লকডাউন ডায়েরি – ২ মে, ২০২০

০২.‌০৫.‌২০২০। শনিবার

বেলা ১১.‌০৬

ইংলিশ ওয়েদারের ঠেলায় সারা রাত ফ্যানের রেগুলেটর বাড়াতে–কমাতেই কেটে গেল। ফলে ঘুম ভাঙল সাড়ে ৮টায়। অ্যালার্ম দিতেও ভুলে গিয়েছিলাম। ধড়মড়িয়ে যখন উঠলাম, বাইরে বেশ কড়া রোদ্দুর। সেই রোদ্দুরই রায় দিলেন, এবার উঠে পড়ুন। আর বিছানায় সাঁতার কাটবেন না।

বাবা–মা’কে চা ইত্যাদি দিয়ে ওয়ার্কআউট শুরু করতে করতে সাড়ে ৯টা। তারপর খানিক ঝাঁপিয়ে, খানিক হাঁপিয়ে সাড়ে ১০টা নাগাদ ম্যাট–শয্যা নিয়েছিলাম। একটু আগে উঠে খানিক ধাতস্থ হয়ে আজকের প্রথম এন্ট্রি করতে বসেছি। দেশ–দুনিয়ায় কি অনেককিছু ঘটে গিয়েছে ইতিমধ্যে?‌

বেলা ১১.‌৫৪

আজ সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন। জন্মশতবর্ষ। সকালে দেখলাম, আমার ফেসবুক পেজের অ্যাডমিনরা সত্যজিৎকে লেখা ‘খোলা চিঠি–ইতি অনিন্দ্য’ পেজে আবার শেয়ার করেছে। তাই আমিও ফেসবুকে পোস্ট করে দিলাম চিঠিটা। একবছর আগে এটা লিখেছিলাম। ভাবছি আরেকবার পড়ে দেখব। এমনিতে নিজের কোনও লেখাই প্রকাশিত হওয়ার পর পড়ি না। কারণ, সবসময় মনে হয়, আরও ভাল লেখা যেত। আফশোস হয়। কিন্তু এই লেখাটা আবার পড়ে দেখতে ইচ্ছে করছে।

দুপুর ১২.‌০৬

পড়লাম। দেখলাম, মন্দ লিখিনি। চলে যায়।

তপশ্রী’দি নিজের টাইমলাইনে একটা ছবি পোস্ট করেছেন। একটা রিকশার পাদানিতে থরে থরে ম্যাগির প্যাকেট সাজানো বাক্স রাখা। লিখেছেন, ‘বদলে যাচ্ছে অর্থনীতি। পেটের টানে খড়কুটো আঁকড়ে ধরছে শ্রমজীবী মানুষ। রিকশাওয়ালা ম্যাগি ফেরি করছে পাড়ায় পাড়ায়’। এই কথাটা লকডাউন শুরুর সময়েই মনে হয়েছিল যে, এরপর পেশা বদলে যাবে মানুষের। এখন দেখা যাচ্ছে, সেটা সত্যিই ঘটতে শুরু করেছে। একটা মিশ্র অনুভূতি হল। একদিকে মনে হল, এই দিন–আনা দিন–খাওয়া লোকগুলোর বড় দুর্দশা। দিন চালানোই দুষ্কর। অন্যদিকে মনে হল, তা–ও তো গ্রাসাচ্ছাদনের একটা উপায় বেরিয়েছে। লড়াইয়ের একটা রাস্তা বেরিয়েছে। দিনের শেষে জীবনধারণের জন্য মানুষ সব পারে।

দুপুর ১২.‌৫২

একটা মাস চলে গেল। আবার মায়ের পেনশন তোলার সময় আসছে। ভাবছি, পেনশনটা তুলে এনে মা’কে বলব, প্রচুর পরিশ্রম যাচ্ছে। এবার মাইনে দাও। কথাটা ভেবে নিজের মনে খুব একচোট হাসতে হাসতেই আরেক ‘মা’ হাজির হলেন হোয়াট্‌সঅ্যাপে পাঠানো পোস্টারে। ইনি ‘মা’ বটে। তবে ‘জ্যাক’। জ্যাক মা।

ধনকুবের আলিবাবা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেছেন,‘যাঁরা ব্যবসা করেন তাঁদের কাছে ২০২০ সালটা স্রেফ কোনওমতে নিজেদের প্রাণটা বাঁচানোর বছর। ভুলেও নিজের স্বপ্ন বা পরিকল্পনার কথা উচ্চারণ করবেন না। স্রেফ প্রাণে বেঁচে থাকাটা নিশ্চিত করুন। বেঁচে থাকলেই মনে করবেন ইতিমধ্যে লাভ করে ফেলেছেন।’ এই বেদবাক্য অবশ্য আমি এবং আরও অনেকে উচ্চারণ করতে পারি। কিন্তু আমরা তো আর পৃথিবীর ‘মা’, থুড়ি জ্যাক মা নই।

দুপুর ১.‌‌৪৬

আমেরিকায় মৃত আপাতত ৬৪ হাজার ৮০৪ জন। আপাতত। এর মধ্যেই আজ কেমডিভির ব্যবহারে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্পের কিন্তু পাগল–পাগল অবস্থা এখন। মনে হচ্ছে, সামনে কাউকে দেখলেই কামড়ে দেবে!‌

পাকিস্তানে মৃত ৪০২ জন। ভারতে আজ পর্যন্ত মৃত ১,২১৮ জন। আক্রান্ত ৩৭ হাজার ৩১৭ জন।

দুপুর ২.‌০৪

লকডাউনে আটক শ্রমিকদের বাড়ি ফেরাতে আজ দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেন চালু হল। এমনই একটা ট্রেন রাজস্থানের আজমীড় শরিফ থেকে কাল কলকাতা স্টেশনের দিকে রওনা দেবে। তবে ক’টার সময়, তা এখনও ঠিক হয়নি। প্রসঙ্গত, রাজস্থানের কোটায় আটক পড়ুয়াদের কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

পরিযায়ী শ্রমিকরা মূলত বাংলা, বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ থেকেই রুজির ধান্দায় বিভিন্ন রাজ্যে যান। লকডাউনে আটকে থেকে এতদিনে তাঁরা বাড়ি ফিরছেন। আজকেই রাজস্থানের জয়পুর থেকে বিহারের দানাপুরে ফিরেছেন একঝাঁক শ্রমিক। প্ল্যাটফর্মে নেমে তাঁরা আঙুল তুলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়েছেন। পিটিআই ছবিটা পাঠিয়েছে। সেটাই পেজ ওয়ানে নিলাম।

ওই ছবিটা দেখেও একটা মিশ্র ভাবনা তৈরি হল। একদিকে মনে হল, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য এটা ভালই হল। সকলে ভিটেয় ফিরে আসবেন। আত্মীয়–পরিজনদের আশ্রয়ে। কিন্তু অন্যদিকে আবার মনে হল, এঁরা ঘরে ফিরেও তো কোনও কাজ পাবেন না। এঁদের মধ্যে অনেকে বিশেষ স্কিলসম্পন্ন। তাঁরা কি লকডাউন মিটলেও আর ভিনরাজ্যে পাড়ি দেবেন? সেক্ষেত্রে তাঁদের স্কিলগুলো ওইসব রাজ্যের লোকদের শিখতে হবে। ততদিন কি ওইসব রাজ্যে কাজ বন্ধ থাকবে?‌ আরও প্রশ্ন:‌ স্টেশনে না হয় পুলিশি প্রহরায় গোল গোল সাদা দাগের মধ্যে বসিয়ে তাঁদের মধ্যে দৈহিক ব্যবধান বজায় রেখে ট্রেনে তুলে দেওয়া হল। ট্রেন ছাড়ার সময় রেলপুলিশের কর্তারা দাঁড়িয়ে একযোগে হাততালিও দিলেন। কিন্তু ট্রেনের দীর্ঘ যাত্রাপথে কি তাঁদের মধ্যে সেই ব্যবধান বজায় থাকবে?‌ বাড়িতে ফেরার পর তাঁদের জন্য কি কোনও স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা থাকবে?‌ ঠিক জানি না। তবে এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে এসব প্রশ্নের জবাব কারই বা জানা থাকে!‌

রাজ্যপাল আর কল্যাণ’দার আবার লেগেছে। রাজ্যপাল সকালে টুইট করেছিলেন, রাজ্য সরকার করোনায় মৃতের সংখ্যা গোপন করছে। সেই টুইটে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছেন, ‘আপনি বলেছিলেন, বিরোধী দলগুলো মৃতদেহের জন্য শকুনের মতো বসে রয়েছে। এই মন্তব্য প্রত্যাহার করুন!‌’ কল্যাণ’দা দেখলাম তার জবাবে টিভি–তে বলছে, ‘ওঁর একমাত্র টার্গেট মমতা ব্যানার্জি। হি ইজ দ্য প্রাইম ভায়োলেটর অফ দ্য কনস্টিটিউশন।’

রেশনের গুবলুটা কি ক্রমশ ছড়াচ্ছে?‌ জেলায় জেলায় বিক্ষোভ, অশান্তি, ভাঙচুর। কোথাও কোথাও ডিলারের বাড়িতে আগুনও লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই অরাজকতাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে কে জানে!‌ কলকাতার মেয়র বলছেন, ‘সব তো একদিনে হবে না। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু রেশন ব্যবস্থাটা ঠিকঠাকই চালু রয়েছে। আমি কলকাতার চারদিকে ঘুরে তো সেটাই দেখলাম।’

দুপুর ২.১৪

‘নিউজ ১৮’ একটা ভাল স্টোরি করেছে। পাড়ায় পাড়ায় ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়ানো যাদুকরদের নিয়ে। তাঁদের রুজি–রোজগার এখন পুরোপুরি ডকে উঠেছে। চমৎকার আইডিয়া। সত্যিই তো। উঁচুদরের বিনোদনশিল্পীরা তা–ও সঞ্চয় ভাঙিয়ে কিছুদিন টানতে পারবেন। এঁদের কী হবে?‌ সকলেই তো আর পিসি সরকার (‌জুনিয়র)‌ নন। নিয়তির কী পরিহাস, এই দুর্বিসহ অবস্থা থেকে বেরোনর জন্য কোনও ম্যাজিক কাজ করবে না। এটা বাস্তব। এখানে পরাবাস্তবতার কোনও জায়গা নেই।

দুপুর ২.২৪

লকডাউন ডায়েরি পড়ে ভাল লাগে জানাতে দিল্লি থেকে লম্বা হোয়াট্‌সঅ্যাপ পাঠিয়েছেন আমার নেমসেক। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় দিল্লির ‘টাইম্‌স অফ ইন্ডিয়া’য় কাজ করেন। একটা সময় ওঁকে ‘এবেলা’য় নেওয়ার কথা হয়েছিল। তারপর বিভিন্ন কার্যকারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। লকডাউনে কল–কারখানা বন্ধ হয়ে দূষণ কমায় যমুনার জল আবার নীল হয়ে গিয়েছে, এমন একটা ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। সেটি তুলেছিলেন এই অনিন্দ্য।

‘খোলা চিঠি–ইতি অনিন্দ্য’র আদলে ‘লকডাউনেষু’ সম্বোধন করে এই অনিন্দ্য লিখেছেন, কলকাতায় ফ্রিল্যান্স করার সময় একদিন তাঁর এক বন্ধু এই অধমকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তার পরের বাক্যটা খুবই এমব্যারাসিং— ‘সেদিন থেকে দুই কলার তুলে চলা মানুষকে শ্রদ্ধা করি। এক আপনি আর অন্যজন আজহারউদ্দিন। আসলে কলার তুলে চলাটা মানায় আপনাদের।’ অনিন্দ্যকে বলা হল না যে, আমার টি–শার্টের কলার তুলে রাখাটা ছিল একটাই কারণে। আমি এমনিতেই কালোমানিক। তারপর ঘুরে ঘুরে রিপোর্টিং করার সময় ঘাড়ে রোদ লেগে সেটা ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করত। ঘাড় বাঁচাতেই কলার তুলে রাখা। তাছাড়া আর কোনও কারণ নেই। তবে আমার সেই ‘কলার তোলা ঔদ্ধত্য’ নিয়ে যুগে যুগে, কালে কালে চারদিকে এমন ক্ষোভ এবং অবিমিশ্র অসূয়ার ঢেউ ওঠা শুরু হল যে, গত কয়েকবছর টি–শার্ট কিনেই প্রথমে কাঁচি দিয়ে কলারটা কেটে নিই। যাতে এ নিয়ে আর অন্য কারও অ্যাসিডিটি না হয়। ঘাড় এখন খোলাই থাকে। যে কেউ ইচ্ছে করলেই এসে কোপ মেরে যেতে পারে।

নেমসেককে জবাব দিলাম, আপনার তোলা নীল যমুনার ছবিটি চমৎকার হয়েছিল।

উত্তর এল, ‘যমুনার লকডাউন প্রাপ্তি’।

দুপুর ২.‌৩৭

অবশেষে ‘আরোগ্যসেতু’ অ্যাপ ডাউনলোড করলাম। জিনিসটা কিন্তু কাজের হয়েছে। অ্যাপে যা দেখছি, তাতে আমার সল্টলেকের বাড়ির ৫০০ মিটারের মধ্যে কোনও কোভিড আক্রান্ত নেই। কিন্তু ১ কিলোমিটারের মধ্যে ১ জন, ২ কিলোমিটারের মধ্যে ৩ জন, ৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১৭ জন এবং ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭৮ জন কোভিড আক্রান্ত রয়েছেন। দেখে মনে হল, ভাগ্যিস বাসন্তী’দিকে আপাতত আসতে নিষেধ করেছি!‌

তবে এই অ্যাপেও একটা ক্যাচ আছে। যাঁরা অ্যাপ ব্যবহার করছেন, তাঁদের কাছে তাঁদের সম্পর্কেই কয়েকটা তথ্য চাওয়া হচ্ছে। সেগুলো যদি কেউ ঠিকঠাক না বলেন (‌যেমন তিনি গত ১৪ দিনে বিদেশ থেকে এসেছেন কিনা বা তাঁর বয়স, সাম্প্রতিক অসুস্থতা ইত্যাদি)‌, তাহলে পুরো প্রসেসটাই বৃথা। অ্যাপটা দেখে মনে হল, কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশের জন্য একটা কোভিড ম্যাপ তৈরি করতে চাইছে। সেটা কিন্তু মন্দ প্রচেষ্টা নয়। ভবিষ্যতের জন্য খুব জরুরি তো বটেই।

দুপুর ৩.‌০০

বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখলাম চারদিকে রাস্তা সাদা হয়ে আছে। মাস্ক ভেদ করে নাকে এল ব্লিচিং পাউডারের ঝাঁঝালো গন্ধ। এই এলাকাটায় কয়েকটা ছোটবড় হাসপাতাল আছে। সম্ভবত সেই কারণেই। কাল রাস্তা জুড়ে ছিল রাধাচূড়ার হলুদ পাপড়ি। আজ ব্লিচিং পাউডার। রাস্তার রং প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে। জীবনের রংয়ের মতো।

দুপুর ৩.‌‌১৫

একটু আগে অফিসে এলাম। আসার পথে উইপ্রোর সামনে দেখলাম, একটা ধূসর রংয়ের পায়রা ঘাড় ভেঙে রাস্তায় পড়ে আছে। নিশ্চয়ই কোনও বেপরোয়া গাড়ি ধাক্কা মেরেছে! হয়তো জানেও না যে একটা প্রাণীহত্যা করে নির্বিকার চলে গিয়েছে। পায়রাটাকে দেখে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারের কথা মনে পড়ল। আর ঝপ করে আবার মনে পড়ে গেল তার সঙ্গে জড়িত একরত্তি চেহারাটা।

তখন ফাঁক পেলেই ট্রাফালগার স্কোয়ারে গিয়ে বসে থাকতাম। সেখানে ঝাঁক ঝাঁক পায়রা। মুম্বইয়ের গেটওয়ে অফ ইণ্ডিয়ার চত্বর বা দাদারের কবুতরখানায় যেমন থাকে। স্কোয়ারের মাঝখানে একটা বিশাল ফোয়ারা। সারাদিন চলে। সেই ফোয়ারার জলে ফিরিঙ্গিরা এক একটা পেনি ছুড়ে ফেলে মানত করে। তাতে নাকি মনস্কামনা পূর্ণ হয়। স্কোয়ারের একদিকে ছোট ছোট নীল বাটিতে গমের দানা পাওয়া যায় পায়রাদের খাওয়ানোর জন্য। অল্পদামে সেই গম কিনে, হাতের তেলোয় নিয়ে দাঁড়ালে পায়রারা এসে কাঁধে–মাথায় বসে। কুট কুট করে গম খেয়ে যায় নির্বিবাদে।

ইউনিভার্সিটি থেকে প্রত্যেক স্কলারকে একটা করে এসএলআর ক্যামেরা দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে ফিল্ম রোল। যা খুশি ছবি তোলার জন্য। যাতে ফ্রেম দেখার বুঝটা তৈরি হয়। গুচ্ছের আবোলতাবোল ছবি তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পয়সাতেই সেগুলো ডেভেলপ করাতাম। সেরা ছবিগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল আমাদের প্রোডিউস করা একটা ম্যাগাজিনে।

ট্রাফালগার স্কোয়ার হল কলকাতার শহিদ মিনারের পাদদেশের মতো। যত রাজ্যের ভানুমতীর খেল আর ভবঘুরের আখড়া। প্লাস বিশ্ববিখ্যাত টুরিস্ট অ্যাট্রাকশন। ছবি তোলার পক্ষে যাকে বলে আদর্শ। একদিন দুপুরে সেখানে বসেছিলাম। কাছের ফোয়ারা থেকে দমকা বাতাসে ইলশেগুঁড়ি উড়ে এসে লাগছে গায়ে। চুপটি করে বসে থাকতে থাকতেই দেখলাম টকটকে লাল রংয়ের ফ্রক পরা দেবশিশুর মতো এক বালিকা ফোয়ারার জলে নামছে আর পেনি কুড়িয়ে কুড়িয়ে পায়রা খাওয়ানোর নীল বাটিতে ভরছে। বাটি ভরে গেলে ফোয়ারা থেকে উঠে কুড়োন পেনি রেখে আবার জলে নামছে আরেকটা নীল বাটি কুড়িয়ে।

শিশুটি আমার উচাটন মনে তরঙ্গ তুলল। একবার ফোয়ারা থেকে ওঠার পর হাত নেড়ে তাকে কাছে ডাকলাম। আপাদমস্তক ভেজা গায়ে পাথরের উপর জলছাপ রেখে সে এসে দাঁড়াল। সপসপে ফ্রক লেপ্টে গিয়েছে গায়ে। লন্ডনের মারুনে শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। হাসিমুখে দু’হাত বাড়াতেই ঝাঁপিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক যুবকের কোলে চলে এল সেই মেয়ে। দু’হাতে জড়িয়ে শরীরের ওম দিয়ে তার শীত কমানোর চেষ্টা করতে করতেই টুকটাক কথা বলছিলাম। দেখলাম দিব্যি ইংরেজি বলে। ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে দেবশিশু জানাল, সে এক বসনিয়ান রিফিউজি। যুদ্ধের জন্য ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত হওয়া বাবা–মা তাকে নিয়ে লন্ডনে এসেছে রুজির খোঁজে। এখন তারা সারাদিন নির্মাণকর্মীর কাজ করে। রাতে ফিরে আসে কাছেই কভেন্ট গার্ডেনে ফুটপাথের আস্তানায়। আর তাদের কন্যা ফোয়ারার জল থেকে পেনি কুড়োয় দিনভর।

আমার মতো নিগারের কোলে সেই উজ্জ্বল শিশুকে দেখে আশপাশের পর্যটকদের কিঞ্চিৎ কৌতূহল হয়েছিল। তাদেরই একজনের হাতে নিজের ক্যামেরা ধরিয়ে বললাম আমাদের কয়েকটা ছবি তুলে দিতে। তারপর সেই একরত্তির হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম কাছের হটডগ স্টোরে। পেটপুরে খাইয়ে তার হাতে দিলাম বৃত্তির টাকা থেকে বাঁচানো কিছু পাউন্ড। নীল চোখ তুলে মেয়ে অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে।

সে চাহনি এখনও ভুলিনি। কারণ, তার সঙ্গে সেই শেষ দেখা। তারপরে বহুবার ট্রাফালগার স্কোয়ারে গিয়েছি তার খোঁজে। পাইনি।

আসল ঘটনাটা ঘটল দেশে ফিরে। ফোয়ারার ধারে তোলা সেই ছবি আমার অফিসের কিউবিক্‌লে বোর্ডপিন দিয়ে আটকে রেখেছিলাম। চারপাশে কৌতূহল বাড়তে শুরু করল। তারপর একদিন এক সহকর্মী যাবতীয় ভদ্রতা এবং লজ্জার মাথা খেয়ে প্রশ্ন করেই ফেললেন, ‘এই বাচ্চাটা কে?‌’

— আমার মেয়ে।

‘অ্যাঁ?‌ এত ফর্সা?‌’

— হ্যাঁ। সাহেববাচ্চা। লন্ডনে থাকে।

অনতিবিলম্বে চরাচরে রটে গেল, অনিন্দ্যর বিলেতে একটি ‘অবৈধ’ কন্যাসন্তান আছে। নিছক প্র্যাকটিক্যাল জোক করে বলা সেই ভ্রান্তি কোনওদিন ভাঙানোর চেষ্টা করিনি। কারণ, মনে মনে সত্যিই সেই পরীকে নিজের সন্তান বলে ভাবতাম। একুশটা বছর কেটে গিয়েছে। এখনও তাকে মিস্‌ করি। বসনিয়ার শরণার্থী সেই মেয়ে নিশ্চয়ই এখন টগবগে তরুণী। লন্ডনেই কি থাকে তারা এখনও?‌ নাকি অন্য কোথাও শিকড় গজিয়েছে তার?‌ জানি না। সেই যুবক এখন মধ্যবয়স্ক। কিন্তু এখনও কোনও যুদ্ধের ক্লাসিক ছবিতে ছিন্নমূল শরণার্থীর সারি দেখলে তার মনে পড়ে ভিজে সপসপে ফ্রক পরা সেই ডলপুতুল আর তার সমুদ্রনীল চোখের অবাক চাহনির কথা। তার মনে তার মেয়ের বয়েস আর বাড়েনি।

আজ পায়রাটাকে দেখে সেই মেয়ে আবার ভেসে এল।

বিকেল ৫.‌৩০

রাজ্যপালকে ১৩ পাতার একটি চিঠি পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যা নিয়ে আবার রাজ্য প্রশাসন তোলপাড়। কিন্তু করোনা–ভীত বঙ্গবাসীর কি সত্যিই কিছু যায়–আসে এই পত্রযুদ্ধে?‌ জানি না।

লকডাউনের সময় দুটো অত্যাশ্চর্য কাণ্ড ঘটেছে। গাদিয়াড়ার গঙ্গায় শুশুক দেখা গিয়েছে আর সনৎ রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছে। আজ অবশ্য এসেই বলল, ‘মাস্ক পরে পরে নাক ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমার মোবাইল ফোন আমারই ফেস ডিটেক্ট করতে পারছে না!‌’

সন্ধ্যা ৮.৩০

রাহুল গান্ধী টুইট করেছেন, আরোগ্য সেতু অ্যাপ আসলে একটা সফিস্টিকেটেড সারভিলেন্স সিস্টেম। যার দায়িত্বে একজন প্রাইভেট অপারেটর।যার উপরে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারিও নেই। এর ফলে ডেটা সিকিউরিটি এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে সিরিয়াস উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে।

যার জবাবে কঙ্গনা রানাবত লিখেছেন,

– আপনি আই ফোনের সঙ্গে সব ডেটা শেয়ার করতে পারেন।

– আপনি ফেসবুক, গুগল, টুইটার টিন্ডার-সহ সব সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের সব ডেটা শেয়ার করতে পারেন।

অথচ, নিজের কিছু তথ্য পাবলিক সেফটির জন্য তৈরি একটা অ্যাপে শেয়ার করতে পারেন না।

দোনো মা-বেটে বহত ঘাটিয়া হ্যায়।

রাত ১০.‌৪০

আজও খুব চাপের দিন গেল। রাহুল-কঙ্গনা টুইট যুদ্ধ, রাজ্যে করোনা আক্রান্ত, মৃত এবং রোগমুক্তদের সংখ্যা বিজবিজে মগজ নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়েছিলাম। গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখলাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।

নিমেষে জীবন পিছিয়ে গেল ২১টা বছর। মনে হল, ছুঁয়ে যাচ্ছে এক অবিশ্রান্ত ফোয়ারার জলবিন্দু। ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক পায়রা।

আর আগাপাশতলা সপসপে ভেজা লাল ফ্রকের এক ডানা-হারানো পরী দু’হাত বাড়িয়ে অচেনা আগন্তুকের চোখে রাখছে তার সমুদ্রনীল চোখ।

6 thoughts on “লকডাউন ডায়েরি – ২ মে, ২০২০

  1. I think mukesh Ambani is second to jack Ma in Asia now. The figures in this case is applicable to Asia , I presume.

    Like

  2. The drug now the FDA is permitting/using is remdesivir. It is an anti viral drug , now treating Covid patients in the US.

    Like

  3. প্রিয় অনিন্দ্য,
    কি মিষ্টি…
    ওই লালপরীর নীল চোখ আমিও দেখতে পেলাম। আমিও ওর স্বপ্নে বিভোর হলাম আজ।
    এত মৃত্যু
    এত হতাশা
    তবু ওই না দেখা নীল চোখের মায়ায় বাঁচার অনুভূতি হল আজ।
    আসলে মায়াই বাঁচিয়ে রাখে।
    শুভ হোক
    নন্দিতা ভট্টাচার্য

    Like

  4. Apnar lockdown diary ..Ekta dolil ho a thakbe. Jod kokhono kono sokal a uthe mon a hoi eti k kono publishers er madhyome boi akare prokash korben , bhobisyot projonmer kache ekta docuement ho a thakbe…. J bangali ghorbondi obosthai Kemon katiachilo… Ek virus er chokh rangani te.. bhalo thakun.. soporibar a. Lockdown er ei kothin somoi a .. apnar fan ho a gelam.

    Like

Leave a comment