
৩০.০৫.২০২০। শনিবার
সকাল ৮.০৬
নটেগাছটি মুড়োল।
ভনিতা না করে সকাল সকাল সোজা কথাটা সোজাভাবে লিখে ফেলি। আজই শেষ ‘লকডাউন ডায়েরি’। অনেকদিন হয়ে গেল। দু’মাসেরও বেশি। লকডাউন জীবনের কার্যত অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। আবার এখন চারদিকে যা দেখছি, তাতে লকডাউন প্রায় উঠেই যেতে বসেছে। ফলে ‘লকডাউন ডায়েরি’ও এখন অপ্রাসঙ্গিক। যেমন ধীরে ধীরে সবকিছুই এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। জীবন, মৃত্যু, জীবিকা, মানুষ— সবকিছুই।
ফলে এই দিনলিপির আর প্রয়োজন নেই।
দ্বিতীয়ত, যে ডায়েরিতে এই রোজনামচা শুরু করেছিলাম, তারও পাতা ফুরিয়েছে। প্রতিদিন সকাল থেকে সেই নোটবুকের পাতায় এন্ট্রি শুরু করতাম (যার ছবি আজকের প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে)। যখন যা মনে হতো, টাইম দিয়ে লিখে রাখতাম। কখনও নিজের এলোমেলো ভাবনা, কখনও দিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি। স্কুলে থাকতে বাধ্যতামূলকভাবে ডায়েরি লিখতাম। ভাল লাগত। তার পর থেকে কখনও এতদিন ধরে এত ধারাবাহিকভাবে ডায়েরি লিখিনি। এটাকে প্রথমত সেল্ফ এক্সপ্রেশন এবং দ্বিতীয়ত একটা শৃঙ্খলা হিসেবে দেখে এসেছি। বাট অল গুড (অর ব্যাড) থিংস কাম টু অ্যান এন্ড! সো ডাজ দ্য ‘লকডাউন ডায়েরি’।
আরও একটা কথা। সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। ইন ফ্যাক্ট, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— অন্তর থেকে গভীরভাবে বিশ্বাস করি, জিনিয়াস ইজ অল অ্যাবাউট নোয়িং হোয়্যার টু স্টপ। কোথায় থামতে হবে, সেটা সম্পর্কে সম্যক ধারনা থাকাটাই হল জিনিয়াসের লক্ষণ। নিজের সীমারেখাটা জেনে নেওয়া, চিনে নেওয়াটা খুব প্রয়োজন। জীবনে সবচেয়ে জরুরি হল থামতে জানা। এবং নির্মোহভাবে থামতে জানা। ওই টাইমিংটাই মানুষ হিসেবে, পেশাদার হিসেবে একজনের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য তৈরি করে দেয়।
আর লঘুভাবে বললে, রবি ঠাকুরের সেই গল্পটা—
কোনও এক ফড়ে শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের কাছে এসে রোজ এক ওস্তাদের নাম করে খুব প্রশংসা করে। বক্তব্য, ওস্তাদ দারুণ কালোয়াতি গায়। একবার যদি গুরুদেব শুনে দেখেন। রবীন্দ্রনাথ রোজ শোনেন সেই আর্জি। কিছু বলেন না। ফড়ে রোজ ঘ্যানঘ্যান করে। একদিন সম্ভবত খানিকটা বিরক্ত হয়েই রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ঠিক আছে। কাল নিয়ে এসো তোমার ওস্তাদকে। দেখি কেমন গায় সে।’
ফড়ে মহাখুশি। আভূমি নত হয়ে কুর্নিশ করে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, গুরুদেব পিছন থেকে ডাকলেন, ‘ওহে অমুক, তোমার ওস্তাদ থামতে জানে তো?’
ফড়ে গলবস্ত্র হয়ে বলল, ‘আজ্ঞে, ওস্তাদ দারুণ গায় গুরুদেব।’ গুরুদেব বললেন, ‘আহা, তা তো জানি। গাইতে তো জানে। থামতে জানে তো?’
অস্যার্থ— থামতে জানতে হয়। সেই সীমারেখা চিনেই আজ থামছে ‘লকডাউন ডায়েরি’।
সকাল ৯.০৪
অবশেষে ‘হু’–র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করল আমেরিকা। আজ ঘোষণা করে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ৩,০০০ কোটি টাকা দেয় আমেরিকা। এবার তার কী হবে? ‘হু’–র লোকজন বেতন পাবেন তো? নাকি তাঁদেরও পারিশ্রমিকে কাটছাঁট হবে?
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তো বটেই, আমেরিকা এখন উত্তাল প্রকাশ্য রাজপথে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্মীর হাতে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের প্রাণ হারানোর ঘটনার ভিডিও নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগাপাশতলা জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সে বিক্ষোভ হিংসাত্মক। গত সোমবার মিনেসোটায় পুলিশের হাতে প্রকারান্তরে খুনই হন জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। জর্জকে রাস্তায় শুইয়ে তাঁর ঘাড়ে হাঁটু চেপে ধরে শ্বাসরোধ করা হয়েছিল। জর্জ বারবার বলছিলেন, ‘প্লিজ, প্লিজ! আই কান্ট ব্রিদ!’ কিন্তু সে আকুতি কানে তোলেনি শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার। বস্তুত, মোবাইল ফোনে সেই দৃশ্যের ছবি তোলা হচ্ছে দেখেও টনক নড়েনি তার। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়েন জর্জ। তিনি নিথর হয়ে যাওয়ার পর হাঁটু সরায় পুলিশ অফিসার। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জর্জকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। তারপরেই ওই পুলিশ অফিসারকে গ্রেফতারের দাবিতে পথে নেমেছে আমেরিকা। লকডাউনের মধ্যেই যেখানে–সেখানে হিংসাত্মক অবরোধ, বিক্ষোভ হচ্ছে। নিন্দার ঝড় উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। টুইটারে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছেন অধুনা প্রাক্তন তথা আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি বলেছেন, ‘এটা স্বাভাবিক যে, অতিমারী এবং আর্থিক সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আমরা যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিকতায় ফিরতে চাইছি। কিন্তু পাশাপাশিই এটাও মনে রাখতে হবে যে, জাতি এবং বর্ণের ভিত্তিতে এক বিরাট সংখ্যক আমেরিকানকে ভিন্নদৃষ্টিতে দেখাটাও আবার সেই স্বাভাবিকতারই অঙ্গ। ২০২০ সালের আমেরিকায় এই বিষয়টা স্বাভাবিক হওয়া উচিত নয়। এটা স্বাভাবিক হতে পারে না। আমরা চাই, আমাদের সন্ততিরা এমন এক দেশে বড় হোক, যা নীতির প্রশ্নে সর্বোত্তম’।
সকাল ৯.২২
বিক্ষোভ আরও আছে। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। কাল রাতে সল্টলেকে কলকাতা পুলিশের সশস্ত্র বাহিনীর ফোর্থ ব্যাটেলিয়নের ব্যারাকে আবার বিক্ষোভ–ভাঙচুর হয়েছে। পুলিশ ট্রেনিং স্কুল এবং গড়ফা থানার পর আবার বিক্ষোভ পুলিশকর্মীদের। তাঁদের বক্তব্য, করোনায় আক্রান্ত পুলিশকর্মীদের ব্যারাকে রেখেই চিকিৎসা করানো হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, পিটিএস এবং গড়ফা থানাতেও এই একই ইস্যুতে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন পুলিশকর্মীরা।
পদস্থ অফিসাররা কাল রাতে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। কিন্তু ইউনিফর্মড ফোর্সের মধ্যে মাঝেমধ্যেই এমন বিক্ষোভের ফুলকি ছড়াতে শুরু করলে ভবিষ্যতে তা নিয়ে গভীর চিন্তার অবকাশ থেকে যায়।
সকাল ১০.১০
আজ সকাল থেকে মুখে আবার সেই তিতকুটে স্বাদটা ফিরে এসেছে। আবার সেই খারাপ লাগা। আবার সেই অন্তহীন গহ্বরে পড়ে যাওয়ার অনুভূতি। ঘুম থেকে উঠে মনে হচ্ছিল, এই ঘুমটা না ভাঙলেই হতো। কিন্তু সে কি আর আমার হাতে!
বেলা ১১.২৩
চুপচাপ বসে গত দু’মাসের কথা চিন্তা করছিলাম। আসলে ভাবছিলাম দিনের পর দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে ‘লকডাউন ডায়েরি’ লেখার কথা। আজ যখন ডায়েরির শেষ পাতায় এসে পৌঁছেছি, তখন ফেলে–আসা পাতাগুলোর কথা আরও বেশি করে মনে পড়ছে। যে পাতাগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই লেখা আছে সহকর্মী সনৎ সিংয়ের নাম। পেশাগত বা ব্যক্তিগত কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজে উদ্যোগ নিয়ে রোজ রোজ ডায়েরির কভারের ছবি বেছে দিয়েছে সনৎ। মাঝেমধ্যে যখন আমিও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছি, তখন তাগাদা দিয়েছে। ঠেলা দিয়েছে লেখার জন্য।
বস্তুত, এই ডায়েরি শেষ হবে শুনে যে সবচেয়ে বেশি ক্ষুন্ন, তার নাম সনৎ। ইতিমধ্যেই একাধিকবার আবেদন এসেছে, ‘শেষ করবেন না প্লিজ!’ সনৎকে বললাম, নাহ্ রে, অল গুড থিংস কাম টু অ্যান এন্ড। ওর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
চিরকাল মনে হয়েছে, পাবলিক অ্যাকনলেজমেন্ট করা খুব জরুরি। কারও উপকারের কথা সর্বসমক্ষে স্বীকার করতে খুব বেশি কলজের জোর বা অর্থ লাগে বলে কখনও শুনিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সাধারণত মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কৃপণ থাকে। কেন থাকে জানি না। কাউকে ভাল বলতে কুণ্ঠা কোথায়? কে জানে! নিজেকে সবসময় বলি, যেন খোলামনে উপকারীর ঋণ স্বীকার করতে পারি। যেন অ্যাচিভারের প্রশংসা করতে পারি মুক্তকণ্ঠে।
আরও একজনকে এই ডায়েরিতে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখতে চাই। সপ্তর্ষি ঘটক। কোনও ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। ফেসবুকে গান গাইতে শুনেছি। কিন্তু এমনিতে গলাটাও কোনওদিন শুনিনি। রাতের পর রাত ডায়েরির ছোটখাট টাইপোগ্রাফিক্যাল এরর মেসেঞ্জারে লিখে লিখে জানিয়েছেন সপ্তর্ষি। এমনকী, গতকালও। ভুল আরও অনেকে ধরিয়েছেন। তথ্যগত ভ্রান্তি বা আরও কিছু টাইপো। কিন্তু সপ্তর্ষি অক্লান্ত থেকেছেন। অন্যদের কাছে কৃতজ্ঞতা আছে। কিন্তু সপ্তর্ষির কাছে ঋণের শেষ নেই।
যাঁরা রোজ এই ডায়েরি মন দিয়ে পড়েছেন, ফেসবুক অথবা আমার ব্লগে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কিছু লিখে বা না–লিখে, তাঁদের কাছেও কৃতজ্ঞতা জানানো রইল এই ডায়েরির পাতাতেই। আমপানে নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার পর একজন যেমন মেসেঞ্জারে লিখেছিলেন, কলকাতায় নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলেন না। একটা কাজে ঝাড়খণ্ড গিয়েছিলেন। সেখানে নেটওয়ার্ক পেয়ে প্রথমেই তার আগের তিনদিনের ‘লকডাউন ডায়েরি’ পড়েছেন। ভাবা যায়!
এঁদের ঋণ কোনওদিন শোধ করা যাবে না। কিছু কিছু ঋণ শোধ করা যায় না। স্বীকার করা যায় শুধু। এঁদের কাছেও ঋণটুকু স্বীকার করা রইল মাত্র।
বেলা ১১.৪৪
হঠাৎ সুভাষ’দার একটা হোয়াট্সঅ্যাপ ঢুকল। বিনা ভূমিকায়। বিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলার লিখেছেন, ‘তোমার মতো একজন মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে ভাবলে নিজেকে ধন্য মনে করি। ভাল থেকো। আর ভাল ভাল লেখা লিখে আমাদের সমৃদ্ধ করো।’
বলা বাহুল্য, খুবই লজ্জা পেলাম। লিখলাম, ‘আশীর্বাদ করবেন। ভাল থাকবেন।’
দ্রুত জবাব এল, ‘তোমাকে আশীর্বাদ করব, এ দুঃসাহস আমার নেই। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, সবাই ভাল থাকো। ঈশ্বর সার্থক করুন তোমার জীবন।’
এবার আর কিছু লিখতে পারিনি। জোড়হাতের ইমোজি পাঠিয়ে নিরুত্তর রইলাম। কী বলব! এতটাও কি প্রাপ্য ছিল?
দুপুর ১২.৪২
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা স্বপ্ন দেখলাম। অনেকদিন পর।
দেখলাম একটা পুরনো আর লজঝড়ে অ্যাম্বাসেডর গাড়ির পিছনের সিটে বসে আছি। গাড়িটা চলছে। কেউ একজন চালাচ্ছেন। কিন্তু গাড়িটা রাস্তায় চলছে না। চলছে নরেন্দ্রপুরের অভেদানন্দ ভবনের টানা লম্বা বারান্দা দিয়ে। ভবনে আর কোথাও কোনও লোকজন নেই। একেবারে ফাঁকা! গাড়িটা চলছে প্রতিটা বারান্দার এমাথা থেকে ওমাথা। বারান্দা শেষ হয়ে গেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। একতলা থেকে দোতলা। তারপর দোতলা থেকে তিনতলা। আবার নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। আবার বারান্দা পরিক্রমা করছে। কিন্তু ভবন থেকে কখনও রাস্তায় বেরোচ্ছে না।
অভেদানন্দ ভবনের যে তিনতলা জুড়ে গাড়িটা চলাফেরা করছে, তার উল্টোদিকে অদ্বৈতানন্দ ভবন। কিন্তু অনেকটা কাছাকাছি। সেটাও একেবারে ফাঁকা। দুটো বাড়ির মাঝখানে বাস্তবের ঘাসজমিটার বদলে একটা রাস্তা। দু’পাশে চওড়া ফুটপাথ। রাস্তাটা পিচের নয়। কংক্রিটের। বাঁধানো। সেটাও জনমানবহীন।
ওইভাবে গাড়িটা ঘুরল দুপুর পর্যন্ত। তারপর একটা সময়ে একতলার বারান্দায় গাড়িটা থামিয়ে ড্রাইভার আমার দিকে পিছু ফিরে তাকালেন। দেখলাম, একেবারে অচেনা একটা মুখ। তেল চুপচুপে চুল ব্যাকব্রাশ করা। লম্বা জুলপি। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মোটা গোঁফ। চোখে একটা মোটা ফ্রেমের বড় চশমা। ঘোলাটে দৃষ্টি। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি কি এবার একটু খেয়ে আসব? আর খেয়ে এসে কি গাড়ি গ্যারেজ করে দেব?’
আমি বললাম, না–না। গাড়ি গ্যারেজ করবেন না এখন। আমায় অফিস যেতে হবে তো! আপনি এখন আমায় এখানে নামিয়ে দিয়ে যান। আমি এই ফুটপাথে বসে আছি। খেয়ে এসে আমায় আবার তুলে নেবেন।
ওইখানেই ঘুমটা ভেঙে গেল। উঠে বসে ভাবার চেষ্টা করলাম, স্বপ্নটার কার্যকারণ কী হতে পারে। মনে হল, লকডাউনের কারণে যে আপাত–বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে, তার সঙ্গে কোথাও একটা নরেন্দ্রপুরের হস্টেলবাসের শৃঙ্খলিত জীবনযাপনের মিলমিশ তৈরি হয়ে স্বপ্নটা দেখেছি। গাড়ি আছে। অথচ ইচ্ছেমতো যাতায়াত করতে পারছি না। হস্টেলের বারান্দার মধ্যে ঘুরপাক খেতে হচ্ছে।
দুপুর ১.০০
গত কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছে, করোনাকে প্রশাসন আর সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। আমরা কেউই সিরিয়াসলি নিচ্ছি না। এবার থেকে করোনা আর প্রশাসনের দায়িত্ব হবে না। ব্যক্তিগত দায়িত্ব হয়ে যাবে। ব্যক্তিগতভাবে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করব। হাত ধোওয়া ইত্যাদি নিয়ম মানব। তারপর করোনা হলে হবে। না হলে না হবে।
সকাল থেকে একের পর এক টেক্সট আসছে দেখছি। অমুক ব্র্যান্ড স্টোর খুলে যাচ্ছে। তমুক শো–রুম খুলছে। বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করা হবে। এসব থেকে মনে হচ্ছে, এবার দ্রুত সব খুলে যাবে। দোকান–বাজার খুলবে। শপিং মল খুলবে। সিনেমাহলও খুলবে। খেলাধুলো শুরু হবে। সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে।
শুধু মাঝখান থেকে আরও কিছু লোকের মৃত্যু হবে। আরও কিছু লোক অসুস্থ হবেন। কিন্তু সামগ্রিক ভয়টা আর থাকবে না। ভালই হবে। এখন আর করোনাকে আটকানোর চিন্তা করলে হবে না। সেই সময় পেরিয়ে গিয়েছে। এখন চিন্তা করতে হবে করোনা হলে বাড়িতে কী কী করণীয়। বিলেতের একজন কোভিড–যোদ্ধা নার্স যেমন জানিয়েছেন—
১. প্যারাসিটামল রাখুন।
২. কাশির ওষুধ সঙ্গে রাখুন। যা মিউকাসকে তরল করবে।
৩. মধু এবং লেবু খান।
৪. বুকের জন্য ভিক্স ভেপোরাব মজুত রাখুন।
৫. ভেপার নেওয়া ভাল। প্লেন ভেপার নিন।
৬. অ্যাজমার ইতিহাস থাকলে হাতের কাছে প্রয়োজনীয় ইনহেলার রাখুন।
৭. জল খান। প্রচুর জল খান।
৮. প্রচুর বিশ্রাম নিন। বাড়ি থেকে বেরোবেন না। বাড়িতেও মাস্ক এবং গ্লাভস পরুন।
৯. নিজের শোওয়ার ঘর আলাদা রাখুন। বিছানার লিনেন ধোওয়ার ব্যবস্থা রাখুন। খাবার দিয়ে যেতে বলুন দরজার বাইরে।
১০. আপনার ব্যবহার্য বাথরুমও নিয়মিত সাফ করুন স্যানিটাইজার দিয়ে।
অত্যধিক জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট না হলে এবং ওষুধে কোনও উপশম না হলে তবেই হাসপাতালে যান।
দুপুর ১.১৩
ফেসবুক মেসেঞ্জারে নন্দিতা’দি জানালেন, রবীন্দ্র সরোবরে তিনটি ভূপতিত বৃক্ষ আবার খাড়া করা হয়েছে। আবার তাদের পুনর্স্থাপিত করা হয়েছে। কলকাতা পুরসভার সহায়তায় একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ওই তিনটি গাছ আবার তুলে দাঁড় করিয়েছে। এটা সত্যিই ভাল খবর।
দেখেই মনে পড়ে গেল, আজই রবীন্দ্র সরোবরের ক্ষতিগ্রস্ত গাছগুলির পুনর্বাসন নিয়ে কলকাতা পুরসভায় মিটিং ডেকেছেন মুখ্য প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম। বন দফতরের সঙ্গে সেই বৈঠকের আগে তিনটি বৃক্ষ তুলে ধরার এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে ইতিবাচক সঙ্কেত পাঠাবে।
দুপুর ২.০২
আজ আবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। গতকালও তাঁদের বৈঠক হয়েছিল। মনে করে নিতে সমস্যা নেই যে, এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠক লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়ে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে বটে যে, লকডাউন–৪ জারি আছে ৩১ মে পর্যন্ত। কিন্তু যতদূর মনে পড়ছে, এই লকডাউনের মেয়াদ ছিল ৩০ মে, অর্থাৎ আজ পর্যন্ত। সেক্ষেত্রে আজই পঞ্চমদফার লকডাউনের গাইডলাইন জানানো উচিত কেন্দ্রীয় সরকারের।
প্রসঙ্গত, গতকালই নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় দফার সরকারের প্রথম বছরের মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে। সেই উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী। যেখানে তিনি পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ওডিশায় আমপানের তাণ্ডব নিয়েও কিছু কথা লিখেছেন।
দুপুর ৩.১২
লকডাউনের সময় আসল হিরো হয়ে দেখা দিয়েছেন হিন্দি ছবির আপাত–ছুটকো অভিনেতা সোনু সুদ। সিক্স প্যাকের অধিকারী সোনুকে সেভাবে কেউ এতদিন পাতে দেননি। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন, তাতে গোটা দেশে ধন্য ধন্য পড়েছে। সেখানেই বলিউডের অনেক হিম্যানের চেয়ে তিনি অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছেন।
সোনু দেখিয়েছেন, তাঁর মানসিক সিক্স প্যাক অনেক বেশি শক্তিশালী এবং জোরাল।
বিকেল ৪.২১
হুগলির মাহেশের রথযাত্রা এবার হচ্ছে না বলে জানাচ্ছে টিভি। বলছে, ৬২৪ বছর পর এই প্রথম মাহেশে রথযাত্রা হচ্ছে না। এই রথযাত্রা নাকি গোটা দেশে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ। পুরীর পরেই।
সন্ধ্যা ৬.৫১
লকডাউন বাড়ল ৩০ জুন পর্যন্ত। অর্থাৎ, আরও একমাস। তবে কিছু শর্তসাপেক্ষে এবং কিছু শিথিলতা–সহ। যে কারণে একে বলা হচ্ছে ‘আনলক–১’। অর্থাৎ, আরও তালাবন্দি নয়। বরং তালা খোলার প্রথম পদক্ষেপ।
‘আনলক–১’ বলছে, দেশে রাত ৯টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে কার্ফু। যা আগে ছিল সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত। শর্তসাপেক্ষে ধর্মীয় স্থানে ঢোকা যাবে। গতকালই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ১ জুন, সোমবার থেকে ধর্মীয় স্থান খুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তবে বেলুড়মঠ, দক্ষিণেশ্বর এবং তারাপীঠের মন্দির বন্ধ থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন। যেমন অধিকাংশ মসজিদও বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন সেগুলির কর্তৃপক্ষ। ঘটনাচক্রে, কেন্দ্রীয় সরকার আজ জানাচ্ছে, ৮ জুন থেকে শর্তসাপেক্ষে ধর্মীয় স্থান এবং উপাসনাস্থল খুলে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, এ বিষয়ে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তারা সহমত।
এ ছাড়াও, এই পর্বে কনটেনমেন্ট জোনের বাইরে শপিং মল, হোটেল এবং রেস্তোঁরা খুলে দেওয়া হবে। তবে সে বিষয়ে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রোসিডিওর’ বা ‘এসওপি’ ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক।
কিন্তু কনটেনমেন্ট জোনে এইসমস্ত কোনও শিথিলতা থাকবে না। উল্টে সেখানে ৩০ জুন পর্যন্ত লকডাউনে আরও কড়াকড়ি করা হবে। পাশাপাশিই কেন্দ্র বলেছে, তারা কোনও রাজ্যের উপরই কোনও নির্দেশ চাপিয়ে দিচ্ছে না। বিভিন্ন রাজ্য সরকার তাদের এলাকার পরিস্থিতি বিচার–বিবেচনা করে ওই সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করবে। কিন্তু সকলকেই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
সে কারণেই পঞ্চমদফার এই তথাকথিত লকডাউনকে বলা হচ্ছে ‘আনলক’ পর্যায়ের ‘ফেজ–১’। শিথিলতার পথে প্রথম ধাপ। এটা চলবে একমাস, আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত। ‘আনলক’–এর দ্বিতীয় পর্যায়ে জুলাই মাসে ‘ফেজ–২’তে স্কুল–কলেজ এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তারও পরে ‘ফেজ–৩’ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হবে মেট্রোরেল, সিনেমাহল, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ইত্যাদি চালু করা নিয়ে। অর্থাৎ, যেখানে একসঙ্গে প্রচুর লোকের ভিড় হয়। সাধারণ রেল চালু করার পর পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মেট্রোরেল নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এটা পরিষ্কার যে, গভীর গাড্ডায় পড়ে–যাওয়া দেশের অর্থনীতিকে টেনে তুলে ধরতে এই ‘আনলক’ প্রক্রিয়া। কিন্তু আমজনতা স্বাস্থ্যবিধি ঠিকঠাক না মানলে এই প্রক্রিয়া ব্যুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে।
রাত ১০.১০
‘লকডাউন ডায়েরি’–র এটাই শেষ এন্ট্রি। মনে হচ্ছে, কাকতালীয়ভাবে হলেও ডায়েরি শেষের দিনটা উপযুক্ত হয়ে রইল। কারণ, কাল থেকে ‘লকডাউন’–এর বদলে অগ্রাধিকার পাবে ‘আনলক’ প্রক্রিয়া। ফলে এমনিতেই ‘লকডাউন ডায়েরি’–র দিন গিয়াছে। এ এক সুখকর এবং স্বস্তিজনক সমাপতন।
ডায়েরি শেষ করছি দু’টি ইচ্ছে নিয়ে—
এক, যেন আজীবন ‘অপু’ থাকতে পারি। সেই অপু, যে বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি। যে রেলগাড়ি দেখেছিল বিস্ফারিত নয়নে। এমন নয় যে, পৃথিবীতে সেদিনই প্রথমবার রেলগাড়ি চলেছিল। সেদিনই প্রথম সারা পৃথিবী রেলগাড়ি দেখেছিল। কিন্তু অপু সেদিন প্রথম রেলগাড়ি দেখেছিল। তাই তার নয়নে সারা বিশ্বের বিস্ময় ছিল। সে নিজেকে সবজান্তা ভাবেনি। মনে করেনি, ওহ্, রেলগাড়ি তো আছেই। ও আর দেখার কী আছে?
পল্লবগ্রাহী এক পেশায় থাকতে থাকতে আমাদের মধ্যে এই ভাবটা চলে আসে যে, এ আর এমন কী ঘটনা? এ তো আকছার হয়েই থাকে। বিস্মিত হওয়ার, বিস্ফারিত হওয়ার ক্ষমতা বিসর্জন দিয়ে আমরা নিজেদের সবজান্তা প্রমাণে নিয়োজিত থাকি প্রতিনিয়ত। সম্ভবত তাই ঘটনার মধ্যেকার সূক্ষ্ণ ঘটনা আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। নিজেকে নিজে তাই বারবার বলি, ‘অপু’ থেকো। আজীবন ‘অপু’ থেকো। বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিও না। যেদিন সেই ক্ষমতা হারাবে, সেদিন থেকে তোমার মানুষ হিসেবে, পেশাদার হিসেবে পতন শুরু।
দ্বিতীয়ত, নিজের ভিতরে এক নির্মোহ সন্ন্যাসীকে যেন সর্বদা লালন করতে পারি। গত দু’মাসের লকডাউনে মিনিম্যালিস্ট জীবনযাপন এবং তজ্জনিত শিক্ষা থেকে যেন কখনও ভ্রষ্ট না হই। কোনও বস্তুর সঙ্গে যেন অপরিসীম নৈকট্য না তৈরি হয়। কোথাও যেন বড় কোনও স্টেক তৈরি না হয়। যেন শিরদাঁড়া সোজা রাখতে পারি। পা যেন সর্বদা মাটিতে থাকে। আর মাথা থাকে কাঁধের উপর।
শেষ এন্ট্রির শেষপাতে এই লাইনগুলোও মন্ত্রের মতো বলা থাক—
‘অ্যান্ড আই উড চুজ ইউ;
ইন আ হান্ড্রেড লাইফটাইমস,
ইন আ হান্ড্রেড ওয়ার্ল্ডস,
ইন এনি ভার্সন অফ রিয়্যালিটি,
আই উড ফাইন্ড ইউ
অ্যান্ড আই উড চুজ ইউ।’