লকডাউন ডায়েরি – ২০ মে, ২০২০

২০.‌০৫.‌২০২০। বুধবার

সকাল ৬.‌৫৪

আমপানের আগমনী বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। ঘুম ভেঙে সেটাই প্রথম চোখে পড়ল। বাইরে চারদিকে এক সোঁদা সকাল। এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে। কখনও বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। কখনও কমছে। গাছেরা মাথা দোলাচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে এবং ঘন্টায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে হাওয়া না দিলে এ একেবারে পারফেক্ট রোমান্টিক সকাল। গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করে লং ড্রাইভে যাওয়ার পক্ষে আদর্শ।

পেশাদার সাংবাদিক এইসময় ফট করে টিভিটা চালাবে এবং দেখে নিতে চাইবে কোথায় কী হচ্ছে। নিজেকে আপডেটেড রাখবে। এখানে–ওখানে ফোন ঘোরাবে।

আর মানসিকভাবে বিবাগী মানুষ এককাপ কালো কফি বানাবে। তারপর বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে দিয়ে বাইরের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকবে। তাকিয়েই থাকবে।

আজ সারাদিন টিভি না দেখলে কেমন হয়?‌

সকাল ৯.‌৪৮

এখনও টিভি চালাইনি। এবং সেটা ভেবে নিজেরই অবাক লাগছে। সকাল থেকে একের পর এক গান শুনছি। বাইরে একটা মাতলা হাওয়া দিচ্ছে। প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে চারদিক। আশপাশের গাছগুলোর মাথা দুলছে অবিরত।

বেশ কয়েকবছর আগের কথা মনে পড়ছে। সম্ভবত এমনই এক দুর্যোগের সকালে তাজপুর থেকে গাড়ি চালিয়ে কলকাতা ফিরছিলাম। ছোট্ট একটা মারুতি এ–স্টার গাড়ি। স্পোর্টস কারের মতো দেখতে। কিন্তু ফঙ্গবেনে। সেদিনও এইরকম ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছিল। তাজপুর থেকে বেরিয়ে দিঘা–কাঁথি রাস্তার উপর পড়ার আগে অনেকটা রাস্তা একটা বাঁধের উপর দিয়ে আসতে হয়। দু’পাশ থেকে মাটি ফেলে উঁচু করা। মাঝখানের রাস্তাটা পিচের। যখন আসছিলাম সেই বাঁধের উপর দিয়ে, হাওয়ার দাপটে মনে হচ্ছিল গাড়িটা রাস্তার উপর চলতে চলতেই আড়াআড়ি সরে যাচ্ছে পাশের দিকে। আরেকটু ঠেলা মারলেই গড়িয়ে নীচের জলে পড়বে।

বেগতিক দেখে চারটে জানালারই কাচ নামিয়ে দিলাম। তাতে ক্রস ভেন্টিলেশন হয়ে গাড়িটা থিতু হল। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে বাঁধ থেকে নেমে ডানদিকে বাঁক নিয়ে কলকাতার রাস্তা ধরলাম। একেবারে ফাঁকা রাস্তা। হয়তো এমনই কোনও সাইক্লোনের কারণে বাড়ি থেকে গাড়িঘোড়া এবং লোকজনের বেরোন নিষেধ ছিল।

স্পিডোমিটারের কাঁটা ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটারে। খোলা জানালা দিয়ে চোখেমুখে বৃষ্টির ছিটে এসে লাগছে। গাড়ির ড্যাশবোর্ডের সিডি প্লেয়ারে হাস্কি গলায় কেনি রজার্সের কান্ট্রি সং। হাওয়ার কলরোল।

কিছু কিছু জার্নি জীবনে ফ্রিজ ফ্রেম হয়ে থেকে যায়।

দুপুর ১.‌০৪

বৃষ্টির তোড় বাড়ল। অবশেষে এবার কি আমপানের আগমন ঘটছে?‌ টিভি অবশ্য বলছে, এখনও পারাদীপের ১২৮ কিলোমিটার দূরে আছে ঘূর্ণিঝড়। ইতিমধ্যেই কিছু জায়গায় গাছ পড়েছে। দিঘার সমুদ্রে প্রবল জলোচ্ছ্বাস। দক্ষিণ ২৪ পরগনার নদীতটবর্তী এলাকায় বাড়িঘরের টিনের শেড উড়ে যাচ্ছে। কলকাতা বিমানবন্দর আগামিকাল সকাল পর্যন্ত বন্ধ রাখা হচ্ছে। ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে শহরের সমস্ত উড়ালপুলে ওঠার রাস্তা।

এই প্রবল দুর্যোগে অডিও ভিস্যুয়্যালের সহকর্মীরা হাওয়ায় টাল খেতে খেতে প্রায় পড়ে গিয়েও বুম ধরে পি–টু–সি দিয়ে যাচ্ছেন। হ্যাট্‌স অফ!‌

দুপুর ১.‌২৬

কাল রাতে নাকি পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভ দেখিয়েছেন কমব্যাট ফোর্স আর র‌্যাফের কর্মীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ডিসি (‌কমব্যাট ফোর্স)‌ ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তাঁকেও নাকি প্রবল বিক্ষোভ এবং হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছে। রাতেই বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা। তারপর আজ নবান্ন যাওয়ার পথে সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং।

মুখ্যমন্ত্রীর ফেসবুক পেজে দেখছি, জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি কথা বলছএন বিক্ষোভকারী পুলিশকর্মীদের সঙ্গে। প্রথমে সকলেই হইহই করে কথা বলতে গিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের বললেন, ‘আপনারা ডিসিপ্লিন্‌ড ফোর্সের লোক। সকলে একসঙ্গে কথা বলবেন না। কোনও একজন বলুন।’ তখন একজন এগিয়ে গিয়ে দাবিদাওয়া এবং ক্ষোভের কথা বললেন। যা বুঝলাম, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, আমপান এবং করোনা–পরিস্থিতি কেটে গেলে বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেওযা হবে।

দুপুর ২.‌৩০

এটাই আমপানের ল্যান্ডফলের সময়। এখন শুরু হলে পুরো প্রক্রিয়াটা চলবে সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা। ফলে কলকাতায় ঘূর্ণিঝড় এসে পৌঁছবে বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে। যখনই হোক, বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। টিভি–তে দেখছি, নামখানা বা কাকদ্বীপের মতো এলাকায় অলরেডি হাওয়ার গতিবেগ তীব্রতর হয়েছে। ভেঙে পড়ছে গাছপালা আর কাঁচাবাড়ি।

টিভি–তে দেখছি মানুষজন একে অপরকে জাপ্টে ধরে রেখেছেন। যাতে হাওয়ায় কাউকে উড়িয়ে না–নিয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্বের কী হবে, সে প্রশ্ন তোলা বাতুলতা। বস্তুত, আজকের জন্য করোনা ভাইরাস এ রাজ্যে হরিজন। কেউ তাকিয়েও দেখছে না। ছোঁয়া তো অনেক দূরের কথা!‌

রসিক বাঙালি এরমধ্যেও ফেসবুকে লিখছে, ‘কোভিড–আক্রান্ত কেউ ঝড়ের যাত্রাপথের দিকে মুখ করে হাঁচি দিলে সেটা যে ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটার বেগে ছড়িয়ে পড়বে, সেটা ভেবে দেখেছেন কি?‌’ অথবা, ‘সাইক্লোন ঢুকছে নিচ দিয়ে (‌ম্যাপের)‌। ইকনমি পিছন দিয়ে। নাম–মুখ দিয়ে করোনা। কান দিয়ে নানারকম সতর্কবার্তা। শরীরের ফুটো থাকা যে কত যন্ত্রণা!‌’

আজকের ‘লকডাউন ডায়েরি’র নাম বদলে কি ‘আমপান ডায়েরি’ রাখা উচিত?‌

দুপুর ২.‌৫৪

নবান্নের কন্ট্রোলরুমে মুখ্যমন্ত্রী। মুখে মাস্ক। সামনের বিশাল টিভি স্ক্রিনে ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাঁর ডানদিকে কয়েকটা চেয়ার পরে বসে আছেন মুখ্যসচিব রাজীব সিন্‌হা। রাজ্য প্রশাসনের তাবড় অফিসাররাও রয়েছেন। সকলে বাধ্য ছাত্রের মতো চেয়ারে বসে সামনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর ফাঁকেই সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ মাস্কটা একবার নামিয়ে একটু নাক চুলকে নিলেন।

মুখ্যমন্ত্রী টুকটাক কথা বলছেন। তার দু’টি নমুনা—
১.‌ ‘বছরে চারবার যদি এমন হয়, তাহলে এই রাজ্যটার আর কী থাকে! কোথায় সামলাবে?‌‌’
২.‌ ‘আসলে বে অফ বেঙ্গলটা খুব ভালনারেব্‌ল এরিয়া।’

পাশাপাশিই দেখা যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে নির্দেশ দিচ্ছেন, রাস্তায় যেসব গাছ ভেঙে পড়েছে, এখনই তা কাটতে যাওয়ার দরকার নেই। কারণ, ঝড়ের গতিবেগ আরও বাড়ছে। বহু এলাকায় বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, ঝড়ে বিদ্যুৎবাহী তার ছিঁড়ে রাস্তায় পড়লে অসাবধানে কেউ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হতে পারে।

সাংবাদিকরাও আছেন নবান্নের কন্ট্রোলরুমে। রাতেও থাকবেন তাঁরা। যেমন পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে নবান্নে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী। সহকর্মীদের একাংশের কাছে শুনলাম, সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা আজ রাতে নবান্নে থাকবেন, তাঁদের দু’টি করে মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজার এবং সার্জিক্যাল টুপি (‌গত্যন্তরে এমনি ক্যাপ হলেও চলবে)‌ নিয়ে যেতে হবে।

দুপুর ৩.‌২৩

অফিসে নিরুপদ্রবেই এলাম। রোজকার মতোই রাস্তাঘাট সুনসান। কোথাও কোথাও কিছু গাছের ডালপালা ভেঙে পড়েছে। উইপ্রোর সামনের ফ্লাইওভারটায় ওঠা গেল না। ঝড়ে কি ফ্লাইওভার ভেঙে পড়তে পারে?‌ নাকি উড়ালপুল থেকে চলন্ত গাড়ি ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে?‌ অফিসেও আলোচনা ঘূর্ণিঝড় নিয়েই।

বিকেল ৪.‌০৫

আবহাওয়া দফতরের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, আমপান এখন কলকাতা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে আগামী এক থেকে দেড়ঘন্টায় কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছবে। আপাতত কলকাতায় ঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় ৭৯ কিলোমিটারের কিছু বেশি।

গোটা আমপান পর্বে সঞ্জীবকে বেশ লাগছে। চোখে চশমা, ফর্মাল শার্ট–ট্রাউজার্সের অত্যন্ত আনঅ্যাজিউমিং অফিসার। অথচ সলিড। নিজের সাবজেক্টটা বোঝেন। সবচেয়ে বড় কথা, পাবলিসিটিবাজ নন। ঝাড়াঝাপ্টা, নো–ননসেন্স একটা অ্যাপ্রোচ আছে ভদ্রলোকের। সাংবাদিক বৈঠকে বাংলায় ব্রিফ করার পর সর্বভারতীয় চ্যানেলের অনুরোধে নৈর্ব্যক্তিক মুখে ইংরেজি এবং হিন্দিতেও ব্রিফ করলেন। এবং দুটো ভাষাতেই একটুও হোঁচট না খেয়ে।

সঞ্জীব বলছেন, আজ মধ্যরাতের আগে আমপানের কলকাতা ছাড়ার সম্ভাবনা কম।

বিকেল ৪.‌১৫

অফিসের বারান্দায় গিয়ে একবার দাঁড়ানোর ইচ্ছে ছিল। দেখলাম, ওদিকটা সিল করে দেওয়া হয়েছে। অগত্যা সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। দূরের ‌গাছগুলো পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছে। চারদিক থেকে একটা গুমগুম করে আওয়াজ হচ্ছে। কোথাও নিশ্চয়ই হাওয়ার দাপটে কিছু ভেঙেচুরে পড়ছে বা উড়ে যাচ্ছে। হাওয়ার একটা পাগলাটে শোঁ–শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। হস্তির বৃংহণের মতো। শুধু মনে হচ্ছে, সেই ঐরাবতের গলাটা ভেঙে গিয়েছে। মাথা দোলাতে দোলাতে সে চারদিক লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে সেই চতুষ্পদ। তার পায়ের তলায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে জনপদ।

টিভি বলছে, কলকাতায় এখন ঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় ১০৫ কিলোমিটার। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘আমপানের চোখটা সাগরে ঢুকেছে। লেজ এখনও ঢোকেনি। ওটাই বড় ধাক্কা দেবে।’

নিউজরুমের বাইরেটায় দাঁড়িয়েছিলাম। ‌হাওয়ার প্রচণ্ড আওয়াজ। দড়াম দড়াম করে দরজা পড়ছে। আর বাতাসের তীব্রতর গতি। সেই দুরন্ত বাতাস বৃষ্টিকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটা বৃষ্টির ঝরোখা ছেয়ে ফেলছে চারদিক। এ জিনিস সত্যিই আগে কখনও দেখিনি। ‌

সন্ধ্যা ৭.‌০০

অফিসের ভিতরে বসেও বাইরের শোঁ–শোঁ আওয়াজটা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। আওয়াজটা একবার বাড়ছে। একবার কমছে। যতবার আওয়াজটা বাড়ছে, মনে হচ্ছে আশপাশের সবকিছুকে একেকটা চোপাটে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে নিজের সঙ্গে। বস্তুত, ওই আওয়াজ এতটাই আতঙ্ক, শঙ্কা আর উদ্বেগ বহন করে আনছে যে, মনে হচ্ছে কানে এয়ারপড লাগিয়ে তারস্বরে গান চালিয়ে দিই। যাতে বাইরের ওই আওয়াজটা কানেই না ঢোকে!‌

অফিসে আপাতত কারেন্ট নেই। ঝুম হয়ে অন্ধকারে বসে আছি। ঘুটঘুটে অন্ধকার ম্যানেজ দিচ্ছি মোবাইলের টর্চ জ্বেলে। অন্ধকারে বসে মনে হচ্ছে ঝড়ের আওয়াজটা চৌদুনে উঠে যাচ্ছে। কম্পিউটারের নেটওয়ার্ক গোলমাল করছে। নেটওয়ার্কের সহকর্মীরা সারানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভোডাফোন আক্ষরিক অর্থেই ‘ভোঁদাফোন’এ রূপান্তরিত। নেটওয়ার্কহীন। মাঝে মাঝে নেটওয়ার্ক আসছে। আবার উধাও হয়ে যাচ্ছে। চলছে না টিভি–র কেবল নেটওয়ার্কও।

এইমাত্র জেনারেটরে আলো জ্বলল অফিসে। চারপাশ অন্ধকারে ডুবে। আশপাশে সকলের মুখে গভীর চিন্তার ছাপ।

সন্ধ্যা ৭.‌১৩

কলকাতায় এখন ঝড়ের গতি ঘন্টায় ১৩০ কিলোমিটার। সমস্ত রাস্তার আলো নিভে গিয়েছে। ল্যাম্পপোস্ট দুলছে। ভেঙে পড়ছে সিগনাল পোস্ট। রাস্তায় পার্ক করা গাড়ি বাতাসের ধাক্কায় দুলতে শুরু করেছে। উল্টে পড়ছে মোটরবাইক আর স্কুটার। গ্লো–সাইনবোর্ড ভেঙে পড়ছে। নবান্নের ১০৯ নম্বর ঘর হাওয়ার দাপটে ভেঙে তছনছ। জানালার কাচ ভেঙে দেয় জোরাল হাওয়া। ঘটনাচক্রে, মন্ত্রী থাকার সময় এই ঘরেই বসতেন শোভন চট্টোপাধ্যায়।

গোটা রাজ্যে ইতিমধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বিপর্যস্ত দিঘা, মন্দারমণি, কাকদ্বীপ। ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং কলকাতা। ভেঙেছে ৬ হাজারেরও বেশি কাঁচাবাড়ি। ভেঙেছে বাঁধ। ভেঙেছে জেটি। ভেসে গিয়েছে হাওড়া ফেরিঘাট।

পরিস্থিতি দেখে পরিচিত অ্যাঙ্করের গলা ধরে এসেছে। সহকর্মীদের প্রতি গর্বের আবেশে কেঁদেই ফেললেন ক্যামেরার সামনে। একবার কোটের হাতায় চোখ মুছতেও দেখা গেল। ক্যামেরা বাধ্য হল বোধহয় জাম্পকাট করে অন্যত্র চলে যেতে।

যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে বাইপাস ধরে ঝড়টা এগিয়েছে। আবহবিদরা বলেছিলেন, পূর্ব কলকাতা ছুঁয়ে যাবে আমপান। বাস্তবেও তেমনই হয়েছে। ফলে তুমুল ক্ষতিগ্রস্ত মাঠপুকুর, বেলেঘাটা, সল্টলেক, দমদম এলাকা। গোটা এলাকা অন্ধকারে ডুবে। বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। স্ট্রিটলাইটও জ্বলছে না।

সন্ধ্যা ৭.‌৪৩

মনে হচ্ছে ঝড়ের দাপট একটু কমেছে। আপাতদৃষ্টিতে। ওই ভয়াল আওয়াজটা আর শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু বৃষ্টি শুরু হয়েছে অঝোরধারে। মনে হচ্ছে, সারা কলকাতার আকাশ ফুটো হয়ে গিয়েছে। অবিশ্রান্ত ধারাবর্ষণ হচ্ছে সমস্ত এলাকায়। টিভি–র দাবি, এমন বীভৎস ঘটনা ঘটেছিল এর আগে ১৭৩৭ সালে। সেবার সাইক্লোনে নাকি গঙ্গায় নাকি প্রায় ৪০ ফুট উঁচু ঢেউ উঠেছিল। মারা গিয়েছিলেন ৩,০০০ মানুষ। অন্তত ২০টি ছোটবড় জাহাজ নাকি ডুবে গিয়েছিল।

এখনও নাকি আরও একঘন্টা আমপানের দাপট চলবে। তবে সেই প্রলয়ঙ্করী আওয়াজটা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে।

রাত ৮.‌১৭

ঝড়ের দাপট অনেকটাই কম এখন। তবে হাওয়াটা এখনও বইছে তোড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবার একটা ঝাপট আসতে পারে। তাঁদের বক্তব্য, এই শান্ত ভাবটা নাকি আসলে ঝড়ের ‘আই’এর। এরপর লেজের ঝাপ্টা আসবে। ওডিশাতেও ‘ফণী’ নাকি এমনই কাণ্ড ঘটিয়েছিল। যেটুকু বাকি ছিল, লেজের ঝাপ্টায় সমস্ত তছনছ করে দিয়ে গিয়েছিল। যদি তেমনকিছু হয়, তাহলে সেটা যা হল, তার চেয়ে অন্তত পাঁচগুণ হবে। এখনও পর্যন্ত কলকাতায় ঝড়ের যে গতিবেগ রেকর্ড করা হয়েছে, তার পরিমাণ ঘন্টায় ১৩৩ কিলোমিটার। যা সুদূর অতীতেও নজিরবিহীন। আর উপকূল এলাকায় সেই গতি ছিল ঘন্টায় ১৮০ কিলোমিটার!‌ অভাবনীয়!‌ অকল্পনীয়!‌ ভয়াবহ!‌

একটু আগে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে এলাম, অফিসের চত্বরে পার্ক–করা গাড়িটা এখনও ঠিকঠাকই আছে। ইচ্ছে করেই বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে রেখেছিলাম। মনে হয়েছিল, ঝড়ে যদি উড়িয়েও নিয়ে যেতে চায়, দেওয়ালটা একটু ঠেকনো বা আড়াল দিতে পারবে। পাঁচিলের অন্যপাশে বড় কোনও গাছ ছিল না। ভাগ্যিস!‌ অফিসের নীচে জল জমে গিয়েছে। আজ হাওয়াই চটি পরে অফিসে এসেছিলাম। ভাগ্যিস!‌

ঝড়ের পুরো সময়টা এয়ারটেলের সার্ভিস ঠিকঠাক ছিল। এখন দেখছি ভোডাফোনের নেটওয়ার্কও ফিরে এসেছে। বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির দাপটও নাকি খানিকটা কমেছে। তেমনই বলছে টিভি। কিন্তু পাশাপাশিই বলছে, কোথাও কোথাও আবার বাড়ছে হাওয়ার দাপট। তবু মনে হচ্ছে, ওই বীভৎসতাটা সম্ভবত আর ফিরবে না।

রাত ১০.‌৩৫

আজকের রাতটা এক গভীর অন্ধকারের রাত। একটা শহর সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে। কোথায় কী ভেঙে পড়েছে, কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার কোনও হদিসও পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় দু’ঘন্টায় কী দেখলাম?‌ ঝড়ের দাপট। বাতাসের গর্জন। মুষলধারে বৃষ্টি। প্রকৃতির সামনে হাঁটু গেড়ে অসহায় মানুষ। সেই মানুষের চোখেমুখে আতঙ্ক। মনে শঙ্কা আর গভীর উদ্বেগ।

প্রকৃতির প্রতিশোধ?‌ কে জানে!‌ হবে হয়তো।

এখনও চোখ বুজলে ভয়াবহ আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছি। সাক্ষাৎ ধ্বংসের শব্দ। মৃত্যুর শব্দ। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর মাটি থেকে একটা অতিকায় দানব চক্রাকারে তার ঘূর্ণায়মান অক্ষের উপর ভর করে উঠে আসছে। আর সামনে যা পাচ্ছে, গিলে নিচ্ছে সেই দানবীয় খোঁদলে। খাবার না পেলে অক্ষম এবং নিস্ফল আক্রোশে ধাক্কা মারছে, মাথা ঠুকছে বিভিন্ন ইমারতে।

আর তার সামনে জোড়হাতে নতজানু হয়ে বসে আছে আপাত–দাম্ভিক মানুষ।

সেখানে কোনও কেনি রজার্স নেই।

লকডাউন ডায়েরি – ১৯ মে, ২০২০

১৯.‌০৫.‌২০২০। মঙ্গলবার

সকাল ৯.‌৩৬

সকাল থেকে চারদিকটা থমথমে হয়ে আছে। এটাই কি ঝড়ের আগের নৈঃশব্দ্য? ‘‌লাল বিফোর দ্য স্টর্ম’?‌ প্রকৃতি কি এই সময়টায় থমকে থেকে এনার্জি স্টোর করে?‌ যাতে পরে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে?‌ চারদিক থেকে যা শুনছি, তাতে তো মনে হচ্ছে মহাপ্রলয় আসছে। সৃষ্টির শেষদিন সমাগত।

টিভি দেখে মনে হচ্ছে আমপান আপাতত করোনাকে একটা শোল্ডার ড্যাশে ছিটকে ফেলে দিয়েছে সাইডলাইনের বাইরে। শুধু রাজ্য নয়, জাতীয় পর্যায়েও এই সুপার সাইক্লোন নিয়ে অভূতপূর্ব তৎপরতা শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাবিনেট সচিব— সকলে ঘনঘন বৈঠক করছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবের সঙ্গেও আলোচনা করা হচ্ছে। সারা দেশ থেকে বিভিন্ন লোকজন সোশ্যাল মিডিয়ায় পশ্চিমবঙ্গ এবং ওডিশার জন্য প্রার্থনা করছেন। এসব দেখে আরও মনে হচ্ছে, করোনা এখন পিছনের বেঞ্চে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। তার জায়গা নিতে চলে এসেছে আরও দুর্বিনীত ছাত্র।

আমার নিজস্ব একটা প্রিয় থিওরি আছে। যেটা সফল বলে প্রমাণিত— রাষ্ট্র, কোম্পানি আর প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে জেতা যায় না। চারপাশ দেখে সেই থিওরিটাকে আরও একটু পরিমার্জিত করলাম। প্রকৃতিই সর্বশক্তিমান। রাষ্ট্র এবং কোম্পানিও মাঝেমাঝে তার সঙ্গে লড়ে জিততে পারে না।

দুপুর ১.‌২০

বৃষ্টি নামল। খুব বেশি জোরে নয় অবশ্য। একটু ঘ্যানঘ্যানে। বিষন্ন। মনখারাপ করা। এটাও বোধহয় আমপানেরই প্রিল্যুড। ইদানীং স্যাটেলাইটের কল্যাণে আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনেক বেশি নিখুঁত হয়। সেই কারণেই মনে হচ্ছে, আমপান–পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরাল হচ্ছে। আয়লা, বুলবুলের চেয়েও এই ঘূর্ণিঝড় অনেক বেশি শক্তিশালী। ফলে অনেক বেশি ক্ষতি করার ক্ষমতাসম্পন্ন।

এইসব সময় এলেই আমার নিজের কভার করা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের অ্যাসাইনমেন্টের কথা মনে পড়ে। কতটা কী করতে পেরেছি, সেটা ইতিহাস বলবে। কিন্তু প্রচুর বিপর্যয়ে অ্যাসাইনমেন্টে গিয়েছি। তার মধ্যে প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল মুর্শিদাবাদের গোকর্ণে টর্নেডোর কভারেজ। কলকাতা থেকে সারারাত অফিসের গাড়িতে করে যাওয়া। সঙ্গী ফটোগ্রাফার চণ্ডীদা। টেরিফিক নার্ভাস। অফিস থেকে বেরোনর আগে বারতিনেক পটি করে নিল। আর রাস্তায় যত ঠাকুবদেবতার থান দেখল, কপালে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করল। ভোরে গিয়ে পৌঁছলাম ঘটনাস্থলে।

জীবনে সেই প্রথম প্রকৃতির চণ্ডরূপ অত কাছ থেকে দেখা। এখনও মনে আছে, একটা আস্ত যাত্রীবোঝাই বাসকে কয়েক কিলোমিটার উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছিল ঘূর্ণিঝড়। যাত্রীরা কোথায় উড়ে গিয়ে পড়েছিলেন কে জানে!‌ তবে দেখেছিলাম, বাসটার চেসিস একদিকে। আর চারটে চাকা পরস্পরের থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে পড়ে আছে। তাল আর নারকেল গাছের মাথাগুলো মনে হচ্ছিল কেউ করাত দিয়ে কেটে দিয়েছে। কবন্ধ গাছের সারি দাঁড়িয়ে আছে নির্জন প্রান্তরে। রাস্তাঘাট ভেঙে চৌচির। গাড়ি রেখে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের পর গ্রাম ঘোরা। গাদাগাদা গৃহহীন মানুষ একফোঁটা ত্রাণের জন্য চিলুবিলু করছেন। দেখে ডিপ্রেশন হয়।

সারাদিন ঘোরাঘুরি করে বিকেলে বহরমপুর ফেরার পর সার্কিট হাউসে সরকারের প্রেস কনফারেন্স। রাজ্যের অন্তত ছ’জন মন্ত্রী হাজির। একে একে সাংবাদিকরা পরিচয় দিচ্ছে। ‘আনন্দবাজার’ বলতেই অধুনাপ্রয়াত এবং তৎকালীন ত্রাণমন্ত্রী ছায়া ঘোষ বললেন, ‘আমার কিন্তু আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে।’

তখন প্রফেশনে সবে কয়েকবছর হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেই যথেষ্ট ডেঁপো এবং ঢ্যাটা বলে পরিচিতি লাভ করেছি। ফলে মৃদু হেসে ওঁকে বললাম, ‘আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে তো আপনাদের সবসময়েই অভিযোগ থাকে। বলুন।’

— আমি কাল গোকর্ণে অনেক রাত পর্যন্ত ত্রাণ বিলি তদারক করেছি। কিন্তু আমার নামটা আজ আনন্দবাজার লেখেনি!‌

ডেঁপো এবং ঢ্যাটা ছেলেটির হাসি আরও মৃদু এবং ফিচেল হল। সে বর্ষীয়ান মন্ত্রীকে পাল্টা প্রশ্ন করল, আপনি কি আনন্দবাজারে নাম তোলাতেই ওখানে গিয়েছিলেন?‌

ছায়া’দি একটু ভেবলে গেলেন। কী উত্তর দেবেন যখন মনে মনে গোছাচ্ছেন, তখন পরিস্থিতি ঘোরাল হয়ে যাচ্ছে দেখে আসরে নামলেন শ্যামল’দা। রাজ্যের তৎকালীন পরিবহণ মন্ত্রী পরিবেশ লঘু করার চেষ্টায় হাসতে হাসতে বললেন, ‘আরে, ও তো অনিন্দ্য। খুব ভাল ছেলে। আমার পাড়ায় থাকে।’ তারপর ব্যাপারটা সত্যিই আর অতটা গুরুগম্ভীর রইল না। দিনচারেক ছিলাম। বিধ্বস্ত হয়ে ফিরলাম কলকাতায়।

ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল গুজরাত ভূমিকম্প কভার করতে গিয়ে। অন্যের নামের একটা এয়ারটিকিট যোগাড় করে আমেদাবাদ থেকে ভুজ এয়ারবেসে নেমেছিলাম। রানওয়েতে ফাটল ধরেছে। কোনওমতে বোয়িং ল্যান্ড করিয়েছিলেন পাইলট। বাইরে বেরিয়ে গোটা তিনেক আর্মির ট্রাকে হিচ হাইক করে পৌঁছেছিলাম শহরে।

অত সম্পন্ন একটা শহর মুহূর্তে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। বহুতল বাড়িগুলো হেলে পড়েছে। বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। ক্লক টাওয়ারের ঘড়ি থমকে। সবচেয়ে অবাক লেগেছিল দেখে যে, সম্ভ্রান্ত চেহারার মানুষজন ত্রাণের ট্রাকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন। দাবি কী?‌ খাবারদাবার নয়। একটা সামান্য জলের পাউচ। ট্রাক থেকে গাদা গাদা পাউচ ছুড়ে ফেলা হচ্ছে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার দিকে। আর তৃষ্ণার্ত মানুষ লাফিয়ে–ঝাঁপিয়ে ক্যাচ লুফে সেগুলো নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। ওই দৃশ্যটা কখনও ভুলব না। বানিয়া গুজরাতি তখন রাস্তার ভিখারিতে পরিণত। তখনই প্রথম মনে হয়েছিল কথাটা— প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে জেতা যায় না। অর্থ, মান, প্রভাব, প্রতিপত্তি— কিচ্ছু কাজ করে না। ফুটপাথবাসী আর মিলিওনিয়ার এক সারিতে দাঁড়িয়ে থাকে ত্রাণের খিচুড়ির জন্য।

ভুজটা তা–ও প্লেনে করে যেতে পেরেছিলাম। অন্যত্র সর্বত্র গাড়িতে। জানুয়ারির মারুনে ঠাণ্ডায় আমেদাবাদ থেকে গভীর রাতে একটা টাটা সুমো নিয়ে বেরোতাম। ড্রাইভার গুটখা খেতে খেতে ঘুম তাড়িয়ে গাড়ি চালাত। পিছনের সিটে বিস্কুটের প্যাকেট আর জলের বোতল নিয়ে বসে বসে ঢুলতাম। সময়ের অঙ্ক কষে ঠিক ভোরবেলা ঈপ্সিত গন্তব্যে পৌঁছতাম। কোনওদিন আঞ্জার, কোনওদিন ভাচাউ, কোনওদিন কান্দলা। ভোরবেলা পৌঁছে ম্যাক্সিমাম বেলা ১২টা পর্যন্ত কাজ করতাম। তারপর আবার গাড়ি নিয়ে আমেদাবাদের পথে। দূরত্ব হিসেব করে বিকেলের মধ্যে ঢুকতাম আমেদাবাদে। হোটেলে বসে ঝাঁ ঝাঁ করে কপি লিখতাম। ততক্ষণ আমার রথের সারথি কিছু খেয়ে নিয়ে গাড়ির মধ্যে টেনে ঘুমোত। তারপর অফিসে কপি ফ্যাক্স করে আবার জল–বিস্কুট বগলদাবা করে রাতে বেরিয়ে পড়তাম পরবর্তী গন্তব্যের পথে।

টানা এক সপ্তাহ এই ছিল গুজরাত ভূমিকম্প কভারেজের রুটিন।

এরপর বড় বিপর্যয় সুনামি। সমুদ্রের উপকূল ধরে চেন্নাই থেকে দক্ষিণ ভারতের যে’কটা শহরে গিয়েছিলাম, সর্বত্র একই দৃশ্য। দোতলা, তিনতলা সমান উঁচু ঢেউ এসে সাগরতীরে এক থেকে দু’কিলোমিটার এলাকা যেন ধুয়ে সাফ করে নিয়ে গিয়েছে। তার ওপারে আবার সব স্বাভাবিক। দেখে আশ্চর্য লেগেছিল। পুদুচেরি শহরটা বেঁচে গিয়েছিল সমুদ্রের পাড়ে বোল্ডারের শক্ত বাঁধ থাকায়। একমাত্র ওই শহরটার সমুদ্রতটে সামান্যতম ক্ষতিও হয়নি।

আমপান নিয়ে যে পরিমাণ আতঙ্ক, উদ্বেগ এবং শঙ্কা দেখছি, তাতে ওই দিনগুলো আবার মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আবার যদি কাঁধে ব্যাকপ্যাক, ট্রাউজার্সের পকেটে বিস্কুটের প্যাকেট আর হাতে জলের বোতল নিয়ে বেরিয়ে পড়া যেত!‌

দুপুর ২.‌৩৬

আজ থেকে অনেকে কাজে বেরোতে শুরু করেছে। ফেসবুকে তেমনই দেখছি। প্রায় দু’মাস পর আবার স্বাভাবিকতার দিকে ফেরার চেষ্টা শুরু। দরজা অল্প ফাঁক করে বাইরের আলোয় বেরিয়ে একটু দাঁড়ানো। দেখে নেওয়া যে, তাতটা কেমন এখন।

সমস্যাটা হল, এখন এই লোকগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু হবে। সারাদিন পর তারা বাড়ি ফিরলে এমন একটা ভাব করা হবে যে, ছোঁয়া লাগলে জাত যাবে। এটা একটা প্রবলেম্যাটিক জোন তৈরি হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে। টিদিং ট্রাবলের মতো। নতুন কিছু শুরু হলে যেমন হয় প্রথম প্রথম। এটাও তো একটা নতুন জীবন, নতুন যুগেরই শুরু।

মনে হয়, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। অবশ্য না হয়েই বা উপায় কী!‌

দুপুর ২.‌৫৮

যা দেখছি, আমপান নিয়ে একটা যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। হাওয়া অফিস জানাচ্ছে, কাল থেকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হবে দক্ষিণবঙ্গের সমস্ত জেলায়। সুন্দরবনের গা ঘেঁষে দিঘা এবং হাতিয়া দ্বীপের উপর দিয়ে এই সুপার সাইক্লোন বয়ে যাবে। নির্ধারিত সময় বেলা ২টোর কাছাকাছি। ঝড়ের গতিবেগ থাকবে ঘন্টায় ১৬৫ থেকে ১৭৫ কিলোমিটার। সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটার। কলকাতায় ঝড়ের গতিবেগ থাকবে ঘন্টায় ১৩৫ কিলোমিটার।

আবহবিদেরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি এবং পূর্ব মেদিনীপুরে। আবহাওয়া দফতর রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে, কাল যেন কলকাতা এবং লাগোয়া এলাকার সমস্ত দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়। ইতিমধ্যেই সমুদ্র উত্তাল। মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে নামতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে সবমিলিয়ে ‘ম্যাসিভ ড্যামেজ’ হবে। ভয়াবহ ক্ষতি হবে ফসলের। বৃষ্টিতে কাঁচা এবং এমনকী, দুর্বল পাকা বাড়িও ধসে পড়তে পারে। তবে কলকাতায় যে সমস্ত চার বা পাঁচতলা বাড়ি তৈরি হয়, সেগুলি ঘন্টায় ২২০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো বাতাস সামলাতে পারে। তবে ভেঙে পড়বে গাছ এবং বিদ্যুতের খুঁটি। ফলে ব্যাহত হতে পারে বিদ্যুৎ সরবরাহ। ব্যক্তিগতভাবে এই ব্যাপারটা নিয়েই সবচেয়ে বেশি চিন্তায় আছি। কারেন্ট না থাকলে গোটা বাড়ির সিস্টেম ভেঙে পড়বে। বন্ধুবান্ধবরা বলছে, মোবাইল ইত্যাদিতে আগে থেকে ভাল করে চার্জ দিয়ে রাখতে। যাতে পরে বিপদে না পড়ি।

এ জিনিস লকডাউনেও হয়নি!‌

দুপুর ৩.‌৩৭

আমপান নিয়ে নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলছেন, এই ঝড়ের তিনটি অংশ— মাথা, চোখ আর লেজ। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘সবচেয়ে প্রথমে মাথা হিট করবে। যখনই দেখবেন, ঋড়টা থেমে যাচ্ছে, ভাববেন না থেমে গেল। আরও একটা বড় দমকা আসবে। সেটা আই। এরপর লেজ এসে মুড়িয়ে নিয়ে যাবে। ফণীতে যেমন ওডিশায় লেজটাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিল।’

কাল দুপুর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে ল্যান্ডফল হওয়ার কথা আমপানের। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য কাল দিনেরবেলা থেকে শুরু করে রাতেও তিনি নবান্নেই থাকবেন। আজ তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। যদি কোনও সাহায্য প্রয়োজন হয়। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার সমস্ত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তৈরি। এখন বলছেন, ‘আমরা সবরকমভাবে প্রস্তুত আছি। ইতিমধ্যেই ৩ লক্ষেরও বেশি লোককে সরিয়ে আনা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। বুলবুলে আমরা প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষকে ইভ্যাকুয়েট করেছিলাম।’

বিকেল ৫.‌০৫

করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আগামী শুক্রবার নিজেদের মধ্যে ভিডিও বৈঠক করবেন বিরোধী নেতানেত্রীরা। সেখানে থাকবেন সোনিয়া গান্ধী, শরদ পওয়ার, এম কে স্ট্যালিনরা। থাকবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও। তিনি আজ বলেছেন, ‘সবসময় তো সরকারের সঙ্গেই বৈঠক হয়। বিরোধীরাও নিজেদের মধ্যে কথা বলুক না। খারাপ কী?‌ বিভিন্ন রাজ্যে করোনার পরিস্থিতি কেমন, কীভাবে সকলে মিলে এর মোকাবিলা করা যায়। তা নিয়ে কথা হবে। তাছাড়া, যেভাবে সামান্য কয়েকঘন্টার নোটিসে লকডাউন জারি করা হয়েছিল, সেটা নিয়েও বিরোধীদের অনেকের আপত্তি আছে। তাই আমরা ঠিক করেছি, নিজেদের মধ্যে কথা বলব।’

করোনা–সময়ে বিরোধীদের নিজেদের মধ্যে এই যোগাযোগ নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক। এনআরসি ইস্যু পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে। আন্দোলনের নতুন বিষয় তৈরি করতে হবে। ফলে এখন করোনা মোকাবিলা সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে চারদিক থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে অভিমন্যুর মতো ঘিরে ধরা। এখন কথা হচ্ছে, বিরোধীদের এই ঐক্য কতদূর কী করতে পারবে। সেটা অবশ্য বলবে ভাবীকাল। যা আসতে আপাতদৃষ্টিতে এখনও চারবছর বাকি। ২০২৪ সাল। পরের লোকসভা ভোট।

রাত ৮.‌৫৩

যত রাত বাড়ছে, তত বাড়ছে আমপান নিয়ে আতঙ্ক এবং আশঙ্কা। সোশ্যাল মিডিয়ায় কন্ট্রোলরুম আর হেল্পলাইন নম্বরের ছড়াছড়ি। চারদিকে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি। তার মধ্যে যে প্রস্তুতিটি আমার বুকে শেল হেনেছে, সেটা ঘটেছে আজ দুপুরে। অফিসে বেরোনর আগে দেখলাম পাশের বাড়ির ছাদে উঠে বাঁশের মাথায় লাগানো আঁকশির ডগায় প্লাস্টিকের থলে লাগানো একটা শস্ত্র দিয়ে যাবতীয় আম পাড়া হচ্ছে।

ফলে আমপানের আমই আর রইল না!‌ আর পানদোষ আমার নেই। ফলে হাতে রইল পেনসিল। লকডাউন ডায়েরি লেখার জন্য।

রাত ১০.‌২৩

চারদিক আরও থমথম করছে। ঘ্যানঘ্যানে ইলশেগুঁড়ি ঝরছে আকাশ থেকে। গাছের পাতা–টাতাও তেমন নড়ছে না। রাতটাকে খুব রাগী আর গম্ভীর লাগছে আজ।

পরিমার্জিত থিওরিটা আবার মনে মনে আউড়ে নিলাম— প্রকৃতিই সর্বশক্তিমান। কখনও কখনও রাষ্ট্র এবং কোম্পানিও তার সঙ্গে লড়ে জিততে পারে না।

লকডাউন ডায়েরি – ১৮ মে, ২০২০

১৮.‌০৫.‌২০২০। সোমবার

সকাল ৬.‌৫০

আজ অনেক তাড়াতাড়ি ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে। কেন কে জানে!‌ সকাল সকাল যে কী করে এত গরম পড়ে!‌ মনে হয়, মাঝখানে রাতটা আসেনি। সূর্য পাটে বসেনি কাল। গেলেও কাছাকাছি কোথাও একটা ঘাপটি মেরে ছিল। সকাল হতেই একলাফে বেরিয়ে এসে আগুন ওগরাতে শুরু করেছে।

সকাল ৭.‌১৩

আবার অবাক করেছে অন্তরা!‌ কাল রাতে বাড়ি ফিরে ফেসবুক চেক করতে করতে ওর টাইমলাইনে একটা সাদা–কালো ভিডিও আর তার সঙ্গে ওর গান দেখলাম। শুনলাম। পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপন্নতা নিয়ে। খুব ভাল লাগল। গর্ব হল। আবার মনে হল, গুণী ছেলেমেয়েগুলো যখন আশেপাশে থাকে, তখন তাদের গেঁয়ো যোগী মনে হয়। অন্তরা যখন ‘এবেলা’য় আমার সঙ্গে কাজ করত, তখন এগুলো জানতামই না। ওকে বরাবর একজন হ্যাপি গো লাকি, ফান লাভিং আর বিন্দাস বাচ্চা বলে মনে হতো। ওইপর্যন্তই। সেই মেয়ের মধ্যে যে এই জিনিস থাকতে পারে, তখন একবারও মনে হয়নি। আসলে বাচ্চাটা বড় হয়ে গিয়েছে।

এই অন্তরাটাকে যেন ও ওর মতো করে বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের সকলেরই স্ক্রিপ্ট কেউ না কেউ কোথাও একটা লেখে। সেই চিত্রনাট্যে অন্তরা বরাবরের হিরোইন হয়ে থাক।

বেলা ১১.‌১৫

আজ থেকে ‘নাইট কার্ফু’ জারি হওয়ার কথা। এটা কতটা এবং কীভাবে এনফোর্সড হয়, সেটা দেখার জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকব। দেখতে চাইব, মানুষ কীভাবে এই আটবাঁধটায় সাড়া দেয়। কারণ, অধিকাংশ মানুষ তার ভিতরের বেসিক বিশৃঙ্খলায় বিশ্বাস করে। তার সঙ্গে বেশ খানিকটা অশিক্ষা। যারা এখনও বুঝতে পারছে না, যে একটা মারণ ভাইরাস সারা পৃথিবীকে নতজানু করে মাটিতে বসিয়ে দিয়েছে এবং তার পাল্লায় পড়লে নিমেষে প্রাণটা বেরিয়ে যেতে পারে, তাদের এভাবেই তালাবন্দি করে রাখতে হয়।

সমস্যাটা হল, আমরা করোনার চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছি লকডাউনকে!‌ লকডাউনের মেয়াদ আরও ১৪ দিন বেড়েছে শুনে চারপাশে যে সমবেত দীর্ঘশ্বাস পড়তে শুরু করেছে, তাতে ঘূর্ণিঝড় আমপানকে কিন্ডারগার্টেনে শিশু মনে হচ্ছে। লোকে বলবে প্যারানইয়া। আতঙ্কগ্রস্ততা। তাদের বলে বোঝানো যাবে না, এখন আতঙ্কটাই প্রয়োজন। খালিহাতে যারা বাঘ মারতে যায়, তারা বীর নয়। আকাট মূর্খ। গর্ধভ।

দেখা যাক, আগামী ১৪ দিন কীভাবে যায়। পাশাপাশি এটাও দেখতে চাই যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই নাইট কার্ফু বলবৎ করে কিনা।

দুপুর ১২.‌৩৯

আবার নর্মাল রুটিনে ফেরত গেলাম। ৪৫ মিনিট ওয়ার্কআউট। গরমের চোটে এসি চালিয়ে ওয়ার্কআউট করব বলে একবার ভেবেছিলাম। কিন্তু মধ্যবিত্ত বিবেক বড় ভীরু। বড় নাচার। তার মনে পড়ে গেল, ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি’ ইত্যাদি। অতএব ভ্যাপসা গরমেই কসরত করে ঘামে চপচপে টি–শার্ট গায়ে এই এন্ট্রি লিখলাম।

দুপুর ১.‌৩৩

আজ দুপুরের মেনু ডাল–ভাত–আলুসেদ্ধ আর ডিমসেদ্ধ। রাজা মেনু। এই বয়সে নাকি বেশি ডিম খাওয়া বারণ। কিন্তু এক–দুদিন খেলে কি আর কোলেস্টেরল লাঠি নিয়ে তাড়া করবে?‌

চিরকাল মাছ খাওয়ায় আপত্তি। ছোটবেলায় বড়মামু হাতে লাঠি নিয়ে বসে থাকত আর আমার হাঁ–মুখে মাছেভাতের গ্রাস ঠুসে দেওয়া হতো। সেই অত্যাচারে চোখ থেকে জলও গড়িয়ে পড়ত বলে জনশ্রুতি। একটু লায়েক হওয়ার পর জীবন থেকে মাছ বাদ দিয়ে দিলাম। লোকে শুনলে মারতে আসবে যে, ইলিশ মাছ খেতে ভাল লাগে না। একটাই কারণ— কাঁটা। ওই সরু সরু কাঁটা–ফাটা ছাড়িয়ে মাছ খাওয়া খুব বোরিং। অনেকে কাঁটাও চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। আমি পারি না। বেড়াল তো নই। তবে কেউ মাছ বেছে দিলে ঠিক আছে। ফলে মাছ বলতে আমার কাছে ভেটকি, আড়, পমফ্রেট বা চিংড়ি। অথবা লম্বা লম্বা তলোয়ারের মতো কাঁটাওয়ালা কাতলামাছের টুকরো। যাকে নরেন্দ্রপুরে ফ্ল্যাট পেটি বলে ডাকা হতো। হস্টেলে ডিম থাকলে খুব আনন্দ হতো। কারণ, থালা ধুতে কোনও চাপ নেই। পাতে কোনও বাড়তি এবং ফালতু জঞ্জাল নেই। এমনকী, চাইলে চেটেও থালা সাফ করে ফেলা যায়।

আমাকে অনেকে প্রশ্ন করে, ডিম কেন আমার সবচেয়ে প্রিয়?‌

ডিমে কাঁটা নেই!‌

দুপুর ২.‌০০

আজ সকালে মিঠু ওর টাইমলাইনে ক্রিকেটব্যাট কাঁধে ওর একটা ছোটবেলার ছবি দিয়েছে। সাদা–কালো। তার তলায় রাজা লিখেছে, ‘বন্ধু চল।’

পোস্টটা দেখে একদৌড়ে ৩০ বছর আগে চলে গেলাম। ক্রিকেট খেলে বড় হওয়ার স্বপ্ন আর গাব্দা কিটব্যাগ কাঁধে করে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে খেলতে যাওয়ার দিনগুলোয়। অফিসটাইমে ভিড় বাসে সেই ব্যাগের গুঁতো খেয়ে নিত্যযাত্রীদের গঞ্জনা। নিরীহ মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা। তারপর দু’দিনের ম্যাচ। সারা বছর বেলেঘাটা লেকের মাঠে কোচিং নিতে যাওয়া। উদয়াস্ত পরিশ্রম। সারাদিন ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা। বুস্টার লাগিয়ে ঝিরঝিরে টিভি স্ক্রিনে বাংলাদেশ ধরে চ্যানেল নাইনে খেলা দেখা এবং শেষমেশ অসমসাহসী হয়ে স্রেফ ডোনেশনের উপর ভর করে পাড়াতেই একটা কংক্রিটের উইকেট বানিয়ে ফেলা।

মধ্যবিত্ত সংসারে কষ্ট করে কেনা ইংলিশ উইলো। তাতে তার্পিন তেল মাখিয়ে সজুত করা। রাতে বালিশের পাশে নিয়ে নতুন ব্যাটের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঘু্মিয়ে পড়া। রোজ স্বপ্ন দেখা যে, চকচকে লাল বল কংক্রিট উইকেটের উপরের ম্যাটে পড়ে আরও দ্রুত ছুটে আসছে। আর কখনও সামনের পায়ে, কখনও ব্যাকফুটে গিয়ে কপিবুক ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করছি।

নেটে ব্যাট করতে গিয়ে রাউন্ডের শেষে মনে মনে কল্পিত ফিল্ডিং সাজিয়ে জেতার রান তোলার চেষ্টা করতাম। কখনও মিঠু নেটের ভিতরে উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে দুঃসাহসিক কিপিং করত। ক্রিজ ছেড়ে বেরোলেই চোখের পলকে উইকেট ভেঙে দেবে। কখনও রাজা আম্পায়ারের জায়গায় দাঁড়িয়ে বলত, ‘থ্রি ডেলিভারিজ টু গো। টেন রান্‌স টু গেট। জিতে দেখা!‌’ কখনও বাপ্পা ছোট রান আপে এসে বাতাসে ভাসিয়ে ছোট ছোট আউটসুয়িং করাত। আবার একই অ্যাকশনে এসে শেষমুহূর্তে কাঁধের জোরে একটা অফ কাটার মারত।

ব্যাট স্পিডের সঙ্গে ছুটে আসা লাল বলের একটা আত্মীয়তা আছে। ব্যাটের সুইট স্পটে বলটা ধাক্কা খেলে ‘টকাস’ করে একটা স্বর্গীয় আওয়াজ হয়। সেই আওয়াজটা শোনার জন্য ইডেনে কতবার খেলা শুরুর একঘন্টা আগে পৌঁছে গিয়েছি!‌ যাতে নেটটা দেখতে পারি। আর ওই আওয়াজটা ফাঁকায় ফাঁকায় কানে আসে।

স্কোয়্যার অফ দ্য উইকেটে স্ট্রং ছিলাম। আর ‘ভি’–এর মধ্যে খেলতে। মশারির মতো নেটে স্কোয়ার কাট, কভার ড্রাইভ বা ফ্লিক কতদূর গেল বোঝা যেত না। কখনও সখনও একেকটা স্ট্রেট ড্রাইভ গুলির মতো ছুটত বোলিং উইকেটের পাশ ঘেঁষে। সবুজ ঘাস ফালা ফালা হয়ে যেত বলের সিমে। ফলো থ্রুতে স্ট্রোকটা ফিনিশ করে যতক্ষণ দেখা যায়, তাকিয়ে থাকতাম।

ছোটবেলার ইনজামাম উল হকের মতো দেখতে মিঠুর ব্যাটিংয়ে একটা অলস সৌন্দর্য ছিল। কালেভদ্রে বোলিং করত। করলে লাইনে লাইনে। বাপ্পা মূলত বোলার ছিল। কিন্তু ব্যাটটাও দারুণ করত। রাজা ওয়াজ আ ডেড সিরিয়াস ব্যাট। ফিল্ডিংয়ে প্রচণ্ড জোর দিতাম। ফিল্ডিং নিয়ে প্রচণ্ড খাটতাম। আসলে আমরা ফিল্ডিং করতে ভালবাসতাম। পৃথিবীটা ছিল একটা অতিকায় স্কোরবোর্ডের মতো। সেখানে রোজ নিজেদের রান বাড়ানোর চেষ্টা করে যেতাম।

দোজ ওয়্যার দ্য ডেজ মাই ফ্রেন্ড। আই থট দে উড নেভার এন্ড!‌

দুপুর ২.‌২৩

আজ বেসরকারি বাস পথে নামেনি। হলুদ ট্যাক্সির অবস্থাও নাকি তথৈবচ। অন্তত টিভি তেমনই বলছে। আরও বলছে, সরকারি বাসও নাকি পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। রাস্তায় বেদম ভিড়। এই অবস্থাটা কাম্য ছিল না। একেবারেই কাম্য ছিল না।

বিকেল ৪.‌১০

কেন্দ্যীর সরকারের নির্দেশিকা মেনেই পশ্চিমবঙ্গে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত লকডাউন থাকবে। নবান্নে জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে ঘোষিত নাইট কার্ফু নয়। যেমন মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আমরা অফিশিয়ালি কার্ফু বলবৎ করছি না। কার্ফু শব্দটা ভাল নয়। দাঙ্গা–টাঙ্গা হলে বা ওইধরনের কোনও গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি হলে কার্ফু জারি করা হয়। এটাও অবশ্য গুরুতর পরিস্থিতি। কিন্তু আমরা কার্ফু শব্দটা ব্যবহার করছি না। মানুষকে দমবন্ধ করে টেনশনে ফেলা উচিত নয়। আপনারা লকডাউন মেনে চলবেন। রাস্তায় গ্যাদারিং হলে কিন্তু পুলিশ অ্যাকশন নেবে।’

পাশাপাশিই মুখ্যমন্ত্রী জানাচ্ছেন, ২১ মে থেকে আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস চালু হবে। চালু হবে অটোও। অটো চালানোর আগে পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে। কনটেনমেন্ট জোনের বাইরে সব বড় দোকান খুলবে ওইদিন। দোকানে মাস্ক এবং গ্লাভস বাধ্যতামূলক। স্যানিটাইজারও রাখতে হবে। খুলবে সেলুন, পার্লার ইত্যাদিও। সামাজিক দূরত্ব মেনে খোলা হবে হোটেল। তবে রেস্তোঁরা এখনই খুলছে না।

২৭ মে খুলবে হকার্স মার্কেট। জোড়–বিজোড় নীতি মেনে হকার্স মার্কেট খুলতে পাস দেবে পুলিশ। সর্বত্র মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার রাখতে হবে। যেখানে যেখানে সম্ভব, সেখানে খেলাও শুরু হবে। প্রাথমিকভাবে ইন্ডিভিজ্যুয়্যাল স্পোর্ট। কিন্তু কোনও দর্শক থাকবে না।

করোনাভাইরাসের প্রকোপের নিরিখে বিভিন্ন এলাকাকে এ, বি এবং সি জোনে ভাগ করা হবে।
‘এ’— অ্যাফেক্টেড জোন
‘বি’— বাফার জোন
‘সি’— ক্লিন জোন

বিকেল ৪.‌২২

সুপার সাইক্লোন আমপান নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সেখানে সমস্ত রাজ্যের প্রতিনিধিকে ডাকা হয়েছিল। ওই বৈঠক নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, রাজ্যের মুখ্যসচিব বা স্বরাষ্ট্রসচিবকে ওই বৈঠকের বিষয়ে কিছু জানায়নি দিল্লি। অবহিত করেনি মুখ্যমন্ত্রীকেও। তার বদলে দিল্লিতে নিযুক্ত পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট কমিশনারকে ডেকেছিল বৈঠকে।

পশ্চিমবঙ্গের কুপিত মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘রেসিডেন্ট কমিশনারকে ডেকে ব্রিফ করেছেন হোম মিনিস্টার। এটা অসৌজন্য। এটাকে অসাংবিধানিক বলব কিনা জানি না। কিন্তু ওঁরা আমাদের কাউকেই কিছু জানাননি। রেসিডেন্ট কমিশনার তো আর ব্যাপারটা সামলাবে না। কাজটা তো করছে রাজ্য সরকার। তো তাদেরই কিছু জানানো হল না?‌ এই ব্যাপারটা আমাকে ভাল করে দেখতে হবে।’

সন্ধ্যা ৭.‌৪৪

আমপান যেভাবে শক্তিবৃদ্ধি করছে, মনে হচ্ছে সাময়িকভাবে করোনাকে পিছনে ফেলে দেবে। টিভি–তে ঘনঘন আপডেট, হাওয়া অফিসের কর্তার বাইট এবং তার সঙ্গে স্যাটেলাইটে ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান নিয়ে নিরন্তর চর্চা। অফিসে সহকর্মীদের কাছে যা শুনছি, এর কাছে আয়লা–টায়লা নাকি একেবারে বাচ্চা। ঝড়ের গতিবেগ হতে পারে ঘন্টায় ১৮০ কিলোমিটার। ইতিমধ্যেই উপকূলে সতর্কতা জারি হয়েছে। হ্যান্ডমাইক নিয়ে ধাতব গলায় প্রশাসনিক আধিকারিকরা লোকজনকে সতর্ক করতে বেরিয়ে পড়েছেন।

কিন্তু আসল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে বাসিন্দাদের তুলে এনে রাখা হবে কোথায়?‌ কোনও স্কুল বা কলেজের বাড়িতে রাখলে সেখানে তো আবার সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানা যাবে না। বাড়িতে থাকলে আমপানে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। শেল্টারে থাকলে করোনায় ধরবে। এই উভয়সঙ্কটে লোকগুলোর যে কী হবে!‌ তবে মাটির মানুষদের সহ্যশক্তি প্রবাদপ্রতিম। তাঁরা ঠিক বেঁচে থাকবেন এবং টুকটুক করে ভাঙা জীবনের অংশগুলো কুড়িয়ে আবার জোড়া দিয়ে নেবেন।

ঘূর্ণিঝড়ের কথা উঠলেই ‘সিডার’–এর কথা মনে পড়ে। সাধারণত, প্রতিটা ঘূর্ণিঝড়ই এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলা কোলে টেনে নেয়। সেবারও তা–ই হয়েছিল। বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কয়েক হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছিল। কলকাতা থেকে কভার করতে গিয়েছিলাম। তখন ঋতব্রত ভট্টাচার্য কাজ করত তৎকালীন স্টার আনন্দে। ও–ও জুড়ে গেল আমার সঙ্গে।

ঢাকায় একদিন কাটিয়ে পরদিন বিশাল পদ্মা পেরিয়ে বরিশালে গেলাম। জেটি থেকে ডেক পর্যন্ত পাতা পাটাতন পেরিয়ে স্টিমারে পরপর যাত্রী–সহ গাড়ি উঠে গেল। আমরাও সেভাবেই গেলাম। এমন অভিজ্ঞতা তার আগে কখনও হয়নি। পদ্মা পেরনোর সময় উপরের ডেকে গিয়ে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলাপ করলাম। দারুণ মানুষ। এবং বাকি বাংলাদেশিদের মতোই অসম্ভব অতিথিবৎসল। চলন্ত স্টিমার থেকেই জাল ফেলিয়ে মাছ তোলালেন। ওপারে পৌঁছতে পৌঁছতে সেই মাছ কাটিয়ে, ভাজিয়ে খাইয়েও দিলেন।

বরিশালে নেমেই মা’কে ফোন করলাম। মা প্রবল উত্তেজিত গলায় গড়গড়িয়ে বলতে শুরু করল, ‘অমুক পাড়ার তমুক বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করিস। ওখানে একটা কাঠচাঁপার গাছ ছিল। সেটা আছে কিনা একটু দেখিস তো!‌ বড়মামুকে ফোন করে জিজ্ঞাসা কর। তোকে ঠিকঠাক বলে দিতে পারবে।’

আবেগতাড়িত মায়ের সিডার কোনওক্রমে থামিয়ে বললাম, অ্যাসাইনমেন্টে এসেছি। মাতামহের ভিটে এবং তার আঙিনায় কাঠচাঁপা গাছের খোঁজে নয়।

দিনতিনেক ছিলাম বরিশালে। সত্যিই ‘আইতে শাল, যাইতে শাল’। সাঁতার জানতাম না। এখনও জানি না। পড়ে গেলে স্রেফ একটা ঢিলের মতো ডুবে যেতাম। কিন্তু রোজ নৌকা করেই ঘুরতাম। কোথাও নদী, কোথাও খাল, কোথাও খাঁড়ি। দেখতাম, কী অবর্ণনীয় কষ্ট মানুষের। ঘূর্ণিঝড় তাঁদের প্রান্তিক সংসার ওলটপালট করে দিয়ে গিয়েছে। রাস্তায় বসে আছেন মাথায় হাত দিয়ে। তাঁদের ভাষায় কথা–বলা ভিনদেশি সাংবাদিক দেখে আঁকড়ে ধরে কষ্টের কথা বলতেন। তাঁদের পাশেই ভেঙেচুরে যাওয়া রাস্তার উপর কাঠের উনুন জ্বালিয়ে ভাত রান্না হতো। আতুর মানুষের গায়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ থাকে। ভাতের সুবাস আর সেই ক্লিন্ন গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত।

আমপান নিয়ে যে পরিমাণ উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে সেই মানুষগুলো আবার জলে পড়বেন।

রাত ১০.‌৩১

চার নম্বর লকডাউনের প্রথমদিন কেটে গেল। ডায়েরি বন্ধ করার আগে চোখ বুজলে শুনতে পাচ্ছি ব্যাটের সুইট স্পটের ‘টকাস’ শব্দটা। সবুজ ঘাস চিরে বাউন্ডারির দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে চকচকে নতুন বল। লকডাউনের পৃথিবীর স্কোরবোর্ডে আরও কিছু ধৈর্যের রান জুড়ল। ‌

লকডাউন ডায়েরি – ১৭ মে, ২০২০

১৭.‌০৫.‌২০২০। রবিবার

সকাল ৮.‌২৮

কাল রাত আড়াইটেয় শিবাজির হোয়াট্‌সঅ্যাপ ঢুকল। রাজশেখর বসুর লেখা ‘মহাভারত’। টোটাল ৭২০ পাতা। কী বলে যে ওকে ধন্যবাদ দেব জানি না। নিশ্চয়ই ‘লকডাউন ডায়েরি’–তে পড়েছিল যে, আমি অ্যামাজনে ‘মহাভারত’ না পেয়ে হা–হুতাশ করেছি। তারপর নিজেই উদ্যোগী হয়ে পাঠিয়েছে। এইসব সময়ে কৃতজ্ঞতা জানানোর শব্দ কম পড়ে যায়।

কাল অনেক রাতে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। একটু আধটু হাওয়া দিচ্ছিল। দূরে রাস্তার দুটো হ্যালোজেন ভেপার ল্যাম্প কেন জানি না বন্ধ ছিল। তাই উপরে রাতের আকাশটাকে আরও গাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল। আর সেই আকাশে জ্বলজ্বল করছিল একটিমাত্র তারা। ওটা কি শুক্রগ্রহ?‌ ঠিক জানি না। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তেমন ফান্ডা নেই। কিন্তু তারাটা দেখতে আশ্চর্য লাগছিল। একটু বেশিই যেন উজ্জ্বল।

সকাল ৯.‌০৬

কাল থেকে রাস্তায় বেশি সরকারি বাস নামবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ, প্রাইভেট বাসের বাড়াবৃদ্ধির দাবি নাকচ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। নাকচ হয়ে গিয়েছে ট্যাক্সির ভাড়াবৃদ্ধির প্রস্তাবও। ফলে বেসরকারি বাস–ট্যাক্সি রাস্তায় না নামলে চাপ সামলাতে অতিরিক্ত সরকারি বাস নামাতে হবেই। সেই প্রস্তুতিই দেখছি আজ দিনভর চলছে। বিভিন্ন বাস ডিপোয় সার সার সরকারি বাস স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। পিপিই পরিহিত অদ্ভুতদর্শন কর্মীরা সেই কাজে ব্যাপৃত।

দুপুর ১২.‌৪৮

নীচে যেতে ভয় লাগছে। কাল থেকেই মা খুব ভেঙে পড়েছে। অনর্গল কান্নাকাটি করছে। আসলে মায়েরা পাঁচ ভাইবোন খুব ঘনিষ্ঠ। পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসা ইস্তক বেঁধে বেঁধে থেকেছে। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর মামাবাড়ির সংসারে গিয়ে গঞ্জনা শুনে বড় হয়েছে। যে বাড়িতে বাটিতে করে ভাত মেপে দেওয়া হতো। দিনে একবারের বেশি হাগু করলেই বলা হতো, পেট খারাপ। পরদিন খাওয়া বন্ধ!‌

অপমানে, অসম্মানে সেই বাড়ি ছেড়ে চলে এসে দিদাকে নিয়ে পাঁচজন যাদবপুরে টালির চালের ঘর থেকে জীবনে যে যার মতো করে দাঁড়িয়েছে। মা ছিল সেই কলোনি ঘরের পরিশ্রমী, উপার্জনক্ষম কন্যা। যে প্রচুর কষ্টে পড়াশোনা করে সংসার চালানোর ব্যয় নির্বাহ করত। বাকি দুই বোন তাকে নিঃস্বার্থভাবে সাপোর্ট দিত। মায়ের জীবনের গল্প শুনতে শুনতে মনে হয়েছে, ‘মেঘে ঢাকা তারা’র সুপ্রিয়া দেবীর চরিত্রের সঙ্গে অদ্ভুত মিল। বড়মামু আর ছোটমামুও উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছে। মা বলছিল, ‘ছোটমামুর প্রথম পোস্টিং ছিল জলপাইগুড়িতে। ছুটিতে বাড়ি আসত। মা বলত, তোর নতুন চাকরি। এত ছুটি নিস না! ‌ও বলত, না–না, আমি তোমাদের সঙ্গে একটু থাকতে চাই। অফিসে রিকোয়েস্ট করলে কয়েকদিন ছুটি বাড়িয়ে দেবে ঠিক।’

মা বলছিল, ‘মাইনের টাকা বাঁচিয়ে তোর জীবনের প্রথম ট্রাইসাইকেলটা কিনে দিয়েছিল ছোটমামু। তুই যখন টেপ রেকর্ডারের জন্য মাথা খাচ্ছিস আর আমার সামান্য শিক্ষকতার মাইনেতে তার সঙ্কুলান হচ্ছে না, তখন ছোড়দা যেচে এসে টাকাটা দিয়ে দিয়েছিল। এগুলো ভুলব কী করে?‌’

শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, অস্টিও আর্থ্রারাইটিসে শয্যাশায়ী মা কতবার বলেছে একবার লাবনিতে ছোটমামুর কাছে নিয়ে যেতে। বলেছে, ‘অনেকদিন ছোড়দাকে দেখিনি। ‌আমার পা’টা একটু ভাল হয়ে গেলে একবার নিয়ে যাবি?’ পারিনি। আসলে যাইনি। নিজের সময়কে মায়ের ইচ্ছের চেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দিয়েছি। মনে হয়েছে, মা’কে তিনতলা পর্যন্ত তুলে নিয়ে যাব কী করে?‌ অসুস্থ হয়ে পড়ায় একবার একতলার ঘর থেকে কোলে করে গাড়িতে তুলেছিলাম। কিন্তু তিনতলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ভেবেছি, ঠিক আছে। হবে’খন। একদিন না হয় নিয়ে যাব।

সেটা আর হল না।

কাল দুপুরে যখন ছোটমামুকে নিয়ে কাচের গাড়িটা আমাদের বাড়ির প্রায় গা বেয়ে বাইপাস ধরছিল, তখন কেন জানি না আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছিল একলা একটা খাটে শুয়ে থাকা মায়ের কথা। কাঁদতে কাঁদতে যার চোখের জল ততক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে। বাড়ি ফেরা পর্যন্ত আমি আর যোগাযোগই করিনি। মুনমুনকে বলেছিলাম ও যেন মা’কে সবসময় আপডেটেড রাখে।

ফেরার পর মা আমাকে শিশুর মতো হাত বাড়িয়ে একবার জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল। আমি বলেছি, নাহ্‌, আমি সারাদিন হাসপাতালে–শ্মশানে ঘুরেছি। হেভি এক্সপোজার। তুমি এখন আমাকে ছুঁয়ো না। কাল সকালে কথা হবে।

আজ সকালে ঘর ‘মপ’ করার সময় মা ঝরঝরিয়ে ছোটবেলার দুঃখকষ্টের মধ্যেও একসঙ্গে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্তগুলোর কথা বলছিল। মনে হচ্ছিল, জীবনধারণের জোটবদ্ধ স্ট্রাগল মানুষকে এক আশ্চর্য স্নেহ–ভালবাসার সুতোয় বেঁধে দেয়। যত দিন যায়, তত সেই বাঁধন শক্ত হয়। মানুষগুলো এদিক–ওদিকে ছড়িয়ে পড়লেও বাঁধন ছেঁড়ে না। যাদবপুরের কালিবাড়ি লেনের টালির চালের দু’কামরায় যে পরিবার কষ্টে দিন কাটাত, তারা এখন কেউ ফ্ল্যাটে, কেউ নিজের বাড়িতে। কিন্তু জীবনের সেই দিনগুলো তাদের এখনও আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে।

দুপুর ১.‌২৩

এতক্ষণ প্রচুর কাজ করলাম। প্রথমে রান্না। তারপর বোতলে জল ভরলাম। এই কাজটার মতো বোরিং বিষয় জীবনে দুটো নেই। কিন্তু করতে তো হবেই। আফটার অল, জলের অপর নাম জীবন। বহুদিন পর বাড়ির দুটো তলা ‘মপ’ করলাম। গাড়িও ধুলাম। অনেকদিন গাড়ি ধোয়া হয় না। খুব ময়লা হয়েছিল। নিজেরই উঠতে কেমন একটা লাগত। আরেকটা তুকও আছে। দেখেছি, আমি গাড়ি ধুলেই বৃষ্টি নেমে সেটা কাদা–কাদা হয়ে যায়। তাই গাড়ি ধুয়ে বৃষ্টিকে আবাহনের চেষ্টা। নইলে যা গরম পড়েছে, কিছুদিনের মধ্যে বাষ্প হয়ে উড়ে যাব!‌

‘আম্ফান’ না কী একটা জটিল নামের ঘূর্ণিঝড় কোথা থেকে একটা আসবে আসবে করেও কাঁচরাপাড়ার লেভেল ক্রসিংয়ে আটকে আছে। গাড়ি ধুয়ে সেই ড্রপগেটটা যদি তোলা যায়। কাল হয়ে ওঠেনি। আজও ওয়ার্কআউট করা হল না। ফলে আজ গাড়ি ধোয়াটাই আমার শরীরচর্চা হয়ে রইল। কাল থেকে আবার নর্মাল রুটিনে ফিরব। কারণ, জীবন থেমে থাকে না।

দুপুর ২.‌১৭

ছোটমামুর পারলৌকিক কাজ নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে পরিবারের বিভিন্ন খাপখোপে। এটা আমার কাছে একইসঙ্গে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং বিরক্তিকর ব্যাপার। কোনওদিনই লৌকিকতায় বিশ্বাস করিনি। এখনও করি না। পারতপক্ষে কোনও শ্রাদ্ধবাড়িতে যাই না। গেলেও কিছু খাই না। শুধু ফুল দিয়ে নমস্কার জানিয়ে চলে আসি। খুব অস্বস্তি হয়। আর ওই যে শ্রাদ্ধের পর ‘মৎস্যমুখ’ বলে একটা কাণ্ড হয়, সেটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের ধ্যাষ্টামি বলে মনে হয়। একজন পরপারে চলে গিয়েছেন আর লোকে কব্জি ডুবিয়ে মাছ খাচ্ছে। তার মাঝখানে পারিবারিক হাট বসেছে। লোকে ছবি তুলছে। সেল্‌ফি নিচ্ছে। অশ্লীল অর্থহীন অপচয়!‌

ছোটবেলার এক বন্ধু (‌বন্ধু বলা ঠিক হল না। তবে এছাড়া আর কী বলব?‌ পরিচিতের চেয়ে বেশি আফটার অল)‌ তার বাবার মৃত্যুর শ্রাদ্ধের দিন হাসি হাসি মুখে মা’কে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছিল। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম!‌ এদের কি বয়স বাড়ে না?‌ নাকি ছেলেটা বরাবরই এইরকম গবেট, প্রগলভ আর নির্লজ্জভাবে সেল্‌ফ প্রমোশনাল ছিল?‌ কে জানে!‌ ওই ছবিটা এতবড় টার্ন অফ ছিল যে, ছেলেটির সঙ্গে আর কথা বলারই প্রবৃত্তি হয়নি। কোনওদিন হবেও না।

ছোটমামু কড়াধাঁচের বামপন্থী ছিল। এতটাই যে, বাড়িতে ‘গণশক্তি’ রাখত। সারাজীবন সিটু করেছে মন দিয়ে। সেই লোকটা থাকলে যে শ্রাদ্ধশান্তি করতে বাধা দিত, তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। দিদা চলে যাওয়ার পর যখন লোক খাওয়ানো হয়েছিল, তখনও ছোটমামু প্রভূত গজগজ করেছিল। আমি থাকতে পারিনি। গুজরাত ভূমিকম্প কভার করতে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরে শুনেছিলাম, ছোটমামু ভাল করে খায়ওনি। অথচ, খেতে ভালবাসত। তরিবত করে খেতও। ডাল খেতে খুব ভালবাসত। কিন্তু সেদিন সেসব ছুঁয়েও দেখেনি।

ঠিকই করেছিল।

বিকেল ৫.‌০০

মহারাষ্ট্র আর তামিলনাড়ুতে ৩১ মে পর্যন্ত লকডাউন বাড়িয়ে দেওয়া হল। যা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, গোটা দেশও লকডাউনটা ৩১ মে পর্যন্ত টানবে। আজ রাতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করার কথা। কিন্তু বুঝহ যে জন জানহ সন্ধান। ফলে বুদ্ধিমান লোকেরা বুঝে গিয়েছে, এই মাসটা পুরোই তালাবন্ধ থাকবে।

শহরের কিছু কিছু আমোদগেঁড়ে অবশ্য ধরে নিয়েছে, এখনও পর্যন্ত যখন প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে কোনও ভাষণ দেননি, তখন লকডাউন কাল থেকেই শিথিল করে দেওয়া হবে। আবার ক্যালক্যাল করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া যাবে। পাড়ার মোড়ে গুলতানি করা যাবে আর চায়ের দোকানে রাজা–উজির মারা যাবে। ফলে তারা কাছাখোলা হয়ে আজকেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। এই ছাগশিশুদের যদি বোঝানো যেত যে, কোনও সরকারি ঘোষণা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে টিভি–তে আসতে হয় না। একটা সরকারি কাগজই যথেষ্ট। রাজনীতিকরা সেই কাগজ হয়ে টিভি–তে আসেন। কারণ, তাঁরা ফুটেজ খেতে চান।

বিকেল ৫.‌৪৫

চেতলা থেকে এসএওস এসেছে— ট্রাইপড অসুস্থ। নেতিয়ে পড়েছে। হাঁটাচলাও করছে না। শরীরের কোথাও একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু গায়ে হাত দিতে দিচ্ছে না। ডাক্তার দুটো ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছেন। কিন্তু চেতলায় সমস্ত ওষুধের দোকান বন্ধ। ইমিডিয়েটলি ওষুধ দিতে হবে। তা না হলে ও আরও নেতিয়ে পড়বে। অফিসে বসে বসেই সল্টলেকের তিনটে দোকানে ফোন করলাম। সব বন্ধ। সেবা হাসপাতালের নীচে দোকানটা খোলা থাকবে ভেবেছিলাম। কিন্তু সেটাও নাকি রবিবার বন্ধ থাকে। কী করি!‌

সন্ধ্যা ৬.‌৫০

ফাটিয়ে দিয়েছি!‌ সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৫০ মিনিটের থ্রিলার। ওষুধের খোঁজে নেমে জানা গেল, বিডি ব্লকে একটা দোকান নাকি খোলা আছে। সেদিকেই রওনা হয়েছিলাম। মাঝখানে ঝাঁ করে মনে হল, অতদূর কেন?‌ জিডি মার্কেটটা একবার দেখে নিই না। কীমাশ্চর্যম, ওষুধের দোকান খোলা এবং ফাঁকা পাওয়া গেল। পাশাপাশিই জানা গেল, সোমবার মার্কেটের রুটিন ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিনই এই ওষুধের দোকান রাত সাড়ে ৮টা–৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

ওষুধ কিনেই একছুটে চেতলা। ওষুধ দিয়ে একদৌড়ে অফিস। লকডাউন জিন্দাবাদ!‌

সন্ধ্যা ৭.‌০২

বুদ্ধিমানেরা যা ভেবেছিলাম। ৩১ মে পর্যন্ত বাড়ল লকডাউন। পাশাপাশিই এবার জারি হচ্ছে নাইট কার্ফু। সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত কোনও অবস্থাতেই ঘর থেকে বেরোন নিষিদ্ধ। একমাত্র একান্ত জরুরি প্রয়োজনে এবং সরকারি অনুমতি–সহ বেরোন যেতে পারে। গাইডলাইন–সহ এই নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। সেখানে আগের গাইডলাইনগুলো অক্ষতই আছে। সঙ্গে দুটো ইন্টারেস্টিং জিনিস জুড়েছে।

১.‌ একত্রে ৫০ জন বা তার কম লোক নিয়ে বিয়েবাড়ি হতে পারবে।
‌২.‌ স্পোর্টস কমপ্লেক্স খোলা যাবে। কিন্তু কোনও দর্শক থাকবে না।

আর হ্যাঁ, ৩১ মে পর্যন্ত বাড়ল ‘লকডাউন ডায়েরি’–র মেয়াদ। যেমন বাড়ল পথিমধ্যে আটক–থাকা মুখে মাস্ক আর কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষায় থাকা মানুষের হয়রানি।

রাত ১০.‌৪০

আরও একটা চাপের রবিবার কেটে গেল। এবার বাড়ি ফিরব। যে বাড়িতে এক প্রায়ান্ধকার ঘরে বিছানায় লেপ্টে আছে এক ক্ষীণসার চেহারা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁতের শাড়ি আর কপালে বড় টিপ–পরা যে মেয়েকে সম এবং অসমবয়সী পড়ুয়ারা চোখে হারাত, গরিব বাড়ির মেয়ে হয়েও রোজ পরিষ্কার, পাটভাঙা শাড়ি পরে ক্লাস করতে যাওয়ায় আড়ালে যাকে ‘টিপটপ’ বলে ডাকা হতো, সে এখন শিশুর মতো আত্মভোলা হয়ে গিয়েছে।

আজ বাড়ি ফিরতে অস্বস্তি হচ্ছে। মনে পড়ছে, ওই শিশু বলেছিল, ‘পা’টা ভাল হয়ে গেলে আমাকে একবার ছোটমামুর কাছে নিয়ে যাবি?‌’

যেমন এক রুগ্ন বালিকা তার ছোটভাইকে বলেছিল, ‘সেরে উঠলে আমাকে একদিন রেলগাড়ি দেখাবি?‌’

লকডাউন ডায়েরি – ১৬ মে, ২০২০

১৬.‌০৫.‌২০২০‌। শনিবার

সকাল ৭.‌১৫

আবার পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু। এবার উত্তরপ্রদেশের সড়কে। ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আরও ৩৫ জন আহত।

এটা কি পরিযায়ী শ্রমিকের মড়ক?‌ তা তো নয়। এটা তো করোনা অতিমারী। প্যানডেমিক। কিন্তু ইদানীং রোজ সকালে টিভি খুললেই দেশের কোথাও না কোথাও পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। রেলপথে আর নয়। এবার সবই সড়কপথে। কারণ, এই পরিযায়ী শ্রমিকরা আর বোধহয় রেলপথ ধরে হাঁটছেন না। তাঁরা এবার নেমে এসেছেন সড়কে। এত ট্রেন এতদিক থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে তাঁদের নিজস্ব রাজ্যে ঢুকছে। তবু মনে হচ্ছে, শ্রমিকসমুদ্র এখনও বহমান। ঠিকই। সাগর থেকে এক ঘটি জল তুললে তার আয়তন কি কমে যায়?‌ যে পরিমাণ পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরে এসেছেন, তাঁদের সংখ্যা যাঁরা এখনও পথে পথে ঘুরে মরছেন, তাঁদের তুলনায় নগণ্য।

লকডাউন না হলে কি আমরা এই শ্রমিকদের কথা আদৌ জানতে পারতাম?‌ আমাদের শহুরে এবং দৈনন্দিন আপাত–ব্যস্ততার জীবনে তো এঁদের কোনও অস্তিত্বই ছিল না!‌ এখন যেভাবে প্রত্যেকদিন তাঁরা আমাদের প্রাতরাশের টেবিল থেকে ডিনারের মেনু জুড়ে থাকেন, তাতে মনে হয় এদেশে ওঁরাই সংখ্যাগুরু। মনে হয়, লকডাউনের আকস্মিক পদাঘাতে উইয়ের ঢিবি ভেঙে গিয়েছে। আর সেই ভাঙাচোরা বসত থেকে বেরিয়ে আসছে শ’য়ে–শ’য়ে, হাজারে–হাজারে, লক্ষে–লক্ষে বল্মীক। তারা ছেয়ে ফেলছে আমাদের চারপাশ। বাইছে আমাদের গায়ে–পায়ে–মাথায়। গা ঝাড়া দিয়ে আমরা তাদের ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছি। কিন্তু তারা গা বেয়ে মুখ–মাথা হয়ে সটান ঢুকে পড়ছে আমাদের মগজে।

ছেড়ে যাচ্ছে না। বেরোচ্ছে না। বেরোবেও না কোনওদিন।

সকাল ৮.‌১৫

মুনমুন ফোন করেছিল। ছোটমামু আর নেই।

শুনে খানিক ঝুম হয়ে বসে রইলাম। তারপর এক এক করে সাজাতে লাগলাম— এখন কী কী করণীয়।

ছোটমামি চলে গিয়েছে অনেক বছর আগে। নিঃসন্তান ছোটমামু সল্টলেকের লাবনিতে থাকে আমাদের ছোটমাসি, পাখিমাসিকে নিয়ে। আজীবন এলআইসি–র কর্মী, একটা পা একটু টেনে চলা এবং বামপন্থী ইউনিয়ন করা ছোটমামু বহিরঙ্গে অত্যন্ত লাউড। চেঁচিয়ে ছাড়া কথা বলতে পারে না। এককালে চিমনির মতো সিগারেট খেত। প্লেন চারমিনারও খেতে দেখেছি অনর্গল। কয়েকবছর আগে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা এবং ছাড়িয়ে আনার সময় আমিই ধমকে ছাড়িয়েছিলাম। কিন্তু মা’দের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র ছোটমামুই সকলের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে খোঁজখবর নিত নিয়মিত। ছোটবেলায় সেটা অবাক হয়ে দেখতাম। দেখতাম, রোজ একবার করে ফোন করত। রোজ!‌‌

সেই ছোটমামু গত দেড়বছর ধরে ক্যান্সারে ভুগছে। আমি আর মুনমুনই ডাক্তার–বদ্যি করেছি। প্রথমে টাটা মেমোরিয়াল। তারপর ক্যান্সার স্পেশালিস্ট সুবীর গাঙ্গুলির কাছে। বিচক্ষণ, বাস্তববাদী এবং সুচিকিৎসক সুবীরদা তখনই বলেছিলেন, ‘বাঙালির গড়পড়তা আয়ু ৭২ থেকে ৭৬ বছর। উনি এখন ৮৫। সেটা মাথায় রেখো।’ সুবীরদার পরামর্শক্রমেই ছোটমামুকে অ্যাপোলোতে প্যালিয়েটিভ রেডিয়েশন দিতে নিয়ে গিয়েছি পরপর দশদিন। যাতে অফিসে যেতে অসুবিধা না হয়, সেজন্য সকাল ৮টায় রেডিয়েশন বুক করেছি। প্রত্যেকদিন লাবনির তিনতলার ফ্ল্যাট থেকে ছোটমামুকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আবার ঘন্টাখানেক পর ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে নিয়মিত ব্লাড টেস্ট, ওষুধ, ওরাল কেমো।

কিন্তু পরিবারের কাউকে কিছু জানতে দেওয়া হয়নি। আমি নিজে একটা রগচটা ইমেজ রাখি। কারণ, তাতে অনেক অবাঞ্ছিত প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যায়। সকলে একটা নিরাপদ দূরত্ব রেখেই চলে। এসব ক্ষেত্রে তাতে আরও আরও সুবিধা। রইল বাকি মুনমুন। ছোটমামুর ক্ষেত্রে ওই ছিল প্রাইমারি কেয়ারগিভার। মুনমুন যা করেছে, তা অভাবনীয়। কিন্তু, ওরও মুখ আমার কথায় বন্ধ ছিল।

ছোটবেলা থেকে হাই পাওয়ারের চশমা। তারপর এই বয়সে ডানচোখের পাতায় ক্যান্সার। চোখে দেখতেই পেত না ছোটমামু। কিন্তু প্রত্যেক ভিজিটে সুবীরদার ঘরে ঢুকেই আন্দাজে হাতজোড় করে বলত, ‘নমস্কার ডাক্তারবাবু। আপনি ভাল আছেন?‌’ সুবীরদা ছোটমামুর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পলিটিক্স নিয়ে আলোচনা করতেন। বলতেন, সিপিএমের কোনও চান্স নেই। ছোটমামু বিমর্ষ হতো। বেরোনর মুখে বলত, ‘আমাকে কেমন দেখলেন?‌ একেবারে ফিট না?‌’

সুবীরদা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে বলতেন, ‘আমার তো গতবারের চেয়ে অনেক ফিট লাগল। আপনার কী মনে হচ্ছে? ওই কবিতাটা একবার শোনাবেন নাকি?‌’

ব্যস! কোনওদিন ছাত্র পড়িয়েছে, এমনকিছু মা বা অন্য কারও কাছে শুনিনি। কিন্তু ছোটমামু উদাত্ত গলা কাঁপিয়ে শুরু করত কালিদাস রায়ের ‘ছাত্রধারা’—

‘বর্ষে বর্ষে দলে দলে, আসে বিদ্যামঠতলে..‌।’

ছোটমামুকে একবারও বলিনি, অসুখটা কী। মেসো মানে মুনমুনের বাবা ছাড়া পরিবারেরও কাউকে বলিনি। প্রথমত প্রত্যেকেই বয়স্ক। ক্যান্সার শুনলে তখন থেকেই কান্নাকাটি পড়ে যেত। কারণ, প্রায় ৩০ বছর আগে মুনমুনের মা, খুকুমাসিও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালে চলে গিয়েছিল। তার একটা এফেক্ট এখনও আছে। গোটা ফ্যামিলিতে বিষন্নতার ছায়া মোকাবিলা করা খুব কঠিন। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক পরিবারেই কিছু পাকা এবং তেঁএটে খচ্চর থাকে, যারা পারিবারিক পলিটিক্সের রাশ নিজের হাতে রাখতে এবং সেই অনুযায়ী বাকিদের নাচাতে ভালবাসে। আমাদের পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়। তাদের থেকে তথ্যটা গোপন রাখা জরুরি ছিল। কিন্তু জানতাম, একটা ইতিমধ্যেই হেরে যাওয়া যুদ্ধ লড়ছি। শুধু লড়াইয়ের জন্যই লড়া।

টাটা মেমোরিয়ালে গেলে একটা মিশ্র অনুভূতি হতো। ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে একটা হুইলচেয়ারে ছোটমামু বসে বসে ঝিমোত। আমি আর মুনমুন ওয়েটিং বে’তে বসে থাকতাম। দেখতাম আশেপাশে সার সার অসুস্থ মানুষ ধৈর্য ধরে বসে আছেন। কখন ভিতরে তাঁর ডাক পড়বে তার অপেক্ষায়। তাঁদের মধ্যে কিশোর–কিশোরীও আছে। কেমোথেরাপির দাপটে মাথার চুল উঠে গিয়েছে। অনেকে হুইলচেয়ার–বাউন্ড। এখন মনে পড়ছে, সেখানেই প্রথম মুখে মাস্ক পরিহিত রোগী দেখা।

প্রথম প্রথম খুব ডিপ্রেশন হতো। মনে হতো, চারদিকে মৃত্যুর গন্ধ। যে লোকগুলোকে দেখছি, তারা অনেকেই দিন গুনছে পরপারে যাওয়ার। মাথা নিচু করে ঢুকতাম। মাথা নিচু করে বেরোতাম। যাতে কোনওদিকে নজর না যায়। কিন্তু দেখতে দেখতে সেই দৃষ্টিটাই কেমন বদলে গেল। মানুষগুলোকে ক্রমশ লড়ুয়ে মনে হতে লাগল। মনে হতে লাগল, এরা সকলেই একটা অসম যুদ্ধে লড়ছে। কিন্তু হাল ছাড়ছে না। কী অদম্য যোদ্ধা! ‌কী অসম্ভব ফাইটিং স্পিরিট!‌

ছোটমামু গত কয়েকদিন ধরেই ভাল নেই বলে শুনছিলাম। যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি। জানতাম, কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। জানতাম না, কবে শেষ হবে। আজ একটু আগে জানলাম। সব শেষ।

সকাল ৮.‌৪০

মুনমুনকে বললাম, পিকনিক গার্ডেনের বাড়ি থেকে ওকে তুলে লাবনিতে যাব। তার আগে ফুল, ধুপকাঠি এবং সাদা থান কাপড় কিনব। ছোটমামুর আধার কার্ড খুঁজতে হবে। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, শ্মশানে মৃতের আধার কার্ড দরকার হয়।

যে কোনও মৃত্যুতে পরিকাঠামোগত কয়েকটা জিনিস প্রথমেই যোগাড় করে ফেলতে হয়।
১.‌ ডেথ সার্টিফিকেট।
২.‌ শববাহী গাড়ি।
৩.‌ শ্মশানে দাহ করার বন্দোবস্ত।

লাবনিতে ফোন করে জানা গেল, কাছাকাছির অন্তত তিনজন ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট দিতে অস্বীকার করেছেন। বাড়ি থেকে তুলে আনা এবং ফিরিয়ে দেওয়া হলেও নয়। বলেছেন, নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে। এঁদের জন্যই ডাক্তারদের বদনাম হয় আর ভাল চিকিৎসকরাও ক্যালানি খান। অগত্যা ফোন করলাম কার্তিকদাকে। একসময় দীর্ঘদিন ছোটমামুর চিকিৎসা করেছিল। ছোটমামু শেষবার হসপিটালাইজ্‌ডও হয়েছিল কার্তিকদার আন্ডারেই।

চণ্ডীগড় এবং বিলেতে পড়াশোনা করা কার্তিকদার মধ্যে মনুষ্যত্ব এবং দায়িত্ববোধের অভাব কখনও ছিল না। বলতেই রাজি হয়ে গেল। বললাম, তোমায় আমি তুলে নিয়ে আসছি। কার্তিকদা বলল, ‘তোলার কী আছে?‌ আমার গাড়িই তো আছে। আমি হসপিটালে যাওয়ার আগে ঘুরে যাব।’

বিধাননগরের মেয়র পারিষদ দেবাশিসদাকে অনুরোধ করার পর বললেন, গাড়ি পাওয়া যাবে। কোনও অসুবিধা নেই। তাঁকে যেন শুধু সময়টা জানিয়ে দিই।

শ্মশানের ব্যাপারে আমার ‘গো টু পার্সন’ বরাবর একজনই থেকেছেন। সবসময় সাহায্য করেছেন। কিন্তু মালাদি বললেন, আজ কেওড়াতলা শ্মশান বিকেল ৪টে পর্যন্ত বন্ধ। কারণ, আজ মাসের ১৬ তারিখ। প্রতিমাসের ১৬ তারিখেই রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেওড়াতলা শ্মশান সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত বন্ধ থাকে। মালাদি বললেন, ‘গড়িয়া শ্মশানে নিয়ে যাও। আমি বলে দিচ্ছি। কোনও অসুবিধা হবে না।’

সকাল ৯.‌০৫

‌এবার বেরিয়ে পড়ি। অনেক কাজ। প্রত্যেকটা ধাপ ঠিকঠাক সময় অনুযায়ী হলে যা বুঝতে পারছি, বিকেলের মধ্যে মুনমুনকে আবার বাড়িতে ড্রপ করে দিতে পারব।

বিকেল ৫.‌০৫

এতক্ষণে সব মিটল। এতক্ষণে একটু বসতে পারলাম। সব ঠিক ছিল। গোলপার্কে ফুল আর ধুপকাঠি পাওয়া গিয়েছিল তবে থান কাপড় কোথাও পেলাম না। বাড়ির পরিষ্কার চাদর ঢাকা দিয়েই ছোটমামুকে বিদায় দিতে হল। কার্তিকদা বাড়ি এসে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে গিয়েছিল। দেবাশিসদা ঠিক সময়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। যদিও গাড়ির সঙ্গে একটি পিশাচ এসেছিল। কাজ করার আগেই যে এই লকডাউনের বাজারে ‘পারিশ্রমিক’ (‌প্রকারান্তরে বাড়তি টাকা বা বিনা অপরাধের ঘুষ)‌ দাবি করে বসল। তাকে কিঞ্চিৎ ওরাল অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হল। তাতেও কাজ না হলে আইভি করে ওষুধ দিতে হতো। অশোক নামের পিশাচ সর্বসমক্ষে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ায় ব্যাপারটা ততদূর যায়নি।

গড়িয়া শ্মশান এমনিতেই আমার খুব পরিচ্ছন্ন লাগে। শান্তও। কোনও অত্যাচার নেই। পুজো করুন–পুজো করুন বলে পুরোহিতের ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়া নেই। শবদাহকদের বাড়তি অর্থের দাবি নেই। পাশাপাশি আজ একজন পরিচ্ছন্ন মানুষেরও সঙ্গে আলাপ হল সাব রেজিস্ট্রারের অফিসে। ডাঃ রমেশ রজক। থাকেন গার্ডেনরিচে। লকডাউনের বাজারে ২২ কিলোমিটার মোটরসাইকেল চালিয়ে ডিউটিতে আসেন। টানা আড়াইদিন ডিউটি করেন এবং বাড়ি ফেরেন। কিন্তু মুখের হাসিটি অমলিন রাখেন। ভিআইপি ব্যতিরেকে তীব্র গরমে অতিথিদের পানীয় জলের বোতলটি এগিয়ে দেন। পাখার তলায় বসান।

ডাঃ রজক বলছিলেন, আজ সকাল থেকে মাত্রই ৮–১০ টা বডি এসেছে। অন্যান্যদিন এর চেয়ে অনেক বেশি আসে। তিনিই জানালেন, এই শ্মশান সকাল ৮টা থেকে বেলা ৪টে পর্যন্ত বন্ধ থাকে প্রতিমাসের ১৭ তারিখ।

গাড়িভাড়ার ২,০০০ টাকা ছাড়াও ৫০০ টাকা দিলাম পিশাচটাকে। গাড়ির চালককে আরও ৫০০। দু’জনেই লম্বা সেলাম করল। বলল, ‘আবার দরকার হলে বলবেন স্যার।’ রাজনীতিকরা ঠিকই করেন। মানি স্পিক্‌স। অ্যান্ড ওনলি মানি স্পিক্‌স।

ছোটমামুর অস্থি বিসর্জন দিয়ে, মুনমুনকে বাড়িতে নামিয়ে এবং শ্মশান থেকে ফেরার পথে ফোনে পরিবারের বিভিন্ন প্রান্তে খবর দিতে দিতে এলাম। মা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘খুকু আর রথীনদা দুজন চলে গেল। এরপর আমার পালা।’

এক দাবড়ানি দিয়েছি!

‌রাত ৯.‌১৬

আজ সারাদিন বহির্জগতের সঙ্গে প্রায় যোগাযোগ ছিলই না। এখন যা যা দেখছি—

১.‌ বাংলার আটক পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেনভাড়া রাজ্য সরকারই দিয়ে দেবে বলে রেলবোর্ডকে চিঠি লিখেছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব।
২.‌ লকডাউনের মেয়াদ নাকি আরও ২ সপ্তাহ বাড়তে পারে। অর্থাৎ, মে মাসের শেষ পর্যন্ত। সেটা অবশ্য খুব অপ্রত্যাশিত নয়। খবরও নয়। এখন যেটা দেখার, চতুর্থ দফার লকডাউনে কী কী ছাড় দেওয়া হয়। সম্ভবত কাল সেই বিষয়ে গাইডলাইন প্রকাশ করবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক।
৩‌. ‌তৃণমূলের উপস্থিতি বাদ দিয়েই শিলিগুড়িতে প্রশাসক বোর্ড নিয়োগ করল নবান্ন। গতকাল ওই বিষয়ে কড়া প্রতিবাদ করেছিলেন শিলিগুড়ির বিদায়ী মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। বলেছিলেন, ওই নির্দেশিকা মানবেন না। আজ নবান্ন থেকে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। অশোক খুশি। নির্দেশিকা মেনে নিয়েছেন।

রাত ১০.‌১৬

রাত নেমে গেল। দীর্ঘ একটা দিনের শেষ। অন্যরকম দিন। লকডাউনে এই অভিজ্ঞতাটাও হয়ে গেল। লাবনির বাড়িটা আরও একটু ফাঁকা হয়ে গেল। ভাবছিলাম, ভালই হল। বড্ড কষ্ট পাচ্ছিল লোকটা। ভিতরের যন্ত্রণায় মেজাজ হারাত। পাখিমাসিকে অযথা বকাবকি করত। কিন্তু কখনও বলত না, কষ্ট হচ্ছে।

খানিকক্ষণ আগে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হয়তো মনেরই ভুল। কিন্তু অন্তরাল থেকে স্পষ্ট গমগমে গলায় ভেসে আসছিল—

ক’দিনের এই দেখা
সাগর সৈকতে রেখা
নূতন তরঙ্গে মুছে যায়

ছোট ছোট দাগ পা’র
ঘুচে যায় একাকার
নব নব পদ–তাড়নায়..‌

লকডাউন ডায়েরি – ১৫ মে, ২০২০

১৫.‌‌০৫.‌২০২০। শুক্রবার

সকাল ৭.‌৩০

কাল বেশি রাতে মানস’দা ফোন করেছিল। দেবেশ রায় চলে গিয়েছেন। তার খানিক আগে ফেসবুকে বাংলাদেশের এক বন্ধুর পোস্ট দেখেছিলাম— আনিসুজ্জামান প্রয়াত।

ইদনীং কেউ চলে গেলে প্রথমেই ধক করে একটা প্রশ্ন এসে বুকে লাগে— কোভিড নয় তো?‌

ওপার বাংলার বন্ধুর পোস্ট বলছিল, আনিসুজ্জামান করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা ওই ধরনের কোনও প্রতিষ্ঠানে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া যাবে না। কোভিড প্রটোকল অনুযায়ী তাঁর দেহ দাফন করা হবে। আর আজ সকালে পরিচিতরা বলল, দেবেশবাবুকে শ্বাসকষ্ট নিয়ে বাগুইআটির নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়েছিল। ফলে প্রয়াণের পর তাঁরও নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেটি কোভিড পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। টেস্ট রেজাল্ট না আসা পর্যন্ত তাঁরও অন্ত্যেষ্টি থমকে থাকবে।

কী আশ্চর্য!‌

শোনা ইস্তক বারবার মনে হচ্ছে, এই লকডাউনের সময় যাঁরা চিরকালের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, সেইসব গুণী মানুষের শেষযাত্রাটা অপ্রত্যাশিতভাবে সাদামাটা হয়ে থাকল।

পিকে ব্যানার্জি, ঊষা গাঙ্গুলি, চুনী গোস্বামী, ইরফান খান, ঋষি কাপুর। তারপর দেবেশবাবু। সকলেই কেমন অন্তরালবর্তী হয়ে বিদায় নিলেন। কোথাও কোনও গণশ্রদ্ধাজ্ঞাপন হল না। মরদেহে মালা দিতে পারলেন না গুণমুগ্ধরা। পা ছুঁয়ে প্রণাম জানাতে পারলেন না শেষবারের মতো। পিকে–র প্রয়াণের সময় তা–ও পরিস্থিতি খানিকটা কম গন্ডগোলের ছিল। কিন্তু চুনী?‌ ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নক্ষত্র। তাঁর প্রয়াণ এবং প্রস্থান হল প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। যোধপুর পার্কের নার্সিংহোমে দেহান্ত। তারপর পাশেই বাড়ি হয়ে কেওড়াতলা। ‘আজকাল’–এর খেলার পাতায় ‘তর্পণ’ সিরিজে সুভাষ ভৌমিক বলেছেন, ‘চুনীদা জীবনে যা চেয়েছেন, সব পেয়েছেন। ছেলেকে বলেছিলেন, তাঁর মৃতদেহ যেন কোথাও ঘোরানো না হয়। শ্মশান ছাড়া মাটিতে না নামানো হয়। সেই শেষ ইচ্ছেটাও পূর্ণ হয়েছে।’
পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, আজীবন গ্ল্যামার ধরে রাখা চুনী যে চাইবেন না তাঁর মরদেহ মাটিতে নামানো হোক, সেটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই এটাও চাননি যে, তাঁর শেষযাত্রা হোক মুখে মাস্ক পরিহিত এবং কার্যত জনমানবহীন পটভূমিতে!‌

বারবার মনে হয়, মৃত্যুর পর তাঁদের স্মৃতিতর্পণের জন্য কী করা হচ্ছে, মৃতেরা তা জানতেও পারেন না। কিন্তু মনে হয়, কৃতী বা সাধারণ— যেমনই হোন, মৃত্যুকে সবসময় সেলিব্রেট করা উচিত। মরজগৎ থেকে আত্মার মুক্তির সেলিব্রেশন। মৃত্যু তো আসলে একটা মুক্তিই। লিবারেশন।

সকাল ৮.‌২৩

কেন জানি না দেবেশবাবুর খুব বেশি লেখা পড়িনি। এমনিতে যে আমি খুব পড়ুয়া, তা নয়। টুকটাক পড়ি এইমাত্র। কিন্তু দেবেশবাবুর লেখা সেভাবেও পড়া হয়ে ওঠেনি। খানিকটা লজ্জার সঙ্গেই লিখছি, তাঁর ‘যযাতি’ বা ‘মানুষ খুন করে কেন’ তো দূরস্থান, তাঁর অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত‌’ও খুব খুঁটিয়ে পড়েছি, তা নয়। বরং ওই উপন্যাস নিয়ে সুমন মুখোপাধ্যায়ের নাটকটা বেশি মন দিয়ে দেখেছিলাম। মনে হয়, দেবেশবাবুর ঘোষিত রাজনৈতিক মতাদর্শই তাঁকে এই অধম পাঠকের কাছে লেখক হিসেবে নিজেকে উন্মুক্ত করতে দেয়নি। সেটা পাঠকেরই খামতি। সিঙ্গুর–নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় নিজেকে একেবারে আন্দোলনের বিপরীত সারিতে রেখেছিলেন। সেটাও তাঁর থেকে পাঠক হিসেবে দূরত্ব রচনার একটা কারণ হয়ে থাকবে। যদিও ব্যক্তিগতভাবে বাম বা অবাম— কোনও রাজনীতিতেই আমার বিশ্বাস নেই। হবে বলেও মনে হয় না। কারণ, পুরোটাই তামাশা বলে মনে হয়।

দেবেশবাবুর সঙ্গে প্রথম এবং শেষ দেখা গতবছরের ২২ নভেম্বর রোটারি সদনে। ‘মতি নন্দী পুরস্কার’ অনুষ্ঠানের মঞ্চে। ঘটনাচক্রে, তিনি এবং জয় গোস্বামী প্রাপকদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন। এবং ঘটনাচক্রে, দুই প্রাপকের মধ্যে একজন ছিলেন বাংলাদেশের সেলিনা হোসেন। অন্যজন এই হীনম্নন্য।

পুরস্কার অর্পণের আগে দেবেশবাবু একটি সুদীর্ঘ বক্তৃতা করেছিলেন। সেদিন কলকাতায় ভারত–বাংলাদেশ গোলাপি বল নিয়ে দিনরাতের ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়েছে। গোটা শহর সেই মোচ্ছবে। ফলে রোটারি সদন কার্যত ফাঁকা। শ্রোতার আসনে তেমন কেউ নেই। মঞ্চে বসা মন্ত্রীও উসখুস করছেন। তাঁকে আবার ইডেনে ফিরতে হবে। কিন্তু দেবেশবাবু পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। অন্তত সাতপাতার একটি ভাষণ লিখে এনেছিলেন। ধীরেসুস্থে পাতা উল্টে উল্টে পুরোটা শেষ করলেন। তারপর আসনে ফিরতে ফিরতে বললেন, ‘আরও একটু বলতে পারতাম। কিন্তু সময় কম।’

বলার যেটা, ওই ভাষণে তিনি আমার সম্পর্কে এমন তথ্য দিয়েছিলেন, যা আমি নিজেও ভুলে গিয়েছিলাম। আমি নাকি আনন্দবাজারে কাজ করাকালীন একদিন রাত দুটোর সময় তাঁকে ফোন করে কোনও একটি ফার্সী শব্দের বঙ্গানুবাদ জানতে চেয়েছিলাম। হতে পারে। না–ও পারে। কিন্তু সেদিন তিনি ওই কথাটা বলার পর পুরস্কারের অভিজ্ঞানটি নিয়ে এবং তার সঙ্গে দাতব্য ৫০ হাজার টাকার নগদনারায়ণ বা সম্মানদক্ষিণাটি উদ্যোক্তাদের ফিরিয়ে দিয়ে আসা পর্যন্ত মাথা খুঁড়েও স্মৃতিতে তেমন কোনও ঘটনা খুঁজে পাইনি। হয়তো সত্যিই ভুলে গিয়েছি।

দেবেশবাবু সম্পর্কে ওই সন্ধ্যাটিই আমার একমাত্র স্মৃতি। তাঁর প্রয়াণে ফেসবুক ইত্যাদি জুড়ে যখন শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ঢল নেমেছে, তখন কি এই স্মৃতির কথা না লিখলেও চলত? কে জানে!‌ কিন্তু এই ডায়েরি তো আটবাঁধ রহিত সমকালের দলিল। না হয় সেখানে তার অনায়াস পদচারণা রইলই।

সকাল ৯.‌২৭

বরাবর মনে হয়, এই শোকের ছায়াটা নামে কীভাবে?‌ কোথায় নামে?‌ কোথা থেকে নামে?‌ এই ছায়াটা কি গ্রহণের মতো?‌ চারদিকটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যায়?‌ তারপর আবার গ্রহণ ছাড়ে। তখন আবার ছায়া সরে যায়। তেমন?‌

বা শোকস্তব্ধ। তখন কী হয়?‌ সকলে কি বোবা হয়ে যায়?‌ কেউ কোনও কথা বলতে পারে না?‌ মুখ চাপা দিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে?‌ নাকি কাঁদতেও পারে না?‌ স্রেফ স্ট্যাচু হয়ে যায়?‌ স্তব্ধতাটা কতক্ষণ বা কতদিন থাকে?‌ মরদেহ সৎকার হওয়া পর্যন্ত?‌ নাকি স্মরণসভা বা শোকসভা হওয়া পর্যন্ত?‌

এই কথাগুলো মাঝেমাঝেই মনে হয়। কাউকে বলতে পারি না। যদি ভাবে, রসিকতা করছি। কিন্তু সিরিয়াসলিই মনে হয়। মনে হয়, শোকের আয়ু কতদিন?‌ কত ঘন্টা?‌

বেলা ১১.‌৪৮

এবার শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন নিয়ে কেন্দ্র–রাজ্য লেগে গেল!‌

গতকাল মুখ্যমন্ত্রী টুইট করে জানিয়েছিলেন, দেশের বিভিন্ন রাজ্যে আটক বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য মোট ১০৫টি ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল জানিয়ে দেন, রাজ্য সরকার ১০৫টি ট্রেনের কথা বলেছে আগামী একমাসের জন্য অর্থাৎ, ১৫ জুন পর্যন্ত। তা–ও সেগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও তথ্য রেলকে দেওয়া হয়নি। গোয়েলের বক্তব্য, ‘আমরা চাইলে দিনে ১০৫টা করে ট্রেন দিতে পারি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ৭টা ট্রেন ঢোকার অনুমতি দিয়েছে। আমরা চাই, বাংলার যেসব শ্রমিক বিভিন্ন রাজ্যে আটকে আছেন, তাঁরা যথাসম্ভব দ্রুত বাড়িতে ফিরে যান। কিন্তু রাজ্য সরকারের সেই সদিচ্ছা আছে বলে মনে হচ্ছে না।’

একই দাবি গতকাল করেছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। তিনিও বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৭টার বেশি ট্রেন ঢোকার অনুমতি দেয়নি। সেখানে উত্তরপ্রদেশ প্রায় ৪০০টি, বিহার ২০০টিরও বেশি ট্রেন ঢোকার অনুমতি দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ঝাড়খন্ড, রাজস্থান এবং ছত্তীশগড় প্রশাসন সম্পর্কেও একই বক্তব্য কেন্দ্রীয় সরকার তথা রেলমন্ত্রকের। যে, এই রাজ্যগুলির কোনও সদিচ্ছাই নেই তাঁদের রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজেদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

ঘটনাচক্রে, এই চারটি রাজ্যই আপাতত অ–বিজেপি শাসিত। ফলে এই বাগ্‌বিতন্ডা রাজনৈতিক। যা আবার নতুন করে শুরু হল। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে রেশন নিয়ে গোলমালের পর আবার একটা নতুন ফ্রন্ট খুলল যুদ্ধের। বা বলা ভাল, রাজ্যপাল আবার টুইট করার মশলা পেলেন।

দুপুর ১২.‌০৯

গরমে একটু বেশিই কাহিল হয়ে পড়েছি। গত কয়েকদিন ধরে আন্দামানের দিকে তাকিয়ে আছি। সেখান থেকে নাকি বিশাল ঘূর্ণিঝড় আসবে। কবে আসবে কে জানে!

‌কালবৈশাখিও আর আসে না। রাস্তা ভুলে গিয়েছে বোধহয়। বেডরুমটা এখন একটা গর্তের মতো লাগে। মনে হয়, সারাদিন এই গর্তেই থাকি। বাইরে বেরোলেই গরমের চোটে দম আটকে আসে। ট্যাপ খুললে আগুনের মতো গরম জল পড়ে। স্নান করেও শান্তি মেলে না। গা মোছা মাত্র কপাল ঘেমে যায়। কানের পিছন দিয়ে তিরতির করে ঘাম নামতে থাকে। এই গেরো থেকে বোধহয় জীবনে আর মুক্তি নেই। বিভিন্ন জেলায় শিল পড়ছে আর ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে শুনলে আরও গা জ্বালা করে।

আজ ইচ্ছে করেই ওয়ার্কআউটে বিরতি দিলাম। শরীরে দিচ্ছে না। এমনিতেও সাতদিনে একদিন বিরতি দেওয়া বা বিশ্রাম নেওয়া ভাল। এটাই নিজেকে নিজে আজ বোঝালাম।

দুপুর ১.‌০৫

বরফজলে স্নান করেছি। একটু বেটার লাগছে। যতদিন না এই কুৎসিত গরমটা যাচ্ছে, ততদিন দুপুরে বরফজলেই স্নান করব। আর ব্যক্তিগত ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্প শুরু করব। অর্থাৎ, অফিসে বেরোনর আগে বালতিতে জল ধরে জল ভরে রেখে যাব। রাতে বাড়ি ফিরে সেটায় স্নান করব।

দুপুর ১.‌২৫

শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবছিলাম। তখনই আবার মনে হল পাবলিক স্পিকিংয়ের কথা। মনে হল, আমরা বড় বেশি কথা বলি। বক্তৃতা?‌ হচ্ছে তো হচ্ছেই। সাংবাদিক বৈঠক?‌ চলছে তো চলছেই। গুচ্ছের আজেবাজে বকা। যার কোনও প্রয়োজন নেই। কাজের কথাটা বলে দিলেই হয়। কিন্তু সেটা হয় না। সাধে কি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর দেশ জুড়ে মিম তৈরি হয় এই মর্মে যে, কী বলতে চাইছো?‌ অর্থাৎ, বকলাম প্রচুর। কিন্তু কাজের কথা কিছু বললাম না।

আরও মনে হল, মঞ্চ এবং মাইক্রোফোন কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তার একটা গাইডলাইন বা ম্যানুয়্যাল সর্বত্র থাকা উচিত। বহু বছর আগে কলকাতার এক শিল্পোদ্যোগী এক অনুষ্ঠানের মঞ্চে ভরা স্টেডিয়ামে অমিতাভ বচ্চনের হাত ধরে টানতে টানতে বলেছিলেন, ‘তুমি বাংলার জামাই। কচি করে কিছু দিয়ে যাও গুরু!‌’ তখনই মনে হয়েছিল, এটার একটা প্রোটোকল থাকা উচিত। কোথায় কী বলা উচিত এবং উচিত নয়। বা বললেও কতক্ষণ বলা উচিত।

নিজে যখনই পাবলিকলি কিছু বলেছি, সময় বা বিষয়ের পরিসরের বাইরে যাইনি। আইসিসিআরে সুমিত’দার স্মরণসভায় সময় ছিল বক্তা প্রতি পাঁচমিনিট। যতদূর মনে পড়ছে, প্রত্যেকেই সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছিলেন। পাঁচ তো দূরের কথা, অনেকে ১০ এমনকী, ১৫ মিনিটও নিয়েছিলেন। উইংসে দাঁড়িয়ে সঞ্চালক ডেরেক ও’ব্রায়েন মাথা চাপড়াচ্ছিল। আমি ছিলাম সকলের শেষে। রিস্টওয়াচটা পোডিয়ামে চোখের সামনে রেখে ৪ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডে শেষ করেছিলাম। ডেরেক হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। স্মরণসভার পর বলেছিল, ‘ইউ আর দ্য ওনলি ডিসিপ্লিন্‌ড ওয়ান। শর্ট, টু দ্য পয়েন্ট অ্যান্ড দ্য বেস্ট!‌’

বাঙালি এমনিতেই মাইক্রোফোন ভালবাসে। টিভি চ্যানেল কারও বাইট নিতে গেলে দেখেছি, একটা প্রবণতা থাকে প্রথমেই দু’হাতে বুমটা ধরে নেওয়ার। যাতে চাইলেও কেউ সেটা সরিয়ে না নিতে পারে। এখন অবশ্য রিপোর্টাররা সতর্ক হয়ে গিয়েছে। তারা আর কাউকে বুম ছুঁতে দেয় না। বেশ করে!

‌পাবলিক স্পিকিং নিয়ে বরাবর একটা কৌতূহল আছে। সেটা বক্তৃতাই হোক বা টিভি কমেন্ট্রি। ইডেনে রনজি ট্রফি সেমিফাইনাল দেখতে গিয়ে বিষয়টা নিয়ে লাঞ্চের সময় দীপের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। দীপের কমেন্ট্রি আমার বেশ লাগে। যেখানে শুরু করেছিল, সেখান থেকে নিজেকে ঘষেমেজে অনেক, অনেকটাই ধারাল করেছে। ও বলছিল, কিছু কিছু জিনিস প্রোডিউসাররা বলে দেয়। আর কিছু কিছু রুল নিজেকেই বানিয়ে নিতে হয়। বলেছিল, ‘ওয়াসিমভাই খুব হেল্প করেছিল। ও যখন চ্যানেল নাইনে কমেন্ট্রি করত, তখন ওরা একটা ডু’জ অ্যান্ড ডোন্ট্‌স দিয়েছিল। ও সেটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। সেটা থেকেও অনেককিছু শিখেছি।’ দীপের কাছ থেকে জেনে অবাক লেগেছিল যে, ওর মতে এখন প্রাক্তন ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম ভাল কমেন্টেটর হল ইয়ান বিশপ। দীপ বলেছিল, ‘বিশ একা যে কোনও শো টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। ও এতটাই পড়াশোনা করে এক একটা সিরিজ কভার করতে আসে।’

দুপুর ২.‌০৫

বাইপাস বরাবর হোর্ডিংগুলো সমস্ত ফাঁকা। কঙ্কালের মতো কাঠামোগুলো দাঁড়িয়ে আছে শুধু। পটভূমিকায় নীল ঝকঝকে আকাশ। অতিকায় একটা ভাঙাচোরা ফিল্মসেটের মতো লাগছিল।

সত্যিই তো। কীসের হোর্ডিং দেবে?‌ কোন পণ্যের? কোন বাণিজ্যিক বিপণনটা এখন হবে?‌ মানুষের তো এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জীবাণুনাশকের। যেমন এখন টিভি–তে দেখি সমস্ত পণ্যই কোভিড আর করোনা অ্যাঙ্গলে চলে গিয়েছে। টুইঙ্কল খান্না সোনামুখ করে বলছেন, কীভাবে জীবাণুনাশক দিয়ে টেব্‌লটপ বা গোটা বাড়ি শুদ্ধ করবেন। বাইপাসের ধারে এইসমস্ত হোর্ডিংয়েও নিশ্চয়ই একদিন ওগুলোরই বিজ্ঞাপন দেখতে পাব।

বিকেল ৪.‌১৩

শোক আর আনন্দ— কোনওটারই বহিঃপ্রকাশ আর আলিঙ্গন দিয়ে হবে না। শোকের সময় মানু্ষ মানুষকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিতে পারবে না। আবার আনন্দেও একে অপরকে আলিঙ্গন করতে পারবে না। শ্মশানে বহ্নিমান চিতার পাশে দাঁড়িয়ে কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ে পাশের লোকটার কাঁধে মাথা রাখতে পারবে না। রাখতে পারবে না হাতে হাত। আবার ঈদে বা বিজয়ায় বন্ধুরা এড়িয়ে যাবে পারস্পরিক কোলাকুলি।

কী দিন এল!‌ ‌কী দিন আসছে!‌

সন্ধ্যা ৭.‌৩৬

আবার পুর প্রশাসন নিয়ে গোলমাল। কলকাতার মতোই শিলিগুড়িতেও প্রশাসকমন্ডলী বসানোর নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন। কিন্তু সমস্যা হল, শিলিগুড়িতে পুরবোর্ড বিরোধী বামফ্রন্টের। সেখানে বিদায়ী মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। তিনি বেঁকে বসেছেন। সটান বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, তিনি মুখ্য প্রশাসক হতে চান না।

এতে একটু রাজনীতিও আছে।

অশোকের বিবৃতি বলছে, তাঁর অধীনস্থ প্রশাসকমন্ডলীতে বিদায়ী মেয়র পারিষদদের রাখা হয়েছে। কিন্তু তারই পাশাপাশি তৃণমূলের পাঁচজনকেও রাখা হয়েছে। যারা সেখানে বিরোধীদল। অথচ, কলকাতা পুরসভার প্রশাসকমন্ডলীতে বিরোধীদের কাউকে রাখা হয়নি। অশোকের প্রশ্ন— শিলিগুড়ির ক্ষেত্রে কেন এই ব্যতিক্রম?‌ তাঁর বক্তব্য, তাঁরা এই নির্দেশ মানছেন না। প্রশাসক বসাতে হলে কলকাতা–সহ রাজ্যের অন্যান্য পুরসভার মতোই বসাতে হবে।

এই খেলাটাও চলবে। দেখা যাক।

সন্ধ্যা ৭.‌৫৬

মানস’দাকে ফোন করলাম। বলল, দেবেশবাবুর টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। একটু পরেই নার্সিংহোম থেকে মরদেহ নিয়ে ওরা বেরিয়ে একবার বাড়ি হয়ে সোজা চলে যাবে রতনবাবুর ঘাটে। আজ রাতেই অন্ত্যেষ্টি।

আরও একটা পর্ব শেষ হয়ে গেল বিনা আড়ম্বরে। কিন্তু স্বস্তিতে। দেবেশবাবুর শেষযাত্রায় কোভিডের ছোঁয়া না থাকার স্বস্তি।

রাত ৮.‌৪৫

কালার্স বাংলা চ্যানেল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চারটি ধারাবাহিকের সঙ্গে জড়িত সকলকে কার্যত অন্ধকারে রেখে। অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, কলাকুশলী সকলকেই। কাল রাত থেকেই ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট দেখছি।

বিনোদন জগতে করোনার থাবা পড়েই গেল অবশেষে।

রুদ্রনীল একটা পোস্ট করেছে — ‘ মুখে কেউ কিছু বলছি না। কিন্তু আমরা আর কতদিন টানতে পারব জানি না।..‌ আমাদের পিএফ, গ্র্যাচুইটি কিছু নেই। পেটে খাবার থাক না থাক, হাসিমুখে সেজেগুজে থাকতে হয় জাস্ট জীবিকার নিয়মে।..‌ যদি আপনাদের বাড়িতে বা পাড়ায় এঁরা ভাড়া থাকেন, সাধ্যমতো একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। তাড়িয়ে দেবেন না’।

রাত ১০.‌৪৭

মণিপুরের ১৮৫ জন নার্স শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তাঁদের রাজ্যে ফিরে গিয়েছেন। মণিপুর সরকার তাঁদের জন্য বাস পাঠিয়েছিল। এতজন নার্স শহর ছেড়ে যাওয়ায় পরিকাঠামো সঙ্কটে পড়বে তো বটেই। হাসপাতাল কর্তাদের মনে হয়েছে, এরপর স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভেঙে পড়বে। যদি না দ্রুত অন্য রাজ্য থেকে নার্স এনে সেই খামতি ভরাট করা যায়।

কিন্তু এঁরা মণিপুরে ফিরে গেলেন কেন?‌

কারণ, এঁদের পাড়া–পড়শিরা প্রকাশ্যেই এঁদের ‘করোনাভাইরাস’ বলে ডাকছিলেন। অশিক্ষিত, বাচাল এবং অতিচালাক বাঙালি মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখ, চোখ, নাক দেখে এঁদের চিনের নাগরিক বলে ভুল করেছিল। এবং যেহেতু করোনাভাইরাসের উৎপত্তি চিনে, তাই এঁদের সেই ভাইরাসের বাহক বলে প্রকাশ্যেই দেগে দিতে শুরু করেছিল। কোথাও অ্যাপক্যাবের চালক, কোথাও পাড়ার বাসিন্দা প্রকাশ্যেই গজগজ করছিল এঁদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে।

কোথায় যেতেন এঁরা?‌ এই নির্বোধ শহরে পড়ে থাকতেন?‌ একটা লোকও এঁদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেনি। কেউ প্রোটেক্ট করেনি। বরং ইন্ধন দিয়েছে। এখন এঁরা সেই সামাজিক চাপে শহর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন‌। বেশ করছেন!

আর আমরা বাঙালি, মাইক ধরে এখনও বাগাড়ম্বর করছি— ‘সব ঠিক হ্যায়!‌’

লকডাউন ডায়েরি – ১৪ মে, ২০২০

১৪.‌০৫.‌২০২০। বৃহস্পতিবার

সকাল ৯.‌০৫

এবার বাস দুর্ঘটনায় পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় ১৬ জনেরও বেশি পরিযায়ী শ্রমিক মারা গিয়েছেন। কোথাও গাড়ির চালক মদ্যপান করে ঈষৎ টালুমালু ছিল। কোথাও আবার রাস্তা খারাপ হওয়ায় স্টিয়ারিংয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়নি।

মনে হচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ২০ লক্ষ কোটি টাকা আর এঁদের জীবনে দেখা দিল না!‌ কিন্তু সত্যিই কি এঁদের কথা ভেবে এই প্যাকেজ?‌ কোনও সরকার যখন নীতি তৈরি করে এবং প্রণয়ন করে, তখন কি তাদের মাথায় দেশের এই লোকগুলোর মুখ ভেসে ওঠে?‌ এইসব নিরন্ন, নাচার, অসহায় মুখ?‌ তাদের আশা–আকাঙ্ক্ষা, তাদের সুখ–দুঃখ, তাদের দিনযাপন, তাদের রোজ আর রুজির লড়াই?‌ মনে হয় না। তেমন হলে স্বাধীনতার ৭৩ বছর পর আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষের এই অবস্থা হয় না। স্বাধীনতার পর সাত–সাতটা দশক বেরিয়ে গেলেও নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে নেতাদের পাকা রাস্তা, পানীয় জল বা বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হয় না। গণতন্ত্র না তামাশা!‌

কাল রাতে টিভি–তে দুটো দৃশ্য দেখছিলাম। ইমেজ অফ দ্য ডে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রী এবং দু’বছরের সন্তানকে একটা চাকা লাগানো পিঁড়িতে বসিয়ে টানতে টানতে হাইওয়ে ধরে চলেছেন এক যুবক। ওইভাবে তিনি পাড়ি দেবেন ৬০০ কিলোমিটার রাস্তা। দীর্ঘদিন ট্রেনের অপেক্ষাতে থেকেও তিনি ট্রেন পাননি। এছাড়া আর তাঁর উপায় কী?‌

দ্বিতীয়:‌ মা’কে হাতগাড়িতে বসিয়ে কাঁধে জোয়াল জুতে নিয়েছেন ছিপছিপে তরুণ। সেই জোয়ালের অন্যপ্রান্তে একটি শ্বেতশুভ্র বলদ। গাড়ি টানার জন্য দ্বিতীয় বলদ পাওয়া যায়নি। কী করা যাবে!‌ কঠিন সময়। মা’কে নিয়ে পৌঁছতে হবে গন্তব্যে। রাজপথ ধরে একটি মানুষ এবং একটি মনুষ্যেতর প্রাণীর মরিয়া যাত্রা শুরু হয়েছে ৮৫০ কিলোমিটার পেরোনর লক্ষ্যে। ৮–৫–০ কিলোমিটার!‌ ভেবেছেন কখনও কেউ?‌

এঁদের কথা ভেবে নীতি প্রণয়ন করেন আপনার–আমার নেতারা?‌ মনে হয়?‌ এঁরাই আমার দেশবাসী। সহ–নাগরিক। টিভি ভুল বলছিল। ওগুলো মোটেই ‘ইমেজ অফ দ্য ডে’ নয়। ‘ইমেজ অফ এভরিডে’!

সকাল ১০.‌১৩

বারান্দায় শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় তুলতে গিয়ে দেখলাম একটা কাঁচা আম পড়ে আছে। লোনলি। নিশ্চয়ই পাশের বাড়ির গাছ থেকে এসে পড়েছে। এ কীসের ইঙ্গিত?‌ এ কীসের আমন্ত্রণ?‌

বেলা ১১.‌১৭

আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে শ্রমিক স্পেশাল এবং স্পেশাল ট্রেন ছাড়া অন্য কোনও যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে না। যাঁদের বুকিং করা আছে, তাঁদের টাকা ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তবে এবার স্পেশাল ট্রেনেও ওয়েটিং লিস্ট টিকিট থাকবে। আরএসি থাকবে না। ফলে রেল পরিষেবা ধাপে ধাপে স্বাভাবিক হওয়ার যে জল্পনা চলছিল, তা অন্তত ৩০ জুন পর্যন্ত হচ্ছে না।

দিল্লি থেকে ছাড়া স্পেশাল ট্রেনটি হাওড়ায় পৌঁছেছে। স্টেশনে ৪০টি বাস রেখেছিল রাজ্য পরিবহণ দফতর। সেগুলিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বসে যাত্রীরা রওনা দিয়েছেন নিজ নিজ গন্তব্যে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী টুইট করেছেন, বিভিন্ন রাজ্যে আটক বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ১০৫টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই ট্রেনগুলি বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাংলার অভিমুখে রওনা দেবে’।

দুপুর ১২.‌‌০৫

‘হু’ জানিয়ে দিল, এইচআইভি ভাইরাসের মতোই করোনাভাইরাসও পৃথিবীতে থাকবে। অর্থাৎ, একে পুরোপুরি নির্মূল করা যাবে না। এই কথাটা প্রথম থেকেই মনে হয়েছে। কিন্তু পাশাপাশিই মনে হয়েছে, তফাতও আছে। প্রথমত, বহু গবেষণাতেও এইচআইভি–র প্রতিষেধক পাওয়া যায়নি। করোনার প্রতিরোধক এবং প্রতিষেধক হয়তো দ্রুত আবিষ্কার করা যাবে। কিন্তু কবে?‌ আজ, এইমুহূর্তে যদি করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়, তাহলেও তা বাজারে আসতে আসতে আরও ১৮ মাস। অর্থাৎ অন্তত দেড়বছর। দ্বিতীয়ত, এইচআইভি যেভাবে সংক্রমিত হয়, তার চেয়ে অনেক সহজে এবং নিরাপদে করোনা সংক্রমিত হতে পারে। ফলে করোনা আরও বিপজ্জনক।

এই কথাগুলো মাঝেমধ্যেই জনান্তিকে এবং প্রকাশ্যে বলে থাকি। কিন্তু ‘হু অ্যাম আই?‌’ একমাত্র ‘হু’ বললেই বিষয়টা বৈধতা পায়। এবং সেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এইচআইভি–র মতো করোনাও আমাদের সঙ্গে থাকবে। ফলে করোনার সঙ্গে সহবাসে অভ্যস্ত হওয়াটাই ভাল।

করোনাকে দিনযাপনের সঙ্গী করেই দুটো বিষয় চিকিৎসাবিজ্ঞান চেষ্টা করে যাবে। প্রতিষেধক বা প্রতিরোধক আবিষ্কার। সেগুলো হয়তো কোনও না কোনওদিন বেরোবেও। তারপর পাড়ার ল্যাবে ল্যাবে করোনা পরীক্ষার কিট পাঠাতে হবে। যাতে লোক সহজে এবং বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা করাতে পারে। তারপর সেই অনুযায়ী তারা বাইরে বেরোবে বা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবে। যেমন এখন চিকেন পক্স হলে হয়। কিন্তু তাতেও ফ্যাচাং আছে। একবার টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ হলেও দ্বিতীয়বার পজিটিভ হতে পারে। তখন?‌ নাহ্‌, আর ভাবতে পারছি না। তখন ভাগ্যের হাতে ভবিষ্যৎ!‌

দুপুর ১.‌১১

বাবা–মা’কে খেতে দিতে গিয়েছিলাম নীচে। নামতে নামতে শুনলাম গভীর আলোচনা চলছে। বিষয়:‌ গতকাল রাতে বাবার গ্যারাজের দিকের দরজার তালা খুলে বাইরে বেরোনর প্রয়াস। মা প্রশ্ন করছে বাবাকে, ‘কাল অত রাতে তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?‌’

— কোথায়?‌ আমি জানি না তো!‌

‘জানো না?‌ কী বলছ?‌ তালার চাবি খুঁজছিলে তো। দরজা খোলার জন্য। মেন সুইচ অফ করে দিয়েছিলে। মনে নেই?‌’

— না তো!‌ আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না। (‌আমার দিকে তাকিয়ে)‌ কোথায় যাচ্ছিলাম আমি?‌ তুমি কি জানো?‌ কিছু বলতে পারবে?‌

আমি: ‌হ্যাঁ জানি। কেন বলতে পারব না। তুমি একটু বেড়াতে যাচ্ছিলে। বাড়িতে থাকতে থাকতে বোরড হয়ে গিয়েছো তো।

— তা–ই না?‌ হবে বোধহয়। আমার এখন আর মনে পড়ছে না (‌একগাল হাসি)‌।

কিছু চিকেন প্রিপারেশন বাকি ছিল। সেটা মা–কে দিলাম। প্রশ্ন করায় বলল, খুবই ভাল হয়েছে নাকি খেতে। হাসলাম। জানি, যতটা বলছে, অতটা মোটেই নয়। জাস্ট পাতে দেওয়ার মতো হয়েছে। ওটা অপত্যস্নেহ বলছিল।

দুপুর ১.‌৩৪

কালকের ‘লকডাউন ডায়েরি’তে বাবার কথা পড়ে অনেকে লিখেছেন আমার ফেসবুকের ওয়ালে। লিখেছেন তাঁদের নিকটজনদের ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কথা। লিখেছেন সেই কাছের মানুষদের নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। সুদীপ্তা লিখেছেন। ইন্দ্রভান লিখেছেন। শর্মিষ্ঠা লিখেছেন। নীলাঞ্জন লিখেছেন। তানিয়া লিখেছেন। শবনম লিখেছেন। সুমনা লিখেছেন।

সকলেরই মনে পড়েছে তাঁদের বাবা বা জীবনে অন্য নানা বয়স্ক মানুষের কথা। যাঁরা ডিমেনশিয়ায় ভুগেছেন। এঁরা যে আমার পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পেরেছেন, সেটা ভেবেই আর নিজেকে একা লাগছে না। মনে হচ্ছে, ওই তো!‌ কতজন আছেন, যাঁরা জীবনের কোনও না কোনও সময়ে এই সঙ্কটে পড়েছেন। এমনই কঠিন সময় কাটিয়েছেন। আবার উঠেও দাঁড়িয়েছেন।

মনে হচ্ছিল, এই ডায়েরি লিখতে লিখতে কত মুহূর্তকে ছুঁয়ে ফেলছি রোজ। কত জমা নীরবতার সঙ্গে সেতু রচনা হচ্ছে। ভাল লাগছে। সাহসী লাগছে।

দুপুর ২.‌১৫

মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রাচীন ভারতের বর্ণাশ্রম প্রথা, ছোঁয়াছুঁয়ি, বাছবিচারই আবার করোনার হাত ধরে ছদ্মবেশে ফিরে এল। তফাত হল— এই বিচার ধর্ম বা বর্ণ নয়। এই বিচার নির্ভর করে সুস্থতা, সুরক্ষা এবং সংক্রমণের উপর। অর্থাৎ, করোনা থাকলে ছোঁয়া যাবে না। সে ব্রাহ্মণ হোক বা অব্রাহ্মণ। এখন আর শূদ্রের সঙ্গে ব্রাহ্মণের বর্ণভেদ থাকবে না। করোনা–আক্রান্ত ব্রাহ্মণকে ছুঁতে আপত্তি জানাতে পারবে শূদ্রও।

বর্ণাশ্রম গিয়েছে। এসেছে ‘করোনাশ্রম’।

বিকেল ৪.‌১৫

কিছু ইনফো পেলাম। ঝপাঝপ লিখে রাখি। এগুলো জরুরি।

১.‌ বেসরকারি বাসের ভাড়া তিনগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাসমালিকদের সংগঠন। ভাড়ার যে তালিকা তৈরি হয়েছে, তাতে এবার থেকে বাসে উঠলেই ২০ টাকা। মিনিবাসে ৩০ টাকা। সর্বোচ্চ দূরত্ব পর্যন্ত গেলে ৫০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া হতে পারে। অনেকেই দেখছি গজগজ করছেন। এঁরা হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা টোল প্লাজায় টোল ট্যাক্স ফাঁকি দিতে চান। কিন্তু বাসমালিকরাই বা কী করবেন?‌ তাঁরা তো আর ভর্তুকি পান না। ভাড়া বাড়ানো ছাড়া উপায় কী?‌ তবে সর্বোচ্চ ৫০ টাকাটাও একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। দেখা যাক, রাজ্য সরকার এই প্রস্তাব মেনে নেয় কিনা। নাকি কিছু কাটছাঁট করে একটা মধ্যপন্থা বেরোয়।

২.‌ সরকার যে সমস্ত বাস চালু করেছে, সেখানে ওঠার জন্য দেখছি গাদাগাদি ভিড়।

৩.‌ সোমবার থেকে কলকাতার রাস্তায় হলুদ ট্যাক্সি চালু হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভাড়ার অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ অর্থ দিতে হবে। অর্থাৎ, ১০০ টাকা মিটারে ভাড়া উঠলে দিতে হবে ১৩০ টাকা।

৪.‌ মধ্য হাওড়ার হরিজন বস্তিতে ৩২ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে।

৫.‌ চেন্নাইয়ের এক পাইকারি বাজারে ২,৬০০ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে।

৬.‌ অর্থাভাবে কলকাতা এবং বৃহত্তর কলকাতার অনেক বাড়িতে কেব্‌ল সংযোগ ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। মাসে চার থেকে পাঁচশো টাকা কেব্‌লের পিছনে ফালতু খরচ বলে মনে হচ্ছে অনেকের। এটা ব্যাপকহারে শুরু হলে টিভি সিরিয়ালের দর তথা টিআরপি কমতে শুরু করবে। সিরিয়াল ইন্ডাস্ট্রি বড়সড় গোলমালে পড়বে।

৭.‌ অমিতাভ বচ্চন টুইট করেছেন, ‘১৯৬৯ সালে ফিল্মে কাজ শুরু করেছিলাম। এটা ২০২০ সাল। একান্ন বছর। প্রচুর বদল এবং চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। এখন আরেকটা চ্যালেঞ্জ। আমার ছবি গুলাবো সিতাবোর রিলিজ ১২ জুন অ্যামাজন প্রাইমে। আরও একটা বদলের অংশ হতে সম্মানিত’। এই ছবির পরিচালক সুজিত সরকার। অমিতাভের সঙ্গে অভিনয় করেছেন আয়ুষ্মান খুরানা। কিন্তু এই ছবি যে সিনেমাহলে রিলিজ করার কথা ছিল। তার জন্য আগাম টাকা বিনিয়োগ করা ডিস্ট্রিবিউটররা এখন কী করবেন?‌ তাঁরা কি টাকা ফেরত পাবেন?‌

৮.‌ আজ থেকে নবান্ন স্যানিটাইজ করা শুরু হল। আজ এবং আগামিকাল ওই প্রক্রিয়া চলবে। তারপর শনি এবং রবি ছুটি। ফলে নবান্ন আবার খুলবে সোমবার।

৯. ‌একটা ফিচেল পোস্ট দেখলাম। ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্টেটাসের জায়গায় সিঙ্গল, ইন আ রিলেশনশিপ, ম্যারেড, ডিভোর্সড, সেপারেটেড–এর সঙ্গেই এবার থেকে নাকি ‘আত্মনির্ভর’ লেখা থাকবে। এই বিপন্ন সময়েও ব্যাপক লাগে মানুষের বিশুদ্ধ রসিকতাবোধ দেখে। এঁদের সত্যিই স্যালুট।

বিকেল ৫.‌১৩

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশিই জানালেন, আগস্ট মাস থেকে এক দেশ এক রেশনকার্ড চালু হচ্ছে। এর ফলে দেশের যে কোনও জায়গায় যে কোনও রেশনকার্ড ব্যবহার করা যাবে। এরও লক্ষ্য মনে হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকরা। তাঁরা ঠাঁইনাড়া হলে যেখানে যাবেন, সেখানে একই রেশনকার্ড ব্যবহার করতে পারবেন।

পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য দাবি করছেন, ‘এই প্রকল্প ইমপ্লিমেন্ট করা যাবে না। টিভি–র ঘোষণা টিভি–তেই থেকে যাবে।’

শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য এই ব্যবস্থা আগে নেওয়া যেত না?‌ তাঁরা তো যুগ যুগ ধরে এভাবেই কাটিয়ে যাচ্ছেন। এখন লকডাউনের জন্য তাঁদের কথা জানতে পারছে গোটা দেশ। এখন তাঁদের উপর প্রচার এবং সহানুভূতির সার্চলাইট পড়েছে। হাইওয়ে ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটা, হাঁটতে হাঁটতে ধুঁকতে ধুঁকতে রাস্তায় পড়ে প্রাণ দেওয়া, মালগাড়ির চাকা বা ট্রাকের তলায় পিষ্ট হওয়া— সরকার বাহাদুরের নজরে পড়ার জন্য তাঁদের এতজনকে প্রাণ দিতে হল!‌ অবশ্য, গণতন্ত্রের ভিত তো শহিদ বেদির উপরেই তৈরি হয়।

রাত ৮.‌৫৮

অমিতাভের ছবি অ্যামাজনে রিলিজ করা নিয়ে আইনক্সের তরফে কড়া বিবৃতি। যাতে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, এই চেষ্টা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও এর ফলে পারস্পরিক বিশ্বাসের বাতাবরণ বিষিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত, এখন এমন একটা সময়, যখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা উচিত। এই প্রবণতা বিপজ্জনক এবং অনভিপ্রেত।

আইনক্স কর্তৃপক্ষ আরও বলেছেন, সিনেমা এবং কনটেন্ট ক্রিয়েটররা বরাবর এক পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং লাভের ভিত্তিতে কাজ করে এসেছে। ভাল বিষয় যাতে প্রচুর মানুষ দেখতে পারেন, সেজন্য সারা দেশে আইনক্স বিশ্বমানের সিনেমা অভিজ্ঞতার ব্যবস্থা করেছে। সমস্ত কনটেন্ট নির্মাতার কাছে আইনক্সের আবেদন, থিয়েটার রিলিজ এড়িয়ে যাবেন না। তাতে সমস্ত স্টেকহোল্ডাররাই ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।

এই বিষয়টা কোথায় যায়, তার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকব। কারণ, এই আক্রমণাত্মক এবং বিক্ষুব্ধ বিবৃতির অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এক ৬ ফুট ২ ইঞ্চির ফ্রেঞ্চকাট। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আইনক্স তো সরাসরি পাঙ্গা নিয়ে নিল বলিউডের শাহেনশাহর সঙ্গেই!‌ বিনোদন জগতে এই যুদ্ধ অভূতপূর্ব তো বটেই।

রাত ৯.‌১০

রাজ্যপাল আবার চিঠি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীকে। ইস্যু:‌ কলকাতা পুরসভায় প্রশাসক নিয়োগ। কেন তাঁকে সেই নির্দেশিকা সংক্রান্ত তথ্য এখনও পাঠানো হয়নি। এটা ক্রমশ একটা পাকা ফোড়ার মতো হয়ে উঠছে। টনটন করছে। পিন ফোটালেই গলগল করে পুঁজরক্ত বেরিয়ে আসবে। এখন দেখার পিনটা কে এবং কবে ফোটায়।

রাত ৯.‌২৫

টুইটারে এইমাত্র দেখলাম, আবার ৯ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। যে ট্রাক্টরে চেপে তাঁরা যাচ্ছিলেন, সেটি একটি বিদ্যুৎস্তম্ভের সংস্পর্শে এসে তড়িদাহত হয়। সেখানেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান মোট ৯ জন।

রাত ১০.‌৪৫

বাড়ি ফেরার আগে অফিসে বসেই আজকের শেষ এন্ট্রিটা লিখছি। এরপর কম্পিউটার শাটডাউন করব। জিনিসপত্র গোছাব। ডায়েরি ব্যাগে ভরব। তারপর টুকটুক করে নীচে নেমে পোর্টিকোয় রাখা গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে ১০ মিনিটে বাড়ি পৌঁছব। গাড়ি পার্ক করে হাত ধুয়ে, হট প্লেট আর মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করে রাতের খাওয়া সেরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ব। সহজ। সুন্দর। সরল। এই–ই তো।

আর এই দেশেরই কোনও এক প্রান্তে এই একই আকাশের তলায় চাকা লাগানো পিঁড়ি টেনে টেনে চলা এক যুবক ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে ঘুমিয়ে থাকবেন। গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে তাঁকে আঁকড়ে ধরে থাকবেন তাঁর স্ত্রী। পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকবে তাঁদের সন্তান। আবার অন্য এক প্রান্তে কাঁধ থেকে জোয়াল খুলে বলদের খাবারের ব্যবস্থা করবেন এক তরুণ। মায়ের রাতের খাবারের জোগাড়টাও তাঁকেই করতে হবে।

এই ঘটনাগুলো সবই যুগপৎ ঘটতে থাকবে। এই দেশে, এই একই আকাশের তলায়।

লকডাউন ডায়েরি – ১৩ মে, ২০২০

১৩.‌০৫.‌২০২০। বুধবার

রাত ৩.‌৩৪

কিছুতেই ঘুম আসছে না। তাই মনে হল এন্ট্রিটা করেই রাখি।

ঘন্টাখানেক আগে হঠাৎ ফ্যান আর এসি–টা বন্ধ হয়ে গেল। ঘুম ভেঙে গেল। ভাবলাম লোডশেডিং হয়েছে। বেজায় গরম। বিছানায় এপাশ–ওপাশ করছিলাম। কখন কারেন্ট আসে। হঠাৎ দেখি, নীচে একটা কথা বলার আওয়াজ হচ্ছে। তারপর দেখি, মা ফোন করছে। ধরতেই বলল, ‘এখনই একবার নীচে আয়!’

‌গিয়ে দেখি, সিঁড়ির তলায় বাবা পা ছড়িয়ে বসে আছে। ঘেমেনেয়ে একসা। মা বলল, ‘মেন সুইচ অফ করে তালা খুলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমি এতবার ডাকছি!‌ পাত্তাই দিচ্ছে না! শুনছেই না!‌’ বুঝলাম, ডিমেনশিয়ার রোগী দিনরাতের হিসেব গুলিয়ে ফেলেছে। আগে গিয়ে মেন সুইচ অন করলাম। আলো–পাখা ফিরে এল। তারপর বাবাকে গিয়ে বললাম, ওঠো। অসহায় মানুষটা ক্ষীণস্বরে বলল, ‘উঠতে পারছি না।’ ধরে ধরে তুললাম। পরনের টি–শার্ট ঘামে ভিজে সপসপ করছে। আস্তে আস্তে হাতদুটো ধরে এনে বিছানায় শোওয়ালাম। ফ্যান চালিয়ে দিলাম ফুলস্পিডে। তারপর কিছুক্ষণ বসে রইলাম। ঘুমিয়ে পড়ার পর বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে মা’কে বললাম, ‘দরজা বন্ধ করে গেলাম। যদি বাইরে আসতে চায়, আমাকে ফোন করবে বা চেঁচিয়ে ডাকবে।’

উপরে উঠতে উঠতে মনে হল, স্মৃতি বিস্মৃত বৃদ্ধও কি বাকি মনুষ্য সম্প্রদায়ের মতো লকডাউনে বন্দি থাকতে থাকতে মানসিক স্থৈর্য্য হারিয়ে বসেছে?‌ তারও মনে হচ্ছে, এই আগল ভেঙে বাইরে যেতে হবে!‌ আর ভাল লাগছে না। সেও কি তার খাঁচার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যেতে চায়?‌ তাই বেরোনর আগে মেন সুইচ অফ করে বাড়িটাকে সুরক্ষিত করে যেতে চেয়েছিল? কে জানে কোন কুয়াশায় এখন তার বসবাস। ভাগ্যিস তালা খুলে বেরিয়ে যায়নি!‌ এই রাতে কোথায় খুঁজতাম?‌

তার পর থেকেই আর ঘুম আসছে না। মনে হচ্ছে, এর শেষ কোথায়?‌ কবে ফিরবে স্বাভাবিক জীবন?‌ এই অনন্ত সার্কাস আর কতদিন চলবে?‌ যেখানে ডিমেনশিয়া রোগীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের চাহিদার কোনও তফাত নেই। সুস্থতা–অসুস্থতা গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকেই স্বাভাবিকতার মুখোশ পরে থাকার চেষ্টা করছে। অথচ ভিতরে ভিতরে সারা পৃথিবীর উপর চণ্ড রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, টান মেরে মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ি। যা হয় হবে। কিন্তু পরমুহূর্তে হতমান হয়ে বসে পড়ছে খাঁচার ভিতর।

সকাল ৬.‌৫৫

বাবা একটু আগে ঘুম থেকে উঠে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। গিয়ে খুলে দিয়ে এলাম। দেখলাম, ঠিকঠাকই আছে।

সকাল ৭.‌৫৫

বাবা–মা’কে চা–বিস্কুট দিয়ে এলাম। দেখলাম বাবা দিব্যি বাধ্য ছেলের মতো সোফায় বসে আছে পা তুলে। আর মা বরাবরের মতো চেঁচাচ্ছে, ‘পা নামাও!‌ সোফা থেকে পা নামাও!‌ কতবার বলেছি, সোফায় পা তুলে বসবে না!‌’ বাবা কোনও ভ্রূক্ষেপ করছে না। ভাবছিলাম, এইভাবে নরমে–গরমে এরা কতদিন কাটিয়ে দিল। ঝগড়াঝাটি, বাগ্‌বিতন্ডা, বিবাদ–বিসম্বাদ আর মায়া–ভালবাসা নিয়ে।

সকাল ৮.‌১৩

জীবনের ডায়নামিক্সটা পুরোপুরি বদলে গেল। আপসাইড ডাউন। যে জীবনে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগত ভেদরেখাটা মুছে যাচ্ছে। যে লোকটা দিনে পঁচিশবার হাত ধুয়ে বর্ডারলাইন ওসিডি–র হওয়ার জন্য আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে দুয়ো খেত, এখন সেই আওয়াজ–দেওয়া লোকগুলোই সেদ্ধ করতে দেওয়ার আগে ভিমের গুঁড়ো দিয়ে কাঁচা ডিম ধুচ্ছে। বাজার থেকে সব্জি কিনে এনে আগে নুনজলে ডোবাচ্ছে। যে লোকটা পয় পরিষ্কার থাকার জন্য কপট গঞ্জনা শুনেছে আজীবন, এখন সেই লোকটাই পৃথিবীর রোলমডেল।

বেলা ১১.‌২৫

কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এইমাত্র ঘুম ভাঙল। উঠে দেখছি, টিভি বলছে বিমান চালানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কলকাতা বিমানবন্দর। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বিমানযাত্রা শুরু হবে এবার। সেই মর্মে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং বিমান পরিবহণ সংস্থাকে নির্দেশ পাঠিয়েছে অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক।

এতদিনে নাকি কলকাতা থেকে একটিই বিশেষ বিমান উড়েছে। সাতজন জাপানি নাগরিককে নিয়ে। তাছাড়া আর কোনও বিমান এই শহরে ওঠানামা করেনি। এমনকী, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বন্দে ভারত’ মিশনেও কলকাতায় কোনও বিমান আসছে না। নির্দেশ অনুযায়ী টার্মিনালে অপেক্ষার সময় একটা করে চেয়ার ছেড়ে রেখে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে চেয়ারে বসা যাবে না, তার উপর একটা ক্রসচিহ্ন। কাউকে কেবিন ব্যাগেজ নিতে দেওয়া হবে না। চেক ইন ব্যাগেজও নাকি একটাই নেওয়া যাবে। সর্বোচ্চ ২০ কেজি। ৮০ বছরের বেশি বয়স্কদের জন্য বিমানে ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।

শেষ নিষেধাজ্ঞাটা দেখে আবার নীচে সোফার উপর পা তুলে বসে থাকা বৃদ্ধের কথা মনে পড়ল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লোকে কেমন বাতিলের খাতায় চলে যায়!‌

বেলা ১১.‌৪০

শপিং মল, সিনেমাহল— এগুলো কি আর কোনওদিন খুলবে?‌ মনে হয় না। অদূর ভবিষ্যতে কি তাদের প্রয়োজন হবে?‌ এখন অনলাইনেও সমস্ত শৌখিন আইটেম ‘কারেন্টলি নট ডেলিভারেব্‌ল’ বলছে। অর্থাৎ, শৌখিন জিনিস আর অত্যাবশ্যকীয় নয়। জরুরি নয়। ফলে ডেলিভারি করা যাবে না। শুধু জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম সামগ্রীই এখন পাওয়া যাবে। সেখানেই অগ্রাধিকার থাকবে। শপিং মল বাহুল্যের তালিকায় চলে যাবে।

আজই দেখলাম ‘স্পেনসার্স’ টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছে:‌ টি–শার্ট ইত্যাদি বরাত দিলে বাড়িতে ডেলিভারি করে দেবে। ২,৫০০ টাকার বিল হলে কিছু ডিসকাউন্টও আছে। তাহলে কি এবার আরও বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোও বাড়িতে আসবে?‌ ভ্যানে করে টাটকা মুরগি যেমন আসছে এখন?‌

সিনেমাহলগুলো কী করবে?‌ কারণ, সিনেমা কবে আবার বানানো হবে কেউ জানে না। সামাজিক দূরত্ব মেনে কি আর শ্যুটিং হয়?‌ ছবি যদি বানানোই না হয়, তাহলে সিনেমাহলে কী রিলিজ করবে?‌ আর পুরোন ছবি লোকে কেন সিনেমাহলে গিয়ে দেখবে? কেনই বা পুরনো ছবির জন্য পপকর্নের পয়সা খরচ করবে?‌

দুপুর ১২.‌২৪

করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বড় শিকার কি বিনোদনের দুনিয়া?‌

এর মধ্যে একদিন সোহিনীর সঙ্গে টেক্সট মেসেজে কথা হল ‘লকডাউন ডায়েরি’ নিয়ে। বলছিল, ‘দারুণ লাগছে। এটা একটা বই কোরো।’ ওকে বললাম, তোমার ভাল লাগছে জেনে ভাল লাগল। কিন্তু আমার বই আর কে ছাপাবে?‌ এমনিতেও আমি লিখি সেল্‌ফ এক্সপ্রেশনের জন্য। এত লোক পড়বেন কখনও ভাবিনি। তোমরা পড়ো ভেবেই অভিভূত লাগে।

সোহিনী লিখল, ‘দারুণ!‌ আমায় একটা স্ক্রিপ্ট লিখে দাও। নাটক বানাব। নতুন ফর্মে। আবার যখন সব ঠিক হয়ে যাবে। লোক আসবে হল–এ। দিও।’ একটু থেমে লিখল, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে তো?‌ স্টেজে উঠতে চাই।’

লিখলাম, ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ!‌ লেট্‌স লিভ উইথ দিস স্পিরিট।

সোহিনীর ভিতরের উচাটনটা বুঝতে পারছিলাম। ওর মতো পাওয়ারফুল অভিনেতা কম দেখেছি। ‘পারমিতার একদিন’ দেখে বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিলাম। এত ন্যাচারাল অভিনয় হতে পারে?‌ করতে পারে কেউ?‌ তখন থেকেই সোহিনীর অভিনয়ের ফ্যান। বড় ফ্যান। ওর সঙ্গে আরও একটা অপ্রত্যক্ষ যোগসূত্র আছে। ২০০০ সালে তৎকালীন ই–টিভি’তে ‘জবাব চাই, জবাব দাও’ বলে একটা টক শো করতাম। প্রচুর এপিসোড করেছিলাম। শোয়ের প্রোডিউসার ছিল শিবু। ডিরেক্টর ব্রাত্য। তখন কি আর জানতাম, কালক্রমে শিবু সুপারহিট পরিচালক হবে আর ব্রাত্য নাট্যব্যক্তিত্ব এবং মন্ত্রী!‌

কাজের চাপে একটা সময় শো–টা আর করতে পারিনি। একেকদিনে পাঁচ থেকে ছ’টা এপিসোড শ্যুট করতে হতো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্যুটিংয়ের পর আবার অফিস গিয়ে দিনের কাজ। দুটোই সাফার করছিল। প্লাস অফিসেও কিছু কিছু লোকজন তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। অন্য কাউকে টিভি–তে দেখা গেলে বিখ্যাত–হওন–প্রয়াসী মানুষ আর তার অসূয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। ওটা বেরিয়ে আসে।

আনন্দবাজারে ততদিনে ১০ হাজার বার নাম বেরিয়ে গিয়েছে। সেটা গা–সওয়া হয়ে গিয়েছিল লোকজনের। টক শো শুরু হতে দেখলাম, যাদের সঙ্গে অফিসে পাশাপাশি ইউরিনালে নীরবে হিসি করা ছাড়া কখনও দেখা হয়নি, তারাও করিডরে থামিয়ে বলছে, ‘তোমায় টিভি–তে দেখলাম!‌’ বুঝলাম, এই লোকগুলোই বলবে, অনিন্দ্য অফিসের কাজে ফাঁকি দিয়ে টিভি–তে টক শো করে বেড়াচ্ছে। ফলে ছেড়ে দিতে হল।

আমি ছাড়ার পর এসে সঞ্চালক হিসেবে শো–টা ধরেছিল সোহিনী। কিন্তু বিদায় নেওয়ার আগে ওর সঙ্গে আলাপ করে আসা হয়নি। যতদূর মনে পড়ে, এখনও মুখোমুখি একবারও কথা হয়নি ওর সঙ্গে। আজকালের ‘সপ্তাহের সাক্ষাৎকার’–এর জন্য ওকে ইন্টারভিউ করেছিলাম। ফোনেই। কিন্তু সেজন্য তো আর কাজের ভক্ত হওয়া আটকায় না।

সোহিনী অ্যান্ড আদার থেসপিয়ান্‌স উইল বি অন স্টেজ এগেইন। ইনশাআল্লাহ!‌

দুপুর ২.‌২৫

অফিসে আসার পথে রাস্তায় একটু বেশি গাড়ি দেখলাম আজ। স্বাভাবিক সময়ের মতো নয়। কিন্তু সংখ্যা বেড়েছে। কোথাও কোথাও পুলিশ গাড়ি থামিয়ে চেকিংও করছে। তবে সরকারি অনুমতি থাকলেও অ্যাপক্যাব নাকি ঠিকঠাক পাওয়া যায়নি। সরকারি বাস চলেছে। কিন্তু টিভি বলছে, তাতে সামাজিক দূরত্বের বালাই ছিল না। সত্যি বলতে কী, থাকা বোধহয় সেভাবে সম্ভবও নয়।

গাড়ি চালাতে চালাতেই হঠাৎ মনে হল, এরপর হয়তো এমন একটা সময় আসবে, যখন পুলিশ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চালক এবং আরোহীদের ‘কোভিড সার্টিফিকেট’ দেখতে চাইবে। নিয়ম হবে, করোনা টেস্ট না করিয়ে রাস্তায় বেরোন যাবে না। সেই টেস্ট ‘নেগেটিভ’ থাকতে হবে। পলিউশন সার্টিফিকেটের মতো। কোভিড ছাড়পত্র না পেলে কাউকে রাস্তায় বেরোতেই দেওয়া হবে না। হয়তো তখন সেই ছাড়পত্র পাওয়ার জন্যেও কোনও চক্র তৈরি হবে। তারা অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট বার করে দেবে। এ দেশে সবই সম্ভব!‌

বিকেল ৪.‌৩৫

প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা নিয়ে কাল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে খিল্লি শুরু হয়েছিল। মিম–টিম বেরিয়ে একাকার। ফেসবুকে কাল একটা স্টেটাস দেখছিলাম, ‘ফুচকা থেকে মোমো আর নান থেকে তন্দুরি— সবই বাড়িতে বানানো হচ্ছে। এর বেশি আত্মনির্ভর হতে গেলে তো এবার বাড়িতে সালোকসংশ্লেষ করতে হবে’। আজ দেখলাম একজন গুনে বার করেছেন, ৩৫ মিনিটের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ২৯ বার ‘আত্মনির্ভরতা’ শব্দটা বলেছেন। এনার্জি আছে বটে লোকজনের!‌

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী আজ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের প্রথম দফার ব্যাখ্যা করলেন। আরও দু’দিন করবেন। তিনি কী বললেন, তা নিয়ে টিভি–র সান্ধ্য শোয়ে তুমুল চাপানউতোর চলবে জানি। শুধু একটা ব্যাপার বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল। অর্থমন্ত্রী ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন ইংরেজিতে। তিনি প্রতিটি পয়েন্ট বলার পর তাঁর পাশে বসা একজন সেটা হিন্দিতে অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন। এটার কি খুব প্রয়োজন ছিল?‌ কিন্তু কী করা যাবে!‌ রাজনীতিকরা ফুটেজ খাওয়ার সুযোগ পেলে ছাড়েন না। আফটার অল, এর ফলে অর্থমন্ত্রী অন্তত দ্বিগুণ সময় ধরে টিভি স্ক্রিন জুড়ে রইলেন।

সন্ধ্যা ৬.‌০০

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল— চশমাটা পাল্টেছেন। এখন হাফ রিম ফ্রেম। চমৎকার লাগছে দেখতে। একেবারে প্রথমে রিমলেস পরতেন। তারপর পরা শুরু করলেন রেট্রো ফ্রেম। এখন হাফ রিম। তবে বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখে এবং কথা শুনে বোঝা গেল, প্রধানমন্ত্রীর প্যাকেজের ঘোষণা নিয়ে বেদম ক্রুদ্ধ হয়ে রয়েছেন। পরিষ্কারই বললেন ‘অশ্বডিম্ব’, ‘বিগ জিরো’, ‘নাথিং’!‌ বললেন, ‘এই ২০ লক্ষ কোটি টাকা আসলে জিরো, জিরো, জিরো জিরো। টোটালটাই বিগ জিরো!‌ রাজ্যের অধিকার কেড়ে নিয়ে লকডাউনে রেখে রাজ্যগুলোকে লকআউট করার চিন্তা।’

আজ দুপুরেও মুখ্যমন্ত্রী পঞ্চায়েত নিয়ে বৈঠক করেছেন। তখনও একবার ব্রিফ করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মুখ্যসচিব রাজীব সিন্‌হা এবং মুখ্যমন্ত্রী সচিবালয়ের অফিসার গৌতম সান্যাল। ঘটনাচক্রে, এই পর্যায়ে এই প্রথম গৌতমবাবুকে আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিংয়ে দেখা গেল।

রাত ৯.‌৩১

অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সামনের জমিটায় ফনফন করে ঘাস বেড়ে যাচ্ছে। একপাশে একটা একতলা শেড। গেট থেকে সেখানে পৌঁছনোর একটা শুঁড়িপথ আছে। তার দু’পাশে দেওয়ালের মতো ঘাসের প্রাচীর উঠছে। ফটকের কাছে বোধহয় ওয়াচম্যান থাকে। দেখছি সেখানে অন্ধকারে ধিইয়ে উঠছে বিড়ির আগুন। জোনাকির মতো। শেডটা বন্ধ। ওই শুঁড়িপথে কারও পা পড়ে না গত প্রায় দু’মাস। মৃতপ্রায় ঘাসজমিটা পড়ে থাকে প্রাণের অপেক্ষায়।

রাত ১০.‌৩১

বাড়ি ফিরতে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, এই মুখোশবন্দি জীবন আর কতদিন?‌ মনে হচ্ছিল, অনেক হয়েছে!‌ এবার মুখ থেকে অসহায় জোকারের মুখোশ টান মেরে সরিয়ে বেরিয়ে আসুক পৃথিবী! ছিঁড়ে ফেলুক বন্দিত্বের নির্মোক! শেষ হয়ে যাক এই অনন্ত সার্কাস!‌

লকডাউন ডায়েরি – ১২ মে, ২০২০

১২.‌০৫.‌২০২০। মঙ্গলবার

সকাল ৭.‌৫২

কাল রাতে বাড়িতে ঢোকার মুখে সিঁড়ির সামনে জুতোর তলায় কীসের যেন একটা কটাস করে আওয়াজ হল। নিচে তাকিয়ে প্রথমে মনে হল একটা শামুকের খোল। তারপর ভাল করে ঠাহর করে দেখলাম, ও হরি!‌ খোল তো নয়। একটা জীবন্ত শামুক। ঘন্টায় ১ মিলিমিটার গতিতে চলছে। নিশ্চয়ই বাগান থেকে পরশুদিন যাত্রা শুরু করে আজ রাতে সিঁড়ির কাছে পৌঁছেছে। কে জানে কবে গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছবে। দেখে আশ্বস্ত হলাম, ওটা পচা শামুক নয়। জুতো পরে থাকায় আমার পা–ও কাটেনি। ফলে পচা শামুকে পা কাটার ব্যাপারটা এ যাত্রা এড়িয়ে যাওয়া গেল।

সারা রাত ভয়াবহ গরম। ভয়াবহ!‌ ঘর থেকে ওয়াশরুম যাওয়ার জন্য বেরোলেও মনে হচ্ছে থর মরুভূমিতে কন্ডাক্টেড ট্যুরে এসেছি। অথচ কাল রাতটা কত অন্যরকম ছিল। ওয়েদার হল পৃথিবীতে সবচেয়ে আনপ্রেডিক্টেব্‌ল!‌

কাল অনেক রাত পর্যন্ত হেডফোনে সলিল চৌধুরী শুনছিলাম। তারপর কানে ওই ঝিঙেবিচি গোঁজা অবস্থাতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙে গেল এক যান্ত্রিক নারীকণ্ঠে বারংবার ‘প্লিজ চার্জ দ্য হেডসেট’ আর্জি শুনে। প্রথমে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। কোন মহিলা এসে কানে কানে এসব বলছে! তারপর মনে হল, ‌আরে! এটা তো শিক্ষিত হেডসেট। কথা বলতে পারে। খাবার ফুরিয়ে গেলে নিজে চেয়ে নিতে পারে। কানের গয়নাদুটো খুলে বেস–এ চার্জে বসিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকাল ৯.‌৩০

লকডাউন কি আরও বাড়বে?‌ মে মাসের শেষ পর্যন্ত চলবে?‌ তারপর করোনার সঙ্গে বোধহয় সহবাস করতে শিখতে হবে সকলকে। যারা পারবে, তারা টিকে থাকবে। বাকিরা ঝরাপাতার মতো খসে পড়বে। দুঃখজনক। কিন্তু কারও কিছু করার থাকবে না। নতজানু হয়ে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

সহবাসের জন্য স্ত্রী হিসেবে করোনা কেমন হবে?‌ অথবা স্বামী হিসেবে?‌ দাপুটে হবে। প্রতাপশালী হবে। ভয় পেতে হবে অহরহ। সারাজীবন সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকাতে হবে। জীবনযাপনে বেচাল দেখলেই ঘ্যাঁক করে ধরবে। এবং কোনও অবস্থাতেই ডিভোর্স দেবে না। খুব মুশকিল!‌

ওহ্‌, কাল থেকে কলকাতায় মোট ১৫টা রুটে সরকারি বাস চালু হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাস চলবে কনটেনমেন্ট জোন এড়িয়ে। কিন্তু কনটেনমেন্ট জোন তো চারদিকেই!‌ কীভাবে রুট তৈরি হবে?‌ ২০ জনের বেশি যাত্রী বাসে থাকবে না। কাল থেকে অ্যাপক্যাবও চালু হওয়ার কথা। তাতেও দু’জনের বেশি যাত্রী থাকতে পারবেন না। আর ট্রাভেল করতে পারবেন শুধু স্বাস্থ্যকর্মী এবং সরকারি আধিকারিকরা। অর্থাৎ, যাঁরা এই পরিস্থিতিতে আপৎকালীন পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত। তাও পরিচয়পত্র এবং ই–পাস দেখিয়ে। গাড়িতে স্যানিটাইজার রাখা বাধ্যতামূলক। চালককে মাস্ক, গ্লাভস এবং ফেস শিল্ডও ব্যবহার করতে হবে।

আজ বিকেল থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন পরিষেবা চালু হচ্ছে। দিল্লি থেকে যেমন ১৫টি প্রান্তিক স্টেশনের অভিমুখে ১৫টি ট্রেন যাত্রা শুরু করবে। আবার সেই স্টেশনগুলি থেকে ১৫টি ট্রেন যাত্রা শুরু করবে দিল্লির দিকে।চলন্ত ট্রেনে কেক–বিস্কুটের মতো শুকনো খাবার আর পানীয় জল পাওয়া যাবে শুধু। যে যাত্রার দিকে তাকিয়ে আছে গোটা দেশ। দীর্ঘ এই যাত্রাপথে গণ সংক্রমণ ছড়াবে কিনা, তা নিয়েই শঙ্কা। ছড়ালেও বা আর কী করণীয়? ‌উপায় তো নেই।

ঝুঁকি? ‌তা তো বটেই। কিন্তু তবু কপাল ঠুকে সব আবার ধাপে ধাপে চালু করতে হবে। উপায় নেই। সত্যিই উপায় নেই।

বেলা ১১.‌১৫

এইমাত্র ওয়ার্কআউট করে উঠলাম। আজ একটু তাড়াতাড়ি। কারণ, তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। কারণ, তাড়াতাড়ি ব্যাঙ্কে গিয়ে মায়ের পেনশন তুলতে চাই।

ওয়ার্কআউট করতে করতে একটা ফ্ল্যাশ হল। গত প্রায় আটবছর ধরে সপ্তাহে চারদিন ভোরে উঠে লেক গার্ডেনসের ক্লাবে ব্যাডমিন্টন খেলার দৃশ্যগুলো। আর খেলতে নামার আগে কোর্টের পাশে ওয়ার্ম আপ। কতদিন খেলতে যাই না!‌ আর কোনওদিন যেতে পারব?‌ গেলেও কি মাস্ক পরে যেতে হবে?‌ ব্যাড বাডিদের সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে এ জীবনে?‌ জেতা হবে?‌ হারা হবে? ঝগড়া হবে?‌ ‌লাইনকল নিয়ে ঝামেলা হবে?‌ খেলার পর সকলে মিলে হজমোলা চা খাওয়া হবে?‌ কী জানি!‌

বেলা ১১.‌২১

স্বাস্থ্যসচিব বিবেক কুমারকে সরিয়ে দেওয়া হল পরিবেশ দফতরে। নতুন স্বাস্থ্যসচিব হলেন পরিবহণ সচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম। ব্যাপারটা নাকি কাল রাতেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আজ সকালে নির্দেশিকা জারি হয়েছে।

কী কারণে বদলি?

‌টিভি বলছে, বিবেকের কাজকর্মে নাকি চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ অখুশি ছিল। সেখান থেকে অভিযোগ আসছিল নবান্নে। চিকিৎসকরা নাকি করোনা মোকাবিলায় সঠিক পরিকাঠামো এবং সরঞ্জাম পাচ্ছিলেন না। কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ নাকি আমলামহলের অন্দরের সমস্যা। বেশ কিছুদিন ধরেই স্বাস্থ্যসচিবের সঙ্গে এক শীর্ষ আমলার গোলমাল শুরু হয়েছিল। সেইসময়েই নজরে আসে, করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের তথ্যের বিস্তর ফারাক হয়ে যাচ্ছে। ইন ফ্যাক্ট, বিবেক নাকি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিবকে লেখা একটি চিঠির সঙ্গে একস্ট্রা একটা পাতা জুড়ে দিয়েছিলেন। যাতে বলা হয়েছিল, রাজ্যে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি।

মোট কথা, বিবেককে যেতে হল। এর আগে রেশনে অব্যবস্থার জেরে বদলি করা হয়েছিল খাদ্যসচিবকে। সুতরাং, বিবেক হলেন দ্বিতীয় আমলা যাঁকে করোনা খেয়ে নিল।

দুপুর ১২.‌০২

আজ রাত ৮টায় আবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ প্রধানমন্ত্রীর। মনে হচ্ছে, লকডাউন নিয়ে কিছু একটা বলবেন। প্রশ্ন হল, ঘরবন্দিত্বের মেয়াদ কি আরও বাড়বে। বাড়লেও কোন কোন ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে। মেয়াদ বাড়ালেও ছাড় দেওয়া ছাড়া তো উপায় নেই। লকডাউন তো আর অনন্তকাল চলতে পারে না। প্রায় দু’মাস হতে চলল গোটা দেশ থমকে। এভাবে আর কতদিন চলবে?‌ কিন্তু এই সময়টাই সবচেয়ে ভালনারেব্‌ল। রাজনীতি আর প্রশাসনে টাইমিংটাই হল আসল। দেখতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর টাইমিং সেন্স ঠিকঠাক কাজ করে কিনা।

পাশাপাশিই মনে হচ্ছে, আজ কোনও আর্থিক প্যাকেজও ঘোষণা করা হতে পারে। কারণ, ভেন্টিলেটরে চলে যাওয়া অর্থনীতিকে কোরামিন দিতে গেলে এছাড়া কিছু করার নেই। এতদিনে বেশ কয়েকবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিবারই দেশের লোক ভেবেছে, তিনি কোনও আর্থিক পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করবেন। যা যে কোনও কল্যাণকামী রাষ্ট্রেরই কর্তব্য ও দায়িত্ব। যেমন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে হচ্ছে। কিন্তু কোনওবারই ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোনও আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেননি। অথবা বলেলনি যে, এই দুরবস্থা থেকে বেরোতে কী করা হবে। লকডাউন বাড়ানো ছাড়া কোনও দিশা নেই। মনে হচ্ছে, ইটস হাই টাইম হি ডাজ দ্যাট।

টাইমিং!‌ টাইমিং ইজ এভরিথিং ইন পলিটিক্স অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন।

দুপুর ১.‌৩২

ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম মায়ের পেনশন তুলতে। কিন্তু পালিয়ে এলাম। বাইরের ফুটপাথ পর্যন্ত টাকা তোলার লাইন চলে গিয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়েও ছিলাম। কিন্তু এত গরম যে মাথা–ফাথা ঘুরছিল। টি–শার্ট ঘামে ভিজে ক্যাতক্যাত করছে। মাথা বেয়ে ঘাম নামছে পিঁপড়ের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর দেখলাম, তখনও সামনে অন্তত ২০ জন দাঁড়িয়ে। মনে হল, আজকের মতো রণে ভঙ্গ দিই। আবার পরে দেখা যাবে। একেবারে না খেতে পেয়ে তো মরছি না!‌

ব্যাঙ্ক থেকে সটান অফিসে চলে এসেছি। এখনও কেউ আসেনি দেখছি। নিজের ঘরে ঢুকে এসি আর ফ্যান চালিয়ে বসলাম। এবার একটু চোখ বুজে চেয়ারে গা এলিয়ে দিতে হবে। নিন্দকেরা বলবে ঘুমোচ্ছি। অতিপাকারা স্টাইল করে বলবে, পাওয়ার ন্যাপ। আমি বলব, এটা হল কনজার্ভেশন অফ এনার্জি। এর একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। এনার্জি স্টোর না করলে দরকারে এনার্জি খরচ করা হবে কী করে?‌ পুরোটাই এনার্জির খেলা।

বিকেল ৪.‌১০

চিনের ইউহান, যা নাকি করোনা–মুক্ত বলে ঘোষিত হয়েছিল, সেখানে আবার ছ’জনের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এই খবরটা ডিপ্রেসিং। অত্যন্ত ডিপ্রেসিং।

বিকেল ৪.‌২৫

তিন সহকর্মীর তিনটে আলাদা আলাদা বক্তব্য শুনলাম।

সব্যসাচী সরকার:‌ করোনার অপর নাম নিয়তি। কেউ এড়াতে পারবে না। যখন যাকে ইচ্ছে হবে ধরবে আর নিয়ে চলে যাবে। কারও কিছু করার থাকবে না। যেমন নিয়তির সঙ্গে আমরা লড়তে পারি না।
— সম্পূর্ণ সহমত। করোনা এখন নিয়তিরই নামান্তর। কার যে কখন ডাক আসবে কেউ জানে না।

অভীক রায়:‌ এখন রোজ ভ্যানে করে জ্যান্ত মুরগি নিয়ে বাড়িতে আসছে লোকজন বিক্রি করতে। কিনলে ওজন করে সেখানেই কেটেকুটে দিয়ে দিচ্ছে। এই জিনিসটা আগে কখনও দেখিনি। আরও একটা জিনিস দেখিনি। হঠাৎ হঠাৎ পাড়ায় ঢুকে ব্লিচিং পাউডার মেশানো জল স্প্রে করা হচ্ছে একতলা পর্যন্ত। আগে থেকে বলা হচ্ছে না। গরমের জন্য একতলার দরজা–জানালা খোলা থাকছে। ব্লিচিং–জল সমস্ত বিছানা–টিছানা ভিজিয়ে দিচ্ছে।
— ব্লিচিং পাউডারের জল ছিটিয়ে কী হবে?‌ কোভিড–১৯ তো আর এয়ারবোর্ন ভাইরাস নয়। ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়। জেনারেল জীবাণুনাশক হিসেবে ব্লিচিং পাউডার মেশানো জল অবশ্যই ভাল। কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে কার্যকরী কি?‌ তাহলে তো মুঠো মুঠো ব্লিচিং পাউডার খেয়ে ফেললেই হতো!‌

তারিক হাসান:‌ অফিসে আসার পথে টালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে গাড়ি থামিয়ে ভিক্ষে চাইল একজন। বলল, অন্তত একটা টাকা দিয়ে যান!‌ পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম, ১০ টাকার একটা নোট উঠল। সেটাই দিলাম। দেখলাম, একজন নয়। পাঁচজন ভিখারি দাঁড়িয়ে আছে। ১০টা টাকা ওরা দু’টাকা–দু’টাকা করে ভাগ করে নিল!‌ এই পর্যায়ে কলকাতার রাস্তায় এই প্রথম ভিখিরি দেখলাম। কিন্তু ওদের কাউকে দেখে ঠিক ভিখিরি বলে মনে হল না।
— এটা হবে জানতাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে ভাবিনি। কিছুদিন আগেও ভিখিরিরা একটাকার কয়েন নিতে চাইত না। সেই তারা এখন বলছে, অন্তত একটা টাকা হলেও দিয়ে যান!‌ এই লোকগুলো এখন নাচার। ওদের আড় ভেঙে গিয়েছে। পেটের দায়ে লজ্জাবোধও আর নেই। কিন্তু এরপর তো আরও ভয়ঙ্কর দিন আসছে। যেদিন এই লোকগুলো আর ভিক্ষে চাইবে না। কেড়ে নেবে। কলার ধরবে। পথে পথে এই মানুষগুলোর সামনে দিয়ে কী করে থলেভর্তি বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরবে লোকজন? কিন্তু এরাই বা কী করবে?‌ চাকরি নেই। জীবিকার সংস্থান নেই। ‌সংসার প্রতিপালন করতে হবে তো। মরিয়া হয়ে তো এরা অধিকার ছিনিয়ে নিতে নামবেই। তখন?‌

বিকেল ৪.‌৩৫

আগামী ১৪ থেকে ১৭ মে বিজন সেতু বন্ধ থাকবে। ভারবহন ক্ষমতার পরীক্ষা করা হবে। এটা লকডাউনের সুবিধার দিক। এখন কি শহরের অন্য প্রাচীন সেতুগুলোও দেখে নেওয়া যায়?‌ মাঝেরহাট ব্রিজ পুনর্নির্মাণের কাজটা দ্রুত সেরে ফেলা যায়?‌

আজ বিশেষ ট্রেন চালু হল। ঘটনাচক্রে, ওই ট্রেনে যাঁরা ট্রাভেল করবেন এবং করছেন, সকলকে বাধ্যতামূলকভাবে আরোগ্যসেতু অ্যাপে যোগ দিতে বলা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, এবার যে কোনওদিন নাকি বিমান পরিষেবাও চালু হবে। দিল্লি থেকে তেমনই ইঙ্গিত পেয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে তৎপরতা শুরু হয়েছে। স্যানিটাইজেশন প্রসেসও শুরু হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরেই উচ্চপর্যায়ে বৈঠক চলছিল। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এতদিন প্লেনগুলো দাঁড়িয়ে আছে। এরপর ঝপ করে চালানোটা দুষ্কর। সমস্যা তৈরি হবে। হিতে বিপরীতও হয়ে যেতে পারে। অতএব পুরোপুরি সার্ভিস শুরু করার আগে একটা মক ট্রায়াল অন্তত দিতে হবে।

বিকেল ৪.‌৪০

বেশ কিছুদিন পর আবার প্রেস ব্রিফিংয়ে মুখ্যমন্ত্রী। যা বললেন, তার মূল কথা— করোনা এখনই যাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু কবে যাবে, সেজন্য অপেক্ষাও করা যাবে না। করোনাকে রুখতে হবে। আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও ফিরিয়ে আনতে হবে। ফলে আপাতত আগামী তিন মাসের জন্য একটা শর্ট টার্ম প্ল্যানিং করা উচিত। তারপর একটা মিড টার্ম এবং পরিশেষে একটা লং টার্ম প্ল্যান।

আরও একটা তথ্য:‌ আগামী বৃহস্পতি ও শুক্রবার নবান্ন স্যানিটাইজ করা হবে। অতএব বৃহস্পতি, শুক্র, শনি এবং রবি— পরপর চারদিন রাজ্য প্রশাসনের সদর দফতর বন্ধ থাকবে। বাকি সময়ের অধিকাংশই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঝাড়লেন মুখ্যমন্ত্রী। বললেন, ‘বিধানসভা ভোট এখনও একবছর বাকি। এখনই ক্ষমতাদখলের তাড়া কেন?‌’

ওহ্‌, দুপুরেই শুনেছিলাম। লিখতে ভুলে গিয়েছি। হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র রথীন চক্রবর্তী রাজ্যপালের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। চিকিৎসক হিসেবে কিংবদন্তি ভোলানাথ চক্রবর্তীর পুত্র রথীনের খ্যাতি আছে। মেয়র হিসেবে কী করেছেন ঠিক জানা নেই। কিন্তু এটা ঠিক যে, শাসক তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর দুস্তর দূরত্ব তৈরি হয়েছে গত প্রায় একবছর ধরে। যে সূত্রে মনে হচ্ছে, তাঁর এই নিয়োগ পুরোপুরি রাজনৈতিক।

মনমোহন সিংহ ভাল হয়েছেন। তাঁকে এইমস থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আজ।

রাত ৮.‌৪০

প্রধানমন্ত্রীর পঁয়ত্রিশ মিনিটের ভাষণে দুটো অপারেটিভ পার্ট।

১.‌ করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ। যা দেশের জিডিপি–র প্রায় ১০ শতাংশ। এই পরিমাণটা কত?‌ কোনও আইডিয়া নেই। ২০ লক্ষ কোটি গুণতে কত সময় লাগে, তা–ও জানি না। কাল থেকে কয়েকদিন ধরে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্যাকেজের খুঁটিনাটি ঘোষণা করবেন।
২.‌ লকডাউন–৪ আসছে। যা আগের তিনটি লকডাউনের থেকে অন্যরকম হবে। রাজ্যগুলির পরামর্শ পাওয়ার পর তার গাইডলাইন ১৮ মে–র আগে দেশবাসীকে জানিয়ে দেওয়া হবে। তবে এটা স্পষ্ট যে, ১৭ তারিখ সার্বিক লকডাউন উঠছে না।

বাকি যা বললেন, তার মর্মার্থ— করোনা আরও অনেক সময় ধরে আমাদের জীবনে থাকবে। কিন্তু আমরা করোনাকে মাথায় চড়ে বসতে দেব না। ভারতকে ‘আত্মনির্ভর’ করার জন্য এই প্যাকেজ ঘোষণা করা হল। উদাহরণ?‌ করোনার প্রাদুর্ভাবের সময় ভারতে একটিও পিপিই বা এন–৯৫ মাস্ক তৈরি হতো না। এখন দেশে রোজ ২ লক্ষ করে পিপিই এবং ২ লক্ষ করে এন–৯৫ মাস্ক উৎপাদন হচ্ছে। যে উদাহরণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ভারত বিপদকে সুযোগে পরিণত করেছে। এই প্যাকেজ মধ্যবিত্তদের জন্য। যাঁরা আয়কর দেন। আপনারা লোকালের জন্য ভোকাল হোন। শুধু স্থানীয় পণ্য কেনাই নয়, স্থানীয় পণ্যের হয়ে প্রচার করুন।’

যা থেকে বোঝা গেল, বিদেশি বিনিয়োগের ভরসা আর করছে না কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ, বিদেশের অর্থনীতিও ভেঙে পড়েছে। ফলে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার উপর জোর দিতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন ধরনের টিকা–টিপ্পনি শুরু হয়ে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এখনও পর্যন্ত যেটা নজর কাড়ল— আত্মনির্ভর ভারত:‌ ট্রান্সলেশন ‘আপনা আপনা দেখ লো’।

৮.৪৭

কোটি টাকার কেলেঙ্কারি ! প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরেই উৎসাহিত হয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী টুইট করেছিলেন ‘দেশের জিডিপির দশ শতাংশ (২০ লাখ টাকা) ব্যয়ে নতুন প্যাকেজ।’ পরক্ষনেই ভুল বুঝে টুইট করেছেন, ‘ সরি এভরিবডি ফর দা টাইপো : দয়া করে পড়ুন ২০ লক্ষ কোটি টাকা।’

খুবই নির্ভরযোগ্য হাতে রয়েছে ভারতের অর্থনীতি। ইহারেই কয় রামরাজ্য।

রাত ৯.‌০৫

আজ সারাদিন ধরে একটা কথা মনে হচ্ছে। অকর্মণ্য এবং অপদার্থরা সবসময় নিজের দোষ ঢাকতে একটা ভিলেন খোঁজে। যে কাজটা করতে ‘ক’ বাবু ব্যর্থ হন, তিনি তাঁর সেই ব্যর্থতার দায় চাপানোর জন্য সবসময় ‘খ’ বাবু বা ‘গ’ বাবুকে খুঁজে বার করেন। ব্যর্থ মানুষদের একটা ভিলেন খুব প্রয়োজন। ‘বলির পাঁঠা’ শব্দটা প্রাচীন। তার মধ্যে কোথাও পাঁঠার প্রতি একটা সহানুভূতির অ্যাঙ্গল থেকে যায়। কিন্তু ‘ভিলেন’ হল সার্বজনীন খারাপ লোক। তার জন্য কোনও মমতা থাকে না।

রাত ১০.‌০৫

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব তিনদিন আগে বলেছিলেন, ‘করোনাকে সঙ্গে নিয়েই জীবন কাটাতে হবে।’

মুখ্যমন্ত্রী আজ বললেন, ‘করোনা এখনই যাবে বলে মনে হয় না।’

প্রধানমন্ত্রীও বললেন, ‘করোনা আরও অনেক সময় ধরে আমাদের জীবনে থাকবে।’

যা দাঁড়াল, করোনার সঙ্গে বিয়ে পাকা হয়েই গিয়েছে আমাদের। এবার থেকে তাকে জীবনসঙ্গী করেই বাঁচতে হবে এবং আমৃত্যু সন্দেহাকুল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। জীবনযাপনে বেচাল দেখলেই জীবনসঙ্গী ঘ্যাঁক করে ধরবে এবং কোনওমতেই ডিভোর্স দেবে না।

প্রশ্ন হল, এই বিয়ের ভোজ খেতে লোক পাওয়া যাবে তো!‌

লকডাউন ডায়েরি – ১১ মে, ২০২০

১১.‌০৫.‌২০২০। সোমবার

সকাল ৮.‌৫৩

অ্যামাজনে রামায়ণ অ্যাভেলেব্‌ল। মহাভারত নয়। আপাতত। তবে ইফ রামায়ণ ইজ দেয়ার, ক্যান মহাভারত বি ফার বিহাইন্ড?‌ অতএব হে মানব, গীতার বাণী মানো। চেষ্টা করিয়া যাও। ফলের আশা করিও না। মা ফলেষু কদাচন।

প্রতিদিন রাতে বাড়ি ফেরার সময় দেখি ফাঁকা রাস্তায় পথকুকুরদের খাওয়াচ্ছেন একদল যুবক। সেক্টর ফাইভের অফিস থেকে সল্টলেকের বাড়ি কতদূর?‌ বড়জোর ১০ মিনিট। তার মধ্যে অন্তত তিনটে জায়গায় রোজ রাতে এই ছবিটা দেখি। অদ্ভুত ভাল লাগে। মনে হয়, ভিড় করে আসা চতুষ্পদদের মধ্যে কোথাও একটা লবঙ্গ আছে। একটা ইনস্টু বা একটা ট্রাইপড আছে। রাতচরা গাড়ি দেখলে ওদের কেউ কেউ দৌড়ে আসে। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা পথ দৌড়োয়। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসি। মনশ্চক্ষে দেখি লবঙ্গ–ইনস্টু–ট্রাইপড আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

রোড অ্যাকসিডেন্টে কোমরের হাড় ভেঙে এসেছিল লবঙ্গ। তিনমাস ধরে চিকিৎসা করার পর সুস্থ হয়েছিল। কিন্তু ওকে রাস্তায় ছেড়ে দিতে পারিনি। কারণ, বনের পাখি থেকে ও তখন খাঁচার পাখি হয়ে গিয়েছে। ওকে অ্যাডপ্ট করার জন্য ফেসবুকে নোটিফিকেশন গিয়েছিল। কালিন্দীর বাসিন্দা একজন রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু সন্তানকে কি ছেড়ে দেওয়া যায়?‌ মায়া হয়। লবঙ্গ রয়ে গেল।

ইনস্টু আর ট্রাইপড এসেছিল পাড়ার লোকেদের তাড়া খেয়ে। আগে ওরা অ্যাপার্টমেন্টের নীচেই রাতে থাকত। সারাদিন পাড়ায় টইটই করত। অত্যন্ত ভদ্র এবং নিরীহ। দু’বেলা খেয়ে যেত। কিন্তু তাতেও কিছু পড়শির বেজায় সমস্যা শুরু হল। এঁরা হচ্ছেন সেই প্রজাতির লোক, যাঁরা রাতে রাস্তায় কুকুর ডাকলে ভাবেন না যে, ওরা অবাঞ্ছিত এবং অপরিচিত লোক দেখে চেঁচাচ্ছে। ওরাই আসল পাহারাদার। তাঁরা ঘুম ভেঙে উঠে ঢিল খুঁজে এনে ওদের মারেন। ঢিলের অভাবে বাড়ি থেকে পেপারওয়েট ছুড়ে মারতেও দ্বিধা বোধ করেন না। যুগে যুগে, কালে কালে এই ধরনের পাষণ্ড দেখা গিয়েছে। চেতলা ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন?‌ ওই সমস্যার সুরাহার একটাই উপায় ছিল। ভদ্দরলোকেদের হাত থেকে বাঁচাতে ওদের সটান বাড়িতে নিয়ে আসা। বেওয়ারিশ প্রাণীকে সকলে খেদিয়ে দেয়। তার গায়ে গৃহপালিতের তকমা লাগলে সমীহ করে। রোডেশিয়ান হলেও। অতএব কাজলকালো চোখের ইনস্টু আর সাড়ে তিন পায়ে দৌড়ে বেড়ানো ট্রাইপডের একটা ঠিকানা জুটল।

মায়া। বড় মায়া।

সকাল ৯.‌১৫

কাল রাতে বেডরুমের সমস্ত জানালা–দরজা খুলে দিয়েছিলাম। যাতে ক্রস ভেন্টিলেশন হয়। একপশলা বৃষ্টির পর হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। অবিকল সমুদ্রতীরের মতো। হাওয়ার ঝাপটায় জানালার পর্দাগুলো উড়ে যাচ্ছিল দূরদূরান্তে। মাথার কাছের জানালাটা দিয়ে হাওয়ার দমক আসছিল। বারান্দার পাশে গাছের পাতা থেকে জল ঝরে পড়ার নীচু টুপটাপ শব্দ। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা আসলে তত খারাপও নয়।

শুধু তাল কাটছিল রাস্তার সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পটা। ওই হাওয়া, ওই নৈঃশব্দ্য, ওই নীরবতা আরও একটু অন্ধকার দাবি করে।

সকাল ৯.‌৪৯

কলকাতায় কনটেনমেন্ট জোনের সংখ্যা বেড়েছে। অনেকটাই বেড়েছে। এখন ৩৪০। কেন এমন হচ্ছে কে জানে! ‌এত কড়াকড়ি। এত নজরদারি। এত নাকা চেকিং। তারপরেও কেন এই অবস্থা?‌ কোথাও কি তাহলে কোনও ফাঁক রয়ে যাচ্ছে?‌ গেলেও সেটা ভরাট করা যাচ্ছে না কেন?‌ ‌

ভাবতে ভাবতেই সেই বন্ধুর কথাটা এসে ধাক্কা মারল। তার এক পরিচিতের মা করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন শহরের বেসরকারি হাসপাতালে। কয়েকদিন পর মারা যান। খবর আসে হাসপাতাল থেকে। ফোন করে মৃত্যুসংবাদ দেওয়ার পাশাপাশি জানতে চাওয়া হয়, দেহ দাহ করা হবে না কবর দেওয়া হবে?‌ ‘দাহ’ বলার পর ফোন কেটে যায়। তারপর আর কিছু জানা নেই।

জানি এমনই হয়। এমনই হচ্ছে। তাছাড়া উপায়ও নেই। কোভিড প্রটোকল তেমনই বলে। বলে, নিকটাত্মীয়দের হাতে মরদেহ তুলে দেওয়া যাবে না। প্রশাসন থেকেই সৎকারের ব্যবস্থা করা হবে উপযুক্ত প্রোটেকশন–সহ। অযথা সেন্টিমেন্টাল হয়ে লাভ নেই। সবই বুঝি। কিন্তু মাতৃহারা সন্তান যখন নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার অক্ষম চেষ্টায় প্রশ্ন করে, ‘মায়ের কাজটা ওরা ঠিকঠাকই করেছে। তাই না?‌’ তখন মাথা নেড়ে আশ্বাস দেওয়া ছাড়া কিছু বলার থাকে না। তথ্যকে ডিনায়ালে রাখতে হয়। আর মা, বাবা, বন্ধু, আত্মীয়, পরিজন— সকলে ‘বডি’ হয়ে কোথায় কোন তেপান্তরের মাঠে মিলিয়ে যায়।

মনে হয়, রাস্তায় আঁকা গোল গোল চুনের দাগের মতো আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এখন এক অদৃশ্য গণ্ডি এসে হাজির। তার মধ্যেই আমাদের নিত্য বসবাস। কখনও সে গণ্ডি সামাজিক দূরত্বের। কখনও তথ্যগত দূরত্বের। কখনও সেই গণ্ডি আটকে রাখছে ব্যক্তিগত আবেগকে। কখনও তৈরি করছে সম্পর্কের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান।

মনে হয়, গণ্ডির বাইরে কোথাও গুঁড়ি মেরে বসে আছে একটা প্রকাণ্ড বাঘ। সবসময় জরিপ করছে গতিবিধি। লক্ষ্ণণরেখা পেরোলেই লাফ দিয়ে ঘাড়ে পড়বে। প্রাণ না নিয়ে ছাড়বে না। সবসময় শরীরে বিঁধছে সেই অদৃশ্য অথচ প্রবল শক্তিধর শত্রুর দৃষ্টি।

সকাল ১০.‌৪৮

আজ লকডাউনের ৫০ তম দিন। হাওয়ার মতো সময় যাচ্ছে। টিভি–তে দেখছি, আবার রাজ্যের মুখ্যসচিবকে চিঠি লিখেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব। বলেছেন..‌কী বলেছেন কে জানে!‌ হু ইজ বদার্ড?‌ এই চিঠিচাপাটি আর ভাল লাগছে না। এর সঙ্গে আমজনতার যোগাযোগ কোথায়?‌ একেক সময় মনে হয়, এই লকডাউন পিরিয়ডে এত লোক এত চিঠি লিখছে যে, এই শারদীয়াতে চাইলে একটা ‘লকডাউন পত্রাবলি’ ছাপা হতে পারে!‌

সকাল ১০.‌৫৪

ফেসবুকে এক চিকিৎসকের একটা পরামর্শমূলক পোস্ট দেখলাম। লিখেছেন, ‘ট্রেনের পর আস্তে আস্তে অনেককিছুই চালু হবে। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে বাইরে বেরোতে হলে কিছু জিনিস মাথায় রাখা দরকার। এই ভাইরাস আমাদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন থাকতে চলেছে। বাড়ির বাইরে বেরোনর কিছু উপদেশ লিখলাম। এটি কোনও অফিশিয়াল উপদেশ নয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত। মূল কথা #‌দূরত্ব #‌পরিচ্ছন্নতা #‌মাস্ক’।

পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, এর মধ্যে কী কী আমি করতে পারব।

১.‌ ঘড়ি এবং আংটি বর্জন।
— খুবই সম্ভব। বস্তুত, লকডাউনের প্রথমদিকে তো ঘড়ি–আংটি পরা ছেড়েই দিয়েছিলাম। আবার শুরু করেছি। কারণ, মাঝেমধ্যেই ঘড়ি দেখা আমার মুদ্রাদোষ। না পরলে কিছু একটা নেই বলে মনে হয়। তবে আবার ছেড়েও দিতে পারি। সমস্যা নেই।

২.‌ শুধু ক্রেডিট, ডেবিট কার্ড আর অল্পকিছু টাকা সঙ্গে রাখুন।
— নো প্রবলেম। ক্রেডিট কার্ড নেই। কারণ, ধারবাকিতে বিশ্বাস করি না। বাকিটা মূলত ডেবিট কার্ডেই সারি। নগদ টাকার চেয়ে খুচরো কাগজই বেশি থাকে ওয়ালেটে।

৩.‌ ফোন একটি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের প্যাকেটে রাখুন। পরে বাড়ি ফিরে এসে প্লাস্টিক ফেলে দিন।
— এটায় চাপ আছে। অত স্বচ্ছ প্লাস্টিকের প্যাকেট পাব কোথায়?‌ বিশেষত, এখন যখন প্লাস্টিক বর্জনের নিদানও আছে পরিবেশের জন্য। তার চেয়ে বরং এখন যা করছি বাড়ি ফিরে সেটাই করব। স্যানিটাইজার দিয়ে ফোন প্রক্ষালন।

৪.‌ মাথা ঢাকা টুপি, ওড়না।
— অ্যাবসোলিউটলি ফাইন। এটা নিশ্চয়ই মাথার চুলে ভাইরাসের আটকে থাকা আটকাতে। চুল প্রায় সব উঠে যেতে বসেছে। টুপি পরলে সেটা ক্যামোফ্লাজ করা যাবে। গ্রেট আইডিয়া!‌ ঘাম মোছার জন্য এমনিতেই গলায় দোপাট্টা প্যাঁচানো থাকে। সেটাও মাথা ঢাকার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। আরও একটা কথা মনে হচ্ছে। চুলে ভাইরাসের অনুপ্রবেশ আটকাতে যদি চুলই বিসর্জন দিয়ে দেওয়া যায়?‌ ন্যাড়া হয়ে গেলেই তো হল। স্টাইলও হল। স্লিপারি সারফেসে ভাইরাসও পিছলে যাবে। নট ব্যাড।

৫.‌ মাস্ক নাকের উপর দিয়ে।
— এটা প্রায় কেউই করছে না। আমি করছি। চশমার তলা দিয়ে নাক ঢাকছি। মুখ তো বটেই।

৬.‌ মুখে, নাকে, মাস্কে একদম হাত দেওয়া নয়।
— এটাও সম্ভব। কিন্তু এইসব নিষেধাজ্ঞার সময়েই কে জানে কেন, মুখ–নাক বেশি বেশি চুলকোয়। যা হোক, ওটা ইগনোর করতে হবে।

৭.‌ আপ্রাণ চেষ্টা করুন পাশের লোকের সঙ্গে ৩ ফুট দূরত্ব রাখতে।
— খুবই চেষ্টা করব। কিন্তু এটায় প্রায়ই ভুল হয়ে যায়। বিশেষত, খবরের কাগজে পেজ প্রোডাকশনের কাজ করতে গেলে একটা ভৌগোলিক নৈকট্য দরকার হয়। তবু খেয়াল রাখতে হবে।

৮.‌ বারে বারে হাত ধোয়া অথবা স্যানিটাইজার ব্যবহার। প্লাস্টিকে মুড়ে পকেটে একটা ছোট সাবান রাখুন।
— প্রথম পয়েন্টটা সম্ভব। কিন্তু প্লাস্টিকে মুড়ে পকেটে সাবান বহন করাটা একটু কেমন যেন না?‌ ধরে নিচ্ছি, ট্রাউজার্সের পকেটের কথাই বলা হচ্ছে। প্যাকেট থেকে দুর্ঘটনাবশত সাবানে লেগে–থাকা জল বা ফেনা বেরিয়ে পকেট ভিজে গেলে খুব এমব্যারাসিং হবে। বিপ্লবের যেমন হয়েছিল। পকেটে রাখা স্যানিটাইজারের শিশির ছিপির প্যাঁচ খুলে গিয়ে কেলেঙ্কারি। তার চেয়ে বারবার হাত ধোয়া এবং স্যানিটাইজার ব্যবহার নিরাপদ।

৯.‌ প্লাস্টিকের চটি বা জুতো, যেটা ধোয়া যাবে। সেটা বাইরে ছেড়ে তবে বাড়িতে ঢোকা।
— কঠিন কাজ। জুতো যদি বাইরেই ছেড়ে রাখি, তাহলে আর ধোওয়ার কী দরকার?‌ ওদিকে জুতো না ধোওয়া হলে তো রোজ রোজ সেখানে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি হতে পারে। আবার ধুতে হলে বাড়ির বাইরে প্রথমে একটা জলের কল ফিট করতে হবে। বাড়ির বাইরে জুতো রেখে এলে কেউ যদি নিয়ে চলে যায়?‌

১০.‌ বাড়ি ফিরে এসে বাইরের জামাকাপড় কেচে দেওয়া। অথবা চার সেট জামাকাপড় রাখা। ১, ২, ৩, ৪। চতুর্থদিনের পর পর আবার প্রথমদিনের জামা পরা। প্রত্যেকদিন ফিরে এসে পারলে রোদে টাঙিয়ে দেওয়া।
— প্রথম ব্যাপারটা খুবই সম্ভব। কিন্তু পরের ব্যাপারটা আমার মতো মানুষের পক্ষে অসাধ্য। বাড়ি ফিরি কমপক্ষে রাত ১১টায়। তখন রোদ কোথায়?‌ সূর্যদেবতার কাছে কি লিখিত অ্যাপ্লিকেশন দেব?‌ ইয়ার্কি থাক। মনে হচ্ছে, উনি বলেছেন, বাইরে টাঙিয়ে দিতে। যাতে যখনই হোক তারা রোদ খেতে পারে।

১১.‌ ১ লিটার জলে দেড় চামচ ব্লিচিং পাউডার দিয়ে একটি দ্রবণ বা মিক্সচার বানান। এটি একটি শক্তিশালী জীবাণুনাশক। সাবধানে সেটি দিয়ে জুতো এবং সন্দেহজনক স্থান ভাইরাস মুক্ত করুন।
— এটা নিয়ে ভাবছি। ভিস্যুয়ালাইজ করছি, ব্লিচিং পাউডারের মিক্সচার ভর্তি বোতল রান্নাঘরের জানালার র‌্যাকে রাখা আছে আর রাতবিরেতে একহাতে সেই বোতল আর অন্যহাতে টর্চ নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে সন্দেহজনক স্থান খুঁজছি। মনে হলেই শান্তিজলের মতো ছিটিয়ে দিচ্ছি।

এই তাহলে জীবন হতে চলেছে?‌ এর চেয়ে লকডাউনই ভাল!‌

দুপুর ১২.‌১৪

সোশ্যাল মিডিয়ায় কাল থেকে কল্কি অবতারের উদয় হয়েছে। যিনি উকুলেলে বাজিয়ে গান গেয়ে তাঁর সদ্যোজাত সন্তানকে ঘুম পাড়াচ্ছেন। ওইপর্যন্ত ঠিকই আছে। চমক তার পরে। কারণ, গানটি হল বিশুদ্ধ বাংলায় ‘ঘুমপাড়ানি মাসি–পিসি মোদের বাড়ি এসো’। সেখানেই ক্যাচ। কারণ, অবতারের নাম কল্কি কেঁকলা। বলিউডের মিনিংফুল ছবির অভিনেত্রী এবং পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপের প্রাক্তন স্ত্রী। জন্মসূত্রে ফরাসি। জন্মস্থান পুদুচেরি। আপাতত তাঁর পার্টনার গাই হার্শবার্গ। যিনি ইজরায়েলি ন্যাশনাল। তাঁদের কন্যা সাফোর জন্ম হয়েছে গত ফেব্রুয়ারিতে।

এর মধ্যে পুদুচেরি তথা শ্রী অরবিন্দ ছাড়া কোথাও কল্কির বং কানেকশন আপাতদৃষ্টিতে দেখতে পেলাম না। ফলে বঙ্গসন্তান হিসেবে ভাল লাগার পাশাপাশিই ‘ঘুমপাড়ানি’ রহস্যটাও রয়ে গেল।

দুপুর ২.‌৫০

অফিসে আসার আগে ত্রিস্তরীয় সার্জিক্যাল মাস্ক পরার সময় মাথার পিছনের গিট্টুটা বাঁধতে গিয়ে খেয়াল করলাম, এটা দেখতে একেবারে সেরকম লাগছে, যেভাবে মহিলারা দু’হাত মাথার পিছনে নিয়ে গিয়ে খোঁপা বা পনিটেল বাঁধেন।

দুপুর ৩.‌০০

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীদের ভিডিও বৈঠক শুরু হল। যদিও সেটা লাইভ দেখানো হচ্ছে না কোথাও। সে যাক। পরে নিশ্চয়ই জানা যাবে কী হল।

ঘটনাচক্রে, আর একঘন্টা পরেই রেলের টিকিটের অনলাইন রিজার্ভেশন শুরু। কাল ১৫টি ট্রেন যাত্রা শুরু করবে দিল্লি থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। শুনলাম, একেকটি ট্রেনের যাত্রীসংখ্যা ১,২০০ থেকে বাড়িয়ে ১,৭০০ করা হয়েছে। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের নিকুচি করে এই গাদাগাদি ভিড়ে–ঠাসা ট্রেন ছাড়া কেন?‌ টিকিটের টাকা তুলে নেওয়ার জন্য?‌ নাকি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও আটকে–থাকা শ্রমিকদের বেড়ালপার করতে?‌

বিকেল ৫.‌০৫

এই যাহ্‌!‌ রেলের বুকিং শুরুই হয়নি। বলা হচ্ছে, সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু হবে। কেন দু’ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হল?‌ রেলের বক্তব্য, কম্পিউটারে ডেটা আপডেট করা হচ্ছে। তাই দেরি। গোটা দেশ এই ট্রেনযাত্রা শুরুর দিকে তাকিয়ে আছে। দিল্লি থেকে যাত্রা শুরু করে এই ট্রেনগুলো দেশের ১৫টি প্রান্তিক স্টেশনে পৌঁছবে এবং আবার ফিরে যাবে দিল্লিতে। এখন দেখার, পথিমধ্যে তারা কোভিডের পরিবাহী হিসেবে কতটা কাজ করে এবং কোথায় কোথায় তার কী কী অভিঘাত হয়।

সন্ধ্যা ৭.‌৩০

অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু এবং মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন যাতে কাল থেকে যাত্রীট্রেন চালানো বন্ধ রাখা হয়। তাঁদের মতে, এর ফলে হু হু করে সংক্রমণ বেড়ে যাবে। যদিও মনে হচ্ছে না, ওই আপত্তিতে খুব একটা কাজ হবে। কেন্দ্র মোটামুটি সব ব্যবস্থা করে প্রস্তুতি নিয়েই ফেলেছে।

বস্তুত, চারটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাব দিয়েছেন লকডাউন অন্তত ৩১ ম পর্যন্ত চলুক। বলা হচ্ছে দু’তিন দিনের মধ্যে কেন্দ্র লকডাউনের নতুন গাইডলাইন ইস্যু করবে।

টিভি বলছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, প্রথমত, এভাবে ট্রেন চালু করা উচিত নয়। তাতে সংক্রমণের আশঙ্কা আরও বাড়বে। তাঁর আরও অভিমত, পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছ থেকে রেলের ভাড়া নেওয়া উচিত নয়। যদি ভাড়া নেওয়া হয়, তাহলে বাংলার শ্রমিকদের ভাড়া রাজ্য সরকার দিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, তিনি বলেছেন কেন্দ্র যেমন একদিকে লকডাউন হাল্কা করছে, তেমনই আবার অন্যদিকে রাজ্যগুলোকে বলা হচ্ছে সংক্রমণ আটকাতে। এই দু–মুখো নীতি না নিয়ে বরং রাজ্যকেই দায়িত্ব দেওয়া হোক কোথায় কোথায় লকডাউন থাকবে আর কোথায় থাকবে না, সেটা ঠিক করার।

কেন্দ্রীয় দল নিয়েও ক্ষোভ জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, তাঁরা কেন্দ্রের নেতৃত্বেই করোনা মোকাবিলার কাজ করছেন। তাই কেন্দ্রীয় দল পাঠানোর কোনও দরকার নেই। আর কোন রাজ্যে কত সংক্রমণ, তা নিয়ে আঙুল তোলা উচিত নয়। এখন পারস্পরিক দোষারোপের সময় নয়। এখন হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার সময়। কাল ট্রেন চালু হলে লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিক ফিরে আসবেন রাজ্যে। তাছাড়াও, আরও ৯টি ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেন রাজ্যে ঢুকবে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে। তখন সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের খাবার বা অন্য বিভিন্ন পরিষেবা নিয়ে সমস্যা তৈরি হবে। সেজন্য যে রাজ্য থেকে তাঁরা আসছেন, সেই রাজ্যের সঙ্গে সমণ্বয় রক্ষা করা প্রয়োজন।

রাজ্যের তরফে কেন্দ্রের কাছে অর্থের দাবিও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। লিখে রাখি, আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে করোনা এবং কো–মর্বিডিটিতে মৃত ১৯০ জন। তার মধ্যে করোনায় মৃত ১১৮ জন। কো–মর্বিডিটিতে ৭২ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের।

রাত ৮.‌৩০

টিভি–তে অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জির সাক্ষাৎকার হচ্ছে। বরাবরই ওঁর মতামত খুব স্পষ্ট। বেশি জ্ঞান দিতে যান না। জাহির করার কোনও চেষ্টা নেই। সেটা খুব ভাল লাগে। যেমন নোবেল পাওয়ার পর বলেছিলেন, ‘আমার প্রথমেই মনে হল, অনেকগুলো প্লেনের টিকিট ক্যানসেল করতে হবে।’ আজ যেমন বললেন, ‘করোনার প্রকোপে আমেরিকায় বহু লোকের চাকরি চলে গিয়েছে। আমার চাকরি আছে। বাড়ির পাশের পার্কে ফুটবল খেলা বন্ধ হয়ে গেলেও হাঁটাহাঁটি চালু আছে। সেটা করতে পারছি। ব্যাডমিন্টন খেলতে পারছি।’

সাধারণত অ্যাকাডেমিক্‌সের লোকজন খুব গেরামভারি, সিরিয়াস এবং গুরুগম্ভীর হন। আমাদের মতো পাঁচপেঁচিদের তাঁদের বিদ্যার পাহাড়ের তলায় চাপা পড়ার ভয় থাকে। কিন্তু অভিজিতের সেন্স অফ হিউমার তুলনারহিত। সেখানে কোথাও এই পণ্ডিতের সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পারি।

রাত ৯.‌‌ ১৩

মনমোহন সিংহ এখনও হাসপাতালে। স্থিতিশীল। ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে জানাচ্ছেন এইমস কর্তৃপক্ষ।

রাত ১০.‌২৩

লকডাউনের ৫০ তম দিনটা কেটে গেল। ঘুম আসছে না। কানে বাজছে মাতৃহারা কন্যার অনন্ত জিজ্ঞাসা, ‘মায়ের কাজটা ওরা ঠিকঠাকই করেছে। তাই না?‌’

বাঘটা গুঁড়ি মেরে বসে আছে কোথাও। ‌‌