লকডাউন ডায়েরি – ২২ মে, ২০২০

২২.‌‌০৫.‌২০২০। শুক্রবার

সকাল ৮.‌৩৫

কাল অনেক রাতে আকাশে প্লেন ওড়ার আওয়াজ পেয়েছিলাম। মনে হল , আমপানের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে প্রধানমন্ত্রী রাতেই চলে এলেন নাকি?‌ তারপর মনে হল, সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবাহিনী এসেছে। যারা ভিভিআইপি মুভমেন্টের আগে আসে ‘অ্যাডভান্স পার্টি’ হিসেবে। যেমন বাঘের আগে ফেউ।

আবার ফটফটে রোদ্দুর উঠেছে। গরমে দফারফা। কে বলবে, ৪৮ ঘন্টা আগে আকাশের রংটাই অন্যরকম ছিল। কাল অনেক রাতে ঘুমিয়েছি। তাই আজ উঠতে একটু দেরিই হয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে বাবা–মা’কে চা দিলাম। গোটা বাড়িতে ঝরাপাতা পড়ে আছে। হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। মনে হচ্ছে, যথাসম্ভব দ্রুত ঘরগুলো পরিষ্কার করতে হবে। শরীর খিতখিত করছে দেখে। বারান্দায় শুকনো পাতার স্তূপ। দোতলার ড্রয়িংরুমের দরজা বন্ধ থাকলেও যে কী করে এত শুকনো পাতা ভিতরে ঢুকে পড়ল কে জানে!‌

এখনও টিভি ডাউন। তবে নেট একটু একটু কাজ করছে। পুরোপুরি নয়। ভোডাফোন কাজ করছে নিজের ইচ্ছেমতো। যখন ইচ্ছে, থাকছে। যখন ইচ্ছে, যাচ্ছে। কাল রাত পর্যন্তও মোবাইলটা পেপারওয়েটের মতো ছিল। মানে, কাগজ চাপা দিয়ে রাখা ছাড়া যার আর কোনও ইউটিলিটি নেই। এখন অতটা খারাপ অবস্থা নয়। নেট একটু একটু ফিরে আসার পর চারদিক থেকে যা খবর পাচ্ছি, তাতে ঘূর্ণিঝড়ের পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। কলকাতা–সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। পানীয় জল নেই। চারদিকে হাহাকার। তবু রক্ষে, সল্টলেকে বিদ্যুৎ আছে। জলও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তা–ও কোথায় একটা বিরক্তি লাগছে।

করোনার সঙ্গে যুদ্ধে লকডাউন জীবনধারনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোর খামতি ছিল না। বাড়িতে থাকলেও শান্তিতে থাকা যাচ্ছিল। ঘূর্ণিঝড় সেই প্রশান্তি একটানে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। বাড়ির মানুষগুলো এখন রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন। কে জানে কপালে আরও কত ভোগান্তি আছে।

সকাল ৯.‌১৭

যা ভেবেছিলাম!‌ রাজ্যপাল ঠিক উঠে পড়ছেন প্রধানমন্ত্রীর হেলিকপ্টারে। নিজেই আবার সেটা টুইট করে জানিয়ে দিয়েছেন সকাল সকাল। গত তিন দশকের পেশাগত জীবনে বহু সেল্‌ফ প্রমোটার দেখেছি। আমাদের প্রফেশনেও কিছু এমন জিনিয়াস আছেন, যাঁরা নিজেদের প্রমোশনকে শিল্পের পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান রাজ্যপালের কাছে এঁরা সকলে দুগ্ধপোষ্য শিশু। বস্তুত, চাইলে রাজভবনে গিয়ে সাতদিনের ক্র্যাশ কোর্সও করে আসতে পারেন।

এনিওয়ে, যা শুনছি, রাজ্যপাল প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একই কপ্টারে থাকবেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যে রাজ্যপালের বাক্যালাপ হবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। কৌতূহল হচ্ছে কপ্টারের ভিতরে সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট নিয়ে। জনশ্রুতি অথবা রাজভবনের দাবি:‌ প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকেই নাকি রাজ্যপালকে একই কপ্টারে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। হতে পারে।

দু’টি কপ্টার যাচ্ছে দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে। একটিতে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল। দ্বিতীয়টিতে রাজ্য থেকে দুই হাফ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এবং দেবশ্রী চৌধুরী।


আকাশ থেকে পরিস্থিতি দেখাটা যুগে যুগে, কালে কালে হয়ে আসছে। কিন্তু বরাবরই ব্যাপারটা একেবারে প্রতীকী বলে মনে হয়। যা চরাচরে এই বার্তা প্রেরণ করে যে, ঘটনাটা বড়। এবং এই বড় বিপর্যয়ে আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। সিদ্ধান্ত মোটামুটি আগেই নেওয়া থাকে। এবার সেটা ঘোষণা করার আগে তার উপর একটু সরেজমিনে সফরের পোঁচ বুলিয়ে নেওয়া।

ঘটনাচক্রে, এমন কিছু আকাশ–সফরে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রতিবারই দেখেছি, ভিভিআইপি কোলে ম্যাপ নিয়ে তার সঙ্গে মিলিয়ে নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ে দেখছেন। কারণ, এসব ক্ষেত্রে নীচে অগাধ জলরাশি থেকে কোথাও কোথাও জেগে–থাকা উঁচু বাড়ির মাথা বা বাঁধের উপর আশ্রয় নেওয়া দুর্গত মানুষ ছাড়া সচরাচর কিছু দেখা যায় না। মানুষগুলো ভাবেন, আকাশপথে ত্রাণ আসছে। হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। বাচ্চা থেকে বুড়োর মেলে–ধরা প্রত্যাশী কান তাড়া করে ফেরে আকাশযানের রোটর ব্লেডের কানফাটানো শব্দ। তাঁরা জানেন না, ভিভিআইপি কপ্টারে ত্রাণ আসে না। ওই কপ্টারের পেটে ভিভিআইপি–র সঙ্গী মন্ত্রী–অমাত্যরা তাঁকে বোঝাতে থাকেন, কোন এলাকায় কী হয়েছে। ত্রাণ ও পুনর্গঠনে কী বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। মোদ্দা কথায়— ভিভিআইপি–কে কনভিন্স করা।

প্রধানমন্ত্রীর এই সফরও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।

সকাল ১০.‌০০

গাড়িটা এখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। স্টার্ট করলেই ফটফট ফটফট করে একটা আওয়াজ হচ্ছে ক্রমাগত। শস্তার জেনারেটরে যেমন হয়। প্রকৃতিগতভাবে আমি বর্ডারলাইন ওসি। অর্থাৎ, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। একটু ধাক্কা দিলেই চৌকাঠ পেরিয়ে রোগটার ভিতরে ঢুকে পড়ব। ফলে গাড়িতে এই আওয়াজ প্রাণে সইছে না।

প্রমোদকে ফোন করলাম। বলল, ‘চলে আসুন ১১টার সময়। দেখে দিচ্ছি।’ এটা একটা বাড়তি কাজ যোগ হল আজকের মেনুতে। এবং এমন একটা কাজ, যা কতক্ষণ খেয়ে নেবে কেউ জানে না। মনে হচ্ছে না, বাবা–মা’কে ঠিক সময়ে আজ দুপুরের খাবারটা দিতে পারব।

সকাল ১০.‌৩৫

লকডাউনের জেরে শূন্যেরও নীচে নামবে দেশের জিডিপি। সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়ে দিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস।

দুপুর ১.‌৪৫

এই বাড়ি ফিরলাম। এবং হুটোপুটি করে বাবা–মা’কে খেতে দিলাম। তারপর বাড়ির দুটো তলা ঝেঁটিয়ে সাফও করলাম। এরপর ডায়েরিতে এন্ট্রি করে, স্নান করে, নাকেমুখে দুটো গুঁজে অফিসে যেতে একটু দেরিই হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। যাকগে যাক। আমি এমনিতে খুবই ওবিডিয়েন্ট চাকর। মাঝেমধ্যে এক–দু’দিন দেরি হয়ে গেলে নিশ্চয়ই ক্ষমা পাব। এই চাকরবৃত্তি নিয়েও আমার একটা থিওরি আছে। সেটাও এই ডায়েরিতে লেখা থাকা দরকার।

এনিওয়ে, গত কয়েকঘন্টার ‘ইন্ট্রো’ হল গাড়ির সমস্যা মেটানো যায়নি। মেটাতে পারেনি প্রমোদ। ঠিক ১১টায় হাজির হয়েছিলাম নয়াপট্টির গ্যারাজে। সমস্যা শুনে এবং গাড়িটা একচক্কর চালিয়ে প্রমোদকে খুবই নিশ্চিন্ত মনে হল। অতঃপর বনেট খুলে খুটখাট শুরু হল। আমি রাস্তার পাশের একটা রোয়াকে গাছের ছায়ায় বসলাম। এবং পরের দেড়ঘন্টা কখনও বসলাম। কখনও দাঁড়ালাম। বসে বসেই দেখলাম, আকাশে পর পর দুটো এমআই–৬ হেলিকপ্টার উড়ে গেল। সেই দু’টি ঘটনাবহুল হেলিকপ্টার।

গাড়ির পুরনো মবিল বদলে নতুন মবিল ঢালা হল। চারটে স্পার্ক প্লাগ বদলানো হল। কার্বুরেটর খুলে সাফসুতরো করা হল। সেখান থেকেও কিছু সল্টলেকের বালিমিশ্রিত জল বেরোল। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না। মহার্ঘ গাড়ি থেকে শস্তার জেনারেটরের আওয়াজ বেরোতেই লাগল।

অবস্থা দেখে পাশের গ্যারাজের একজন বড় এবং একজন মেজো মিস্ত্রি এলেন। তাঁরা দেখেশুনে রায় দিলেন, ইঞ্জিনের নীচে দু’নম্বর ভাল্‌ভটা বসে গিয়েছে। তাই ওই আওয়াজটা হচ্ছে। আপাতত এই অবস্থাতেই চালাতে হবে। তবে খুব জোরে চালানো যাবে না। ওইভাবে চালাতে চালাতে কপাল ভাল থাকলে ভাল্‌ভ আবার সিধে হয়ে যেতে পারে। নইলে হাফ ইঞ্জিন ডাউন করতে হবে। সে দিনসাতেকের ধাক্কা। কিন্তু গাড়ি ছাড়া তো আমার জীবন অচল। প্রমোদ বলল, ‘লকডাউন উঠলে কোম্পানির ওয়ার্কশপে দিতে পারেন। আমাদের কাছেও দিতে পারেন। যেটা আপনি ভাল বোঝেন। কিন্তু যেখানেই দিন, খর্চা আছে।’

তা আর নেই?‌ কোমরজলে গাড়ি নামিয়ে বিরল প্রজাতির গাধামি করেছি। মাসুল তো দিতেই হবে।

প্রমোদকে বললাম, কত দেব?‌

ছাব্বিশ বছরের সদ্যবিবাহিত যুবক ব্যাজার মুখে বলল, ‘কাজটাই তো হল না স্যর। কী আর টাকা দেবেন?‌ এত খাটাখাটি করলাম। এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করলাম। কাজটা হয়ে গেলে ৪০০/‌৫০০ টাকা যা দিতেন খুশি হয়ে দিতেন। কিন্তু কাজটা তো করে দিতে পারলাম না। কী করে টাকা নেব বলুন?‌’ শুনে অবাক লাগছিল। সারাতে না পারুক, দেড়টি ঘন্টা তো এই গরমে ঘাম ঝরিয়েছে। একবার মনে হল, জোর করে দিয়েই দিই কিছু টাকা। তারপর মনে হল, ওটা সম্ভবত ওর আত্মসম্মানকে আহত করবে।

গাড়ি ঘুরিয়ে চললাম উল্টোডাঙায়। মায়ের পেনশনটা যদি তোলা যায়। ঘূর্ণিঝড় আর কোভিডের জোড়াফলায় বিধ্বস্ত শহর। এখনই সুযোগন্ধানী স্ট্রাইকারের মতো ছোঁ মেরে গোলটা করে নিতে হবে। নিলামও। ব্যাঙ্ক প্রায় খালি। ভিতরে এবং বাইরে। সামাজিক দূরত্ব মেনটেন করে মিনিট পঁচিশের মধ্যে টাকা তুলে ফেললাম। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হল, একজন ব্যাপক লোককে চিনলাম।

মুখে মাস্ক। হাতে পার্পল রংয়ের সার্জিক্যাল গ্লাভস। পরনে জিন্‌সের ট্রাউজার্স আর ফুলস্লিভ চেক শার্ট। দাপিয়ে রেখেছেন গোটা ব্যাঙ্ক। মাস্ক না পরে এলে কাউকে ঢুকতেও দিচ্ছেন না। চড়াগলায় হাঁক পেড়ে নির্দেশ দিচ্ছেন সহকর্মী এবং কাস্টমারদের। প্রান্তিক পরিবার থেকে–আসা, টিপসই দিয়ে টাকা–তোলা গ্রাহকদের বকাবকি করছেন। কিন্তু আবার নিজ দায়িত্বে সহায়তাও করছেন। একজন যেমন একটু উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন। ঝড়ে ঘর ভেঙে গিয়েছে। মিস্ত্রি লাগিয়ে এসেছেন। ১৫ হাজার টাকা তুলবেন। কিন্তু ১০ হাজারের বেশি তুলতে অন্তত চারজন সাক্ষী চাই। এই বাজারে সাক্ষী কোথায় পাবেন?‌ মহিলা চিল চিৎকার জুড়েছেন।

ভদ্রলোক এগোলেন। আঙুল তুলে বললেন, ‘আর একবার চেঁচালে একটা টাকাও দেব না!‌ সকলেই সমস্যায় আছে। আপনার ঘর ভেঙেছে। আর আমার বাড়িতে গত দু’দিন কারেন্ট নেই। তা–ও রোজ ব্রাঞ্চে আসছি। একদম চুপ করে থাকুন!‌’ তারপর তিন সহকর্মীকে ডেকে বললেন, ‘সই করুন।’ চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে নিজে উইথড্রয়াল স্লিপে সই করে দিলেন। এক প্রবীণা বারবার মাস্ক খুলে ফেলছেন। তাঁকে সটান বললেন, ‘মাস্ক না পরলে ভিতরে ঢুকতেই দেব না। আপনি আমার মায়ের বয়সী। আপনার ভালর জন্যই মাস্কটা পরতে হবে। আগে পরুন। তারপর ভিতরে ঢুকতে দেব।’

মৃদু ঝাড় খেলাম আমিও। কারণ, দয়াপরবশ হয়ে সেই মাস্ক–হীন নিরক্ষর প্রবীণার টাকা তোলার স্লিপটা লিখে দিয়েছিলাম। দূর থেকে দেখেই উঁচুগলায় ব্যাঙ্ক অফিসার বললেন, ‘উনি মাস্ক পরেননি দেখতে পাচ্ছেন না?‌ আপনি কেন ওঁর স্লিপ লিখে দিচ্ছেন?‌’ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কলম সরালাম। মহিলা আমতা আমতা করে বললেন, ‘আসলে একটু জল খাচ্ছিলাম। তাই খুলেছি।’ অফিসার আরও কড়া, ‘জলটা পাঁচমিনিট পরে খাওয়া যায় না?‌’

ব্যাপক লাগল ভদ্রলোককে। দূর থেকে গলা তুলে বলেই ফেললাম, আপনাকে কিন্তু আমার ব্যাপক লাগছে। যেভাবে আপনি শো–টা চালাচ্ছেন, হ্যাট্‌স অফ। কোনও জবাব এল না। টাকা তুলে বেরোনর সময় হাতছানি দিয়ে ডাকলাম। উনি কাউন্টারের সামনে এলেন। মাস্কের উপর দু’চোখে প্রশ্ন।

আপনার নাম কী?‌

— রায়চৌধুরি। আপনার?‌

অনিন্দ্য। আপনি কী রায়চৌধুরি?‌

— এ। এ রায়চৌধুরি। আপনি কী অনিন্দ্য?‌

জানা। অনিন্দ্য জানা। আর আপনার ‘এ’ ফর?‌

— ওটাই থাকুক। এ রায়চৌধুরি একটাই আছে।

হাত তুলে নমস্কার করলাম। রায়চৌধুরিও প্রতি নমস্কার করলেন। বেরোতে বেরোতে ভাবছিলাম, সরকারি ব্যাঙ্কেও এমন অফিসার থাকেন?‌ যিনি সন্দিগ্ধু হন। যাতে সকলে ঠিকঠাক নথিপত্র জমা দিয়ে কাজটা করেন। আবার অভিভাবকের মতো গাইডও করেন। ঠিকই, এ রায়চৌধুরি একটাই আছে। এই রায়চৌধুরি একটাই হয়।

দুপুর ২.‌৫৮

অফিসে যাওয়ার আগে চাকরামির থিওরিটা লিখে ফেলি। পরে যদি ভুলে যাই?‌

আমরা সকলেই বাবুর বাড়ির বাসন মাজার ঝি। কেউ কাচের বাসন প্রিল বা ভিম দিয়ে মাজি। আবার কেউ এনামেলের বাসন ছাই দিয়ে মাজি। যাকে বাবু যেমন অর্ডার দেন। কাউকে ভরসা করে কাচের বাসন দেন। কাউকে অতটা বিশ্বাস করেন না বলে এনামেলের বাসন। কিন্তু দিনের শেষে বাসন মাজতেই হবে। দিনের শেষে সকলেই বাবুর বাড়ির বাসন মাজার চাকর। অথবা ঝি।

আনন্দবাজারের লিফ্‌টের সামনে দাঁড়িয়ে এক কর্তৃপক্ষ স্থানীয়কে এই থিওরিটা দিয়েছিলাম। উনি হাঁ করে শুনেছিলেন। কী ভেবেছিলেন জানি না। কিন্তু আমি উইথ অল সিরিয়াসনেস বলেছিলাম। আরেকবার অভীকবাবুকে বলেছিলাম, সমস্ত ব্যাপারে আপনাকে মাথা ঘামাতে হলে আপনি আর আমাদের মতো চাকরবাকরদের মাইনে দিয়ে রেখেছেন কেন?‌ রেখেছেন এই কারণেই, যাতে আমরা শো–টা সামলাতে পারি আর আপনি নিশ্চিন্তে গল্‌ফ খেলে বেড়াতে পারেন।

স্নেহপরায়ণ মেন্টর মৃদু হেসেছিলেন। স্পোর্টিং ছিলেন তো। তর্ক করা যেত। আলফাল বলা যেত। কোনও জাজমেন্টে ওঁর ভুল হলে নির্দ্বিধায় স্বীকার করতেন। কারণ, উনি কখনও কাউকে বেতনভুক চাকর ভাবতেন না। ‘সহকর্মী’ ভাবতেন। কন্যার বিবাহে আমন্ত্রণ করেছেন। গিয়ে গুটিসুটি হয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে আছি। বাবুর বাড়ির কীর্তনে ঝি–চাকররা যেমন কুণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন। কন্যা এবং জামাতার সঙ্গে ভদ্রতাসূচক আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দিস ইজ অনিন্দ্য। মাই কলিগ।’ মুহূর্তে সমস্ত সঙ্কোচ আর জড়তা ঝরে গেল।

রিপোর্টারদের মিটিংয়ে হাসতে হাসতে প্রকাশ্যেই একবার বলেছিলেন, ‘রোজ সকালে উঠে অনিন্দ্যকে গাল না দিলে তো আমার ভাত হজম হয় না!‌’ সেই বৈঠকে হাজির একাধিক শকুন দৃশ্যতই খুশি হয়েছিল। বাহ্‌, মালটা তাহলে রোজ ঝাড় খায়!‌ শুধু আমি ভিতরে ভিতরে জানতাম, ওটা পিতৃস্নেহ। তিনি যে পেশাগত জীবনে আমার পিতার আসনে, সেটা ওই ধুতি–পাঞ্জাবির বাঙালি জানতেন। যেমন জানত তাঁর জিন্‌স–টি শার্টের সারোগেট, উদ্ধত এবং অ্যাটিউডওয়ালা সন্তান। সে জানত, আসলে সে বাসন মাজার চাকর ছিল না।

মেন্টর কি আর এমনি বলি?‌ শ্রদ্ধা কি আর এমনি করি? ‌

বিকেল ৪.‌২৩

অফিসে পৌঁছে দেখলাম, বিপ্লব এখনও বারমুডা পরে ঘুরছে। কালও দেখেছিলাম। কৌতূহল হল। প্রশ্ন করে জানলাম, সেই ঘূর্ণিঝড়ের দিন থেকে আর বাড়ি যেতে পারেনি!‌ বাড়িতে বৃদ্ধা মা। আমার মায়ের মতোই পায়ের ব্যথায় হাঁটতে পারেন না। গত তিনদিন তাঁর পুত্র তাঁর কাছে যেতে পারেনি। কারণ, জল ঠেঙিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। ফোনেও যোগাযোগ করতে পারেনি। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। চাইলে ধারেপাশে কারও বাড়িতে থেকে যেতে পারত। আমার বাড়িতে খোলা অফার দেওয়া আছে আগে থেকেই। কিন্তু অফিস ছেড়ে যাবে না।

বিপ্লবকে ভাল তো বাসতামই। আজ শ্রদ্ধা হল।

বিকেল ৫.‌০০

প্রধানমন্ত্রী ঘুর্ণিঝড়–বিধ্বস্ত বাংলার জন্য এক হাজার কোটি টাকার অনুদান ঘোষণা করেছেন। পাশাপাশি, যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ২ লক্ষ করে টাকা এবং আহতদের জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তার চেয়েও যেটা তাৎপর্যপূর্ণ, করোনা এবং আমপান মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

একটু আগে সনৎ একটা ছবি দেখাল। কপ্টারের ভিতরে তোলা। বসে আছেন প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী। দু’জনে দু’দিকের জানালায়। দু’জনেরই দৃষ্টি বাইরে। মাঝখানে বেশ কয়েকফুটের ব্যবধান। এটা সামাজিক দূরত্ব নয়। রাজনৈতিক দূরত্ব।

বসিরহাটে প্রশাসনিক বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘একঘন্টা ধরে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখেছি। পুরো এলাকা জলমগ্ন। কলকাতার ছবিও প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়েছি। আমরা কোনও সাহায্য চাইনি। ওঁরা যা পারবেন দেবেন। আমরা আগেই আমাদের তহবিল থেকে নিহতদের পরিবারকে আড়াই লক্ষ টাকা করে দিয়েছি।’

প্রসঙ্গত, ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে রাজ্যে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে কলকাতাতেই ১৯। দেশের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। ফোন করেছিলেন ওডিশার মুখ্যমন্ত্রীও। ঘটনাচক্রে, পশ্চিমবঙ্গের পরেই প্রধানমন্ত্রী ওডিশা গিয়েছিলেন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আকাশপথ থেকে দেখতে। নবীনের রাজ্যের জন্য ৫০০ কোটি মঞ্জুর করেছেন তিনি।

বিকেল ৫.‌২০

প্রধানমন্ত্রীর সফর সেরেই মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দিয়েছেন। যেখানে মুখ্য বক্তা ছিলেন সোনিয়া গান্ধী।

সন্ধ্যা ৭.‌২৩

বিদ্যুৎ এবং পানীয় জলের অভাবে কলকাতা–সহ বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ ছড়াচ্ছে। পথ অবরোধ হচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য খুব সরল— রাস্তায় ভেঙে–পড়া গাছের জন্যই তার তলায় আটক তার সারিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা যাচ্ছে না। গাছ কাটতে হবে অনতিবিলম্বে। ইন্টারেস্টিং হল এর মধ্যে হাওড়ার বালিতে আমজনতার সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলের বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়া।

কলকাতার বিক্ষোভ নিয়ে মুখ্য প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘আমরা লড়াই করছি। আমাদের হাতে তো ম্যাজিক স্টিক নেই। একেকটা গাছ কাটতে তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লাগবে। আমার হাতে তো ১০ হাজার বা ২৫ হাজার মানুষ নেই যে, সকলকে গাছ কাটার কাজে লাগিয়ে দেব!‌ আর এই লেবাররা অধিকাংশই আসেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে। তাঁরা তো ঝড় আর করোনার জন্য আসতেই পারছেন না!‌’

রাত ৮.‌৫৫

এখনও রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আলো আসেনি। পানীয় জল নেই। নেটওয়ার্ক ডাউন। এখনও রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় হাজারে হাজারে ক্রুদ্ধ, অসহিষ্ণু, কাতর মুখ। তাড়া করছে। পিছু ধাওয়া করছে। মগজে ভিড় করছে মুখগুলো। সে মুখের ভিড়ে কোথাও হিঙ্গলগঞ্জের শিশু। কোথাও শহুরে, আরবান যুবক। বিপর্যয় সকলকে আজ একটা সরলরেখায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সকলেরই অপেক্ষা স্বাভাবিকতার।

রাত ৯.‌২০

আজ এখানেই ডায়েরি বন্ধ করি। দিনের শেষ এন্ট্রি করার সময়েও চোখে ভাসছে এমআই–৬ হেলিকপ্টারে বসা দুটো চেহারা। দু’জনে দু’দিকের জানালায়। দু’জনের দৃষ্টি বাইরে। মাঝখানে বেশ কয়েকফুটের দূরত্ব।

ওই দূরত্বের টুকরো জমিতে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার কাতর, নাচার, অসহায় মুখ।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s