লকডাউন ডায়েরি – ২৫ মে, ২০২০

২৫.‌০৫.‌২০২০। সোমবার

সকাল ৭.‌৫৯

কাল রাতে বাড়ি ফিরে বারান্দা থেকে তোয়ালেটা তুলতে গিয়ে দেখলাম দুর্দান্ত হাওয়া দিচ্ছে। একবার মনে হল, আবার ঝড় আসছে নাকি?‌ তারপর মনে হল, নাহ্‌, তেমন তো কোনও পূর্বাভাস নেই। যে আভাস আছে, সেটা বলছে উত্তরবঙ্গে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হবে। আরও বলছে, সপ্তাহান্তে একটা নিম্নচাপ আসছে। ফলে আবার বৃষ্টি, আবার বাঁধভাঙা, আবার জলবন্দি মানুষ, আবার ভয়, আবার ট্রমা। আর ভাল লাগছে না।

কাল রাতে অফিস থেকে ফিরে ভাল করে স্নান করলাম। একটু ভাল লাগল। ঘটনাচক্রে, কাল রাত থেকে টিভি ফিরে এসেছে। মোবাইল নেটওয়ার্কও আগের চেয়ে বেটার। এগুলো সব পজিটিভ সাইন। জীবন আবার করোনা–ছন্দে ফিরছে মনে হচ্ছে। আশা করি, আজকের দিনটা একটু অন্যরকম যাবে।

৯.‌৪৬

সকাল থেকে রোদ নেই। আজও হাওয়া দিচ্ছে খুব। ইন ফ্যাক্ট, কাল রাতের চেয়েও বেশি গতিতে। কিন্তু এটা ঝড়ের হাওয়া নয়। আমার মতো আরও অনেকে কি ভাবছেন আবার ঝড় আসছে?‌ যেমন ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। কিন্তু আমি এই প্রাচীন প্রবাদে বিশ্বাস করি না। ‌তার একটা সলিড কারণও আছে।

বহুবছর আগে বইমেলায় ‘দেশ’ পত্রিকার বিতর্কসভা কভার করতে গিয়েছিলাম। মোশন সম্ভবত বিয়ে–টিয়ে নিয়ে কিছু একটা ছিল। সেখানে একপক্ষের এক বক্তা কোনও একটা প্রসঙ্গে এই কথাটা বলেছিলেন— ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। বিপক্ষে ছিলেন নকশালপন্থী নেতা অসীম চ্যাটার্জি (‌কাকা)‌। তিনি তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘ওটা গরুদের যুক্তি‌!‌’

কথাটা ভুলিনি। বরং জীবনের বিভিন্ন সময়ে মনে করেছি এবং কাজে লাগিয়েছি। এখনও সেটাই ভাবছি— ওটা গরুদের যুক্তি। এই মনখারাপ, এই কিছু ভাল্লাগছে না–টা গরুদের যুক্তি। আমি গরু নই। আমি গোমাতাও নই।

সকাল ১০.‌১৩

পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ত্রিপুরা ছাড়া আজ সকাল থেকে বাকি রাজ্যে অন্তর্দেশীয় উড়ান চালু হল। চালু হল বটে। কিন্তু বিমানে চড়ার সমস্ত নিয়ম বদলে গিয়েছে—

এয়ারপোর্টে যাত্রীদের আনা–নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে উপযুক্ত গণপরিবহণের বন্দোবস্ত করতে হবে। অথরাইজ্‌ড ট্যাক্সি থাকবে। 

গেটের কাছে যাত্রীদের বোর্ডিং কার্ড স্ক্যান করাতে হবে। 

যাত্রীদের কাছে আরোগ্যসেতু অ্যাপ থাকতেই হবে। না থাকলে তখনই ডাউনলোড করতে হবে। 

বিমানবন্দর কর্মীদের আরোগ্যসেতু অ্যাপের সর্বশেষ স্টেটাস দেখাতে হবে যাত্রীদের। 

১৪ বছরের কমবয়সীদের আরোগ্যসেতু অ্যাপ লাগবে না।

যাত্রীদের মুচলেকা দিতে হবে, তাঁরা কোভিড পজিটিভ নন এবং কোনও কনটেনমেন্ট জোন থেকে আসছেন না। 

কেউ এই সংক্রান্ত কোনও তথ্য ভুল দিলে কঠোর শাস্তি হবে। 

উড়ান ছাড়ার ২ ঘন্টা আগে বিমানবন্দরে পৌঁছতে হবে। 

ব্যাগেজ ট্যাগ অনলাইনে মিলবে। সেটা লাগেজে আটকে দেওয়া হবে।

শুধুমাত্র ওয়েব চেক–ইন করা যাবে। 

বোর্ডিং গেটের কাছে যাত্রীদের সেফটি কিট, মাস্ক, ফেস শিল্ড এবং স্যানিটাইজার সংগ্রহ করতে হবে। 

বিমানের ভিতরে একটিমাত্র হ্যান্ডব্যাগ নিতে দেওয়া হবে। 

চেক–ইন ব্যাগেজও একটিই নেওয়া যাবে। 

‌বিমানের ভিতরে যাত্রীদের যথাসম্ভব কম ল্যাভেটরি / ‌টয়লেট ব্যবহার করতে হবে।

বিমানের মধ্যে টয়লেটে যাওয়ার জন্য লাইন দেওয়া যাবে না। টয়লেটে যাওয়ার সময় শিশু ও বয়স্কদের সঙ্গে মাত্র একজন সঙ্গী থাকতে পারবেন।

বিমানের প্রতিটি আসনে জলের বোতল রাখতে হবে। 

বিমানে কোনও খাদ্যদ্রব্য পরিবেশন করা হবে না। যাত্রীরাও কোনও খাবার নিয়ে বিমানে উঠতে পারবেন না। 

বিমানের ভিতরে খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিন নেওয়া যাবে না। 

বিমান গন্তব্যে অবতরণ করার পর ব্যাগেজ পৌঁছেছে কিনা, তা যাত্রীর মোবাইলে টেক্সট মেসেজ করে জানানো হবে। 

জীবনে প্রথম প্লেনে চড়েছিলাম ১৯৯৩ সালে। মুম্বই বিস্ফোরণ এবং তারপর সঞ্জয় দত্তের গ্রেফতারি কভার করতে যাওয়ার সময়। গিয়েছিলাম অধুনালুপ্ত ‘ইস্ট ওয়েস্ট এয়ারলাইন্‌স’–এ। কথিত ছিল তার মালিক নাকি দাউদ ইব্রাহিম। কিন্তু কোনও সূত্রেই তার কোনও সমর্থন মেলেনি। সেটা নিয়ে খোঁজখবরও করিনি। কারণ খোকা রিপোর্টারের মনে তখন প্রবল উত্তেজনা!‌ প্লেন ছাড়ার তিনঘন্টা আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছেছিলাম। তখন কলকাতা থেকে এত উড়ান চালু ছিল না। ফলে বিমানবন্দর প্রায় ফাঁকা। সিনেমা–টিনেমায় দেখেছিলাম, প্লেনে পেপারব্যাক পড়তে হয়। তাই সেটাও একটা নিয়ে গিয়েছিলাম। ফাঁকা এয়ারপোর্টে খুব মন দিয়ে সেটা পড়ার ভান করতে লাগলাম। আর কাউন্টার খোলামাত্রই গিয়ে একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জানালার ধারে সিট দখল করতে হবে তো।

অফিসের ট্রাভেল ডিপার্টমেন্ট বলেছিল, টিকিট না–ও পাওয়া যেতে পারে। চেষ্টা করছে। তাদের বলেছিলাম, প্লেনের লেজে বেঁধে দিলেও হবে। কিন্তু কলকাতা থেকে আমায় না নিয়ে মুম্বইয়ের উড়ান রওনা হবে না। তবে সিট পাওয়া গিয়েছিল। দরবার করে উইন্ডো সিটটাও নিতে পেরেছিলাম। উড়ানের পুরো সাময়টা শিশুর মতো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। যা খাবার দিয়েছিল, হাভাতের মতো চেটেপুটে খেয়েছিলাম। কিচ্ছু ছাড়িনি।

ওহ্‌ ভি এক দিন থে। ইয়ে ভি এক দিন হ্যায়। জমানা বদল গ্যয়া!‌

সকাল ১০.‌৫০

আজ ইদ–উল–ফিতর।

রমজান মাসের শেষে খুশির ইদ। কিন্তু কোথাও কোনও প্রাণের সাড়া নেই। রেড রোড বা অন্য কোথাও ইদের নমাজ পড়া নেই। কোথাও আনন্দ নেই। আলিঙ্গন নেই। বিরিয়ানি নেই। সিমাই নেই। নমাজ পড়া হচ্ছে বাড়িতে বাড়িতে। ভাবার চেষ্টা করছি, দুর্গাপুজোর সময়টা যদি এইরকম হতো?‌ যদি অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়া হতো বাড়িতে?‌ নতুন জামা পরে বাড়িতেই বসে থাকতে হতো?‌ কেমন লাগত?‌

খানিক আগে পিং করে একটা হোয়াট্‌সঅ্যাপ ঢুকল। চট্টগ্রাম থেকে আসাদভাই পাঠিয়েছে— ইদ মুবারক।

আসাদের সঙ্গে একটা সময় নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ও পুলিশে চাকরি করে। বেশ কয়েকবছর আগে বাংলাদেশ সরকারের অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম কোনও অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়া বাংলাদেশ যাওয়া। সেই প্রথম রাজার হালে চলাফেরা। গাড়ির সামনে পিছনে পাইলট কার আর টেল কার। সঙ্গে ২৪ ঘন্টার পুলিশ এসকর্ট। সেই এসকর্ট টিমেরই সদস্য ছিল আসাদ।

ছিপছিপে চেহারা। বয়সে আমার চেয়ে বেশ খানিকটা ছোট। বাড়ি চট্টগ্রামে। হাতে লোডেড স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। সময়ে সময়ে সেফটি ক্যাচ অন করা থাকত। মুখে ঝকঝকে হাসি। একটা সময় ফুটবল খেলত। ভেবেছিল বড় হয়ে ফুটবলার হবে। পুলিশে চাকরি পেয়ে যাওয়ায় আরও অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের মতো আসাদের ফুটবল–স্বপ্নেরও অপমৃত্যু হল।

দায়িত্ব ছিল এসকর্ট টিমের সকলেরই। কিন্তু আসাদের আমার প্রতি একটা চোরা পক্ষপাতিত্ব ছিল। সেটা বুঝতেও পারতাম। সফরের মধ্যে দু’দিন ধার্য ছিল চট্টগ্রামের জন্য। বাড়ির অত কাছে গিয়েও আসাদ বাড়ি যায়নি। হোটেলের সামনে গাড়িতেই ডিউটিতে ছিল সারা রাত। তার আগে সন্ধ্যায় আমায় নিয়ে গিয়েছিল জিন্‌সের ট্রাউজার্সের হোলসেল মার্কেটে। পরিচিত দোকানে নিয়ে গিয়ে ট্রাউজার্স পছন্দ করিয়ে, দরদাম সেরে সঙ্গে সঙ্গে অল্টার করিয়ে দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছিল। মাত্র ৫০০ বাংলাদেশি টাকার সেই টেরিফিক জিন্‌স পরলে এখনও লোকে জিজ্ঞাসা করে কোথা থেকে কিনেছি!‌ ঘিঞ্জি সেই মার্কেটে আমায় পিছন থেকে দু’হাত দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই আগলে রেখেছিল আসাদ। শুধু সেখানেই নয়, পুরো সফরটা আমার গায়ে গায়ে লেপ্টে ছিল। একটা মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যায়নি। পুলিশ নয়, ভাইয়ের মতো।

হোয়াট্‌সঅ্যাপে জবাব দিলাম। আর মনে মনে জড়িয়ে ধরলাম ওপার বাংলার যুবককে।

ইদ মুবারক, আসাদভাই।

বেলা ১১.‌২০

এখনও কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের দাবিতে পথ অবরোধ আর বিক্ষোভ হচ্ছে। মানুষের তীব্র ক্ষোভ সিইএসসি–র বিরুদ্ধে। টিভি–তে বয়স্ক সব মানুষের কষ্ট চোখে দেখা যায় না। লকডাউনে কাজের লোক আসছে না। অশক্ত শরীর নিয়ে জল টেনে তুলতে হচ্ছে। ঘর পরিষ্কার করতে হচ্ছে। রান্না করতে হচ্ছে। আমার বাড়ির দুই বুড়োবুড়ির দিকে তাকাই। আর ভাবি, ভাগ্যিস!‌

দুপুর ১.‌১৩

আজ থেকে আবার রেগুলার ওয়ার্কআউটে ফিরে গেলাম। অবশেষে। বিকজ আই নিড টু পুল দিস থ্রু। অন্তত ৩০ তারিখ পর্যন্ত ঠিকঠাক কাটাতে হবে। এই পর্যায়ের লকডাউন শেষ হওয়া পর্যন্ত। ৪৫ মিনিট সলিড ঘাম ঝরানো হল। দেখলাম, খুব কষ্ট হচ্ছে না। আসলে সমস্যাটা ছিল মনের। শরীরের নয়। দাঁতে দাঁত চেপে মনটাকে বশে আনতে পেরেছি।

প্ল্যাঙ্ক করতে গিয়ে যখন শেষ ১০ সেকেন্ড সারা দেহ থরথর করে কাঁপতে থাকে, ম্যাটের উপর টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়তে থাকে, তখনও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে যেতে থাকি। প্রাণপণে বশে রাখতে চেষ্টা করি মনকে। মনে হয়, লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। হবেই। ঠিক তেমনই দাঁতে দাঁতে চেপে বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে। হবেই। কাম হোয়াট মে!‌ মনখারাপের কাছে আর আত্মসমর্পণ নয়।

বাবা–মায়ের খাবার তৈরি করতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছি। খানিক নির্বুদ্ধিতা এবং খানিক পাকামির জন্য। হটপ্লেট থেকে খাবারসুদ্ধ পাত্রটা কায়দা করে নামাতে গিয়ে হাতলটা স্লিপ করল। সেটা মাটিতে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে আগুন–গরম পাত্রটাই খপাত করে ধরলাম। আর যায় কোথায়!‌ রাম চিৎকার দিয়েছিলাম। আশপাশের বাড়িও নিশ্চয়ই সচকিত হয়ে উঠেছিল। তবে ফোস্কা পড়তে দিইনি। দ্রুত জলে ধুয়ে টুথপেস্ট লাগিয়ে দিলাম। ছ্যাঁকা খেলে টুথপেস্ট আর কেটে গেলে চিনি— এই হল চালু এবং অব্যর্থ টোটকা। আজকেই শিখলাম।

দুপুর ৩.‌৩৩

অফিসে শুনলাম ঝড়ের দিন নাকি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতেও ঘন্টাচারেক কারেন্ট ছিল না। তারপর সিইএসসি–তে খবর যায়। মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও খবর যায়। দ্রুত বিদ্যুৎ ফেরানো হয়। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতেও দু’দিন আলো ছিল না। সেটা তিনি নবান্নে সেদিন বললেনও। অবাক লাগল যে, তারপরেও সিইএসসি ওঁর বাড়িতে একটা জেনারেটর দিয়ে বিকল্প কোনও ব্যবস্থা করল না?‌ হাজার হোক, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি তো!‌ একটা নিরাপত্তার অ্যাঙ্গলও তো আছে। অবশ্য বলা যায় না, উনি নিজেই হয়তো সেই বিশেষ সুবিধা নিতে রাজি হননি।

যতদূর জানি, একটা সময়ে সিইএসসি–র কাছে কলকাতা শহরের অন্তত ২৬০টি গুরুত্বপূর্ণ নামের তালিকা ছিল। তার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী–সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, টপ সরকারি অফিশিয়াল, হাসপাতাল, ডাক্তার, মিডিয়া প্রতিষ্ঠান এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকদের নাম ছিল। সেসব অবশ্য আর এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রসঙ্গত, সারা দেশের মধ্যে সিইএসসি–র ট্যারিফই নাকি সবচেয়ে বেশি!‌

আরও একটা বিষয় মনে হচ্ছিল। তাঁর পরিচালিত সংস্থা নিয়ে চারদিকে এত ক্রোধ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ। সঞ্জীব গোয়েঙ্কা একবার একটা প্রেস কনফারেন্স করে কিছু বলতে পারলেন না?‌ ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনও আলাপ বা ঘনিষ্ঠতা নেই। একবারের বেশি কথাও হয়নি। কিন্তু দূর থেকে দেখে যথেষ্ট সজ্জন বলেই মনে হয়েছে। খুবই আর্টিকুলেট এবং ভদ্র। মুখে একটা সংক্রামক হাসি লেগে থাকে সবসময়। কোনও অবস্থাতেই সেটা ওঁকে ছেড়ে যায় না।

‘এবেলা’–র অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের মঞ্চে ওঁর সঙ্গে মিনিট দশেকের একটা প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল আমার। শুরুতেই অভীকবাবুর শেখানো প্রশ্নটা করলাম, আপনি তো কলকাতা শহরের সবচেয়ে বড় মুদি?‌

পাঁচতারার ব্যাঙ্কোয়েটে একেবারে সামনের আসনে বসে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তার আশেপাশে রাজনীতিক, ফুটবলার, ক্রিকেটার এবং শহরের পেজ থ্রি সেলিব্রিটিরা। সকলে হাঁ!‌ বলে কী?‌ একটা ইয়ট আর একটা চাটার্ড প্লেনের মালিক নাকি শহরের সবচেয়ে বড় মুদি?‌ ফাংশনের শেষে ডিনারে এক বিখ্যাত গায়ক তো বলেই ফেললেন, ‘‌তুমি পারোও মাইরি!‌ সঞ্জীব গোয়েঙ্কাকে সটান মুদি বলে দিলে?‌’ তাঁকে বললাম, আরে, আমার তো আর ওঁকে ধরে গানের সিডি বার করার স্টেক নেই। অন্য কোনও দাক্ষিণ্যেরও দরকার নেই। অন্তত এখনও পর্যন্ত দরকার হয়নি। আর আমার যা যোগ্যতা, তাতে উনি আমায় ওঁর কোনও সংস্থার চাকরিতেও নেবেন না। কার যেন বাটপাড়ের ভয় থাকে না?‌

গায়ককে যেটা বলিনি, ওটা ছিল একেবারে অভীকবাবুর নিজস্ব স্ট্র্যাটেজি। যে, ব্যাটসম্যান উইকেটে আসামাত্রই গোলার মতো একটা বাউন্সার দাও। সেটা হয় সে মরিয়া হয়ে হুক করার চেষ্টা করবে বা মাথা সরিয়ে ‘ডাক’ করবে। যা–ই করুক, একটু ভেবলে থাকবে। তখন পরপর টকাটক বাকি ডেলিভারিগুলো করতে হবে। দু’ফুট দূরত্বে বসে বুঝতে পারছিলাম, সঞ্জীব মুদি সংক্রান্ত প্রশ্নটি শুনে একটু অবাকই হয়েছেন। ঠিক রিলেট করতে পারছেন না। কিন্তু টসকাচ্ছেনও না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। বললাম, আপনি মুদিই তো। কারণ, আপনি মুদিখানার মালিক। মানে গ্রসারি। মানে স্পেনসার্স।

এবার সঞ্জীব একটু রিল্যাক্সড হলেন। ঝকঝকে দাঁতের হাসিটা ফিরে এল। পরের প্রশ্ন গেল, আপনি কি শহরের সবচেয়ে বড় মুদিই হতে চেয়েছিলেন?‌

এমনিতেই সুপুরুষ। তার উপর সেদিন পিন স্ট্রাইপ্‌ড স্যুটে সঞ্জীবকে লাগছিলও একঘর। সংক্রামক হাসিটা মুখে ধরে রেখেই বললেন, ‘নাহ্‌, শহরের সবচেয়ে বড় মুদি হতে চাইনি। বরং শহরের ঘরে ঘরে আলো জ্বালাতে চেয়েছিলাম। সেটা পেরেছি ভেবেই খুব স্যাটিসফায়েড লাগে।’

অর্থাৎ, সিইএসসি। সেদিনই বুঝেছিলাম, কলকাতা এবং হাওড়ার কিছু অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী এই সংস্থা তাঁর কতটা কাছের। কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও তিনি একবার শহরবাসীর সামনে এসে তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করলেন না?‌ তার বদলে এগিয়ে দেওয়া হল এক মুখপাত্রকে?‌ সংস্থার জনসংযোগ দফতরের অন্যতম শীর্ষকর্তা সাহিত্যিক শংকরকেও তো কোনও বিবৃতি বা ওইধরনের কিছু দিতে দেখা গেল না। অথচ এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে শংকর চ্যাম্পিয়ন। তিনি একাধারে কর্পোরেট এবং কমনম্যান।

কিন্তু সবচেয়ে বেশি ইমপ্যাক্ট হতো সঞ্জীব নিজে কিছু বললে। এই শহরের সঙ্গে তাঁর তো একটা ফুটবল সংক্রান্ত গভীর এবং ঘন সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। যার পোশাকি নাম এটিকে–মোহনবাগান। তিনি তো সে অর্থে শহরের ফুটবলেরও কর্পোরেট মুখ। সেটা বাদ দিলেও তাঁর তো উচিত ছিল নিজের সংস্থার কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো। বহির্বিশ্বের সামনে তাঁদের প্রোটেক্ট করা। তারপর ঘরের মধ্যে না হয়ে ঝেড়ে কাপড় পরাতেন।

বিকেল ৪.‌৩০

সিইএসসি–র সঙ্গে যুদ্ধটা আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন ফিরহাদ হাকিম। তিনি এবার সটান ঘোষণা করলেন, ‘আমি আজ সিইএসসি–কে বলেছি, এনাফ ইজ এনাফ!‌ আপনারা লোকবল বাড়ান। আমরা সব গাছ কেটে ফেলেছি। এবার সেগুলো তুলে নিয়ে ফেলতে হবে। তার জন্য আমাদের খানিকটা সময় লাগছে। ২০০ লরি কাজ করছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ ফেরানোর সঙ্গে কলকাতা পুরসভার কোনও সম্পর্ক নেই।

সেনাবাহিনী তো কাজ করছেই। পাশাপাশি ওডিশা থেকেও ৩০টি টিম এসেছে কলকাতা শহরকে গাছ কেটে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে। প্রতিটি দলে ১০ জন করে সদস্য। তাঁরা ইলেকট্রিক করাত দিয়ে হু–হু করে গাছ কাটছেন। আশা করা যায়, আগামী দু’একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি আয়ত্তে আসবে। সিএইএসসি তো বলেইছে, মঙ্গলবার অর্থাৎ কালকের মধ্যে সর্বত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। হোপফুলি হবে। চারদিকের মানুষের এই কষ্ট আর ভোগান্তিটা গায়ে লাগছে।

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখতে রাজ্যে আসছে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদল। আজই ক্যাবিনেট সচিব রাজীব গৌবা বলেছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সমস্ত রকমের সাহায্য করা হবে।

সন্ধ্যা ৬.‌৫০

ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে গত কয়েকদিন ধরে করোনাভাইরাস সত্যিই পিছনের সারিতে গিয়ে বসেছিল। এই ডায়েরিতেও। আজ কোভিড–ঝাঁপি খুলে দেখছি, সারা দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৪,০০০ ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ১,৪৫,৮৩৮। গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৭,০০০ জন। মৃত্যু হয়েছে ১২৪ জনের।

পশ্চিমবঙ্গে গত ২৪ ঘন্টায় মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। সারা রাজ্যে কোভিডে মৃত এখনও পর্যন্ত ২০৬ জন। তাঁদের মধ্যে কো–মর্বিডিটিতে মৃত্যু হয়েছে ৭২ জনের। রাজ্যে কোভিডে আক্রান্ত এখনও পর্যন্ত ২,১২৪ জন। গত ২৪ ঘন্টায় করোনা–মুক্ত হয়েছেন ৭৫ জন।

রাত ৮.‌০৩

দক্ষিণের গড়ফা থানায় ভাঙচুর। থানায় কর্মরত একজনের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে, এমন খবর থেকেই ক্ষোভ এবং ভাঙচুরের সূত্রপাত। টিভি–তে দেখাচ্ছে, এলাকার মানুষ বলছেন, পুলিশকর্মীরাই নাকি ভাঙচুর চালিয়েছেন থানায়!‌ বিভাগীয় ডেপুটি কমিশনার তদন্তে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি তো দেখলাম স্পিকটি নট!‌

রাত ১০.‌২৮

প্রতিটা দিনই আসলে এক নতুন শিক্ষার দিন। ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কলের লাইনটা মনে রাখব—

দোজ হু হ্যাভ আ ‘হোয়াই’ টু লিভ
ক্যান বিয়ার উইথ অলমোস্ট এনি ‘হাউ’।

আমেন!‌

One thought on “লকডাউন ডায়েরি – ২৫ মে, ২০২০

  1. Well…
    So we have to find out the “why” with regular succession.
    আজ আবার পুরোনো ছন্দে ফিরে পেলাম ডাইরীকারকে।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s