লকডাউন ডায়েরি – ২৬ মে, ২০২০

২৬.‌০৫.‌২০২০। মঙ্গলবার

সকাল ৮.‌০৯

আজও রোদ ওঠেনি। আজও দেদার হাওয়া দিচ্ছে। আজ একটা নতুন দিন। আজ আবার যুদ্ধ শুরু।

একটা শহর একসঙ্গে লড়াই করছে দুটো শত্রুর বিরুদ্ধে। দুটো ফ্যাক্টরের বিরুদ্ধে। ঘূর্ণিঝড় আর অতিমারী। একটা থেকে পরিত্রাণ মিলতে না মিলতেই অন্যটা ঘ্যাঁক করে এসে ধরছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রমাগত ডিসট্রেস কল। ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে টুকরো টুকরো দুঃখদুর্দশার কাহিনি। ছ’দিন কেটে গিয়েছে। এখনও অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ নেই। জল নেই।

অবর্ণনীয় দিনযাপনের কথা শুনে কষ্ট হয়। মাথা ঘুরতে থাকে। ঝকঝকে সকালেও চোখে অন্ধকার নেমে আসে। টেনশন হয়। অসহায় লাগে। কারণ, এর কোনও শেষ দেখতে পাই না। পাচ্ছি না। মনে হয়, বিদ্যুৎ আসবে। পানীয় জলও আসবে। কিন্তু জীবন পরিত্রাণ পাবে না। কারণ, দরজার ওপারে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে কোভিড–১৯।

সকাল ৯.‌১৯

বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হু–হু হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই চন্দ্রবিন্দুর একটা গানের ‘লুপ’–এ পড়ে গেলাম— ‘এই হাওয়া ঝামলে পড়ছে আজ’।

একটা সময় ছিল, যখন রোজ চন্দ্রবিন্দুর গান শুনতাম। ইন ফ্যাক্ট, এখনও ওদের গানের একনিষ্ঠ ভক্ত। এখনও ‘মন’ বা ‘আদরের নৌকো’ শুনে নিই মাঝেমধ্যেই। সেটা বিনা কারণে নয়। প্রথমত, সমস্ত বাংলা ব্যান্ডের বিবিধ ভাঙাগড়ার মধ্যে একমাত্র চন্দ্রবিন্দু তাদের নিজস্ব বাঁধন অটুট রেখে দিয়েছে। দিস ইজ নট আ মিন অ্যাচিভমেন্ট। দ্বিতীয়ত, চন্দ্রবিন্দুর গানে শব্দচয়ন ও শব্দপ্রয়োগের মেধা এবং বুদ্ধি। তার সঙ্গে তীক্ষ্ণ রসিকতাবোধ। অনিন্দ্য, উপল, চন্দ্রিলকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ঠিকই। কিন্তু না চিনলেও বা আলাপ না থাকলেও ওদের কাজের প্রতি মুগ্ধতাটা তৈরি হতো এবং থেকে যেত।

বহুবছর আগে অধুনাপ্রয়াত পৌলোমী সেনগুপ্ত চন্দ্রবিন্দুকে নিয়ে সম্ভবত ‘উনিশ কুড়ি’–তে একটা ফিচার লেখার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিল। আমি তার অনেক আগে থেকেই ওদের গানের ভক্ত। নতুন সিডি বেরোলেই দৌড়ে গিয়ে কিনে ফেলি। বিভিন্ন গান ক্রমাগত ‘লুপ’–এ শুনতে থাকি। গুনগুন করি। তার উপর ভিত্তি করেও লেখাটা নামিয়ে দেওয়া যেত। বুদ্ধিমান লোক সেটাই করত। কিন্তু আমি চিরকালের বিশ্বগেঁড়ে এবং অতি পরিশ্রমে বিশ্বাসী। ফলে আমার মনে হল, ওদের লাইভ অনুষ্ঠান কেমন হয়, লেখার জন্য তার ভাইভটা নিজের চোখে দেখা দরকার। পাটুলির একটা কলেজের সোশ্যালে ওদের অনুষ্ঠানে গেলাম। দেখলাম একটি বুদ্ধিমান বাংলা ব্যান্ড তরুণ প্রজন্মকে কতটা আন্দোলিত করতে পারে!

প্রায় প্রতিটা গান জনতার মুখস্থ। তারা মঞ্চের গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের মতো গেয়ে চলেছে। একটা গান থামার আগে পরের গানের রিকোয়েস্ট চলে আসছে। গোটা কলেজ চত্বর জুড়ে ওই কয়েকঘন্টায় যে এনার্জি তৈরি হয়েছিল, অবিশ্বাস্য!‌ আমার লেখাটাও শুরু হয়েছিল গানের রিকোয়েস্ট দিয়ে। কোন গান, সেটা এখনও মনে আছে— ‘সুইটহার্ট’।

এতবছর চলে গিয়েছে। বাংলা ব্যান্ডের সেই রমরমার দিন আর নেই। ক্যাসেট অবলুপ্ত। সিডি–ও। এখন গান শুনি স্মার্টফোনে। কিন্তু তার মধ্যেও মাঝেমধ্যেই চলে আসে চন্দ্রবিন্দু। যেমন এখন এই সকালে দামাল হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভেসে এল—

‘এই হাওয়া ঝামলে পড়ছে আজ
আর রাস্তাঘাট আলোর মহারাজ।’

দুপুর ১২.‌০৯

টিভি–তে দেখছি রাহুল গান্ধী বলছেন, ভারতে চার দফার লকডাউন পুরোপুরি ফেল করেছে। রাহুলকে কেমন অন্যরকম দেখতে হয়ে গিয়েছে। মাথায় চুল বেড়ে গিয়েছে। মুখটা ছোট দেখাচ্ছে। জ’লাইন বেরিয়ে পড়েছে। আগে যে একটা গ্ল্যাক্সো বেবি মার্কা চেহারা ছিল, সেটাও আর নেই। বয়স্ক লাগছে একটু। পরিণত লাগছে চেহারা ওয়াইজ।অত্যন্ত বিনয়ের রাহুল বলছেন, কংগ্রেসের হাতে দায়িত্ব থাকলে এমন অবস্থা হতো না।

হতো না কি?‌ কে জানে!‌ কংগ্রেস তো একটা সময় টানা প্রায় পাঁচ দশক দেশ শাসন করেছে। সেই সালতামামি যদি গৌরবের হতো, তাহলে আজ কি রাহুলের পৈত্রিক দলের এই দশা হয়?‌

দীর্ঘ তিন দশক এই পেশায় থাকতে থাকতে বিরোধীদের দেখে মনে হয়েছে, বিরোধী হওয়া আসলে খুব সহজ। বিনাবাধায় এবং বিনাদ্বিধায় আলফাল বলা যায় বা করা যায়। শাসক হলে বোঝা যায় কাঁটার মুকুট কোথায় এবং কীভাবে এঁটে বসছে। যুগে যুগে, কালে কালে এটাই হয়ে এসেছে। সোনার পাথরবাটির কথা বলছে জেনেও বিরোধীরা দায়িত্বশীল বিরোধীর ভূমিকা পালন করার কথা বলে এসেছে। একটা সময়ে তারা শাসক হয়েছে। হয়ে যা যা আগে বলে এসেছিল, ঠিক তার উল্টোটা করতে শুরু করেছে। তাদেরও বিরোধী তৈরি হয়েছে। সেই বিরোধীরাও ক্ষমতায় গিয়ে আগের শাসকের মতোই কাজ করতে শুরু করেছে। এ এক আশ্চর্য চক্র। আর সেই দশচক্রের কুম্ভীপাকে আমরা, সাধারণ মানুষ ক্রমাগত লাট খাচ্ছি।

ব্যাডমিন্টনের বন্ধু রাজু ফোন করেছিল। খুবই চিন্তিত। বলল, ‘দাদা, শেয়ার মার্কেট ধসে যাবে। ইট্‌স অন দ্য ভার্জ অফ ক্র্যাকিং ডাউন। কোরামিন দিয়ে ধরে রাখা হচ্ছে। প্রচুর লোক পথে বসবে। শুধু ভারতে নয়, আমেরিকাতেও।’

— এটা কি তোর খবর?‌

‘হ্যাঁ দাদা। এটাই আমার খবর। প্রার্থনা করছি, যাতে আমার খবরটা ভুল হয়।’

দুপুর ১.‌০০

ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে পিছু ফিরে দেখছিলাম। তারপর তাকালাম ভবিষ্যতের দিকে। মনে হল, আমরা কোভিড প্রজন্মের মানুষ হয়ে গেলাম। আমরা, যাদের জীবনটা একটা সময়ে হাজার দুঃখের মধ্যেও ফান লাভিং আর মজার ছিল। যাবতীয় দুশ্চিন্তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া আড্ডা আর বেসুরে গান গাওয়া ছিল। রাস্তার পাশের কফিশপে তুমুল তর্ক ছিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে লং ড্রাইভ ছিল। গাড়িতে জন ডেনভার, কেনি রজার্স, হ্যারি বেলাফন্টে ছিল। বাড়িতে মান্না, দেবব্রত, পীযূষ ছিল।

সেসব কেমন এক লহমায় উধাও হয়ে গেল!‌

মনে হচ্ছিল, এই ক্ষত নিরাময় হতে আরও কয়েকটা প্রজন্ম লেগে যাবে। যেমন হিরোসিমা, নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের পর তার অভিঘাত কাটতে কাটতে কয়েকটা প্রজন্ম চলে গিয়েছে। এখনও তার রেশ পুরোপুরি কাটেনি। আমাদের এই করোনা অভিঘাতও আরও বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে চলবে। আর সেসব প্রজন্মের সূত্রধর হয়ে থাকব আমরা। আমাদের এই প্রজন্ম। আমি আর আমার বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, পরিচিতরা। আমরা— প্রথম কোভিড প্রজন্ম। ইতিহাসে নাম থেকে যাবে।

দুপুর ১.‌২৩

আজকাল প্রায়ই শুনি, ২০২০ সালটা গেলে বাঁচি!‌ তাই?‌ ২০২০ সালটা চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?‌ ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পৃথিবীটা আবার আগের মতো হয়ে যাবে?‌ সব অন্যরকম হয়ে যাবে?‌ আমরা সকলে একটা অন্যরকম আকাশের তলায় বাঁচতে শুরু করব?‌

নাহ্‌। এটা আসলে আমাদের আত্মসান্ত্বনা। নিজেদের মতো করে একটা ডেডলাইন ঠিক করে নেওয়া। কারণ, সামনে কোনও শেষ দেখতে পাচ্ছি না। তাই নিজের মতো করে একটা ক্যালেন্ডার সেট করা আর তারপর নিজেকে ক্রমাগত বলতে থাকা, এই তো। আর কয়েকটা মাস। এই তো, আর কয়েকটা দিন। তারপরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই কাউন্টডাউনটাই এখন আমাদের জীবন। একটা করে দিন যায় আর আমরা নিজেদের বলি, এই বছরটা খুব খারাপ। কিন্তু এই বছরটা কেটে যাবে।

বছর তো কেটে যাবে। যেমন যায়। করোনা–কাল কাটবে কি?‌

দুপুর ২.‌৩২

পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের ১২ জন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আপাতত তাঁরা ভর্তি বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালে।

দুপুর ৩.‌৩০

বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। তাঁর অভিযোগের তির কলকাতা পুরসভার মুখ্য প্রশাসক ফিরহাদ হাকিমের দিকে। প্রবীণ রাজনীতিক বলছেন, ফিরহাদ বিধায়কদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেননি। সাধন তোপ দেগেছেন সিইএসসি–র বিরুদ্ধেও। বলেছেন, ‘কেন একটা সংস্থার মনোপলি থাকবে?‌ কেন প্রতিযোগিতা থাকবে না?‌ সরকারকে এটা চিন্তা করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলা কীভাবে করা হবে, সেটা নিয়ে ফিরহাদ আমাদের কারও সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি। প্রাক্তন মেয়র শোভন চ্যাটার্জিকেও ডেকে কথা বলা উচিত ছিল।’

যার জবাবে ফিরহাদ বলছেন, ‘বাড়িতে বসে অনেক বড় বড় কথা বলা যায়। আমি রাস্তায় নেমে কাজ করছি। সময় লাগবেই। রোম ওয়াজ নট বিল্‌ট ইন আ ডে। এত বড় কাজ একদিনে হয় না। আমরা সব বড় রাস্তা খুলে দিয়েছি। সব বড় রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। ছোট কিছু রাস্তায় এখনও গাছ পড়ে আছে। সেগুলো সরানোর কাজ চলছে।’ খানিক উত্তেজিত গলায় এ–ও বলছেন, ‘সাধনদা নিজে কেন পুরসভায় আসেননি? ওঁর কোনও সাজেশন থাকলে তো পুরসভায় এসেই বলতে পারতেন!‌’‌

প্রশ্ন হল, সাধন কেন আচমকা এই বিস্ফোরণ ঘটালেন?‌ অনেকে বলছেন তিনি চান তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হোক। যাতে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে পারেন। অন্য একাংশের মতে, নিজের এলাকায় ক্ষোভের মুখে পড়ার আশঙ্কায় ধুরন্ধর রাজনীতিক আগেই পাবলিকলি অভিযোগের অভিমুখটা ফিরহাদের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। আর ইতিহাস বলছে, সাধন মাঝেমধ্যেই এমন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে থাকেন। তবে তার মধ্যে বৃহত্তর কোনও পরিকল্পনা থাকে না। বরং অনেক বেশি থাকে স্থানীয় রাজনীতিতে দলের অন্দরে পাঙ্গা নেওয়ার ইচ্ছে।

এবার এটা কোনদিকে যায়, দেখা যাক। বিশেষত আগামী বছর যখন বিধানসভা ভোট।

বিকেল ৪.‌১০

বড় কেলেঙ্কারি!‌ মহারাষ্ট্র থেকে ৪১টি শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন বোঝাই হয়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরছেন রাজ্যে। তাঁদের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। রাজ্য প্রশাসনের কণ্ঠে স্বভাবতই উদ্বেগের সুর। আলাপন’দা অননুকরণীয় ভঙ্গিতে প্রেস ব্রিফিংয়ে ‘মহারাষ্ট্র’ শব্দটা একবারও উচ্চারণ না করে যা বলল, তার মোদ্দা কথা— ‘এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যেভাবে রাজ্যে আসছেন, সেটা যথেষ্ট চিন্তার। রাজ্যের পাবলিক হেল্‌থের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা বিগ ইস্যু এবং বিগ প্রবলেম।’

সবচেয়ে বড় কথা, এই শ্রমিকদের পাঠানোর আগে একবারও রাজ্যের সঙ্গে কোনও আলোচনা করা হয়নি। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে বলেছেন, তিনি নিরুপায়। রেল থেকে তাঁর উপর চাপ দেওয়া হচ্ছে ওই শ্রমিকদের নিজেদের রাজ্যে ফেরত পাঠানোর জন্য। তবে এটাও ঠিক যে, ভারতের কোভিড ক্যাপিটাল মহারাষ্ট্রে যেভাবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে উদ্ধবও চিন্তিত। দেশে মোট আক্রান্তের ৫২ শতাংশ তাঁর রাজ্যে। তিনিই বা কেন সেই বোঝা বইতে যাবেন?‌

এই ৪১টি ট্রেনবাহিত শ্রমিকদের স্টেশনে নামামাত্রই কোয়ারেন্টিনে পাঠানো উচিত। কিন্তু সেই পরিকাঠামো কি আছে এই রাজ্যে?‌ নেই। তাহলে তাঁদের থাকতে হবে হোম কোয়ারেন্টিনে। হোম কোয়ারেন্টিন হল আরেকটি সোনার পাথরবাটি!‌

বিকেল ৫.‌৩২

এডিট মিট থেকে ফিরে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লেও আমার স্নায়ু সজাগ থাকে। এটা আগেও দেখেছি। আজও মনে হল, কোথাও একটা কিছু ঘটছে।

ঝপ করে চোখ খুলে দেখলাম, সামনে দাঁড়িয়ে সনৎ। আমায় চোখ খুলতে দেখে বলল, ‘একটু এদিকে আসুন।’

কোনদিকে?‌!‌

চেয়ার ছেড়ে উঠে দেখলাম, ডিপার্টমেন্টের মাঝ বরাবর চওড়া টেবিলে একটি মনোহর কেক রাখা। উপরে লেখা ‘হ্যাপি বার্থডে টু অনিন্দ্য’। এক লহমায় বহু বছরের পুরনো অপ্রতিভতাটা ফিরে এল। জীবনে কখনও নিজের জন্মদিন নিয়ে পাবলিক মাতামাতি পছন্দ করিনি। বরং কেউ করতে চাইলে সটান পিঠটান দিয়েছি। একবার ‘এবেলা’–র সহকর্মী স্যমন্তক জন্মদিনের কেক আনতে যাওয়ায় প্রথমে খুব বকুনি দিয়েছিলাম। তারপর অফিস ছেড়ে স্রেফ হাওয়া হয়ে গিয়েছিলাম। পরের বছর স্যমন্তক বুদ্ধিমানের কাজ করেছিল। আমায় কিছু না জানিয়ে অন্য সকলের সঙ্গে প্ল্যান করে কেক আনিয়েছিল। সেবার সময়াভাবে এবং রং ফুটে পড়ে যাওয়ায় পালাতে পারিনি। চোখ–টোখ পাকিয়েও সমবেত উচ্ছ্বাসে সায় দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।

কোনওদিন অ্যাটেনশন–সিকার নই। উল্টে কেউ বেশি মনোযোগ দিলে বা আমায় নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের চিন্তা করলে খুবই লজ্জিত এবং বাধো বাধো লাগে। কোনও কিছুর মধ্যমণি হতে ইচ্ছে করে না। বরং অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করি একপ্রান্তে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু নিজের জন্মদিন এমন একটা অকেশন, যেখানে সাইডলাইনে বা রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকার প্রশ্ন নেই। চাই বা না চাই, মাঝখানে থাকতেই হবে!‌ তাই আমি সাধারণত এই দিনটায় খুবই সতর্ক হয়ে, গোপনীয়তা অবলম্বন করে সরু এবং নীচু হয়ে কাটিয়ে দিই। গতকাল রাতেই জুনিয়র সহকর্মী দেবাশিস একটা ভিডিও তৈরি করে পাঠিয়েছিল। কোনও একদিন অফিসে গান গেয়েছিলাম। সেটা রেকর্ড করেছিল ও। সেই গান গাওয়ার ভিডিও এবং তার সঙ্গে কিছু স্টিল ছবি জুড়ে প্যাকেজ। প্যাকেজ হিসেবে দারুণ। কিন্তু আমার পক্ষে বড্ড বিড়ম্বনার। ও–ও সেটা জানত। সে কারণে আমি রেগে যেতে পারি ভেবে ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়েনি দেবাশিস। ঠিকই করেছিল।

ফেসবুক থেকেও বার্থডে ‘হাইড’ করে রেখেছিলাম। যাতে নোটিফিকেশন না যায়। ফলে নিশ্চিন্ত ছিলাম, এবার দিনটা চুপি চুপি কেটে যাবে। যারা এমনিতে মনে রাখে, তারা রাত ১২টা থেকেই মেসেজ পাঠায় বা ফোন করে। নিদেনপক্ষে দিনের দিন সকালে। এবং আমি জানি তারা কারা। প্রত্যেককে আলাদা করে জবাবও দিই। কিন্তু ফেসবুকের কল্যাণে যে শুভেচ্ছার ঢেউ আসা শুরু হয়, তার প্রতিটি আন্তরিক হলেও প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে জবাব দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। পাছে তারা কিছু মনে করে, সেজন্য ইনফর্মেশনটাই লুকিয়ে ফেলা। এটা এই বছরই প্রথম করেছিলাম।

কিন্তু কপালে বিড়ম্বনা থাকলে ঠেকায় কে!‌ দেখলাম, দুপুরের আগে এক স্মার্ট অ্যালেক বন্ধু ফেসবুকের ওয়ালে ‘শুভ জন্মদিন’ জানিয়ে বসেছে। প্রমাদ গুনলাম। জানতাম, এই শুরু হল!‌ ঠিকই জানতাম। তার মধ্যেই স্পোর্টসের হোয়াট্‌সঅ্যাপ গ্রুপে সনৎও শুভেচ্ছা জানিয়ে দিল। দ্বিতীয়বার বিপদঘন্টি বাজল। যার ম্যানিফেস্টেশন হল কিছু আগে সামাজিক দূরত্বকে চুলোর দুয়োরে পাঠিয়ে সাড়ম্বরে কেক–কাটনের মাধ্যমে।

সনৎ, সুতপা, অনির্বাণ, বিপ্লব, দেবাশিস, উত্তম, শুভা’দা, হেমন্ত, অর্ঘ্য, শ্রাবণ, পার্থ, শত্রুঘ্ন, খোকন চলে এল চটপট। বিপ্লব একটা মিষ্টি কলম উপহার দিল। শুভা’দা এক প্যাকেট ক্লাসিক। এটা অবশ্য প্রতিবছরের রিচুয়্যাল। সকলের মাঝখানে খুবই লজ্জা লজ্জা মুখ করে একটা প্লাস্টিকের ছুরি দিয়ে সুতপা আর সনতের আনা কেক কাটলাম। অনির্বাণ তো ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ গানও জুড়ল। তারপর সকলকে কেক খাওয়ানো হল। গ্রুপ ছবি তোলা হল। ব্রীড়াবনত নববধূর মতো সময়টা কাটালাম।

সনৎ অনুযোগ নিয়ে ব্যাখ্যা করল, ‘কেকের উপর অনিন্দ্যদা লেখা নেই কিন্তু। কেন জানেন তো?‌ দোকানের ভিতরে তো ঢুকতে পারিনি। বাইরে থেকে ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছিলাম। কিন্তু দোকানের ছেলেটা অনিন্দ্র লিখেছিল। ওকে বললাম, ভুল হয়েছে। ঠিক করুন। তখন ঠিক করল বটে। কিন্তু শুধু অনিন্দ্য লিখে দিল।’

শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, ওরে!‌ এই কঠিন সময়ে তোরা যে অফিসে আসার পথে গাড়ি ঘুরিয়ে গিয়ে উদ্যোগ নিয়ে এই কাণ্ডটা করেছিস, তাতেই কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসছে। কেকের উপর নামে ‘দাদা’ রইল কি না রইল, তাতে কী যায়–আসে!‌ মনে তো রইল।

সন্ধ্যা ৬.‌১০

সাধনের বিস্ফোরণকে সম্ভবত বেশি গুরুত্ব দেবে না তৃণমূল। অন্তত এখন। কারণ, পুরসভা থেকে বেরোনর মুখে সাধন–প্রশ্নে ফিরহাদ একটা কথাই বলে গেলেন, ‘সাধনদা সুস্থ নন। অসুস্থ। বেচারা কী বলছেন জানি না। ওঁর কথা নিয়ে কিছু বলতে চাইছি না। অসুস্থ মানুষ। কী আর বলব! মন্ত্রী হলেও সব মন্ত্রীই যে সুস্থ, তা তো নয়। ওঁর কথায় অত গুরুত্ব দিচ্ছি না।‌’

রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর গলায় প্রবল সহানুভূতির সুর। কিন্তু ঠাহর করলে বোঝা যায়, একটা দাঁত–চাপা তাচ্ছিল্যও আছে।

সন্ধ্যা ৬.‌৪৮

বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়ায় দক্ষিণ শহরতলির নাদিয়ালে ব্যাপক গোলমাল, পথ অবরোধ, বিক্ষোভ, ভাঙচুর। বেধড়ক মার খেয়েছেন মেটিয়াব্রুজের তৃণমূল বিধায়ক। আপাতত তিনি হাসপাতালে ভর্তি। সিটি স্ক্যান করানো হচ্ছে।

রাত ৮.‌৩৭

ফেসবুকে অফিসের ছবি দিয়েছিলাম। ক্যাপশন:‌ লাভ ইন দ্য টাইম অফ করোনা। যথারীতি ওয়ালে শুভেচ্ছার ঢেউ আসা শুরু হয়েছে। প্রতিটা মেসেজ পড়ছি আর ভাবছি, এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। সকলকে তো জবাবও দিতে পারব না!‌ কেউ কিছু মনে করবেন না তো?‌

কেরিয়ারের গোধূলিবেলায় পৌঁছে এমনিতেই নিজের প্রান্তিক অস্তিত্ব নিয়ে সর্বদা সঙ্কুচিত হয়ে থাকি। মনে হয়, বাকি কর্মজীবনটা সকলের শুভেচ্ছায় ভালয়–ভালয় কাটিয়ে দিতে পারলেই হল। কেউ যেন কিছু মনে না করে। আলাদা করে জবাব দিতে না পারলে কেউ কি অভিশাপ দেবে?‌ কে জানে!‌

রাত ১০.‌৩১

যাহোক করে বিড়ম্বনার দিনটা কেটে গেল। জন্মদিনে রেজোলিউশন–টন কোনওদিন নিইনি। স্রেফ বছরের আরও একটা দিন হিসেবেই দেখেছি। তবে আজ কয়েকটা লাইন মনে মনে বললাম।

জীবনের খুব কঠিন সময়ে এই লাইনগুলো লেখা একটা চিরকুট আমার ওয়ালেটে থাকত। ভাঁজ খুলে দেখতাম না কখনও। কিন্তু জানতাম, লাইনগুলো আছে। খুব কাছাকাছিই আছে। অন্ধকারে মশালের আলোর মতো।

‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা—
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।

সহায় মোর না যদি জুটে, নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।

আমারে তুমি করিবে ত্রাণ, এ নহে মোর প্রার্থনা—
তরিতে পারি শকতি যেন রয়।
আমার ভার লাঘব করি নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
বহিতে পারি এমনি যেন হয়।

নম্রশিরে সুখের দিনে, তোমারি মুখ লইব চিনে—
দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয়।’ ‌

8 thoughts on “লকডাউন ডায়েরি – ২৬ মে, ২০২০

  1. ভালো থাকবেন ,জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা রইলো /লোকডাউন সরকার তুলে নিলে লোকডাউন ডাইরি চলবে কি ?নিশ্চয় না ,কিন্তু show must go on!

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s