
২১.০৫.২০২০। বৃহস্পতিবার
সকাল ৭.১৯
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কাল রাতে। কখন বাড়ি পৌঁছেছিলাম, তা–ও ঠিকঠাক মনে নেই। কতক্ষণ জেগেছিলাম, মনে নেই তা–ও। ঘুম ভেঙেই মনে হল, গাড়িটা ঠিক আছে তো? সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে ফিরে এল কয়েকঘন্টা আগের ছবিগুলো।
গাড়িটা নৌকার মতো দুলছিল। ভাসছিল। কাল রাত ১১টা। হাওয়ার ঝাপট একটু কমায় অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম। সহকর্মীদের অনেকেই বারণ করেছিল। অনির্বাণ মজুমদার, তারিক, শুভা’দা বলেছিল, ‘এখন বেরিও না। সমস্ত রাস্তায় জল। গাছ ভেঙে পড়েছে। আটকে যাবে।’ কিন্তু ভিতরের অবিমৃশ্যকারী, গোঁয়ার এবং অ্যাডভেঞ্চারাস আমি তাদের বলেছিল, ‘কাছেই তো। দশমিনিটে পৌঁছে যাব।’
অফিস থেকে বেরিয়ে ডাইনে গিয়ে সোজা রাস্তা ধরে উইপ্রোর ফ্লাইওভারের কাছে পৌঁছনো যায়। তারপর বাঁদিকে বেঁকে করুণাময়ীর পাশ দিয়ে সোজা রাস্তা। বাড়িটা প্রায় দেখতেই পাচ্ছিলাম। অফিসের সামনে দেদার জল জমেছে। সেটা কোনওমতে পেরোন গেল। কিন্তু খানিক এগিয়েই দেখলাম, আড়াআড়ি দুটো গাছ পড়ে উইপ্রো পর্যন্ত পৌঁছনোর রাস্তা বন্ধ। ইউ টার্ন। যে চৌমাথাটা খানিক আগে পেরিয়েছি, সেটা থেকে ডানদিকে ঘুরলাম। ওটাই টার্নিং পয়েন্ট। যাওয়া উচিত ছিল বাঁয়ে টেকনোপলিসের দিকে। আমি ঘুরলাম কলেজ মোড় অভিমুখে।
মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। সামনের রাস্তায় প্রচুর জল। সেটা ঠেলে ঠেলে যাচ্ছিলাম। কোথাও খানাখন্দ আছে কিনা, কে জানে! কয়েকবার নীচে কিছু ঠোক্করও খেল। তখনই খেয়াল করলাম, গাড়ি থেকে একটা বিজাতীয় আওয়াজ বেরোচ্ছে। একটা মোড় ক্রস করে কলেজ মোড়ের কাছে পৌঁছনোর আগে মাঝরাস্তায় বন্ধই হয়ে গেল মারুতি সুজুকি ব্যালেনো। দু’বার সেল্ফ মারলাম। কোনও সাড়া এল না। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভাল করে নজর চলছে না। খানিকটা দূরে মোড়ের ট্র্যাফিক সিগনালটা নিজের মতো সবুজ, হলুদ আর লাল হয়ে চলেছে। তার পাশের সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলোয় দেখতে পাচ্ছি, তুমুল হাওয়া বৃষ্টির ঝরোখাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দিগ্বিদিকে। এটাই কি আমপানের লেজ? যাওয়ার আগে শেষ ঝাপ্টাটা মেরে যাচ্ছে?
গাড়ির সব কাচ তুলে বসেছিলাম ভোম্বলের মতো। দরজা খুললেই ভিতরে হুড়হুড় করে জল ঢুকবে। নিজের গালে সপাটে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করছিল। কেন বেরোলাম ইডিয়টের মতো!
পাশের রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যে কিছু উঁচু গাড়ি যাচ্ছিল। তার চাকার ধাক্কায় জলের তোড় আর ঢেউ এসে আমার গাড়িটাকে ঠেলে নিয়ে চলে যাচ্ছিল এলোমেলো। একবার মনে হচ্ছিল গাড়িটা ভাসতে ভাসতে গিয়ে রাস্তার পাশের রেলিংয়ে ধাক্কা মারবে। আবার কিছুক্ষণ পর দেখছিলাম চলে এসেছি রাস্তার মাঝখানে। এইসব আধুনিক গাড়ি চলে ইলেকট্রিকে। স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্টিয়ারিং শক্ত হয়ে গেছে। হ্যান্ডব্রেকও কাজ করছে না। ভয় করছিল। মাথা কাজ করছিল না। এতটাই ভেবলে গিয়েছিলাম যে, হ্যাজার্ড লাইটটাও জ্বালাতে ভুলে গিয়েছিলাম।
বিপ্লবকে ‘অফিশিয়াল মা’ বলে থাকি। ওকে অবিরাম ফোন করার চেষ্টা করছিলাম। ডায়াল করামাত্র কেটে যাচ্ছিল। লাইন লাগছিল না। অবশেষে অনির্বাণকে ফোনে পেলাম। ওর মারফত বিপ্লবকে ধরে বললাম অফিস থেকে একটা গাড়ি পাঠাতে। এই জলের মধ্যে কতক্ষণ বসে থাকব? গাড়ি থেকে নেমেই বা অন্ধকারে কতদূর যাব? জলের তোড়ে গাড়িসুদ্ধ ভেসে গেলে কোথায় গিয়ে ঠেকব? কেউ উদ্ধার করে না নিয়ে গেলে তো সমূহ বিপদ!
ফোনে কথা বলতে বলতেই পিছন থেকে একটা জোরাল আলো পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম একটা বিশাল ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে। তার কোমরজলেও সমস্যা নেই। কিন্তু রাস্তার একেবারে মাঝখানে আমার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকায় এগোতে পারছে না। ঝটপট ট্রাক থেকে দু’জন খালাসি নামলেন। তাঁরাই খানিক ধাক্কা মেরে, খানিক ভাসিয়ে আমার গাড়িটা রাস্তার একপাশে নিয়ে গেলেন। ট্রাক চলে গেল। বিশাল বিশাল টায়ারের ধাক্কায় আবার ঢেউ উঠল। সেই ঢেউয়ের তোড়ে আবার আমার গাড়ি দুলতে দুলতে গভীরতর জলের দিকে খানিক এগোল।
কিছুক্ষণ পর অফিস থেকে অ্যাম্বাসেডর নিয়ে এলেন বহু যুদ্ধের সেনানী তপন’দা। ততক্ষণে ঠিক করে ফেলেছি, গাড়ি রাতের মতো ওখানেই রেখে যেতে হবে। যা হয় হবে। ভেসে কোথাও চলে গেলেও বা কতদূর যাবে! ঝপ করে দরজা যথাসম্ভব কম ফাঁক করে নেমে গাড়ি লক্ করে অফিসের গাড়িতে উঠলাম। অভিজ্ঞ তপন’দা ব্যাকগিয়ারে আস্তে আস্তে করে পিছনে গেলেন। তারপর সম্পূর্ণ ঘুরপথে বেরিয়ে পিছন দিক দিয়ে গিয়ে আবার অফিসে ঢুকলাম। সে যাত্রাও অবশ্য বিপদসঙ্কুল। কারণ ততক্ষণে দেখছি, রাস্তায় জীবন্ত বিদ্যুৎবাহী তার–সহ ল্যাম্পপোস্ট উপড়ে এসে পড়েছে। তার মধ্যেই কাটিয়ে বেরোলেন তপন’দা।
কপাল ঠুকে ফোন করলাম জ্ঞানবন্ত সিংকে। রাজ্যপুলিশের আই জি (আইনশৃঙ্খলা) জ্ঞানবন্ত তখন নবান্নের কন্ট্রোলরুমে। বলল, ‘এখনই আপনার নম্বর সল্টলেকের পুলিশ কমিশনারকে দিচ্ছি। উনি আপনাকে ফোন করবেন।’
অফিসে পৌঁছনোর পর থেকেই একের পর এক অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসতে শুরু করল। সল্টলেকের ডিসি (ট্র্যাফিক) ধৃতিমান, ট্র্যাফিক ইন্সপেক্টর অনিল কুমার মণ্ডল, ইলেকট্রনিক কমপ্লেক্স থানার ওসি বজলুর রহমান, সাব ইন্সপেক্টর সুদীপ নস্কর। প্রত্যেকেরই এক প্রশ্ন: কী সাহায্য লাগবে বলুন?
তার মধ্যেই মারুতির ‘রোড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্স’–এ ফোন করে সমস্যা নথিভুক্ত করেছি। কারণ, আমার ইনসিওরেন্সে সেই প্রভিশন আছে। কলসেন্টারের কর্মী খুব আশাব্যঞ্জক গলায় বলেছেন, ‘আমাদের লোক পৌঁছে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তার আগে আপনাকে ফোন করবে। আপনি গাড়ির কাছে চলে যাবেন।’ শুনে অত সমস্যার মধ্যেও হাসি পাচ্ছিল। বিপণনের জন্য কতকিছুই যে বলতে হয়! কত অসত্য আশ্বাস যে দিতে হয়! অবশ্য, গুরগাঁওয়ের কলসেন্টারে বসা কর্মী গুগ্ল ম্যাপ দেখে কী করেই বা বুঝবেন, সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের কোন এলাকাটা নদী হয়ে গিয়েছে।
খানিক পরে বজলুর ফোন করে বললেন, ‘আমি লোক পাঠিয়ে দেখে নিচ্ছি। গাড়িটা কি ঠেলে আপনার অফিস পর্যন্ত দিয়ে আসবে ওরা? রেকারও পাঠানো যেতে পারে। কিন্তু তাতে গাড়ি ড্যামেজ হবে।’ ওঁকে বললাম, অত জল ঠেলে গাড়ি বার করা সম্ভব হবে না। ওটা পণ্ডশ্রম হবে। তার চেয়ে গাড়িটা ওখানেই থাকুক। যাতে নিরাপদে থাকে, সেটা দেখলেই হবে। উনি বললেন, আমি অনুমতি দিলে গাড়ির চাকায় কাঁটা লাগিয়ে দেবেন। যাতে কেউ ঠেলে না নিয়ে যেতে পারে। বললাম, চারটে চাকাই জলে ডুবে। কাঁটাও লাগানো যাবে না।
কিছু পরে বজলুর আবার ফোন করলেন, ‘নিশ্চিন্তে থাকুন। গাড়ি ওখানে যেমন আছে তেমনই থাকুক। আমাদের নাইট পেট্রোল পার্টি গিয়ে রাউন্ড মেরে আসবে। কাল সকালে জল নেমে গেলে থানায় চলে আসুন। আপনার গাড়ি ঠিকমতো উদ্ধার করে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। আর যত রাতেই বাড়ি ফিরুন, আমাকে একটা ফোন করবেন।’
অফিস থেকে বাড়ির দূরত্ব পেরোলাম একঘন্টায়। প্রায় সমস্ত রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়েছে। ল্যাম্পপোস্ট, সিগনাল পোস্ট উপড়ে চলে এসেছে। মাটিতে পড়ে থাকা সিগন্যালে লাল–সবুজ আলো জ্বলছে–নিভছে। ভৌতিক লাগছিল। বাড়ি পৌঁছে বজলুরকে ফোন করলাম। একটা রিংয়েই ফোন ধরে বললেন, ‘আমার লোক গিয়ে দেখে এসেছে। গাড়ি ঠিকঠাক আছে। কাল সকালে আপনি থানায় চলে আসুন।’
সকাল ৯.৪৫
টিভি চলছে না। নেট ডাউন। হোয়াট্সঅ্যাপ আসছে–যাচ্ছে না। ফোন লাগছে না। ফোন এলেও কথা বলা যাচ্ছে না। আচমকাই ‘টুং’ করে একটা টেক্সট মেসেজ ঢুকল। মারুতি রোড অ্যাসিস্ট্যান্সের তরফে কে একটা ভুলভাল ইংরেজিতে প্রভূত দুঃখপ্রকাশ করে জানাচ্ছে, রাতে তারা আমার গাড়ির ধারেপাশে পৌঁছতেই পারেনি। আজ বললে রেকার দিয়ে গাড়ি টেনে ওয়ার্কশপে পৌঁছে দিতে পারে। বাহ্!
দুপুর ১২.৩৫
এইমাত্র গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছেছিলাম থানায়। তার আগেই অনিলবাবু ফোন করে জানিয়েছিলেন, জল নেমে গিয়েছে। গাড়িও ঠিকঠাক আছে। ওঁর লোক গিয়ে দেখে এসেছে। গৌরব বলে এক হোমগার্ডকে তৈরি রেখেছিলেন বজলুর। তিনি রয়্যাল এনফিল্ডে চাপিয়ে নিয়ে গেলেন গাড়ির কাছে। দেখলাম, শুকনো রাস্তায় গাড়িটা একলা দাঁড়িয়ে আছে। যেমন রেখে গিয়েছিলাম কাল রাতে। শুধু সেই নিকষ, থমথমে অন্ধকার আর ভয়াবহ বৃষ্টিটা নেই।
গৌরব বললেন, ‘বেশিবার সেল্ফ মারেননি তো? অনেকবার সেল্ফ মারলে ইঞ্জিন জল টেনে নেয় কিন্তু।’ কাঁপতে কাঁপতে বললাম, যতদূর মনে পড়ছে, দু’বার সেল্ফ মেরেছিলাম। তার বেশি নয়। আমাকে গাড়ির কাছে রেখে নয়াপট্টির ওয়ার্কশপ থেকে গৌরব তুলে আনলেন মোটর মেকানিক প্রমোদকে। দেখা গেল, সাইলেন্সার পাইপ দিয়ে জল ঢুকে গাড়ির প্রায় ইঞ্জিন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ব্যাটারিও বসে গেছে।
সম্ভবত সেটা অনুমান করেই প্রমোদ সঙ্গে সদ্য চার্জ–দেওয়া ব্যাটারি নিয়ে এসেছিল। প্রায় দেড়ঘন্টার কসরতে গাড়ি আবার স্টার্ট হল। অ্যাক্সিলারেটর রেস করে যেতে হল ক্রমাগত। সাইলেন্সার থেকে ঝরঝর করে জল বেরোতে লাগল। প্রমোদকে বললাম, কত দেব? রোগা, কালো এবং আনইম্প্রেসিভ চেহারার যুবক বলল, ‘টাকা পরে হবে। আগে কাজটা হোক।’
চালিয়ে দেখা গেল, গাড়ির ব্রেক খানিক কম ধরছে। প্রমোদ অভয় দিল, ‘ওটা কোনও ব্যাপার না। চালাতে চালাতে ঠিক হয়ে যাবে। ব্যাটারিও চার্জ নিয়ে নেবে।’ ঠিকই। কিছুক্ষণ চালানোর পর দেখা গেল, গাড়ি একেবারে আগের মতোই চাঙ্গা! গৌরবের মোটরবাইকে ওঠার আগে প্রমোদ বলল, ‘আমার নম্বরটা রেখে দিন। আপনার নম্বরটাও দিন। যে কোনও সময় যে কোনও প্রবলেমে ফোন করে বলবেন। ওয়ার্কশপে নিয়ে গেলে ওরা কয়েকদিন গাড়ি রেখে তারপর অনেক টাকা নিয়ে নেবে। আপনি জানতেও পারবেন না কী কাজ হয়েছে। তার চেয়ে আমাদের বলবেন। হয়তো লেবার চার্জটা ৫০ টাকা বেশি নেব। কিন্তু আপনার চোখের সামনে কাজটা করব।’ আর যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘একটাই বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। বেশিবার সেল্ফ মারেননি। তাহলে আর এখানে সারাতে পারতাম না।’
গাড়ি–সহ গেলাম বজলুরের সঙ্গে দেখা করে ধন্যবাদ দিতে। দেখলাম, মুখে মাস্ক–পরা ৪৬ বছরের পুলিশ অফিসার অধস্তনকে নির্দেশ দিচ্ছেন বিধাননগরের পুরভবন থেকে তাঁর এলাকার ফুটপাথবাসীদের জন্য ত্রিপল নিয়ে আসতে। বলছেন, ‘ফোনে হবে না। আপনি চলে যান। মানুষের দরকার। এটা করতেই হবে।’
ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে এত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিপর্যয় কভার করেছি। কিন্তু কখনও এত ট্রমাটাইজ্ড হইনি। কাল রাতে হয়েছিলাম। কারণ, একটা তফাত ছিল। ভূমিকম্প হোক বা সুনামি অথবা সিডার— গিয়ে পৌঁছেছিলাম ঘটনার পর। আর কাল রাতে নিজে সেই ঘটনার মধ্যে ছিলাম। দু’হাত দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না বৃষ্টির তাড়সে। জনমানবহীন রাস্তায় একেকটা ঢেউ এসে ধাক্কা মারছে বন্ধ গাড়ির গায়ে আর তার তোড়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ভেসে ভেসে চলেছি— এই অভিজ্ঞতা সড়কপথে আগে কখনও হয়নি। মনে হচ্ছিল, একটা কফিনের মধ্যে আটকে পড়েছি। আর সেটা কেউ ঠেলে ভাসিয়ে দিয়েছে অকূল পাথারে।
দম বন্ধ করে বসে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল, কেন যে ফোর্ড ইকোস্পোর্টটা বিক্রি করে দিলাম! ওটা উঁচু গাড়ি ছিল। ঠিক জল ঠেলে চলে যেতে পারত।
দুপুর ৩.০৫
ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর উঠে গাড়িটা নিয়েই অফিসে এসেছি। এবং এসে দেখছি, ভয়াবহ সব ছবি চারদিকে। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে আমপান। প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, সারা রাজ্যে ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে কলকাতাতেই মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা থেকে যে সমস্ত ছবি আসছে, সেগুলো মর্মন্তুদ। মানুষের অসহায়তা, বিপন্নতা আর প্রকৃতির তাণ্ডবে ধ্বংসের এই ছবি আগে দেখিনি। সম্ভবত গোটা পশ্চিমবঙ্গই দেখেনি। উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা কার্যত ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর বিপর্যস্ত। সুন্দরবন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। লক্ষ লক্ষ একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।
ভেসে গিয়েছে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া। একের পর এক গাছ ভেঙে পড়েছে রাস্তায় পার্ক করা গাড়ির উপর। বিশাল মহীরূহ ভেঙে পড়ে দু–ফালা করে দিয়েছে আস্ত মিনিবাস। এই কলকাতাকে আমি চিনি না। কলকাতার এই ছবি দেখব বলে কোনওদিন ভাবিনি। দমদম এয়ারপোর্টে হ্যাঙারে দাঁড়িয়ে–থাকা প্লেন জলে ভাসছে। রানওয়েটাকে আস্ত সমুদ্র মনে হচ্ছে।
কিছুক্ষণের জন্য নেটওয়ার্ক ফিরেছিল। সোশ্যাল মিডিয়া ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। কারণ, অধিকাংশ ন্যাশনাল মিডিয়া পশ্চিমবঙ্গে এই প্রাকৃতিক তাণ্ডবের কোনও কভারেজই সেভাবে করেনি। ঠিকই। যতদূর দেখছি, তারা এমন একটা ভাব করছে, যেন বাংলায় কিছু ঘটেইনি। যেখানে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আমপানে বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গ আর ওডিশা নিয়ে একাধিক স্টোরি করেছে। মনে মনে স্যালুট করছিলাম এ রাজ্যের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সহকর্মীকে। যেভাবে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ওরা কভারেজ করেছে, কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট হতে পারে না। সুযোগ পেলেই রিজিওনাল মিডিয়াকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা ন্যাশনাল মিডিয়ার বাগাড়ম্বরবাজরা কিছু শিখবে কি?
প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী–সহ কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী সকাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে একটি টুইটও করেননি। উল্টে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল বলেছেন, আমপানে নাকি ‘ন্যূনতম’ ক্ষতি হয়েছে! এই লোকটা কিন্তু, যাকে বলে, চরম!
বিকেল ৪.১০
একটু আগে রোদ উঠেছিল। দেখে আবার প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার কথা মনে পড়ল। ঠিক ২৪ ঘন্টা আগে এটা ভাবা যেত?
এডিট মিটিংয়ে অশোক’দা বললেন, এই ধরনের দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে রাতে কর্মীদের অফিসে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে ইমিডিয়েটলি। আমার গাড়ি আটকে যাওয়ার খবর শুনে কাল রাতেও খোঁজ নিয়েছিলেন। আজ পুরো ঘটনাটা বিস্তারিত শুনলেন। এবং নির্দেশ দিলেন, ‘তুমি লেখো। আজই লেখো। পার্সোনাল টাচ দিয়ে।’
বিকেল ৪.৪০
ওহ্, অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে টুইট করেছেন প্রধানমন্ত্রী। লিখেছেন, ‘এই বিপর্যয়ে গোটা দেশ পশ্চিমবঙ্গের পাশে আছে।’ বঙ্গবাসী কি আনন্দে লেজ নাড়াবেন? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করেছেন। আহা, কী আনন্দ আমপানের আকাশে–বাতাসে!
নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘বাংলা অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। এটাও নেবে। আমরা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ শুরু করব। আকাশ পরিষ্কার থাকলে পরশু আমি উত্তর আর দক্ষিণ ২৪ পরগনাটা সার্ভে করে দেখব।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোনের প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে বলছেন, ‘ওঁরা কাল কিছু করেননি। তবে আজ ফোন করেছিলেন। আমি বলেছি, আপনাদের সাহায্য করা উচিত। আশা করি, ওঁরা সাহায্য করবেন। আমরা আমাদের সামর্থ্য থেকে ১,০০০ কোটি টাকার ফান্ড তৈরি করেছি। সেটা থেকেই প্রাথমিক কাজকর্মগুলো শুরু করা হচ্ছে।’
বিকেল ৫.০০
রাজ্যপাল ঢোক গিলেছেন। ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে আবার টুইট করে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিনি সমস্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে অবিলম্বে ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বাহ্–বাহ্।
জানতে কৌতূহল হচ্ছে, কার ঝাড় খেয়ে লোকটা এই পাল্টিটা খেল।
বিকেল ৫.৩১
ঘন্টাখানেক আগে রোদ্দুর উঠেছিল। এই দেখলাম, রোদ্দূর রায় উঠেছেন। হোয়াট্সঅ্যাপ পাঠিয়ে জানতে চেয়েছেন, ‘আর ইউ অলরাইট স্যর?’
লিখলাম, ‘সামহাউ সারভাইভ্ড।’
আনন্দবাজারের প্রাক্তন সহকর্মী দেবদূত’দাও হোয়াট্সঅ্যাপ করে জানতে চেয়েছে ভাল আছি কিনা। জানালাম, ‘ঠিক আছি। তোমরাও ভাল থেকো।’ দেবদূত’দা বরাবরই এইরকম। আমি বলতাম, তুমি হলে আনন্দবাজার সেবাদলের চিফ। ফলে এই দুর্যোগের পর ওর মেসেজটা অপ্রত্যাশিত নয়। ভাল লাগল।
সন্ধ্যা ৭.১০
ভোডাফোন মৃত। লং লিভ এয়ারটেল। সেই দুপুর থেকে ভোডাফোন সিগনালের পাশে ‘ফোর জি’ দেখাচ্ছে বটে। কিন্তু কোনও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক নেই। নেই তো নেই–ই! এমনকী, ফোনও করা যাচ্ছে না। ঘটনাচক্রে, আজই আবার মাসিক বিল ইমেল করেছে ভোডাফোন। মনে হচ্ছিল, হেল্পলাইনে ফোন করে তেড়ে গাল দিই! প্রত্যেক মাসে বিল পাঠাতে তো কোনও ভুল হয় না! পরিষেবাটা এমন কুৎসিত কেন? বিশেষত, এই সঙ্কটের সময়?
কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম। এবার প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম, লকডাউন উঠলেই মোবাইল পোর্টেবিলিটি ব্যবহার করে ভোডাফোন ছেড়ে এয়ারটেলে মুভ করে যাব। ‘আপনি যেখানে, আমাদের নেটওয়ার্কও সেখানে’— ভোডাফোনের এই ট্যাগলাইন অস্তমিত দেখেই বোধহয় তাদের পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞাপনের সেই মিষ্টি পাগ কুকুরটাও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। আমি তো নিছকই গ্রাহক। বহুবছর ধরে এই নম্বর বহন করছি ভোডাফোনের আশ্রয়ে। বাট এভরি রিলেশনশিপ কাম্স উইথ অ্যান এক্সপায়ারি ডেট।
রাত ৮.০০
টিভি বলছে, শুধু কলকাতা শহরেই ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৫,০০০ গাছ পড়েছে। সেই গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে শহরের একটা বড় অংশ নিষ্প্রদীপ। বিদ্যুৎ না–থাকায় পানীয় জলও অকুলান। কাল রাতে সল্টলেকে যা দেখেছি, তাতে মনে হয়, অন্তত ২,০০০ গাছ পড়েছে এই সাজানো উপনগরীতে। রাস্তার পর রাস্তা গাছ পড়ে বন্ধ। এবং সেই গাছ তার সঙ্গেই উপড়ে নিয়ে এসেছে তারের জাল–সহ ল্যাম্পপোস্ট। বিভিন্ন পার্কের পাঁচিল ভেঙেছে গাছ পড়ে। গাছের সবুজ ঝরাপাতা রাস্তায় বিছিয়ে আছে কার্পেটের মতো। তার সঙ্গে ছড়িয়ে আছে গাছের ছোটবড় ডাল। দেখতে ভাল। চলতে নয়।
অনেকের মতো আমিও অতীতে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে যথেষ্ট ফাতরামি করেছি। বরাবর কলকাতার বাসিন্দা হিসেবে নিজেকে প্রিভিলেজ্ড ভেবে এসেছি এবং নিজেকে বলেছি, ঘূর্ণিঝড় তো বরাবর সুন্দরবন হয়ে বাংলাদেশে চলে যায়। এবারও নিশ্চয়ই তেমনই হবে। এই প্রথম কলকাতাবাসী বুঝল, বিপর্যয় কাকে বলে! বুঝল, গত দু’মাস লকডাউনে থাকার চেয়েও বেশি দুর্দশায় পড়তে হতে পারে। যেখানে বাড়িতে বন্দি থাকা আছে। কিন্তু আলো নেই। জল নেই। কোথাও কোথাও ইন্টারনেট সংযোগও নেই।
পাশাপাশিই মনে হচ্ছে, পরোক্ষে হলেও লকডাউন খানিকটা সাহায্য করল জীবনহানি কমাতে। লকডাউন না হলে কাল দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত রাস্তায় থাকতেন যথেষ্ট পরিমাণ মানুষ। চলত যানবাহন। সেই গাড়িঘোড়ার কী হতো! কী হতো তাতে সওয়ার জনতার?
রাত ৮.৪৫
কাল রাজ্যে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। আকাশপথে ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখবেন। সঙ্গে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রীও। দুর্গত এলাকা পরিদর্শনের পর বসিরহাটে প্রশাসনিক বৈঠক হওয়ার কথা। তবে সবকিছুই নির্ভর করবে আকাশের অবস্থার উপর। আশা করা যায়, মওকা বুঝে রাজ্যপালটি তাঁদের গায়ে সেঁটে থাকবে না।
আজ দুপুরেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তিনি চান প্রধানমন্ত্রী নিজের চোখে এসে পরিস্থিতি দেখে যান। সেই আহ্বানেই সাড়া দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এখন দেখা যাক, তিনি এই ঘটনাকে ‘জাতীয় বিপর্যয়’ ঘোষণা করেন কিনা বা কোনও বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেন কিনা।
রাত ১০.৪৫
অফিস বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, আজ কেমন সুস্থ–সুন্দর আকাশ। বৃষ্টি নেই। মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে। গাড়ি চলছে ফনফন করে। অথচ ঠিক ২৪ ঘন্টা আগে এই সময়টায় একটা ভাসমান কফিনে বসেছিলাম। চারদিকে নিকষ অন্ধকার। ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে, পিছনে জলের ঢেউ। অসহায় লাগছিল। ভয় করছিল।
ভয় মানুষের মনে বোধিজ্ঞানের জন্ম দেয়। আজ যখন ফিরতে ফিরতে প্রসেস করছিলাম ২৪ ঘন্টা আগের সময়টা, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল! মনে হচ্ছিল, নৈর্ব্যক্তিক পেশাদার হিসেবে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে নোট নেওয়া আর সেই ঘটনার অংশ হয়ে যাওয়ার মধ্যে কত ফারাক!
প্রথমটা অমোহগ্রস্তভাবে জীবনের চলমানতার কথা বলতে চায়। দ্বিতীয়টা জীবনের মোহকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে শেখায়।
পশুপাখি গুলোও বাসা হারা, সন্তান হারা।
আবার ওরা লড়বে, গড়বে
জীবন থামে না যে।
LikeLike