করলাম। কাজটা হয়ে গেলে ৪০০/‌৫০০ টাকা যা দিতেন খুশি হয়ে দিতেন। কিন্তু কাজটা তো করে দিতে পারলাম না। কী করে টাকা নেব বলুন?‌’ শুনে অবাক লাগছিল। সারাতে না পারুক, দেড়টি ঘন্টা তো এই গরমে ঘাম ঝরিয়েছে। একবার মনে হল, জোর করে দিয়েই দিই কিছু টাকা। তারপর মনে হল, ওটা সম্ভবত ওর আত্মসম্মানকে আহত করবে।

গাড়ি ঘুরিয়ে চললাম উল্টোডাঙায়। মায়ের পেনশনটা যদি তোলা যায়। ঘূর্ণিঝড় আর কোভিডের জোড়াফলায় বিধ্বস্ত শহর। এখনই সুযোগন্ধানী স্ট্রাইকারের মতো ছোঁ মেরে গোলটা করে নিতে হবে। নিলামও। ব্যাঙ্ক প্রায় খালি। ভিতরে এবং বাইরে। সামাজিক দূরত্ব মেনটেন করে মিনিট পঁচিশের মধ্যে টাকা তুলে ফেললাম। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হল, একজন ব্যাপক লোককে চিনলাম।

মুখে মাস্ক। হাতে পার্পল রংয়ের সার্জিক্যাল গ্লাভস। পরনে জিন্‌সের ট্রাউজার্স আর ফুলস্লিভ চেক শার্ট। দাপিয়ে রেখেছেন গোটা ব্যাঙ্ক। মাস্ক না পরে এলে কাউকে ঢুকতেও দিচ্ছেন না। চড়াগলায় হাঁক পেড়ে নির্দেশ দিচ্ছেন সহকর্মী এবং কাস্টমারদের। প্রান্তিক পরিবার থেকে–আসা, টিপসই দিয়ে টাকা–তোলা গ্রাহকদের বকাবকি করছেন। কিন্তু আবার নিজ দায়িত্বে সহায়তাও করছেন। একজন যেমন একটু উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন। ঝড়ে ঘর ভেঙে গিয়েছে। মিস্ত্রি লাগিয়ে এসেছেন। ১৫ হাজার টাকা তুলবেন। কিন্তু ১০ হাজারের বেশি তুলতে অন্তত চারজন সাক্ষী চাই। এই বাজারে সাক্ষী কোথায় পাবেন?‌ মহিলা চিল চিৎকার জুড়েছেন।

ভদ্রলোক এগোলেন। আঙুল তুলে বললেন, ‘আর একবার চেঁচালে একটা টাকাও দেব না!‌ সকলেই সমস্যায় আছে। আপনার ঘর ভেঙেছে। আর আমার বাড়িতে গত দু’দিন কারেন্ট নেই। তা–ও রোজ ব্রাঞ্চে আসছি। একদম চুপ করে থাকুন!‌’ তারপর তিন সহকর্মীকে ডেকে বললেন, ‘সই করুন।’ চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে নিজে উইথড্রয়াল স্লিপে সই করে দিলেন। এক প্রবীণা বারবার মাস্ক খুলে ফেলছেন। তাঁকে সটান বললেন, ‘মাস্ক না পরলে ভিতরে ঢুকতেই দেব না। আপনি আমার মায়ের বয়সী। আপনার ভালর জন্যই মাস্কটা পরতে হবে। আগে পরুন। তারপর ভিতরে ঢুকতে দেব।’

মৃদু ঝাড় খেলাম আমিও। কারণ, দয়াপরবশ হয়ে সেই মাস্ক–হীন নিরক্ষর প্রবীণার টাকা তোলার স্লিপটা লিখে দিয়েছিলাম। দূর থেকে দেখেই উঁচুগলায় ব্যাঙ্ক অফিসার বললেন, ‘উনি মাস্ক পরেননি দেখতে পাচ্ছেন না?‌ আপনি কেন ওঁর স্লিপ লিখে দিচ্ছেন?‌’ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কলম সরালাম। মহিলা আমতা আমতা করে বললেন, ‘আসলে একটু জল খাচ্ছিলাম। তাই খুলেছি।’ অফিসার আরও কড়া, ‘জলটা পাঁচমিনিট পরে খাওয়া যায় না?‌’

ব্যাপক লাগল ভদ্রলোককে। দূর থেকে গলা তুলে বলেই ফেললাম, আপনাকে কিন্তু আমার ব্যাপক লাগছে। যেভাবে আপনি শো–টা চালাচ্ছেন, হ্যাট্‌স অফ। কোনও জবাব এল না। টাকা তুলে বেরোনর সময় হাতছানি দিয়ে ডাকলাম। উনি কাউন্টারের সামনে এলেন। মাস্কের উপর দু’চোখে প্রশ্ন।

আপনার নাম কী?‌

— রায়চৌধুরি। আপনার?‌

অনিন্দ্য। আপনি কী রায়চৌধুরি?‌

— এ। এ রায়চৌধুরি। আপনি কী অনিন্দ্য?‌

জানা। অনিন্দ্য জানা। আর আপনার ‘এ’ ফর?‌

— ওটাই থাকুক। এ রায়চৌধুরি একটাই আছে।

হাত তুলে নমস্কার করলাম। রায়চৌধুরিও প্রতি নমস্কার করলেন। বেরোতে বেরোতে ভাবছিলাম, সরকারি ব্যাঙ্কেও এমন অফিসার থাকেন?‌ যিনি সন্দিগ্ধু হন। যাতে সকলে ঠিকঠাক নথিপত্র জমা দিয়ে কাজটা করেন। আবার অভিভাবকের মতো গাইডও করেন। ঠিকই, এ রায়চৌধুরি একটাই আছে। এই রায়চৌধুরি একটাই হয়।

দুপুর ২.‌৫৮

অফিসে যাওয়ার আগে চাকরামির থিওরিটা লিখে ফেলি। পরে যদি ভুলে যাই?‌

আমরা সকলেই বাবুর বাড়ির বাসন মাজার ঝি। কেউ কাচের বাসন প্রিল বা ভিম দিয়ে মাজি। আবার কেউ এনামেলের বাসন ছাই দিয়ে মাজি। যাকে বাবু যেমন অর্ডার দেন। কাউকে ভরসা করে কাচের বাসন দেন। কাউকে অতটা বিশ্বাস করেন না বলে এনামেলের বাসন। কিন্তু দিনের শেষে বাসন মাজতেই হবে। দিনের শেষে সকলেই বাবুর বাড়ির বাসন মাজার চাকর। অথবা ঝি।

আনন্দবাজারের লিফ্‌টের সামনে দাঁড়িয়ে এক কর্তৃপক্ষ স্থানীয়কে এই থিওরিটা দিয়েছিলাম। উনি হাঁ করে শুনেছিলেন। কী ভেবেছিলেন জানি না। কিন্তু আমি উইথ অল সিরিয়াসনেস বলেছিলাম। আরেকবার অভীকবাবুকে বলেছিলাম, সমস্ত ব্যাপারে আপনাকে মাথা ঘামাতে হলে আপনি আর আমাদের মতো চাকরবাকরদের মাইনে দিয়ে রেখেছেন কেন?‌ রেখেছেন এই কারণেই, যাতে আমরা শো–টা সামলাতে পারি আর আপনি নিশ্চিন্তে গল্‌ফ খেলে বেড়াতে পারেন।

স্নেহপরায়ণ মেন্টর মৃদু হেসেছিলেন। স্পোর্টিং ছিলেন তো। তর্ক করা যেত। আলফাল বলা যেত। কোনও জাজমেন্টে ওঁর ভুল হলে নির্দ্বিধায় স্বীকার করতেন। কারণ, উনি কখনও কাউকে বেতনভুক চাকর ভাবতেন না। ‘সহকর্মী’ ভাবতেন। কন্যার বিবাহে আমন্ত্রণ করেছেন। গিয়ে গুটিসুটি হয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে আছি। বাবুর বাড়ির কীর্তনে ঝি–চাকররা যেমন কুণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন। কন্যা এবং জামাতার সঙ্গে ভদ্রতাসূচক আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দিস ইজ অনিন্দ্য। মাই কলিগ।’ মুহূর্তে সমস্ত সঙ্কোচ আর জড়তা ঝরে গেল।

রিপোর্টারদের মিটিংয়ে হাসতে হাসতে প্রকাশ্যেই একবার বলেছিলেন, ‘রোজ সকালে উঠে অনিন্দ্যকে গাল না দিলে তো আমার ভাত হজম হয় না!‌’ সেই বৈঠকে হাজির একাধিক শকুন দৃশ্যতই খুশি হয়েছিল। বাহ্‌, মালটা তাহলে রোজ ঝাড় খায়!‌ শুধু আমি ভিতরে ভিতরে জানতাম, ওটা পিতৃস্নেহ। তিনি যে পেশাগত জীবনে আমার পিতার আসনে, সেটা ওই ধুতি–পাঞ্জাবির বাঙালি জানতেন। যেমন জানত তাঁর জিন্‌স–টি শার্টের সারোগেট, উদ্ধত এবং অ্যাটিউডওয়ালা সন্তান। সে জানত, আসলে সে বাসন মাজার চাকর ছিল না।

মেন্টর কি আর এমনি বলি?‌ শ্রদ্ধা কি আর এমনি করি? ‌

বিকেল ৪.‌২৩

অফিসে পৌঁছে দেখলাম, বিপ্লব এখনও বারমুডা পরে ঘুরছে। কালও দেখেছিলাম। কৌতূহল হল। প্রশ্ন করে জানলাম, সেই ঘূর্ণিঝড়ের দিন থেকে আর বাড়ি যেতে পারেনি!‌ বাড়িতে বৃদ্ধা মা। আমার মায়ের মতোই পায়ের ব্যথায় হাঁটতে পারেন না। গত তিনদিন তাঁর পুত্র তাঁর কাছে যেতে পারেনি। কারণ, জল ঠেঙিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। ফোনেও যোগাযোগ করতে পারেনি। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। চাইলে ধারেপাশে কারও বাড়িতে থেকে যেতে পারত। আমার বাড়িতে খোলা অফার দেওয়া আছে আগে থেকেই। কিন্তু অফিস ছেড়ে যাবে না।

বিপ্লবকে ভাল তো বাসতামই। আজ শ্রদ্ধা হল।

বিকেল ৫.‌০০

প্রধানমন্ত্রী ঘুর্ণিঝড়–বিধ্বস্ত বাংলার জন্য এক হাজার কোটি টাকার অনুদান ঘোষণা করেছেন। পাশাপাশি, যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ২ লক্ষ করে টাকা এবং আহতদের জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তার চেয়েও যেটা তাৎপর্যপূর্ণ, করোনা এবং আমপান মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

একটু আগে সনৎ একটা ছবি দেখাল। কপ্টারের ভিতরে তোলা। বসে আছেন প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী। দু’জনে দু’দিকের জানালায়। দু’জনেরই দৃষ্টি বাইরে। মাঝখানে বেশ কয়েকফুটের ব্যবধান। এটা সামাজিক দূরত্ব নয়। রাজনৈতিক দূরত্ব।

বসিরহাটে প্রশাসনিক বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘একঘন্টা ধরে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখেছি। পুরো এলাকা জলমগ্ন। কলকাতার ছবিও প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়েছি। আমরা কোনও সাহায্য চাইনি। ওঁরা যা পারবেন দেবেন। আমরা আগেই আমাদের তহবিল থেকে নিহতদের পরিবারকে আড়াই লক্ষ টাকা করে দিয়েছি।’

প্রসঙ্গত, ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে রাজ্যে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে কলকাতাতেই ১৯। দেশের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। ফোন করেছিলেন ওডিশার মুখ্যমন্ত্রীও। ঘটনাচক্রে, পশ্চিমবঙ্গের পরেই প্রধানমন্ত্রী ওডিশা গিয়েছিলেন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আকাশপথ থেকে দেখতে। নবীনের রাজ্যের জন্য ৫০০ কোটি মঞ্জুর করেছেন তিনি।

বিকেল ৫.‌২০

প্রধানমন্ত্রীর সফর সেরেই মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দিয়েছেন। যেখানে মুখ্য বক্তা ছিলেন সোনিয়া গান্ধী।

সন্ধ্যা ৭.‌২৩

বিদ্যুৎ এবং পানীয় জলের অভাবে কলকাতা–সহ বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ ছড়াচ্ছে। পথ অবরোধ হচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য খুব সরল— রাস্তায় ভেঙে–পড়া গাছের জন্যই তার তলায় আটক তার সারিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা যাচ্ছে না। গাছ কাটতে হবে অনতিবিলম্বে। ইন্টারেস্টিং হল এর মধ্যে হাওড়ার বালিতে আমজনতার সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলের বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়া।

কলকাতার বিক্ষোভ নিয়ে মুখ্য প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘আমরা লড়াই করছি। আমাদের হাতে তো ম্যাজিক স্টিক নেই। একেকটা গাছ কাটতে তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লাগবে। আমার হাতে তো ১০ হাজার বা ২৫ হাজার মানুষ নেই যে, সকলকে গাছ কাটার কাজে লাগিয়ে দেব!‌ আর এই লেবাররা অধিকাংশই আসেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে। তাঁরা তো ঝড় আর করোনার জন্য আসতেই পারছেন না!‌’

রাত ৮.‌৫৫

এখনও রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আলো আসেনি। পানীয় জল নেই। নেটওয়ার্ক ডাউন। এখনও রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় হাজারে হাজারে ক্রুদ্ধ, অসহিষ্ণু, কাতর মুখ। তাড়া করছে। পিছু ধাওয়া করছে। মগজে ভিড় করছে মুখগুলো। সে মুখের ভিড়ে কোথাও হিঙ্গলগঞ্জের শিশু। কোথাও শহুরে, আরবান যুবক। বিপর্যয় সকলকে আজ একটা সরলরেখায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সকলেরই অপেক্ষা স্বাভাবিকতার।

রাত ৯.‌২০

আজ এখানেই ডায়েরি বন্ধ করি। দিনের শেষ এন্ট্রি করার সময়েও চোখে ভাসছে এমআই–৬ হেলিকপ্টারে বসা দুটো চেহারা। দু’জনে দু’দিকের জানালায়। দু’জনের দৃষ্টি বাইরে। মাঝখানে বেশ কয়েকফুটের দূরত্ব।

ওই দূরত্বের টুকরো জমিতে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার কাতর, নাচার, অসহায় মুখ।

লকডাউন ডায়েরি

২১.‌০৫.‌২০২০। বৃহস্পতিবার

সকাল ৭.‌১৯

কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কাল রাতে। কখন বাড়ি পৌঁছেছিলাম, তা–ও ঠিকঠাক মনে নেই। কতক্ষণ জেগেছিলাম, মনে নেই তা–ও। ঘুম ভেঙেই মনে হল, গাড়িটা ঠিক আছে তো? ‌সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে ফিরে এল কয়েকঘন্টা আগের ছবিগুলো।

গাড়িটা নৌকার মতো দুলছিল। ভাসছিল। কাল রাত ১১টা। হাওয়ার ঝাপট একটু কমায় অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম। সহকর্মীদের অনেকেই বারণ করেছিল। অনির্বাণ মজুমদার, তারিক, শুভা’দা বলেছিল, ‘এখন বেরিও না। সমস্ত রাস্তায় জল। গাছ ভেঙে পড়েছে। আটকে যাবে।’ কিন্তু ভিতরের অবিমৃশ্যকারী, গোঁয়ার এবং অ্যাডভেঞ্চারাস আমি তাদের বলেছিল, ‘কাছেই তো। দশমিনিটে পৌঁছে যাব।’

অফিস থেকে বেরিয়ে ডাইনে গিয়ে সোজা রাস্তা ধরে উইপ্রোর ফ্লাইওভারের কাছে পৌঁছনো যায়। তারপর বাঁদিকে বেঁকে করুণাময়ীর পাশ দিয়ে সোজা রাস্তা। বাড়িটা প্রায় দেখতেই পাচ্ছিলাম। অফিসের সামনে দেদার জল জমেছে। সেটা কোনওমতে পেরোন গেল। কিন্তু খানিক এগিয়েই দেখলাম, আড়াআড়ি দুটো গাছ পড়ে উইপ্রো পর্যন্ত পৌঁছনোর রাস্তা বন্ধ। ইউ টার্ন। যে চৌমাথাটা খানিক আগে পেরিয়েছি, সেটা থেকে ডানদিকে ঘুরলাম। ওটাই টার্নিং পয়েন্ট। যাওয়া উচিত ছিল বাঁয়ে টেকনোপলিসের দিকে। আমি ঘুরলাম কলেজ মোড় অভিমুখে।

মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। সামনের রাস্তায় প্রচুর জল। সেটা ঠেলে ঠেলে যাচ্ছিলাম। কোথাও খানাখন্দ আছে কিনা, কে জানে!‌ কয়েকবার নীচে কিছু ঠোক্করও খেল। তখনই খেয়াল করলাম, গাড়ি থেকে একটা বিজাতীয় আওয়াজ বেরোচ্ছে। একটা মোড় ক্রস করে কলেজ মোড়ের কাছে পৌঁছনোর আগে মাঝরাস্তায় বন্ধই হয়ে গেল মারুতি সুজুকি ব্যালেনো। দু’বার সেল্‌ফ মারলাম। কোনও সাড়া এল না। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভাল করে নজর চলছে না। খানিকটা দূরে মোড়ের ট্র্যাফিক সিগনালটা নিজের মতো সবুজ, হলুদ আর লাল হয়ে চলেছে। তার পাশের সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলোয় দেখতে পাচ্ছি, তুমুল হাওয়া বৃষ্টির ঝরোখাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দিগ্বিদিকে। এটাই কি আমপানের লেজ?‌ যাওয়ার আগে শেষ ঝাপ্টাটা মেরে যাচ্ছে?‌

গাড়ির সব কাচ তুলে বসেছিলাম ভোম্বলের মতো। দরজা খুললেই ভিতরে হুড়হুড় করে জল ঢুকবে। নিজের গালে সপাটে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করছিল। কেন বেরোলাম ইডিয়টের মতো!‌

পাশের রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যে কিছু উঁচু গাড়ি যাচ্ছিল। তার চাকার ধাক্কায় জলের তোড় আর ঢেউ এসে আমার গাড়িটাকে ঠেলে নিয়ে চলে যাচ্ছিল এলোমেলো। একবার মনে হচ্ছিল গাড়িটা ভাসতে ভাসতে গিয়ে রাস্তার পাশের রেলিংয়ে ধাক্কা মারবে। আবার কিছুক্ষণ পর দেখছিলাম চলে এসেছি রাস্তার মাঝখানে। এইসব আধুনিক গাড়ি চলে ইলেকট্রিকে। স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্টিয়ারিং শক্ত হয়ে গেছে। হ্যান্ডব্রেকও কাজ করছে না। ভয় করছিল। মাথা কাজ করছিল না। এতটাই ভেবলে গিয়েছিলাম যে, হ্যাজার্ড লাইটটাও জ্বালাতে ভুলে গিয়েছিলাম।

বিপ্লবকে ‘অফিশিয়াল মা’ বলে থাকি। ওকে অবিরাম ফোন করার চেষ্টা করছিলাম। ডায়াল করামাত্র কেটে যাচ্ছিল। লাইন লাগছিল না। অবশেষে অনির্বাণকে ফোনে পেলাম। ওর মারফত বিপ্লবকে ধরে বললাম অফিস থেকে একটা গাড়ি পাঠাতে। এই জলের মধ্যে কতক্ষণ বসে থাকব?‌ গাড়ি থেকে নেমেই বা অন্ধকারে কতদূর যাব?‌ জলের তোড়ে গাড়িসুদ্ধ ভেসে গেলে কোথায় গিয়ে ঠেকব?‌ কেউ উদ্ধার করে না নিয়ে গেলে তো সমূহ বিপদ!‌

ফোনে কথা বলতে বলতেই পিছন থেকে একটা জোরাল আলো পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম একটা বিশাল ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে। তার কোমরজলেও সমস্যা নেই। কিন্তু রাস্তার একেবারে মাঝখানে আমার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকায় এগোতে পারছে না। ঝটপট ট্রাক থেকে দু’জন খালাসি নামলেন। তাঁরাই খানিক ধাক্কা মেরে, খানিক ভাসিয়ে আমার গাড়িটা রাস্তার একপাশে নিয়ে গেলেন। ট্রাক চলে গেল। বিশাল বিশাল টায়ারের ধাক্কায় আবার ঢেউ উঠল। সেই ঢেউয়ের তোড়ে আবার আমার গাড়ি দুলতে দুলতে গভীরতর জলের দিকে খানিক এগোল।

কিছুক্ষণ পর অফিস থেকে অ্যাম্বাসেডর নিয়ে এলেন বহু যুদ্ধের সেনানী তপন’দা। ততক্ষণে ঠিক করে ফেলেছি, গাড়ি রাতের মতো ওখানেই রেখে যেতে হবে। যা হয় হবে। ভেসে কোথাও চলে গেলেও বা কতদূর যাবে!‌ ঝপ করে দরজা যথাসম্ভব কম ফাঁক করে নেমে গাড়ি লক্‌ করে অফিসের গাড়িতে উঠলাম। অভিজ্ঞ তপন’দা ব্যাকগিয়ারে আস্তে আস্তে করে পিছনে গেলেন। তারপর সম্পূর্ণ ঘুরপথে বেরিয়ে পিছন দিক দিয়ে গিয়ে আবার অফিসে ঢুকলাম। সে যাত্রাও অবশ্য বিপদসঙ্কুল। কারণ ততক্ষণে দেখছি, রাস্তায় জীবন্ত বিদ্যুৎবাহী তার–সহ ল্যাম্পপোস্ট উপড়ে এসে পড়েছে। তার মধ্যেই কাটিয়ে বেরোলেন তপন’দা।

কপাল ঠুকে ফোন করলাম জ্ঞানবন্ত সিংকে। রাজ্যপুলিশের আই জি (‌আইনশৃঙ্খলা)‌ জ্ঞানবন্ত তখন নবান্নের কন্ট্রোলরুমে। বলল, ‘এখনই আপনার নম্বর সল্টলেকের পুলিশ কমিশনারকে দিচ্ছি। উনি আপনাকে ফোন করবেন।’

অফিসে পৌঁছনোর পর থেকেই একের পর এক অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসতে শুরু করল। সল্টলেকের ডিসি (‌ট্র্যাফিক)‌ ধৃতিমান, ট্র্যাফিক ইন্সপেক্টর অনিল কুমার মণ্ডল, ইলেকট্রনিক কমপ্লেক্স থানার ওসি বজলুর রহমান, সাব ইন্সপেক্টর সুদীপ নস্কর। প্রত্যেকেরই এক প্রশ্ন:‌ কী সাহায্য লাগবে বলুন?‌

তার মধ্যেই মারুতির ‘রোড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্স’–এ ফোন করে সমস্যা নথিভুক্ত করেছি। কারণ, আমার ইনসিওরেন্সে সেই প্রভিশন আছে। কলসেন্টারের কর্মী খুব আশাব্যঞ্জক গলায় বলেছেন, ‘আমাদের লোক পৌঁছে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তার আগে আপনাকে ফোন করবে। আপনি গাড়ির কাছে চলে যাবেন।’ শুনে অত সমস্যার মধ্যেও হাসি পাচ্ছিল। বিপণনের জন্য কতকিছুই যে বলতে হয়!‌ কত অসত্য আশ্বাস যে দিতে হয়!‌ অবশ্য, গুরগাঁওয়ের কলসেন্টারে বসা কর্মী গুগ্‌ল ম্যাপ দেখে কী করেই বা বুঝবেন, সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের কোন এলাকাটা নদী হয়ে গিয়েছে।

খানিক পরে বজলুর ফোন করে বললেন, ‘আমি লোক পাঠিয়ে দেখে নিচ্ছি। গাড়িটা কি ঠেলে আপনার অফিস পর্যন্ত দিয়ে আসবে ওরা?‌ রেকারও পাঠানো যেতে পারে। কিন্তু তাতে গাড়ি ড্যামেজ হবে।’ ওঁকে বললাম, অত জল ঠেলে গাড়ি বার করা সম্ভব হবে না। ওটা পণ্ডশ্রম হবে। তার চেয়ে গাড়িটা ওখানেই থাকুক। যাতে নিরাপদে থাকে, সেটা দেখলেই হবে। উনি বললেন, আমি অনুমতি দিলে গাড়ির চাকায় কাঁটা লাগিয়ে দেবেন। যাতে কেউ ঠেলে না নিয়ে যেতে পারে। বললাম, চারটে চাকাই জলে ডুবে। কাঁটাও লাগানো যাবে না।

কিছু পরে বজলুর আবার ফোন করলেন, ‘নিশ্চিন্তে থাকুন। গাড়ি ওখানে যেমন আছে তেমনই থাকুক। আমাদের নাইট পেট্রোল পার্টি গিয়ে রাউন্ড মেরে আসবে। কাল সকালে জল নেমে গেলে থানায় চলে আসুন। আপনার গাড়ি ঠিকমতো উদ্ধার করে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। আর যত রাতেই বাড়ি ফিরুন, আমাকে একটা ফোন করবেন।’

অফিস থেকে বাড়ির দূরত্ব পেরোলাম একঘন্টায়। প্রায় সমস্ত রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়েছে। ল্যাম্পপোস্ট, সিগনাল পোস্ট উপড়ে চলে এসেছে। মাটিতে পড়ে থাকা সিগন্যালে লাল–সবুজ আলো জ্বলছে–নিভছে। ভৌতিক লাগছিল। বাড়ি পৌঁছে বজলুরকে ফোন করলাম। একটা রিংয়েই ফোন ধরে বললেন, ‘আমার লোক গিয়ে দেখে এসেছে। গাড়ি ঠিকঠাক আছে। কাল সকালে আপনি থানায় চলে আসুন।’

সকাল ৯.‌৪৫

টিভি চলছে না। নেট ডাউন। হোয়াট্‌সঅ্যাপ আসছে–যাচ্ছে না। ফোন লাগছে না। ফোন এলেও কথা বলা যাচ্ছে না। আচমকাই ‘টুং’ করে একটা টেক্সট মেসেজ ঢুকল। মারুতি রোড অ্যাসিস্ট্যান্সের তরফে কে একটা ভুলভাল ইংরেজিতে প্রভূত দুঃখপ্রকাশ করে জানাচ্ছে, রাতে তারা আমার গাড়ির ধারেপাশে পৌঁছতেই পারেনি। আজ বললে রেকার দিয়ে গাড়ি টেনে ওয়ার্কশপে পৌঁছে দিতে পারে। বাহ্‌!‌

দুপুর ১২.‌৩৫

এইমাত্র গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছেছিলাম থানায়। তার আগেই অনিলবাবু ফোন করে জানিয়েছিলেন, জল নেমে গিয়েছে। গাড়িও ঠিকঠাক আছে। ওঁর লোক গিয়ে দেখে এসেছে। গৌরব বলে এক হোমগার্ডকে তৈরি রেখেছিলেন বজলুর। তিনি রয়্যাল এনফিল্ডে চাপিয়ে নিয়ে গেলেন গাড়ির কাছে। দেখলাম, শুকনো রাস্তায় গাড়িটা একলা দাঁড়িয়ে আছে। যেমন রেখে গিয়েছিলাম কাল রাতে। শুধু সেই নিকষ, থমথমে অন্ধকার আর ভয়াবহ বৃষ্টিটা নেই।

গৌরব বললেন, ‘বেশিবার সেল্‌ফ মারেননি তো?‌ অনেকবার সেল্‌ফ মারলে ইঞ্জিন জল টেনে নেয় কিন্তু।’ কাঁপতে কাঁপতে বললাম, যতদূর মনে পড়ছে, দু’বার সেল্‌ফ মেরেছিলাম। তার বেশি নয়। আমাকে গাড়ির কাছে রেখে নয়াপট্টির ওয়ার্কশপ থেকে গৌরব তুলে আনলেন মোটর মেকানিক প্রমোদকে। দেখা গেল, সাইলেন্সার পাইপ দিয়ে জল ঢুকে গাড়ির প্রায় ইঞ্জিন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ব্যাটারিও বসে গেছে।

সম্ভবত সেটা অনুমান করেই প্রমোদ সঙ্গে সদ্য চার্জ–দেওয়া ব্যাটারি নিয়ে এসেছিল। প্রায় দেড়ঘন্টার কসরতে গাড়ি আবার স্টার্ট হল। অ্যাক্সিলারেটর রেস করে যেতে হল ক্রমাগত। সাইলেন্সার থেকে ঝরঝর করে জল বেরোতে লাগল। প্রমোদকে বললাম, কত দেব?‌ রোগা, কালো এবং আনইম্প্রেসিভ চেহারার যুবক বলল, ‘টাকা পরে হবে। আগে কাজটা হোক।’

চালিয়ে দেখা গেল, গাড়ির ব্রেক খানিক কম ধরছে। প্রমোদ অভয় দিল, ‘ওটা কোনও ব্যাপার না। চালাতে চালাতে ঠিক হয়ে যাবে। ব্যাটারিও চার্জ নিয়ে নেবে।’ ঠিকই। কিছুক্ষণ চালানোর পর দেখা গেল, গাড়ি একেবারে আগের মতোই চাঙ্গা!‌ গৌরবের মোটরবাইকে ওঠার আগে প্রমোদ বলল, ‘আমার নম্বরটা রেখে দিন। আপনার নম্বরটাও দিন। যে কোনও সময় যে কোনও প্রবলেমে ফোন করে বলবেন। ওয়ার্কশপে নিয়ে গেলে ওরা কয়েকদিন গাড়ি রেখে তারপর অনেক টাকা নিয়ে নেবে। আপনি জানতেও পারবেন না কী কাজ হয়েছে। তার চেয়ে আমাদের বলবেন। হয়তো লেবার চার্জটা ৫০ টাকা বেশি নেব। কিন্তু আপনার চোখের সামনে কাজটা করব।’ আর যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘একটাই বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। বেশিবার সেল্‌ফ মারেননি। তাহলে আর এখানে সারাতে পারতাম না।’

গাড়ি–সহ গেলাম বজলুরের সঙ্গে দেখা করে ধন্যবাদ দিতে। দেখলাম, মুখে মাস্ক–পরা ৪৬ বছরের পুলিশ অফিসার অধস্তনকে নির্দেশ দিচ্ছেন বিধাননগরের পুরভবন থেকে তাঁর এলাকার ফুটপাথবাসীদের জন্য ত্রিপল নিয়ে আসতে। বলছেন, ‘ফোনে হবে না। আপনি চলে যান। মানুষের দরকার। এটা করতেই হবে।’

ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে এত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিপর্যয় কভার করেছি। কিন্তু কখনও এত ট্রমাটাইজ্‌ড হইনি। কাল রাতে হয়েছিলাম। কারণ, একটা তফাত ছিল। ভূমিকম্প হোক বা সুনামি অথবা সিডার— গিয়ে পৌঁছেছিলাম ঘটনার পর। আর কাল রাতে নিজে সেই ঘটনার মধ্যে ছিলাম। দু’হাত দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না বৃষ্টির তাড়সে। জনমানবহীন রাস্তায় একেকটা ঢেউ এসে ধাক্কা মারছে বন্ধ গাড়ির গায়ে আর তার তোড়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ভেসে ভেসে চলেছি— এই অভিজ্ঞতা সড়কপথে আগে কখনও হয়নি। মনে হচ্ছিল, একটা কফিনের মধ্যে আটকে পড়েছি। আর সেটা কেউ ঠেলে ভাসিয়ে দিয়েছে অকূল পাথারে।

দম বন্ধ করে বসে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল, কেন যে ফোর্ড ইকোস্পোর্টটা বিক্রি করে দিলাম!‌ ওটা উঁচু গাড়ি ছিল। ঠিক জল ঠেলে চলে যেতে পারত।

দুপুর ৩‌.‌০৫

ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর উঠে গাড়িটা নিয়েই অফিসে এসেছি। এবং এসে দেখছি, ভয়াবহ সব ছবি চারদিকে। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে আমপান। প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, সারা রাজ্যে ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে কলকাতাতেই মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা থেকে যে সমস্ত ছবি আসছে, সেগুলো মর্মন্তুদ। মানুষের অসহায়তা, বিপন্নতা আর প্রকৃতির তাণ্ডবে ধ্বংসের এই ছবি আগে দেখিনি। সম্ভবত গোটা পশ্চিমবঙ্গই দেখেনি। উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা কার্যত ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর বিপর্যস্ত। সুন্দরবন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। লক্ষ লক্ষ একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।

ভেসে গিয়েছে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া। একের পর এক গাছ ভেঙে পড়েছে রাস্তায় পার্ক করা গাড়ির উপর। বিশাল মহীরূহ ভেঙে পড়ে দু–ফালা করে দিয়েছে আস্ত মিনিবাস। এই কলকাতাকে আমি চিনি না। কলকাতার এই ছবি দেখব বলে কোনওদিন ভাবিনি। দমদম এয়ারপোর্টে হ্যাঙারে দাঁড়িয়ে–থাকা প্লেন জলে ভাসছে। রানওয়েটাকে আস্ত সমুদ্র মনে হচ্ছে।

কিছুক্ষণের জন্য নেটওয়ার্ক ফিরেছিল। সোশ্যাল মিডিয়া ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। কারণ, অধিকাংশ ন্যাশনাল মিডিয়া পশ্চিমবঙ্গে এই প্রাকৃতিক তাণ্ডবের কোনও কভারেজই সেভাবে করেনি। ঠিকই। যতদূর দেখছি, তারা এমন একটা ভাব করছে, যেন বাংলায় কিছু ঘটেইনি। যেখানে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আমপানে বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গ আর ওডিশা নিয়ে একাধিক স্টোরি করেছে। মনে মনে স্যালুট করছিলাম এ রাজ্যের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সহকর্মীকে। যেভাবে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ওরা কভারেজ করেছে, কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট হতে পারে না। সুযোগ পেলেই রিজিওনাল মিডিয়াকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা ন্যাশনাল মিডিয়ার বাগাড়ম্বরবাজরা কিছু শিখবে কি?‌

প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী–সহ কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী সকাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে একটি টুইটও করেননি। উল্টে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল বলেছেন, আমপানে নাকি ‘ন্যূনতম’ ক্ষতি হয়েছে!‌ এই লোকটা কিন্তু, যাকে বলে, চরম!‌

বিকেল ৪.‌১০

একটু আগে রোদ উঠেছিল। দেখে আবার প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার কথা মনে পড়ল। ঠিক ২৪ ঘন্টা আগে এটা ভাবা যেত?‌

এডিট মিটিংয়ে অশোক’দা বললেন, এই ধরনের দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে রাতে কর্মীদের অফিসে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে ইমিডিয়েটলি। আমার গাড়ি আটকে যাওয়ার খবর শুনে কাল রাতেও খোঁজ নিয়েছিলেন। আজ পুরো ঘটনাটা বিস্তারিত শুনলেন। এবং নির্দেশ দিলেন, ‘তুমি লেখো। আজই লেখো। পার্সোনাল টাচ দিয়ে।’

বিকেল ৪.‌৪০

ওহ্‌, অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে টুইট করেছেন প্রধানমন্ত্রী। লিখেছেন, ‘এই বিপর্যয়ে গোটা দেশ পশ্চিমবঙ্গের পাশে আছে।’ বঙ্গবাসী কি আনন্দে লেজ নাড়াবেন?‌ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করেছেন। আহা, কী আনন্দ আমপানের আকাশে–বাতাসে!‌

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘বাংলা অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। এটাও নেবে। আমরা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ শুরু করব। আকাশ পরিষ্কার থাকলে পরশু আমি উত্তর আর দক্ষিণ ২৪ পরগনাটা সার্ভে করে দেখব।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোনের প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে বলছেন, ‘ওঁরা কাল কিছু করেননি। তবে আজ ফোন করেছিলেন। আমি বলেছি, আপনাদের সাহায্য করা উচিত। আশা করি, ওঁরা সাহায্য করবেন। আমরা আমাদের সামর্থ্য থেকে ১,০০০ কোটি টাকার ফান্ড তৈরি করেছি। সেটা থেকেই প্রাথমিক কাজকর্মগুলো শুরু করা হচ্ছে।’

বিকেল ৫.‌০০

রাজ্যপাল ঢোক গিলেছেন। ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে আবার টুইট করে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিনি সমস্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে অবিলম্বে ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বাহ্‌–বাহ্‌।

জানতে কৌতূহল হচ্ছে, কার ঝাড় খেয়ে লোকটা এই পাল্টিটা খেল।

বিকেল ৫.‌৩১

ঘন্টাখানেক আগে রোদ্দুর উঠেছিল। এই দেখলাম, রোদ্দূর রায় উঠেছেন। হোয়াট্‌সঅ্যাপ পাঠিয়ে জানতে চেয়েছেন, ‘আর ইউ অলরাইট স্যর?‌’

লিখলাম, ‘সামহাউ সারভাইভ্‌ড।’

আনন্দবাজারের প্রাক্তন সহকর্মী দেবদূত’দাও হোয়াট্‌সঅ্যাপ করে জানতে চেয়েছে ভাল আছি কিনা। জানালাম, ‘ঠিক আছি। তোমরাও ভাল থেকো।’ দেবদূত’দা বরাবরই এইরকম। আমি বলতাম, তুমি হলে আনন্দবাজার সেবাদলের চিফ। ফলে এই দুর্যোগের পর ওর মেসেজটা অপ্রত্যাশিত নয়। ভাল লাগল।

সন্ধ্যা ৭.‌১০

ভোডাফোন মৃত। লং লিভ এয়ারটেল। সেই দুপুর থেকে ভোডাফোন সিগনালের পাশে ‘ফোর জি’ দেখাচ্ছে বটে। কিন্তু কোনও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক নেই। নেই তো নেই–ই!‌ এমনকী, ফোনও করা যাচ্ছে না। ঘটনাচক্রে, আজই আবার মাসিক বিল ইমেল করেছে ভোডাফোন। মনে হচ্ছিল, হেল্পলাইনে ফোন করে তেড়ে গাল দিই!‌ প্রত্যেক মাসে বিল পাঠাতে তো কোনও ভুল হয় না!‌ পরিষেবাটা এমন কুৎসিত কেন?‌ বিশেষত, এই সঙ্কটের সময়?‌

কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম। এবার প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম, লকডাউন উঠলেই মোবাইল পোর্টেবিলিটি ব্যবহার করে ভোডাফোন ছেড়ে এয়ারটেলে মুভ করে যাব। ‘আপনি যেখানে, আমাদের নেটওয়ার্কও সেখানে’— ভোডাফোনের এই ট্যাগলাইন অস্তমিত দেখেই বোধহয় তাদের পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞাপনের সেই মিষ্টি পাগ কুকুরটাও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। আমি তো নিছকই গ্রাহক। বহুবছর ধরে এই নম্বর বহন করছি ভোডাফোনের আশ্রয়ে। বাট এভরি রিলেশনশিপ কাম্‌স উইথ অ্যান এক্সপায়ারি ডেট।

রাত ৮.‌০০

টিভি বলছে, শুধু কলকাতা শহরেই ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৫,০০০ গাছ পড়েছে। সেই গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে শহরের একটা বড় অংশ নিষ্প্রদীপ। বিদ্যুৎ না–থাকায় পানীয় জলও অকুলান। কাল রাতে সল্টলেকে যা দেখেছি, তাতে মনে হয়, অন্তত ২,০০০ গাছ পড়েছে এই সাজানো উপনগরীতে। রাস্তার পর রাস্তা গাছ পড়ে বন্ধ। এবং সেই গাছ তার সঙ্গেই উপড়ে নিয়ে এসেছে তারের জাল–সহ ল্যাম্পপোস্ট। বিভিন্ন পার্কের পাঁচিল ভেঙেছে গাছ পড়ে। গাছের সবুজ ঝরাপাতা রাস্তায় বিছিয়ে আছে কার্পেটের মতো। তার সঙ্গে ছড়িয়ে আছে গাছের ছোটবড় ডাল। দেখতে ভাল। চলতে নয়।

অনেকের মতো আমিও অতীতে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে যথেষ্ট ফাতরামি করেছি। বরাবর কলকাতার বাসিন্দা হিসেবে নিজেকে প্রিভিলেজ্‌ড ভেবে এসেছি এবং নিজেকে বলেছি, ঘূর্ণিঝড় তো বরাবর সুন্দরবন হয়ে বাংলাদেশে চলে যায়। এবারও নিশ্চয়ই তেমনই হবে। এই প্রথম কলকাতাবাসী বুঝল, বিপর্যয় কাকে বলে!‌ বুঝল, গত দু’মাস লকডাউনে থাকার চেয়েও বেশি দুর্দশায় পড়তে হতে পারে। যেখানে বাড়িতে বন্দি থাকা আছে। কিন্তু আলো নেই। জল নেই। কোথাও কোথাও ইন্টারনেট সংযোগও নেই।

পাশাপাশিই মনে হচ্ছে, পরোক্ষে হলেও লকডাউন খানিকটা সাহায্য করল জীবনহানি কমাতে। লকডাউন না হলে কাল দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত রাস্তায় থাকতেন যথেষ্ট পরিমাণ মানুষ। চলত যানবাহন। সেই গাড়িঘোড়ার কী হতো!‌ কী হতো তাতে সওয়ার জনতার?‌

রাত ৮.‌৪৫

কাল রাজ্যে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। আকাশপথে ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখবেন। সঙ্গে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রীও। দুর্গত এলাকা পরিদর্শনের পর বসিরহাটে প্রশাসনিক বৈঠক হওয়ার কথা। তবে সবকিছুই নির্ভর করবে আকাশের অবস্থার উপর। আশা করা যায়, মওকা বুঝে রাজ্যপালটি তাঁদের গায়ে সেঁটে থাকবে না।

আজ দুপুরেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তিনি চান প্রধানমন্ত্রী নিজের চোখে এসে পরিস্থিতি দেখে যান। সেই আহ্বানেই সাড়া দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এখন দেখা যাক, তিনি এই ঘটনাকে ‘জাতীয় বিপর্যয়’ ঘোষণা করেন কিনা বা কোনও বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেন কিনা।

রাত ১০.৪৫

অফিস বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, আজ কেমন সুস্থ–সুন্দর আকাশ। বৃষ্টি নেই। মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে। গাড়ি চলছে ফনফন করে। অথচ ঠিক ২৪ ঘন্টা আগে এই সময়টায় একটা ভাসমান কফিনে বসেছিলাম। চারদিকে নিকষ অন্ধকার। ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে, পিছনে জলের ঢেউ। অসহায় লাগছিল। ভয় করছিল।

ভয় মানুষের মনে বোধিজ্ঞানের জন্ম দেয়। আজ যখন ফিরতে ফিরতে প্রসেস করছিলাম ২৪ ঘন্টা আগের সময়টা, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল!‌ মনে হচ্ছিল, নৈর্ব্যক্তিক পেশাদার হিসেবে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে নোট নেওয়া আর সেই ঘটনার অংশ হয়ে যাওয়ার মধ্যে কত ফারাক!‌

প্রথমটা অমোহগ্রস্তভাবে জীবনের চলমানতার কথা বলতে চায়। দ্বিতীয়টা জীবনের মোহকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে শেখায়।