লকডাউন ডায়েরি – ১৬ এপ্রিল, ২০২০

১৬.‌০৪.‌২০২০। বৃহস্পতিবার

সকাল ৮.‌০০

গতকাল রাত ১২.‌৪৫ মিনিটে কলকাতা পুলিশের একটা টেক্সট ঢুকেছে। দুপুরে স্পিড লিমিট ভেঙে কেস খেয়েছি। ফাইন হয়েছে। একদম ঠিকঠাক কেস দিয়েছে। স্পিড লিমিট ৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। আমি যাচ্ছিলাম ৭২ কিলোমিটারে। যাতে বোঝা গেল, রাস্তা ফাঁকা থাকলেও টিকিয়া উড়ান (‌যে স্পিডে চালালে হাওয়ার চোটে পাঁড়েজি ড্রাইভারের টিকি ওড়ে)‌ চালানো যাবে না।

দ্বিতীয়ত, কোনও গাড়ি ওভারটেক করে চলে গেলে তাকে ধাওয়া করে টপকে গিয়ে হিরোগিরি দেখানো যাবে না। কাল দুপুরে যেটা করেছিলাম। একটা হুণ্ডাই ভার্নাকে তাড়া করতে গিয়ে স্পিডগানে ধরা পড়েছি। আশা করি, হুণ্ডাইটাও কেস খেয়েছে। তাহলে খানিক জ্বালা জুড়োয়।

সকাল ৮.‌১৩

বান্দ্রা স্টেশন এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে ‘বিভ্রান্তিমূলক’ খবর করার দায়ে একটি মারাঠি চ্যানেলের সাংবাদিক রাহুল কুলকার্নিকে কাল অ্যারেস্ট করেছে মুম্বই পুলিশ। আজ কোর্টে তোলার কথা। নিশ্চয়ই তাঁর জামিন হবে।

সকাল ৮.‌৩৭

মুম্বইবাসী সাংবাদিক বন্ধু নওজের একটা ভিডিও পোস্ট করেছে ফেসবুকে। লিখেছে, ‘এই ছেলের দল লকডাউন অমান্য করেছিল। সম্ভবত ভিলে পার্লের দৃশ্য। খুব নিশ্চিত নই। দেখুন পুলিশ তাদের কী করেছে।’

দেখা গেল হাফপ্যান্ট পরা গোটা দশেক ছেলে রাস্তায় এলবো ওয়াক করতে করতে যাচ্ছে। পিছনে ডান্ডা হাতে পুলিশ। পিচের রাস্তায় ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিশ্চয়ই ছেলেগুলোর কনুই আর হাঁটুর নুনছাল উঠে যাচ্ছিল। থামলেই লাঠির বাড়ি। বেশ কিছুটা ওইভাবে যাওয়ার পর তারা পাশাপাশি রাস্তায় লাইন করে শুয়ে পড়ল। আর পুলিশ অফিসার প্রত্যেকের পশ্চাদ্দেশে গুণে গুণে দু’‌টি করে ডান্ডার বাড়ি মারলেন। একেবারে ফুল সুইংয়ে। তারপর তাদের উঠে দাঁড়াতে দেওয়া হল। অতঃপর পিছনে হাত বোলাতে বোলাতে তারা যেখান থেকে বেরিয়েছিল, সেখানে ফিরে গেল।

আমাদের শহরে লকডাউন ভাঙার জন্য এমন হাতেনাতে দণ্ডবিধান করা যায় না?‌

সকাল ৯.‌০০

সল্টলেকের এই বাড়িতে প্রত্যেক সকালে বাইরে থেকে একটা পিলে চমকানো হাঁক আসে। চারদিক এখন আরও চুপচাপ। ফলে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। রোজ মনে হয়, বাইরে গিয়ে দেখি লোকটা কে। হয় না। আজ গেলাম। দেখলাম, দুগ্ধবিক্রেতা। ভ্যানে করে দুধের প্যাকেট নিয়ে আসে। তারপর ওই রকম একটা বাজখাঁই হাঁক পাড়ে। ‘দুধ’ বলেই চেঁচায় নিশ্চয়ই। কিন্তু বোঝা যায় না। অন্তত আমি বুঝতে পারিনি। আমার ওটা স্রেফ একটা চিৎকার বলে মনে হয়। বস্তুত, দুধের মতো একটা পেলব আর কোমল বস্তু যে অমন কর্কশভাবে বিপণন করা যায়, স্বকর্ণে না শুনলে বিশ্বাস হতো না।

সকাল ৯.‌১২

টিভি–তে দেখলাম, হুগলির উত্তরপাড়া–কোতরং মিউনিসিপ্যালিটির কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে থার্মাল স্ক্রিনিং করছেন। দেখে চমৎকার লাগল। এই রাজ্যে আর কোনও পুরসভা কি এই কাজটা করছে?‌ জানি না। করলেও চোখে পড়েনি। অ্যাট লিস্ট, কলকাতা বা সল্টলেকে তো চোখে পড়েনি। হয়তো হবে ভবিষ্যতে। কোভিডের তো যাওয়ার জন্য বিশেষ তাড়া আছে বলে মনে হয় না। আশা করে থাকি না হয়।

আজ সকাল থেকে মেঘলা। সেই ভয়াবহ গরমটা নেই। মৃদুমন্দ বহিতেছে মলয়পবন। কালকের ঝড়বৃষ্টির পর তাপমাত্রা খানিকটা কমেছে। সাধারণত এমন হলে একটা মিঠে ভাব আসে মনে। কিন্তু এখন ওসব ভাবার সময় নেই। এখন ঝড়বৃষ্টির কথা ভাবলেই মনে হচ্ছে, কাদা প্যাচপ্যাচে গাড়িটা ধুতে হবে।

এই যাঃ!‌ আবার রোদ উঠে গেল!‌ ‌

সকাল ১০.‌১৯

দিকে দিকে ডাক্তার পেটানো বাড়ছে। মোরাদাবাদের পর এবার পূর্ব চম্পারণ। মানুষের এই প্রবৃত্তিগুলো এবার আরও বেরিয়ে আসবে। দাঁত–নখ বেরোবে। মানুষ আরও হিংস্র হবে। কেন জানি না মনে হয়, প্রথমত, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে শৃঙ্খলাকে খুব পছন্দ করে না। আর তারা সবসময় কোনও না কোনও ভিলেন খোঁজার চেষ্টা করে। তাই সামান্য সুযোগেই হইহই করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। আর একটা ভিলেন খাড়া করার জন্য সামনে যাকে পায়, পিটিয়ে হাতের সুখ করে নেয়। কে মরল, কে আধমরা হল, তাতে সেই বিশৃঙ্খল জনতার কিছু যায়–আসে না।

আসলে এ হল সেই প্রবৃত্তি, যা মানুষকে পাঁচটাকার জন্য খুন করতে শেখায়। সেই প্রবৃত্তি, যা সহকর্মীকে নিরন্তর কাঠি করতে প্ররোচনা দেয়। কারণ, আমরা নিজেদের অপদার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার জন্য পারঙ্গম লোকটাকে নীচে টেনে নামাতে চেষ্টা করি। এসবই সারভাইভ্যাল স্ট্র্যাটেজি। যা লকডাউন–উত্তর পর্বে আরও কুৎসিত পর্যায়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে।

দুপুর ১২.‌১০

গাড়ি ধুলাম। অগত্যা। আজ সাঁইয়া হাফ ছিল সঙ্গে। মানে আধা–রোদ, আধা–ছায়া।

দুপুর ১২.‌১৭

ফেসবুকে ‘লকডাউন ডায়েরি’ পড়ে লম্বা একটা পোস্ট করেছে ছোটবেলার বন্ধু রাজা। আগেও করেছে। ঘটনাচক্রে, ও এখন আমার সল্টলেকের বাড়ির কাছেই থাকে। যোগাযোগ খুব কম। ইদানীং ফেসবুকে যোগাযোগ হয়েছে। কেন জানি না, রাজার আজকের পোস্টটা পড়তে পড়তে নস্টালজিক লাগছিল। টেরিফিক ব্যাটসম্যান আর তেমনই ফাটাফাটি ফিল্ডার ছিল রাজা। অপোনেন্ট টিমে থাকলে আমার সঙ্গে মাঠে নিয়মিত ঝামেলা লাগত। খেলায় কখনও ও জিতত। কখনও আমি। কম্পিটিশনটা চলতেই থাকত। কিন্তু আমাদের আজহারউদ্দিন ছিল ও–ই।

দুপুর ১.‌০৯

পার্থ’দাকে ফোন করলাম। একটা উদ্বেগ এবং আরেকটা কৌতূহল নিয়ে। আমার নিজস্ব থিওরি বলে, মোটা মানুষদের মন ভাল হয়। তারা অনেক দিলদরিয়া আর খোলামেলা হয়। পার্থ’দা তো ওজনে সেঞ্চুরি করে ফেলেছে। দ্বিতীয়ত, প্রচন্ড স্পোর্টিং। সেন্স অফ হিউমারও আছে। ‘এবেলা’য় বেরোন কার্টুন বাড়িতে যত্ন করে বাঁধিয়ে রেখেছে। আর ছাপার অক্ষরে এই বাক্য, ‘পৃথিবীতে মাত্র দু–জন মহাসচিব আছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘ আর তৃণমূল। বান কি মুন এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়’ দেখেও বিন্দুমাত্র রেগে যায়নি।

উদ্বেগ— পার্থ’দার কন্যা থাকে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে। আপাতত যা করোনার গর্ভগৃহে পরিণত হয়েছে। পার্থ’দা বলল, মেয়ে এখনও পর্যন্ত ঠিকই আছে। রোজ কথা হচ্ছে। যাক, ঠিক আছে।

আর কৌতূহল— গতকাল টিভি–তে দেখলাম, লকডাউনে বিনাবাধায় ফনফন করে বেড়ে–ওঠা পার্থ’দার বিখ্যাত ফ্রেঞ্চকাট সুচারুভাবে ছাঁটা। নাপিত কোথায় পেল?‌ জানা গেল, নাপিত বাড়িতে এসে কাজ করে গিয়েছে। কিন্তু তাতে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং কি রইল?‌ পার্থ’দা বলল, ‘ও তো বাড়িরই লোক। বাড়ির লোকের সঙ্গে আবার সামাজিক দূরত্ব কীসের?‌’ তারপর খুব উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইল, ‘এর কোনও ওষুধ–টষুধ কি আর বেরোবে না?‌ সমস্ত অ্যাক্টিভিটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এটা থামবে কবে?‌’ শিক্ষামন্ত্রীকে বললাম, ওষুধ বেরোলেও সেটা আগে লাফ দিয়ে পড়ে উন্নত দেশগুলো নিয়ে চলে যাবে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের ফালতু দেশে পৌঁছবে হয়তো দু’বছর পর। কারণ, এখানে মানুষের প্রাণের দাম পোকামাকড়ের চেয়েও কম।

দুপুর ১‌‌.৩০

‌ভিডিও সাংবাদিক বৈঠকে রাহুল গান্ধী। মোবাইলের ভিডিওতে কি সকলকেই একটু ল্যাবা–ল্যাবা লাগে?‌ এটা এক গভীর প্রশ্ন। তবে রাহুল ভাল কথা বললেন। বললেন, লকডাউন আসলে একটা পজ বাটন। কিন্তু লকডাউন ভাইরাসকে হারানোর অস্ত্র নয়। পাশাপাশিই বললেন, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর অনেক বিষয়েই মতভেদ আছে। কিন্তু এখন সেটা দেখানোর সময় নয়। এখন একসঙ্গে লড়াই করা জরুরি।

রাহুলের মুখে কিন্তু মাস্ক দেখলাম না। অবশ্য উনি একাই ছিলেন। আসলে মাস্ক পরলে কথা বলায় একটা অস্বস্তি হয়। মাস্কটা তো ঠিক কথা বলার জন্য ব্যবহৃত হয় না। বরং কথা না বলার জন্য। গিমিক হলে আলাদা কথা। সেদিন মোদিও মাস্ক পরে বক্তৃতা দিতে শুরু করে কয়েকটা লাইন যেতে না যেতে সেটা টেনে নামিয়ে দিয়েছিলেন। টিভি অ্যাঙ্কররা কীভাবে মাস্ক–সহ এত বকরবকর ম্যানেজ করছেন তাঁরাই জানেন। তবে কিছু লোকের দেখছি মাস্কের আড়াল দিয়ে নাক উঁকি মারছে। অভ্যেস নেই। কী আর করা যাবে।

দুপুর ১.‌৫৫

এটা ডায়েরিতে না–লিখে পারা যাচ্ছে না।

লেক মার্কেটে গিয়েছিলাম দুটো মালা কিনতে। কয়েকদিন ধরে দেখছি, দুটো দোকান পাশাপাশি খোলা থাকে। গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই দোকানদার দুটো মালা হাতে তুলে দেখালেন। পছন্দও হল। দোকানদারকে আরও পছন্দ হল। কারণ, তিনি বললেন, মালার দাম ৩০০ টাকা! ‌
— বলে কী?‌!‌ দুটো মালা ৩০০ টাকা?‌
তরুণ ব্যবসায়ী সবিনয়ে বললেন, নাহ্‌, একটা ৩০০। দুটো মালা ৬০০ টাকা।

এবার তাঁর দিকে তাকালাম। অবিকল মানুষের মতো দেখতে। বললাম, দাঁড়ান!‌ আগে আপনাকে ভাল করে দেখি একটু। সভ্যজগতে চোখের সামনে এই প্রথম ডাকাত দেখছি তো!‌ লকডাউন চলছে বলে নেহাত দেখতে পেলাম। নইলে তো কোনওদিন দেখতেও পেতাম না।

ডাকাত এবার খানিক অপ্রতিভ হয়ে মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে বলল, ‘দাদা, ফুলের অনেক দাম এখন। গাড়িভাড়াও প্রচুর দিতে হচ্ছে। আর এটা গোড়ের মালা। বেশি চাইনি।’
তখনও ভ্যাবলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে আবার বলল, ‘আচ্ছা, ওগুলো রাখুন। একটু হাল্কা মালা দিচ্ছি।’ বলে দুটো রোগা মালা দিল, ‘নিন, ৪০০ টাকা দিন।’ কিন্তু হিপপকেট থেকে ওয়ালেট বার করব কী?‌ হাত–ফাত ততক্ষণে ফ্রিজ করে গিয়েছে। অনেক চেষ্টা করে বললাম, দুটো মালা ৩০০ টাকা দেব। দিলে দাও। না হলে তোমার মালা তুমিই গলায় পরে বসে থাকো!‌

দোকানের মালা দোকানদারের গলায় ওঠেনি। শেষপর্যন্ত ৩০০ টাকাতেই রফা হল। জানি, তা–ও বিস্তর ঠকলাম। কিন্তু ওই দুপুর রোদে দাঁড়িয়ে দরাদরি করতে ভাল লাগছিল না। আসার আগে বলে এলাম, ‘শোনো ভাই, এই সময়ে এভাবে লোকের উপর কোপ মেরো না। এখন সকলেরই খারাপ সময়। একদিন তোমারও ভাল সময় আসবে। আমারও আসবে। তখন আমরা আবার আগের মতো সব বুঝে নেব। এখন সকলের মাথায় অদৃশ্য লাল ঝুঁটি দেখছ আর জবাই করছ বটে। কিন্তু উৎপাতের ধন চিৎপাতে যায়। মনে রেখো।’

ডাকাতটা কি একটু লজ্জা পেল?‌

বিকেল ৫.‌১০

নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক। রাজ্যে মৃতের সংখ্যা ৭ থেকে বেড়ে ১০ হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত এইমুহূর্তে ১৪৪ জন। যাক, কমই আছে এখনও। আপাতত কাজে বসি।

রাত ৭.‌১৪

আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। একগাদা বাসন পড়ে রয়েছে সিঙ্কে। খেলার পাতার উল্লেখযোগ্য খবর হল, আজ বিসিসিআই আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিল আইপিএল অনির্দিষ্টকাল স্থগিত রাখা হচ্ছে। অর্থাৎ, আইপিএল বাতিল করা হচ্ছে না। এটা বরাবর মনে হয়েছে, আইপিএলের ব্যবসায়িক স্টেক এত বিশাল, যে শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সেটা অক্ষুন্ন রাখার একটা মরিয়া চেষ্টা করা হবে। যতই সংক্ষিপ্ত আকারে হোক।

রাত ৯.‌৪৮

একটা পোস্টার এল হোয়াট্‌সঅ্যাপে— ‘আজকাল ঘুম এত বেশি বেড়ে গেছে যে, মাঝে মাঝে স্বপ্ন রিপিট হতে শুরু করেছে। গতকাল তো দুটো অ্যাডও এল’। দেখা যাক, আমার স্বপ্নেও অ্যাট–ট্যাড আসে কিনা।

Leave a comment