লকডাউন ডায়েরি – ২৩ মে, ২০২০

২৩.‌০৫.‌২০২০। শনিবার

ভোর ৫.‌১৫

কাল রাতে কফি আর ডায়েট চিড়ে দিয়ে ডিনার করেছি। আর কিছু খেতে ভাল লাগছিল না।

রাতে একটা গানের ‘লুপ’–এ ছিলাম। জয়তী চক্রবর্তীর গাওয়া ‘শ্রাবণের ধারার মতো’। সন্ধ্যার পর অফিসে বসে কাজ করতে করতে হেডফোনে গান শুনছিলাম। এটা প্রায়শই করে থাকি। বহুদিনের অভ্যাস। খুব মন দিয়ে কাজ করলে কানে হেডফোন রাখা। টু শাট দ্য আউটসাইড নয়েজ কমপ্লিটলি। তখনই জয়তীর গানটা কানে চলে এল। আর এল তো এলই!‌ বারবার শুনতে লাগলাম। তারপর একটা প্যাড টেনে নিয়ে পুরো গানটা লিখে ফেললাম।

তখনই আবিষ্কার করলাম, গানের একটা লাইনে রবিঠাকুর ‘তৃষা’ শব্দটার পাশাপাশি ‘ভুখ’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। লিখেছেন ‘নিশিদিন এই জীবনের তৃষার পরে, ভুখের পরে।’ অর্থাৎ, ‘তৃষা’–র মতো একটা আপাদমস্তক তৎসম শব্দের পাশাপাশি ‘ভুখ’–এর মতো একটা অকুলীন শব্দ লিখেছেন। কারণ, তাঁকে ‘দুখ’–এর সঙ্গে ছন্দ মেলাতে হবে। ‘ভুখ’ শব্দটাই সেখানে যায়। ‘ক্ষুধা’ বা ‘খিদে’ যায় না। দেখে আশ্বস্ত হলাম। কারণ, আমি অন্ত্যমিলের জয়ে বিশ্বাস করি। আমি হলাম ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’–র আদি এবং অকৃত্রিম পাঠক।

এ তো গেল গানের শব্দ নিয়ে চিন্তা। বাড়ি ফেরার পর বসলাম বিভিন্ন মহিলা গায়কের গাওয়া ‘শ্রাবণের ধারার মতো’ নিয়ে তুলনা করতে। জয়তী, শ্রাবণী সেন এবং অরুন্ধতী হোম চৌধুরি। বারংবার শুনে নিশ্চিত হলাম, এই গানটায় জয়তীই সেরা। গানটা তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‌‘আলো’ ছবিতে গেয়েছিলেন অরুন্ধতী। খুব একটা ভাল লাগল না। শ্রাবণী ভাল গেয়েছেন। খুবই ভাল গেয়েছেন। বলিষ্ঠ উচ্চারণ। যেমন উনি গেয়ে থাকেন।

কিন্তু এই গানটায় সেরা জয়তীই। গলায় একটা সমর্পণ আছে। সেটা ভারী ভাল। ‘একেবারে’ শব্দটাকে জয়তী যেভাবে উচ্চারণ করেছেন সামান্য এলিয়ে, কেয়াবাত!‌ প্লাস অসাধারণ মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট। গানটা ব্যবহৃত হয়েছে ‘শ্রাবণের ধারা’ ছবিতে। দেখছি লেখা আছে মিউজিক আশু–অভিষেক। সেক্ষেত্রে অ্যারেঞ্জমেন্টটাও তাঁদেরই হবে। দারুণ ব্যবহার আছে ভায়োলিন আর বাঁশির। অবিরাম হন্ট করতে থাকে। জয়তীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু যা শুনছি, তাতে মনে হচ্ছে তিনিই এখন অন্যতম শ্রেষ্ঠ। রবি ঠাকুর ওঁর মঙ্গল করুন।

লকডাউন আর ঘূর্ণিঝড়ের এই বিপর্যস্ত সময়ে যখন দক্ষিণবঙ্গ ধ্বস্ত, কলকাতা শহরের বিস্তীর্ণ এলাকায় জল নেই, আলো নেই, তখন একটা গান নিয়ে এতক্ষণ মেতে রইলাম কেন। কারণ, আমি বহির্জগৎকে ডিনায়ালে রাখতে চাইছি।

সকাল ৬.‌১৩

একটু আগে হোয়াট্‌সঅ্যাপে একটা লেখা পেলাম। ফেসবুক থেকে সংগৃহীত। লিখেছেন পলাশ হক নামে একজন। যিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের ইঞ্জিনিয়ার বলে। লেখাটা পড়ে মনে হল, এটাও কোথাও একটা ডকুমেন্টেড থাকা উচিত। দিস ইজ দ্য আদার সাইড অফ দ্য স্টোরি।

পলাশ লিখছেন—

‘যে পোস্টে আর যে ক্যাপাসিটিতেই চাকরি করি না কেন, দিনের শেষে আমি একজন ইমার্জেন্সি এমপ্নয়ি। আমি বিদ্যুৎকর্মী। বিশ্বাস করুন, গত ৪৮ ঘন্টায় আমাদের দপ্তরের কেউ ঘুমোয়নি। আমাদের মোবাইল ভ্যান, রেস্টোরেশন টিম দিনরাত এক করে ফিল্ডে আছে।

‘প্লিজ বুঝুন, দুই ২৪ পরগনা ধ্বংসস্তূপ হয়ে গিয়েছে। ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ জেলা। প্রতি কিলোমিটারে গড়ে ৭টা করে গাছ পড়ে আছে। গুনে শেষ করা যাবে না, এত পরিমাণ ইলেকট্রিক পোল ভেঙে পড়ে আছে সর্বত্র। যেগুলো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোরও বিশাল অংশ ড্যামেজ্‌ড। অগুন্তি জায়গায় ট্রান্সফর্মারে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। এমতাবস্থায় যদি পাওয়ার চার্জ করা হয়, মুড়িমুড়কির মতো মানুষ মরে পড়ে থাকবে। জমা জলে, ছেঁড়া তারে যে পরিমাণ ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্সিডেন্ট হবে, তা ধারনার বাইরে। বাড়ি, ঘরদোর আর ইন্টারনাল অয়্যারিংসের যা ক্ষতি হয়েছে, বাদই দিলাম। এটা ইলেকট্রিক্যাল নেটওয়ার্ক। সাপের ছোবলের মতো ভয়ানক একটা ব্যাপার।

‘রাজ্য জুড়ে এই ভাস্ট ইলেকট্রিক্যাল নেটওয়ার্কটা যেভাবে লন্ডভন্ড হয়েছে, তা আগের জায়গায় রেস্টোর করতে গেলে যতদিন লাগা উচিত, আমরা সকলেই জানি, ততদিন আপনারা দেবেন না। জল, আলো, চার্জ, ইন্টারনেট না–থাকায় অনেকেই অস্থির হয়ে উঠেছেন। স্বাভাবিকও। কিন্তু বুঝুন, যারা কাজ করছে নাওয়াখাওয়া ভুলে, তারাও মানুষ। তাদেরও পরিবার আছে, সংসার আছে এবং লিখে রাখুন, এই রেস্টোরেশন প্রসেসে তাদেরও অনেকে প্রাণ হারাবে। সামান্য ভুলে পোলের মাথায় কাজ করতে করতে ঝরে পড়বে মৃতদেহ। এটা হয়। এটা হয়েই থাকে।

‘ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অফিসে চড়াও হওয়া শুরু হয়েছে। টেবিল–চেয়ার উল্টে মারধর করা হচ্ছে কারেন্ট নেই বলে। মার খাচ্ছে কর্মীরা। ঝড়ে আমার নিজের বাড়িতে এখনও চুরমার হয়ে থাকা কাচ পড়ে আছে সর্বত্র। জল নেই। সেসব অ্যাড্রেস করার সময়ও নেই। আমরা সহামুভূতি চাই না। শুধু এটুকু বুঝুন। সহযোগিতা করুন। পার্শিয়াল চার্জিং শুরু হয়েছে। যুদ্ধকালীন সার্কুলার হয়েছে। ড্রিঙ্কিং ওয়াটার সোর্স, ইরিগেশন সোর্স, হাসপাতাল এবং টেলিকম টাওয়ারের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে।

‘দু–তিনটে দিন একটু কষ্ট করে সহ্য করে নিন। অন্তত নিজেদের স্বার্থে। প্লিজ।

পলাশ ছাড়াও অনির্বাণ বলে সিইএসসি–র এক কর্মীর লেখাও ফেসবুকে শেয়ার করেছে অদিতি। সেটা আরও ডিস্টার্বিং। পড়ে মনে হল, সত্যিই তো। এঁরাও তো পেশাদারই। এঁরাও তো জানপ্রাণ দিয়ে খেটে শহরটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কষ্ট হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে। ঠিকই। কিন্তু এঁরা কেউ তো গিয়ে আমার–আপনার বাড়ির লাইনটা কেটে দিয়ে আসেননি। বরং জোড়ার চেষ্টা করছেন। এঁদের কাজটা তো এঁদের করতে দিতে হবে।

কিন্তু এসব ধর্মের কাহিনি এখন কে আর শুনতে যায়!‌

সকাল ৯.‌৩০

রাহুল গান্ধী কিন্তু এবার সিরিয়াসলি সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছেন! ‌হরিয়ানা থেকে আগত কিছু পরিযায়ী শ্রমিক, যাঁরা হাঁটতে হাঁটতে উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি যাচ্ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি। আজ সকাল ৯টা থেকে রাহুলের ইউটিউব চ্যানেলে সেটা সম্প্রচারিত হল।

রাস্তায় থেবড়ে বসে রাহুল যেভাবে শ্রমিকদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন, তাতে তাঁকে হুবহু অডিও ভিস্যুয়াল চ্যানেলের সাংবাদিক মনে হচ্ছিল। শ্রমিকরা লকডাউনে তাঁদের দুর্দশার কথা জানাচ্ছিলেন রাহুলকে। বিস্তারিত আলাপচারিতা। রাহুল প্রশ্ন করছিলেন, তাঁদের মাসিক রোজগার কত। এভাবে এত কম নোটিসে লকডাউন জারি করা উচিত ছিল কিনা। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের জন্য এ যাবত কী কী করেছে ইত্যাদি।

প্রশ্ন–টশ্ন করার ভঙ্গি একেবারে পেশাদার সাংবাদিকের মতো। তফাত হল, রাহুলকে ওই শ্রমিকদের প্রতিশ্রুতিও দিতে হল। বলতে হল, তিনি যা যা করণীয় করবেন। পেশাদার সাংবাদিকের সেই দায় নেই। পেশাদার সাংবাদিকের সেই দায় থাকে না।

সকাল ১০.‌০৪

ভোডাফোন তো কার্যত দেহ রেখেইছিল। এখন বিভিন্ন দিক থেকে শুনছি, এযারটেলও ঝোলাতে শুরু করেছে। অধিকাংশ গ্রাহক ভাবছএন, জিও–তে মুভ অন করে যাবেন। জিও–তে নাকি একেবারে ল্যান্ডলাইনের মতো পরিষ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানে ভোডাফোন বা এয়ারটেলে কথা বলতে গেলে মিনিটে দু–তিনবার কল ড্রপ করে যাচ্ছে। কারণ, জিও–র অপটিক্যাল ফাইবার গিয়েছে মাটির তলা দিয়ে। ঘূর্ণিঝড় সেখানে দাঁত ফোটাতে পারেনি। পারবে না।

বারবার একটা কথা মনে হয়। কোনও সভ্য এবং আধুনিক শহরের আকাশে কেন তারের জাল থাকবে। কেন সমস্তকিছুর সংযোগকারী তার এতটা এক্সপোজ্‌ড হয়ে থাকবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সেই তার ছিঁড়ে পড়লে গোলমাল তো হবেই। কিন্তু কলকাতার মতো শহরে তো আবার রাস্তা পুরো খুঁড়ে ফেলে ভূগর্ভস্থ কেব্‌ল বিছিয়ে দেওয়া যাবে না। জনতা অত কষ্ট নেবে না। সহ্যও করবে না।

ফলে এখন মাসুল গুনতে হবে। গুনতেই হবে।

বেলা ১১.‌৩৫

দিকে দিকে আবার পানীয় জল আর বিদ্যুতের দাবিতে পথ অবরোধ, বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। কোথাও কোথাও টানা ৭০ ঘন্টা কারেন্ট নেই। রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ মানুষ। পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। বিক্ষোভ হচ্ছে কলকাতায়। বিক্ষোভ হচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও। কোথাও জেনারেটর চালিয়ে ট্যাঙ্কে জল দেওয়ার জন্য ৫০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে। কোথাও লোকাল কোনও হাফ মিস্তিরিকে ধরে বাড়ির আলো–পাখা চালানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। আবার কোথাও এসইবি অথবা সিইএসসি–র লোকজন ফল্ট সারাতে গেলে ঠ্যাঙানি দেওয়া হচ্ছে।

আসলে আমরা কলকাতার বাসিন্দারা তো বটেই, প্রশাসনও ঘূর্ণিঝড়টাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিল বলে মনে হয় না। কারণ, আমরা সবসময় দেখে এসেছি ঝড়ঝাপ্টা যাই–ই হোক, সেটা কলকাতাকে সেভাবে স্পর্শ করে না। আমরা জানি, প্রথমে ওটা সুন্দরবনে হিট করবে। সেখানে কিছু নদীবাঁধ ভাঙবে। বাড়িঘর ভাঙবে। কিছু গ্রাম জলমগ্ন হবে। কিছু প্রাণহানি হবে। তারপর ঝড়টা বাংলাদেশে চলে যাবে।

স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম কলকাতা এত ধ্বংস দেখেছে। এই প্রথম কলকাতাবাসী বুঝতে পেরেছে প্রকৃতির রোষ কাকে বলে!‌ এই প্রথম ধ্বংসের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে আমার–আপনার শহর। এবার আমাদের গায়ে লাগছে।

মুখ্যমন্ত্রী আজ গিয়েছেন আকাশপথে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখতে। তারপর কাকদ্বীপে প্রশাসনিক বৈঠক। দেখছি, সেখানে তিনি বলেছেন, সিইএসসি একটি বেসরকারি সংস্থা। তারা বাম আমল থেকে কলকাতা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে। ফলে এই সরকারের তাদের কিছু বলার নেই। পাশাপাশিই মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, প্রয়োজন হলে দেড়শো জেনারেটর ভাড়া করে সিইএসসি কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করুন। আর বলেছেন, তিনি এবং কলকাতা পুরসভার প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম গত তিন–চারদিন ঘুমোননি।

দুপুর ১২.‌১৩

নেটওয়ার্কের খানিকটা উন্নতি হয়েছে দেখছি। কাল রাতেও মোবাইল হাতে করে ঘরের বিভিন্ন জায়গায় নেটওয়ার্ক খুঁজতে হয়েছে। অথবা বিছানায় শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে একটা পায়ের উপর বিশেষ অ্যাঙ্গলে মোবাইল তুলে ধরে রাখতে হয়েছে। বিভিন্ন কারণে গত কয়েকদিন ধরে ওয়ার্কআউট করা হচ্ছে না। কিন্তু মোবাইলের সিগনাল খুঁজতে গিয়ে যেভাবে দেহ বিভিন্নভাবে বাঁকাতে–চোরাতে হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে শারীরিক কসরত এমনিতেই হয়ে গিয়েছে।

দুপুর ১.‌১০

কলকাতা পুরসভার কমিশনার খলিল আহমেদকে সরিয়ে দেওয়া হল।

গত কয়েকদিন ধরেই ফিরহাদকে একটু অসহিষ্ণু এবং ক্রুদ্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে, চাপটা নিতে পারছেন না। চাপ আছে ঠিকই। গভীর চাপ। একদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড়। ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। কিন্তু বড় প্লেয়ারদের তো বড় চাপ সামলাতে হবেই। গতকাল যেভাবে ফিরহাদ বলে বসলেন, তাঁরা হাতে যাদুদণ্ড নেই, সেটা দেখে মনে হল নার্ভ ধরে রাখতে পারছেন না। তাতে এই শহরের মানুষ তাঁর উপর আরও কুপিত হতে পারেন।

বস্তুত, আজও ফিরহাদ বলেছেন, ‘সাতদিনের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’ পরিস্থিতির সাপেক্ষে এটা সত্যবচন হতে পারে। কিন্তু এখন সে কথা বলার সময় নয়। এখন আগে মানুষকে কনফিডেন্সে নিতে হবে।

কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট বলে, আগে সমস্যাটাকে অ্যাকনলেজ করতে হবে। অ্যাকনলেজ করা মানে কিন্তু অ্যাপোলোজাইজ করা নয়। ক্ষমাপ্রার্থনা নয়। সমস্যা যে আছে, প্রথমেই সেটা স্বীকার করে নেওয়া। মানুষ সেটাই চায়। চায় যে তার সমস্যার কথাটা স্বীকার করা হোক। মানুষ সেই মনোযোগটুকু দাবি করে। তার বদলে যদি বলা হয়, আমি কী করব?‌ বা আমার হাতে তো ম্যাজিক স্টিক নেই!‌ তাহলে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পায়। অতএব প্রথমে বলতে হবে, আই অ্যাম সরি ফর ইয়োর পেইন। আই অ্যাম সরি ফর ইয়োর প্রবলেম। অর্থাৎ, আপনার সমস্যা হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। আপনার যন্ত্রণার জন্য আমি দুঃখিত।

ব্র্যাকেটে, আমার কিন্তু কোনও দোষ নেই। তবে সহানুভূতি আছে।

সেখানে কারও কাছে নতিস্বীকার করার গল্প থাকে না। কিন্তু গোলমালটা অর্ধেকেরও বেশি কমে যায়। সমস্যায় পড়লে মানুষের ধৈর্যচ্যুতি হবেই। তাঁদের সামলাতে হলে আগে তাঁদের কনফিডেন্সে নিতে হবে। নার্ভ হারিয়ে ঝামেলা আরও বাড়িয়ে দিলে মুশকিল।

দুপুর ২.‌১০

দিলীপ ঘোষ এবং বিজেপি কর্মীদের সঙ্গে বৈষ্ণবঘাটার অদূরে ঢালাই ব্রিজে বচসা এবং হাতাহাতি তৃণমূল কর্মীদের। দিলীপের বক্তব্য, তিনি ত্রাণ দিতে যাচ্ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। পুলিশ তাঁকে আটকে দিয়েছে। খবর পেয়ে আসেন বিজেপি কর্মীরা। তাঁদের সঙ্গে তৃণমূলের কর্মীদের হাতাহাতি হয়। দিলীপের বক্তব্য, তাঁর দলের এক কর্মীর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঢালাই ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দিলীপ বলছেন, ‘এই রাজনীতিই যদি করতে হয়, তাহলে আমিও তৈরি আছি!‌ এবার কিন্তু লাশ গুনতে হবে!‌’

দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, দিলীপকে রাস্তায় এভাবে আটকে কেন ফুটেজ খাওয়ার সুযোগ করে দেয় তৃণমূল?‌ তিনি যদি বিনাবাধায় যেখানে যাওয়ার যেতেন এবং ত্রাণ দিয়ে ভালয় ভালয় ফিরে আসতেন, তাহলে কি এই ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ হতো?‌ অথবা দিলীপও কি পাল্টা হুঁশিয়ারি দেওয়ার সুযোগ পেতেন?‌ দিলীপকে আটকে দিয়ে আসলে তাঁকে প্রাসঙ্গিক হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে না তো তৃণমূল?‌

দুপুর ৩.‌১৫

বিজেপি নেতা রাহুল সিন্‌হা সাংবাদিক বৈঠক করে দাবি করছেন, কলকাতায় সেনা নামানো হোক। পাশাপাশিই, পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাল সমস্ত রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বৈঠক করুক প্রশাসন।

এই নজিরবিহীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে সেনা এখনও কেন নামানো হচ্ছে না, সেটা সত্যিই বোঝা যাচ্ছে না। ফৌজের কাছে অনেক উন্নত ইকুইপমেন্ট আছে। ফোর্স আছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা মেনে অধিকাংশ সরকারি দফতরে কর্মীরা আসতে পারছেন না। কিন্তু সেনাবাহিনীর তো ওসব বালাই নেই। তাদের কোনও পিছুটানও নেই। তারা আগুপিছু দেখে না। স্রেফ অন্ধের মতো তীব্র একমুখিতা নিয়ে কাজটা করে দেয়।

বিকেল ৪.‌০০

অবশেষে সেনাবাহিনীকে ডাকল রাজ্য সরকার। এইমাত্র রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর টুইট করে জানিয়েছে।

টুইটে বলা হয়েছে, রেল, বন্দর এবং অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে কর্মী এবং ইকুইপমেন্ট চাওয়া হয়েছে। ঠিক হয়েছে, জরুরি পরিষেবা যথাসম্ভব দ্রুত চালু করার জন্য যৌথ কমান্ডে কাজ করা হবে। জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন রাস্তার গাছ কাটা এবং সরানো শুরু হবে। পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে রাজ্য জনস্বাস্ত্য কারিগরি দফতরকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় জলের পাউচ বিলি করতে। জেনারেটরও ভাড়া করা হচ্ছে অথবা অন্যান্য সংগঠনের কাছ থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে।

বিকেল ৫.‌০৫

কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ধরেছে টিভি। গোলপার্কের বহুতলে দশতলার ছাদে দাঁড়িয়ে তিনি বলছেন, ‘আমি ঘোলা জলে মাছ ধতে নামিনি। কিন্তু কলকাতার এই অবস্থা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। সাতদিন ধরে আমফানের সতর্কবার্তা ছিল। তা সত্ত্বেও এই অবস্থা হল। তাহলে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও একটা গাফিলতি থেকে গিয়েছে। কোথাও না কোথাও ব্যর্থতা ছিল পুরসভার। ওরা হয়তো বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি।’

এখানে একটা ফুটনোট আছে—‌ শোভন কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই ফ্রেমের একপ্রান্তে দেখা গেল বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তারপর যতক্ষণ শোভন কথা বললেন, ততক্ষণই কখনও না কখনও ফ্রেমের কোনও না কোনও প্রান্তে দেখা গেল বৈশাখীকে।

সন্ধ্যা ৬.‌০০

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী। এবং তিনি যথেষ্ট বিরক্ত। যাঁকে কোনও একটা প্রশ্নের জবাবে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আমি কী করব? ‌হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে পারি। নইলে আমার মুন্ডুটা কেটে নিন!‌’

আরও বলছেন, ‘প্রেসের কাছে কি এইটুকু দায়বদ্ধতা আশা করতে পারি না, যে আপনারা সরকারের পাশে দাঁড়াবেন?‌ কিছু কিছু সাংবাদিক আছেন, পার্টি মাইন্ডেড। তাঁরা এগুলো করবেন না!‌’

মানুষের কাছে ধৈর্য ধরার আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, সিইএসসি–র কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সঙ্গে তিনি একাধিকবার কথা বলেছেন। সঞ্জীবের সঙ্গে কথা বলেছেন মুখ্যসচিবও। পাশাপাশিই মুখ্যমন্ত্রী জানাচ্ছেন, রেলকে রাজ্য সরকার অনুরোধ করেছে ২৬ তারিখ পর্যন্ত বিশেষ ট্রেন না চালাতে। কারণ, স্টেশন থেকে লোকজন নিয়ে বাসগুলো গ্রামে ঢুকতে পারবে না। ঝড়ের প্রকোপে সমস্ত রাস্তা ভেঙে গিয়েছে। সেগুলো সারানোর জন্য দু’দিন সময় চাওয়া হয়েছে রেলের কাছে। যা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘তার পরে যাঁরা আসবেন, তাঁদের বাড়িতেই ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। এখন তো শুনছি, ২৫ তারিখ থেকে ডোমেস্টিক ফ্লাইট চালু হবে। আমি চিফ সেক্রেটারিকে বলছি, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানাতে, যাতে এই রাজ্যে ২৫ নয়, ৩০ তারিখ থেকে প্লেন চালানো হয়।’

সন্ধ্যা ৬.‌৩৭

বিদ্যুতের দাবিতে বিজন সেতুতে অবরোধ স্থানীয় মানুষের। কসবাতেও অবরোধ। অন্যদিকে, সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনীকে দেখা যাচ্ছে। তারা ইলেকট্রিক করাত এবং ইউসিবি নিয়ে নেমে পড়েছে গাছ কাটতে। কলকাতায় পরিস্থিতি মোকাবিলায় মোট পাঁচ কলাম সেনা আসছে রাজ্য সরকারের অনুরোধে।তিন কলাম থাকবে শহরে। বাকি দু’কলাম যাবে গ্রামে।

কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা রাজ্যের বর্তমান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলছেন, তাঁরা এখন ক্লান্ত ঘোড়া। তাঁদের চাবুক মারলে হবে না। পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু সময় লাগবে। আরও বলছেন, ‘সাতদিন আগে থেকে পূর্বাভাস ছিল। ফলে পুরো তৈরি হতে সময় পাওয়া গিয়েছিল।’ কিন্তু তার সঙ্গে যেটা বলছেন, সেটা বড় পলিটিশিয়ানের হলমার্ক— ‘মানুষের ক্ষোভ স্বাভাবিক।’

অর্থাৎ, কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্টে মানুষের সমস্যাকে আগে গুরুত্ব দেওয়া।

রাত ৮.‌২৮

সিইএসসি–র সদর দফতর ভিক্টোরিয়া হাউসে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং!‌ সঙ্গে ছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা। তবে সেখানে তিনি বেশিক্ষণ থাকেননি। কিছুক্ষণ থেকে সঞ্জীবের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে বেরিয়ে যান। ঘটনাচক্রে, তার কিছুক্ষণ আগে সিইএসসি–র তরফে সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পরিস্থিতির উন্নতি কবে হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

এর আগে কোনও মুখ্যমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া হাউসে গিয়েছেন বলে মনে করতে পারছি না। যে নজিরবিহীন ঘটনা থেকে স্পষ্ট— বিদ্যুৎহীনতার সমস্যাটা যথেষ্ট ঘোরাল জায়গায় পৌঁছেছে। নইলে মুখ্যমন্ত্রী সিইএসসি–র সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে যেতেন না।

রাত ৮.‌৪৬

আবার বিক্ষোভ বেহালায়। রাস্তায় নেমে এসেছেন সাধারণ মানুষ। বলছেন, নিজেদের পকেট থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করে রাস্তা থেকে গাছ সরিয়েছেন। তারপরেও সিইএসসি আসেনি ফল্ট মেরামত করতে। বিক্ষোভ রাজারহাটে। সেখানে পুলিশকে ঘিরে ধরে তুমুল কটূক্তি চলছে। যা খানিকক্ষণ পরে হেনস্থায় পরিণত হলে খুব এঅবাক হব না।

রাত ১০.‌৪২

দিনের কাজ শেষ। বাড়ি ফিরব এবার। জানি, ফেরার পর যৎসামান্য খাবার খেতে খেতে এবং খাবার খেয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়তে পড়তে টানা তিনদিন পানীয় জল ও বিদ্যুৎ না পেয়ে ক্রুদ্ধ কলকাতার বাসিন্দাদের কথা মনে পড়বে। মনে পড়বে সেই সহ–নাগরিকদের কথা, যাঁরা বাড়িতে মোমবাতি জ্বেলে বসে আছেন ভুতুড়ে অন্ধকারে। বা রাস্তায় নেমে এসেছেন। বিদ্যুতের অভাবে যাঁদের বাড়ির রেফ্রিজারেটর চলছে না। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীবনদায়ী ওষুধ।

মনে পড়বে সুন্দরবনের ধুয়ে–যাওয়া বাঁধের উপর ত্রাণের আশায় হন্যে চেহারাগুলো। মনে পড়বে এলাকার মহিলাদের হাতে হাতে বাঁধ তৈরির ছবি।

খারাপ লাগবে। কিন্তু সেটারও উপায় আছে। ওই মুখগুলোকে পুরোপুরি ডিনায়ালে রাখতে হবে।

আজ রাতে বরং দেশভক্তির গান শুনি?‌

3 thoughts on “লকডাউন ডায়েরি – ২৩ মে, ২০২০

  1. আপনার ডায়েরি পড়াটা আমার নিত্যদিনের ডায়েরীতেও জুড়ে গেছে। ‘অনু’ নয় অনেক প্রেরণা পাই। তুলনা নয় তবুও ঋতুপর্ণর ফার্স্ট পার্সন মনে করিয়ে দেয়। আমি নিজে একজন শিল্পকলার ছাত্র তাই হয়ত আরো পছন্দ হয় আপনার ব্যক্তিগত উদ্যানে হাঁটাচলা করতে। রসদে পূর্ণ এই অভ্যাস করনাঘটিত লকডাউনের শেষে শেষ করে দেবেন না। অজীর্ণ রোগীদের পায়চারিটা দরকার, আর উদ্যান চলে গেলে কোথায় পায়চারি করব ? আমার অনুরোধে স্পর্ধা থেকে গেলে ক্ষমা করবেন।
    অয়ন

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s