লকডাউন ডায়েরি – ২০ মে, ২০২০

২০.‌০৫.‌২০২০। বুধবার

সকাল ৬.‌৫৪

আমপানের আগমনী বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। ঘুম ভেঙে সেটাই প্রথম চোখে পড়ল। বাইরে চারদিকে এক সোঁদা সকাল। এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে। কখনও বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। কখনও কমছে। গাছেরা মাথা দোলাচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে এবং ঘন্টায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে হাওয়া না দিলে এ একেবারে পারফেক্ট রোমান্টিক সকাল। গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করে লং ড্রাইভে যাওয়ার পক্ষে আদর্শ।

পেশাদার সাংবাদিক এইসময় ফট করে টিভিটা চালাবে এবং দেখে নিতে চাইবে কোথায় কী হচ্ছে। নিজেকে আপডেটেড রাখবে। এখানে–ওখানে ফোন ঘোরাবে।

আর মানসিকভাবে বিবাগী মানুষ এককাপ কালো কফি বানাবে। তারপর বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে দিয়ে বাইরের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকবে। তাকিয়েই থাকবে।

আজ সারাদিন টিভি না দেখলে কেমন হয়?‌

সকাল ৯.‌৪৮

এখনও টিভি চালাইনি। এবং সেটা ভেবে নিজেরই অবাক লাগছে। সকাল থেকে একের পর এক গান শুনছি। বাইরে একটা মাতলা হাওয়া দিচ্ছে। প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে চারদিক। আশপাশের গাছগুলোর মাথা দুলছে অবিরত।

বেশ কয়েকবছর আগের কথা মনে পড়ছে। সম্ভবত এমনই এক দুর্যোগের সকালে তাজপুর থেকে গাড়ি চালিয়ে কলকাতা ফিরছিলাম। ছোট্ট একটা মারুতি এ–স্টার গাড়ি। স্পোর্টস কারের মতো দেখতে। কিন্তু ফঙ্গবেনে। সেদিনও এইরকম ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছিল। তাজপুর থেকে বেরিয়ে দিঘা–কাঁথি রাস্তার উপর পড়ার আগে অনেকটা রাস্তা একটা বাঁধের উপর দিয়ে আসতে হয়। দু’পাশ থেকে মাটি ফেলে উঁচু করা। মাঝখানের রাস্তাটা পিচের। যখন আসছিলাম সেই বাঁধের উপর দিয়ে, হাওয়ার দাপটে মনে হচ্ছিল গাড়িটা রাস্তার উপর চলতে চলতেই আড়াআড়ি সরে যাচ্ছে পাশের দিকে। আরেকটু ঠেলা মারলেই গড়িয়ে নীচের জলে পড়বে।

বেগতিক দেখে চারটে জানালারই কাচ নামিয়ে দিলাম। তাতে ক্রস ভেন্টিলেশন হয়ে গাড়িটা থিতু হল। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে বাঁধ থেকে নেমে ডানদিকে বাঁক নিয়ে কলকাতার রাস্তা ধরলাম। একেবারে ফাঁকা রাস্তা। হয়তো এমনই কোনও সাইক্লোনের কারণে বাড়ি থেকে গাড়িঘোড়া এবং লোকজনের বেরোন নিষেধ ছিল।

স্পিডোমিটারের কাঁটা ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটারে। খোলা জানালা দিয়ে চোখেমুখে বৃষ্টির ছিটে এসে লাগছে। গাড়ির ড্যাশবোর্ডের সিডি প্লেয়ারে হাস্কি গলায় কেনি রজার্সের কান্ট্রি সং। হাওয়ার কলরোল।

কিছু কিছু জার্নি জীবনে ফ্রিজ ফ্রেম হয়ে থেকে যায়।

দুপুর ১.‌০৪

বৃষ্টির তোড় বাড়ল। অবশেষে এবার কি আমপানের আগমন ঘটছে?‌ টিভি অবশ্য বলছে, এখনও পারাদীপের ১২৮ কিলোমিটার দূরে আছে ঘূর্ণিঝড়। ইতিমধ্যেই কিছু জায়গায় গাছ পড়েছে। দিঘার সমুদ্রে প্রবল জলোচ্ছ্বাস। দক্ষিণ ২৪ পরগনার নদীতটবর্তী এলাকায় বাড়িঘরের টিনের শেড উড়ে যাচ্ছে। কলকাতা বিমানবন্দর আগামিকাল সকাল পর্যন্ত বন্ধ রাখা হচ্ছে। ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে শহরের সমস্ত উড়ালপুলে ওঠার রাস্তা।

এই প্রবল দুর্যোগে অডিও ভিস্যুয়্যালের সহকর্মীরা হাওয়ায় টাল খেতে খেতে প্রায় পড়ে গিয়েও বুম ধরে পি–টু–সি দিয়ে যাচ্ছেন। হ্যাট্‌স অফ!‌

দুপুর ১.‌২৬

কাল রাতে নাকি পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভ দেখিয়েছেন কমব্যাট ফোর্স আর র‌্যাফের কর্মীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ডিসি (‌কমব্যাট ফোর্স)‌ ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তাঁকেও নাকি প্রবল বিক্ষোভ এবং হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছে। রাতেই বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা। তারপর আজ নবান্ন যাওয়ার পথে সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং।

মুখ্যমন্ত্রীর ফেসবুক পেজে দেখছি, জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি কথা বলছএন বিক্ষোভকারী পুলিশকর্মীদের সঙ্গে। প্রথমে সকলেই হইহই করে কথা বলতে গিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের বললেন, ‘আপনারা ডিসিপ্লিন্‌ড ফোর্সের লোক। সকলে একসঙ্গে কথা বলবেন না। কোনও একজন বলুন।’ তখন একজন এগিয়ে গিয়ে দাবিদাওয়া এবং ক্ষোভের কথা বললেন। যা বুঝলাম, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, আমপান এবং করোনা–পরিস্থিতি কেটে গেলে বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেওযা হবে।

দুপুর ২.‌৩০

এটাই আমপানের ল্যান্ডফলের সময়। এখন শুরু হলে পুরো প্রক্রিয়াটা চলবে সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা। ফলে কলকাতায় ঘূর্ণিঝড় এসে পৌঁছবে বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে। যখনই হোক, বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। টিভি–তে দেখছি, নামখানা বা কাকদ্বীপের মতো এলাকায় অলরেডি হাওয়ার গতিবেগ তীব্রতর হয়েছে। ভেঙে পড়ছে গাছপালা আর কাঁচাবাড়ি।

টিভি–তে দেখছি মানুষজন একে অপরকে জাপ্টে ধরে রেখেছেন। যাতে হাওয়ায় কাউকে উড়িয়ে না–নিয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্বের কী হবে, সে প্রশ্ন তোলা বাতুলতা। বস্তুত, আজকের জন্য করোনা ভাইরাস এ রাজ্যে হরিজন। কেউ তাকিয়েও দেখছে না। ছোঁয়া তো অনেক দূরের কথা!‌

রসিক বাঙালি এরমধ্যেও ফেসবুকে লিখছে, ‘কোভিড–আক্রান্ত কেউ ঝড়ের যাত্রাপথের দিকে মুখ করে হাঁচি দিলে সেটা যে ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটার বেগে ছড়িয়ে পড়বে, সেটা ভেবে দেখেছেন কি?‌’ অথবা, ‘সাইক্লোন ঢুকছে নিচ দিয়ে (‌ম্যাপের)‌। ইকনমি পিছন দিয়ে। নাম–মুখ দিয়ে করোনা। কান দিয়ে নানারকম সতর্কবার্তা। শরীরের ফুটো থাকা যে কত যন্ত্রণা!‌’

আজকের ‘লকডাউন ডায়েরি’র নাম বদলে কি ‘আমপান ডায়েরি’ রাখা উচিত?‌

দুপুর ২.‌৫৪

নবান্নের কন্ট্রোলরুমে মুখ্যমন্ত্রী। মুখে মাস্ক। সামনের বিশাল টিভি স্ক্রিনে ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাঁর ডানদিকে কয়েকটা চেয়ার পরে বসে আছেন মুখ্যসচিব রাজীব সিন্‌হা। রাজ্য প্রশাসনের তাবড় অফিসাররাও রয়েছেন। সকলে বাধ্য ছাত্রের মতো চেয়ারে বসে সামনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর ফাঁকেই সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ মাস্কটা একবার নামিয়ে একটু নাক চুলকে নিলেন।

মুখ্যমন্ত্রী টুকটাক কথা বলছেন। তার দু’টি নমুনা—
১.‌ ‘বছরে চারবার যদি এমন হয়, তাহলে এই রাজ্যটার আর কী থাকে! কোথায় সামলাবে?‌‌’
২.‌ ‘আসলে বে অফ বেঙ্গলটা খুব ভালনারেব্‌ল এরিয়া।’

পাশাপাশিই দেখা যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে নির্দেশ দিচ্ছেন, রাস্তায় যেসব গাছ ভেঙে পড়েছে, এখনই তা কাটতে যাওয়ার দরকার নেই। কারণ, ঝড়ের গতিবেগ আরও বাড়ছে। বহু এলাকায় বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, ঝড়ে বিদ্যুৎবাহী তার ছিঁড়ে রাস্তায় পড়লে অসাবধানে কেউ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হতে পারে।

সাংবাদিকরাও আছেন নবান্নের কন্ট্রোলরুমে। রাতেও থাকবেন তাঁরা। যেমন পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে নবান্নে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী। সহকর্মীদের একাংশের কাছে শুনলাম, সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা আজ রাতে নবান্নে থাকবেন, তাঁদের দু’টি করে মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজার এবং সার্জিক্যাল টুপি (‌গত্যন্তরে এমনি ক্যাপ হলেও চলবে)‌ নিয়ে যেতে হবে।

দুপুর ৩.‌২৩

অফিসে নিরুপদ্রবেই এলাম। রোজকার মতোই রাস্তাঘাট সুনসান। কোথাও কোথাও কিছু গাছের ডালপালা ভেঙে পড়েছে। উইপ্রোর সামনের ফ্লাইওভারটায় ওঠা গেল না। ঝড়ে কি ফ্লাইওভার ভেঙে পড়তে পারে?‌ নাকি উড়ালপুল থেকে চলন্ত গাড়ি ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে?‌ অফিসেও আলোচনা ঘূর্ণিঝড় নিয়েই।

বিকেল ৪.‌০৫

আবহাওয়া দফতরের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, আমপান এখন কলকাতা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে আগামী এক থেকে দেড়ঘন্টায় কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছবে। আপাতত কলকাতায় ঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় ৭৯ কিলোমিটারের কিছু বেশি।

গোটা আমপান পর্বে সঞ্জীবকে বেশ লাগছে। চোখে চশমা, ফর্মাল শার্ট–ট্রাউজার্সের অত্যন্ত আনঅ্যাজিউমিং অফিসার। অথচ সলিড। নিজের সাবজেক্টটা বোঝেন। সবচেয়ে বড় কথা, পাবলিসিটিবাজ নন। ঝাড়াঝাপ্টা, নো–ননসেন্স একটা অ্যাপ্রোচ আছে ভদ্রলোকের। সাংবাদিক বৈঠকে বাংলায় ব্রিফ করার পর সর্বভারতীয় চ্যানেলের অনুরোধে নৈর্ব্যক্তিক মুখে ইংরেজি এবং হিন্দিতেও ব্রিফ করলেন। এবং দুটো ভাষাতেই একটুও হোঁচট না খেয়ে।

সঞ্জীব বলছেন, আজ মধ্যরাতের আগে আমপানের কলকাতা ছাড়ার সম্ভাবনা কম।

বিকেল ৪.‌১৫

অফিসের বারান্দায় গিয়ে একবার দাঁড়ানোর ইচ্ছে ছিল। দেখলাম, ওদিকটা সিল করে দেওয়া হয়েছে। অগত্যা সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। দূরের ‌গাছগুলো পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছে। চারদিক থেকে একটা গুমগুম করে আওয়াজ হচ্ছে। কোথাও নিশ্চয়ই হাওয়ার দাপটে কিছু ভেঙেচুরে পড়ছে বা উড়ে যাচ্ছে। হাওয়ার একটা পাগলাটে শোঁ–শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। হস্তির বৃংহণের মতো। শুধু মনে হচ্ছে, সেই ঐরাবতের গলাটা ভেঙে গিয়েছে। মাথা দোলাতে দোলাতে সে চারদিক লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে সেই চতুষ্পদ। তার পায়ের তলায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে জনপদ।

টিভি বলছে, কলকাতায় এখন ঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় ১০৫ কিলোমিটার। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘আমপানের চোখটা সাগরে ঢুকেছে। লেজ এখনও ঢোকেনি। ওটাই বড় ধাক্কা দেবে।’

নিউজরুমের বাইরেটায় দাঁড়িয়েছিলাম। ‌হাওয়ার প্রচণ্ড আওয়াজ। দড়াম দড়াম করে দরজা পড়ছে। আর বাতাসের তীব্রতর গতি। সেই দুরন্ত বাতাস বৃষ্টিকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটা বৃষ্টির ঝরোখা ছেয়ে ফেলছে চারদিক। এ জিনিস সত্যিই আগে কখনও দেখিনি। ‌

সন্ধ্যা ৭.‌০০

অফিসের ভিতরে বসেও বাইরের শোঁ–শোঁ আওয়াজটা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। আওয়াজটা একবার বাড়ছে। একবার কমছে। যতবার আওয়াজটা বাড়ছে, মনে হচ্ছে আশপাশের সবকিছুকে একেকটা চোপাটে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে নিজের সঙ্গে। বস্তুত, ওই আওয়াজ এতটাই আতঙ্ক, শঙ্কা আর উদ্বেগ বহন করে আনছে যে, মনে হচ্ছে কানে এয়ারপড লাগিয়ে তারস্বরে গান চালিয়ে দিই। যাতে বাইরের ওই আওয়াজটা কানেই না ঢোকে!‌

অফিসে আপাতত কারেন্ট নেই। ঝুম হয়ে অন্ধকারে বসে আছি। ঘুটঘুটে অন্ধকার ম্যানেজ দিচ্ছি মোবাইলের টর্চ জ্বেলে। অন্ধকারে বসে মনে হচ্ছে ঝড়ের আওয়াজটা চৌদুনে উঠে যাচ্ছে। কম্পিউটারের নেটওয়ার্ক গোলমাল করছে। নেটওয়ার্কের সহকর্মীরা সারানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভোডাফোন আক্ষরিক অর্থেই ‘ভোঁদাফোন’এ রূপান্তরিত। নেটওয়ার্কহীন। মাঝে মাঝে নেটওয়ার্ক আসছে। আবার উধাও হয়ে যাচ্ছে। চলছে না টিভি–র কেবল নেটওয়ার্কও।

এইমাত্র জেনারেটরে আলো জ্বলল অফিসে। চারপাশ অন্ধকারে ডুবে। আশপাশে সকলের মুখে গভীর চিন্তার ছাপ।

সন্ধ্যা ৭.‌১৩

কলকাতায় এখন ঝড়ের গতি ঘন্টায় ১৩০ কিলোমিটার। সমস্ত রাস্তার আলো নিভে গিয়েছে। ল্যাম্পপোস্ট দুলছে। ভেঙে পড়ছে সিগনাল পোস্ট। রাস্তায় পার্ক করা গাড়ি বাতাসের ধাক্কায় দুলতে শুরু করেছে। উল্টে পড়ছে মোটরবাইক আর স্কুটার। গ্লো–সাইনবোর্ড ভেঙে পড়ছে। নবান্নের ১০৯ নম্বর ঘর হাওয়ার দাপটে ভেঙে তছনছ। জানালার কাচ ভেঙে দেয় জোরাল হাওয়া। ঘটনাচক্রে, মন্ত্রী থাকার সময় এই ঘরেই বসতেন শোভন চট্টোপাধ্যায়।

গোটা রাজ্যে ইতিমধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বিপর্যস্ত দিঘা, মন্দারমণি, কাকদ্বীপ। ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং কলকাতা। ভেঙেছে ৬ হাজারেরও বেশি কাঁচাবাড়ি। ভেঙেছে বাঁধ। ভেঙেছে জেটি। ভেসে গিয়েছে হাওড়া ফেরিঘাট।

পরিস্থিতি দেখে পরিচিত অ্যাঙ্করের গলা ধরে এসেছে। সহকর্মীদের প্রতি গর্বের আবেশে কেঁদেই ফেললেন ক্যামেরার সামনে। একবার কোটের হাতায় চোখ মুছতেও দেখা গেল। ক্যামেরা বাধ্য হল বোধহয় জাম্পকাট করে অন্যত্র চলে যেতে।

যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে বাইপাস ধরে ঝড়টা এগিয়েছে। আবহবিদরা বলেছিলেন, পূর্ব কলকাতা ছুঁয়ে যাবে আমপান। বাস্তবেও তেমনই হয়েছে। ফলে তুমুল ক্ষতিগ্রস্ত মাঠপুকুর, বেলেঘাটা, সল্টলেক, দমদম এলাকা। গোটা এলাকা অন্ধকারে ডুবে। বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। স্ট্রিটলাইটও জ্বলছে না।

সন্ধ্যা ৭.‌৪৩

মনে হচ্ছে ঝড়ের দাপট একটু কমেছে। আপাতদৃষ্টিতে। ওই ভয়াল আওয়াজটা আর শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু বৃষ্টি শুরু হয়েছে অঝোরধারে। মনে হচ্ছে, সারা কলকাতার আকাশ ফুটো হয়ে গিয়েছে। অবিশ্রান্ত ধারাবর্ষণ হচ্ছে সমস্ত এলাকায়। টিভি–র দাবি, এমন বীভৎস ঘটনা ঘটেছিল এর আগে ১৭৩৭ সালে। সেবার সাইক্লোনে নাকি গঙ্গায় নাকি প্রায় ৪০ ফুট উঁচু ঢেউ উঠেছিল। মারা গিয়েছিলেন ৩,০০০ মানুষ। অন্তত ২০টি ছোটবড় জাহাজ নাকি ডুবে গিয়েছিল।

এখনও নাকি আরও একঘন্টা আমপানের দাপট চলবে। তবে সেই প্রলয়ঙ্করী আওয়াজটা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে।

রাত ৮.‌১৭

ঝড়ের দাপট অনেকটাই কম এখন। তবে হাওয়াটা এখনও বইছে তোড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবার একটা ঝাপট আসতে পারে। তাঁদের বক্তব্য, এই শান্ত ভাবটা নাকি আসলে ঝড়ের ‘আই’এর। এরপর লেজের ঝাপ্টা আসবে। ওডিশাতেও ‘ফণী’ নাকি এমনই কাণ্ড ঘটিয়েছিল। যেটুকু বাকি ছিল, লেজের ঝাপ্টায় সমস্ত তছনছ করে দিয়ে গিয়েছিল। যদি তেমনকিছু হয়, তাহলে সেটা যা হল, তার চেয়ে অন্তত পাঁচগুণ হবে। এখনও পর্যন্ত কলকাতায় ঝড়ের যে গতিবেগ রেকর্ড করা হয়েছে, তার পরিমাণ ঘন্টায় ১৩৩ কিলোমিটার। যা সুদূর অতীতেও নজিরবিহীন। আর উপকূল এলাকায় সেই গতি ছিল ঘন্টায় ১৮০ কিলোমিটার!‌ অভাবনীয়!‌ অকল্পনীয়!‌ ভয়াবহ!‌

একটু আগে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে এলাম, অফিসের চত্বরে পার্ক–করা গাড়িটা এখনও ঠিকঠাকই আছে। ইচ্ছে করেই বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে রেখেছিলাম। মনে হয়েছিল, ঝড়ে যদি উড়িয়েও নিয়ে যেতে চায়, দেওয়ালটা একটু ঠেকনো বা আড়াল দিতে পারবে। পাঁচিলের অন্যপাশে বড় কোনও গাছ ছিল না। ভাগ্যিস!‌ অফিসের নীচে জল জমে গিয়েছে। আজ হাওয়াই চটি পরে অফিসে এসেছিলাম। ভাগ্যিস!‌

ঝড়ের পুরো সময়টা এয়ারটেলের সার্ভিস ঠিকঠাক ছিল। এখন দেখছি ভোডাফোনের নেটওয়ার্কও ফিরে এসেছে। বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির দাপটও নাকি খানিকটা কমেছে। তেমনই বলছে টিভি। কিন্তু পাশাপাশিই বলছে, কোথাও কোথাও আবার বাড়ছে হাওয়ার দাপট। তবু মনে হচ্ছে, ওই বীভৎসতাটা সম্ভবত আর ফিরবে না।

রাত ১০.‌৩৫

আজকের রাতটা এক গভীর অন্ধকারের রাত। একটা শহর সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে। কোথায় কী ভেঙে পড়েছে, কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার কোনও হদিসও পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় দু’ঘন্টায় কী দেখলাম?‌ ঝড়ের দাপট। বাতাসের গর্জন। মুষলধারে বৃষ্টি। প্রকৃতির সামনে হাঁটু গেড়ে অসহায় মানুষ। সেই মানুষের চোখেমুখে আতঙ্ক। মনে শঙ্কা আর গভীর উদ্বেগ।

প্রকৃতির প্রতিশোধ?‌ কে জানে!‌ হবে হয়তো।

এখনও চোখ বুজলে ভয়াবহ আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছি। সাক্ষাৎ ধ্বংসের শব্দ। মৃত্যুর শব্দ। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর মাটি থেকে একটা অতিকায় দানব চক্রাকারে তার ঘূর্ণায়মান অক্ষের উপর ভর করে উঠে আসছে। আর সামনে যা পাচ্ছে, গিলে নিচ্ছে সেই দানবীয় খোঁদলে। খাবার না পেলে অক্ষম এবং নিস্ফল আক্রোশে ধাক্কা মারছে, মাথা ঠুকছে বিভিন্ন ইমারতে।

আর তার সামনে জোড়হাতে নতজানু হয়ে বসে আছে আপাত–দাম্ভিক মানুষ।

সেখানে কোনও কেনি রজার্স নেই।

3 thoughts on “লকডাউন ডায়েরি – ২০ মে, ২০২০

  1. প্রত্যেকটা ” লকডাউন ডাইরি ” পড়ছি … আগের কয়েকটির মতো আজকেরটাও মন কে ছুয়ে গেল | এরমধ্যেই একটা কথা না জিজ্ঞেস করে শান্তি পাচ্ছি না,সেটা হোল বাড়িতে দু’জন বৃদ্ধ বৃদ্ধা রয়েছেন,তাদের কে এই ঝোড়ো দিনে একলাই থাকতে হোল? এই ভয়ঙ্কর সময়টা তারা কেমন করে কাটালেন??

    .

    Like

  2. এখন পড়লাম
    বিচ্ছিন্ন ছিলাম।
    সেদিন রাতে তবু নিজের বিছানায় শুতে পেরেছিলাম
    বাড়িতে যে ছেলেটি জল দেয় তার ঘরের চাল উড়ে গেছে। সবাই গিয়ে স্কুল বাড়িতে
    আশ্রয় নিয়েছে। অজানা ভবিষ্যত। অনিশ্চিত।
    তবু বেলা করে এসেছে জল দিতে, হাসিমুখে।
    জীবন ঠিক জিতে যায়
    🙏🏻

    Like

Leave a comment