লকডাউন ডায়েরি – ১৪ এপ্রিল, ২০২০

১৪.‌০৪.‌২০২০। মঙ্গলবার

সকাল ৭.‌৫৮

কাল রাতে টুইটারে দেখা একটা ভিডিও থেকে থেকে এসে মগজে ধাক্কা মেরে যাচ্ছে।

চওড়া রাস্তায় গড়িয়ে যাচ্ছে দুধের স্রোত। সেটা পরমানন্দে চেটে চেটে খাচ্ছে চারটে কুকুর। কয়েক হাত দূরে হাঁটু গেড়ে বসে রাস্তা থেকে আঁজলা ভরে সেই দুধ কুড়িয়ে একটা মাটির হাঁড়িতে তোলার চেষ্টা করছেন উলোঝুলো চেহারার এক যুবক। পিচের রাস্তার ধুলোবালি মেশা দুধের ধারা তাঁর আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে কনুই বেয়ে। ঘটির মুখ পর্যন্ত নিয়ে যেতে যেতে কতটুকুই বা বাকি থাকছে অঞ্জলিতে?‌ সেই তলানিটুকু ঢেলে দিয়েই আবার দু–হাত দিয়ে তিনি কাচিয়ে আনছেন দুধের স্রোত। যদি আরেকটু পাওয়া যায়। আরও একটুখানি।

কুকুরগুলো মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে মানুষটাকে দেখছে। তারপর দ্বিগুণ বেগে চাটতে শুরু করছে রাস্তা। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, পিচ রাস্তার ওই যুদ্ধক্ষেত্রে একটা অদৃশ্য লড়াই হচ্ছে মানুষ আর মনুষ্যেতর প্রাণীর মধ্যে। কে কত বেশি তুলে নিতে পারে বেওয়ারিশ এবং মাগনা প্রোটিন।

তাজমহলের শহর আগ্রার রাস্তায় তোলা ভিডিওটা রিটুইট করে অভিনেত্রী রিচা চাড্ডা লিখেছেন, ‘কান্ট ওয়াচ।’

সকাল ৮.‌২৮

কাল রাত থেকেই হোয়াট্‌সঅ্যাপ আর ফেসবুক মেসেঞ্জারে ‘শুভ নববর্ষ’ মেসেজের ঢল নেমেছে। প্রথম প্রথম কয়েকটার জবাব দিয়েছিলাম। তারপর মনে হল, ধুস, আর জবাব দেব না!‌ অনেক বছর ধরে ভেবেছি, নীতিগতভাবে এই ধরনের ঔপচারিকতায় আর সাড়া দেব না। সারা বছর যাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ বা কথাবার্তা থাকে না, তারা যখন বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে এই ধরনের বার্তা পাঠাতে থাকে, তখন বুঝতে পারি, তার মধ্যে জেনুইন শুভকামনার চেয়ে অনেক বেশি থাকে ‘টিক মার্ক’। এতটাই, যে অনেকে খেয়ালও করে না, অন্যের পাঠানো ছবি বা পোস্টারটাই ফরওয়ার্ড করে দিয়েছে!‌ শ্রীযুক্ত ‘ক’ বাবু বা ‘খ’ বিবির থেকে আসা নববর্ষ বা ওই ধরনের কোনও শুভেচ্ছাবার্তায় জ্বলজ্বল করে অমুক ফার্মেসি বা তমুক রেস্টুরেন্টের নাম। হাসি পায়। বিরক্তিও লাগে।

নিজে এই ধরণের পিআর পদ্ধতিতে কোনওদিন বিশ্বাস করিনি। নিজে থেকে তাই কাউকে মেসেজ পাঠাইও না। কিন্তু জবাবটা দিতাম। কারণ, মনে হতো জবাব না পেলে যদি ভাবে, আমার খুব আম্বা?‌ যদি ভাবে অভদ্র?‌ আর ১০০টা মেসেজ এলে তার মধ্যে অন্তত ১০টা তো ঘনিষ্ঠ, পরিচিত এবং আন্তরিক লোকজনেরও থাকে। তারা কী দোষ করল?‌

কিন্তু এবার যা থাকে কপালে বলে কল’টা নিয়েই ফেললাম। ইট্‌স আ ডিফারেন্ট ইয়ার দিস টাইম। সো হোয়াই নট নাউ?‌ অতএব ঠিক করলাম, এবার আর কারও ‘শুভ নববর্ষ’ মেসেজের জবাব দেব না। ব্যক্তিগত স্তরেও নয়। কোনও গ্রুপেও নয়। আর কোন ‘শুভ’টা আছে এই নববর্ষে?‌ যারা পজিটিভিটি ছড়াতে চেয়ে মেসেজ পাঠাচ্ছে, তাদের বলতে ইচ্ছে করছিল, এখন জীবনে পজিটিভ একটাই— ‘করোনা পজিটিভ’। যাদের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ আছে, তারা আমার বিরক্তির কথা জানে। জবাব না পেলেও কিছু মনে করবে না। তবে জবাব না পেয়ে কারও কারও গাল ফুলে যাবে। খারাপ ভাববে। ‌ভাবুক!‌ এমনিতেই মগনলালের মতো বাজারে আমার নামের চেয়ে ‘বোদনাম’ বেশি। আরও খানিক হলেও ইতরবিশেষ হবে না। সাগরে দু–ঘটি জল ঢাললে কি আর সমুদ্রের আয়তন বাড়ে!‌ অতএব, গাল ফুলুক না ফুলুক আজ নববর্ষ। মেসেজ সংক্রান্ত নতুন রেজোলিউশনের দিন। মাভৈঃ!‌

সকাল ৯.‌১৫

এখন আমার প্রিয় চ্যানেল ‘সঙ্গীত বাংলা’। সকাল থেকে রাত অবিশ্রান্ত শ্রীভেঙ্কটেশ প্রযোজিত বাংলা সিনেমার গান চলছে। এনটারটেইনমেন্ট। এনটারটেইনমেন্ট। এনটারটেইনমেন্ট!‌ সহজ–সুন্দর–সিম্পল। গানের নমুনা— ‘তোকে নিয়ে ঘুরতে যাব ১০০ বৃন্দাবন, আমি আর অন্যকিছুর মুডে নেই এখন’। অথবা, ‘একা দিন ফাঁকা রাত, নিভেছে আলো। তুই নেই কেউ নেই, লাগছে না ভাল’। কিন্তু আজ সকালের চার্টবাস্টার হল ‘ললনা, ও ললনা’।

ঝপ করে শুনে প্রথমে মনে হয়েছিল, ‘করোনা, ও করোনা’। ভাবলাম, ওহ্‌ বাবা!‌ এত তাড়াতাড়ি করোনা নিয়ে সিনেমাও হয়ে গেল?‌ একবার মনে হল, এটাই কি সেই অরিন্দম শীল পরিচালিত ছবিটা?‌ তারপর ভাবলাম, সেটা তো হবে না। ওটা তো ক্যামেলিয়া প্রোডিউস করছে। শ্যুটিং শুরু হয়েছে কি?‌ কে জানে!‌ অনেকক্ষণ ঠাহর করে বুঝতে পারলাম শব্দটা ‘ললনা’। আসলে আজকাল তিন অক্ষরের না–কারান্ত কিছু শুনলেই এই শ্রবণেলিউশন হয়।

একটা গানের দৃশ্যে দেখলাম, পাশে বসা নায়ক যাতে দেখতে না পায়, তাই নায়িকা তোয়ালেতে মাথা মুড়ে ভেপার নিতে গিয়ে ওই অবস্থাতেই ডুকরে ডুকরে কেঁদে নিচ্ছে। তোয়ালে সরিয়ে মাথা তোলার পর আবার একেবারে স্বাভাবিক। টিপটপ। শ্বাসকষ্টে ভুগে নিজের ভেপার নেওয়ার অভিজ্ঞতা মনে পড়ছিল। ঝাঁঝ আর গরম বাষ্পের চোটে অন্তরাত্মা কে রে, কে রে করে ডাক ছাড়ে!‌ দম বন্ধ হয়ে আসে। তখন হাপুসনয়নে কান্না?‌ এলেম আছে ভাই!‌ কিন্তু ওই যে, এনটারটেইনমেন্ট। এনটারটেইনমেন্ট। এনটারটেইনমেন্ট!‌ সহজ–সুন্দর–সিম্পল।

সকাল ৯.‌৪৯

জেনেসিসের উজ্জ্বল’দাকে ফোন করলাম। ওঁরা একটা ছোট ভিডিও বানিয়েছেন কর্মীদের নিয়ে। যার যার বাড়িতে শ্যুট করার পর এডিট করে বানানো। ফেসবুকে সেটা দেখেই কথা বলতে ইচ্ছে হল। এমনিতে উজ্জ্বল’দার সঙ্গে বছরে বোধহয় দু–বারও কথা হয় না। কিন্তু যখনই হয়, একটা নতুন পারস্পেক্টিভ খোলে। আজও খুলল, যখন উনি বললেন, ‘গুড ইজ দ্য ওয়ার্স্ট এনিমি অফ গ্রেট!‌ মানুষ যখন সুখে থাকে, ভাল থাকে, তখন সে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে না। ফলে তার আর গ্রেট হওয়া হয় না।’

শুনে মনে হল, ঠিকই। ভিতরে মোচড়–মারা খিদেটা না থাকলে একটা লোক মরিয়া হবে কী করে?‌ সাফল্যের জন্য নিজেকে ঠেলতে ঠেলতে সহ্যের শেষ সীমায় নিয়ে যাবে কীভাবে?‌ অস্বস্তি না থাকলে কি আর ভিতরের আগুনটা জ্বলে?‌ ফলে ‘গুড’ হয়ে সে খুশি থাকবে। ‘গ্রেট’ হওয়ার কঠিন রাস্তাটায় আর পাড়ি দেবে না। ফলে ‘গুড’ তো অবশ্যই ‘গ্রেট’এর সবচেয়ে খারাপ শত্রু।

উজ্জ্বল’দা আরও বললেন, ‘ছোটবেলায় কোনওদিন রাতে প্রবল দুর্যোগ হলে পরদিন সকালে বেরিয়ে দেখতাম, যে গাছগুলোকে খুব পোক্ত আর রোবাস্ট মনে হতো, সেগুলোই উপড়ে গিয়েছে। আর নবীন, ছোটখাটো গাছগুলো নুয়ে পড়লেও বেঁচে আছে। এই মহামারীতেও দেখবে তেমন সব মহীরূহরা উপড়ে যাবে। আর ছোটখাটরা বেঁচে থাকবে।’

শুনে প্রিয় শব্দটার কথা মনে হল— বেতসবৃত্তি। অধুনাপ্রয়াত রাঘব’দা আনন্দবাজারে সারভাইভ্যালের টোটকা হিসেবে শিখিয়েছিল। বলেছিল, ‘বেতসগাছ দেখেছিস?‌ ঝড় এলে মাথাটা নুইয়ে দেয়। ফলে ওর বড় কোনও ক্ষতি হয় না। ঝড় চলে যাওয়ার ক’দিন পর আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। ওটাকে বলে বেতসবৃত্তি। এখানে বেঁচে থাকার ওটাই একমাত্র রাস্তা। মাথাটা নুইয়ে রাখবি।’

গুরুজনের কোনও সদুপদেশ কখনও আমার কানে ঢোকে না। তখনও ঢোকেনি। এই সেদিন পর্যন্তও বেতসবৃত্তিকে ঘৃণা করে এসেছি। তবে ইদানীং ওটা চর্চা করার সিরিয়াস চেষ্টা শুরু করেছি।

সকাল ১০.‌২৫

প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, আগামী ৩ মে পর্যন্ত সারা দেশে লকডাউন থাকবে। শুনে প্রথম যেটা মনে হল, তাহলে অন্তত ৩ মে পর্যন্ত ‘লকডাউন ডায়েরি’ লিখতে হবে।

ঘটনাচক্রে, নরেন্দ্র মোদিকে আজকে একটু কম্পোজড লাগল। চেহারাটা চিন্তায় চিন্তায় আরও ঝটকেছে ঠিকই। কিন্তু কোথাও একটা পরিণতিবোধও এসেছে। সকালে বাংলায় টুইট করে ‘শুভ নববর্ষ’ জানিয়েছেন। ওটা পরিচিত গিমিক। ফলে খুব বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন দেখছি না। কিন্তু ২৫ মিনিটের বক্তৃতা শুনে মনে হল, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। কারণ, আজ আর দেশবাসীকে কোনও ‘টাস্ক’ দেননি। সম্ভবত বুঝেছেন, ওঁর কখনও থালা বাজানো বা কখনও প্রদীপ জ্বালানোর নিদান কাউন্টার প্রোডাক্টিভ হয়ে গিয়েছে। বাকি পাঁচটা কাজের এবং জরুরি প্রয়োজনীয় কথা সেই হল্লাগুল্লায় চাপা পড়ে গিয়েছে। রসক্ষ্যাপারা রে–রে করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। অ্যান্ড হিজ মেইন পারপাস ওয়াজ ডিফিটেড। তাই আজ আর ওসব গিমিকের পথে হাঁটেননি। ঠিকই করেছেন।

আরও যেটা ইন্টারেস্টিং, আগামী ২০ তারিখ পর্যন্ত দেশের যে সমস্ত এলাকা লকডাউন কঠোরভাবে মেনে চলবে, সেসব এলাকায় শর্তসাপেক্ষে কোনও কোনও ক্ষেত্রে লকডাউন শিথিল করার কথা ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী। এ–ও বললেন যে, শিথিলতার পর বেচাল দেখা গেলে ওই অনুমতি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ঠিক যেমন ক্লাসের দুষ্টু ছেলেকে শান্ত করার জন্য হেডমাস্টার লজেন্সের লোভ দেখান। বলেন, দুষ্টুমি না করলে লজেন্স পাবি। আবার দুষ্টুমি করলে কিন্তু লজেন্স কেড়ে নেব।

হোমটাস্ক না–দিলেও দেশবাসীর কাছে আজ সাতটি আর্জি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেগুলোর মধ্যে তিনটে ইম্পর্ট্যান্ট—
১.‌ বাড়ির বয়স্ক মানুষদের যত্ন নিন।
২.‌ আশেপাশে কোনও গরিব পরিবার থাকলে সাধ্যমতো তাদের দেখভাল করার চেষ্টা করুন।
৩.‌ করোনা যোদ্ধাদের সম্মান করুন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ‘সপ্তপদী’র মধ্যে যেটা সবচেয়ে মুভিং লাগল,— ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং উদ্যোগপতিদের বলছি, আপনারা আপনাদের ব্যবসার কর্মচারীদের প্রতি সমবেদনা রাখুন। তাঁদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করবেন না।’ সম্ভবত সেজন্যই আজ আর ওঁকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ খিল্লি হতে দেখছি না।যদিও এই আলোচনাটা হচ্ছে যে উনি কখনওই কোনও আর্থিক অনুদানের ছায়া মাড়ান না। 

তবে এসব বাদ দিলে শেষপর্যন্ত আমার হাতে রইল পেনসিল। থুড়ি, কলম। ৩ মে পর্যন্ত ‘লকডাউন ডায়েরি’ লেখার জন্য। আপাতত ইহাই শাশ্বত এবং ইহাই সত্য।

সকাল ১০.‌৫৬

‘এবেলা’র প্রাক্তন কলিগ শুভ্র ফোন করেছিল। দেখলাম আমেরিকা নিয়ে খুবই চিন্তিত। বলল, ‘ট্রাম্পকে কিন্তু এর পরের ভোটে আমেরিকার লোক সরিয়ে দেবে। ওর অবিমৃশ্যকারিতার জন্য এতগুলো লোক মারা যাচ্ছে। ইতিহাস ওকে ক্ষমা করবে না।’

শুনে বহুবার নিজের মনে আওড়ানো কথাটা আরও একবার মনে মনে বললাম— বাঁদরের হাতে তলোয়ার দিলে সে মানুষই কাটে। কিন্তু তাতে বাঁদরের পাশাপাশি যে মানুষ তার হাতে তলোয়ার তুলে দিয়েছিল, তাদেরও দায় থাকে। ইন ফ্যাক্ট, তাদের দায়টাই বেশি থাকে।

বেলা ১১.‌২৮

টিভি বন্ধ করে দিলাম। এই এক ভ্যাজর–ভ্যাজর আর ভাল লাগছে না।

বেলা ১১.‌৪৮

গত ২০ মিনিট ধরে একটা ইন্টারেস্টিং কাজ করলাম। ফেসবুক কোয়ারেন্টিন। ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে কিছু সন্ন্যাসী উপগুপ্তকে বাদ দিলাম। যাঁরা মথুরাপুরীর প্রাচীরের তলে এতদিন সুপ্ত ছিলেন। এঁরা কোনও বিষয়েই রা কাড়েন না। পার্মানেন্ট শীতঘুমে থাকেন। মনে হয়, ঘাপ হয়ে থেকে টাইমলাইনে নজর রাখেন। কেন যে এঁদের রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেছিলাম, তা–ই বা কে জানে!‌ যাক গে, বালক বয়সে তাত খেয়ে মানুষ অনেক বোকা বোকা কাজ করে থাকে। এটাও তেমনই। তবে শুধরে নিয়েছি সময় থাকতে থাকতে। দের আয়া পর দুরুস্‌ত আয়া।

দুপুর ২.‌৫০

অফিসে ঢুকে লিখছি।

একটা জরুরি কাজে গোলপার্ক গিয়েছিলাম। অনেকদিন পর রাস্তায় স্পষ্ট মরীচিকা দেখলাম। ঝাঁ ঝাঁ করছে গরম। গাড়ির বাইরে বেরোলে একটা ঝাঁঝ নাকেমুখে ঝাপ্টা মারে। দম বন্ধ হয়ে আসে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও ঘেমে যাচ্ছিলাম। ভাগ্যিস আমার টিপিক্যাল সুতির দোপাট্টাটা গলায় জড়ানো ছিল। বহু বছর ধরে ওগুলো আমার অনিবার্য সামার–সঙ্গী। কারণ, ঘাম মোছার জন্য রুমালে আমার শানায় না। এখন প্রায় সিগনেচার হয়ে গিয়েছে। গলায় দোপাট্টা না থাকলে লোকে অবাক হয়।

‘মা’ ফ্লাইওভার থেকে পার্কসার্কাসে নামার পর সামনে শুয়ে থাকা লম্বা পিচের রাস্তার উপরই মরীচিকাটা দেখা গেল। মানে একেবারে জল টলটলে পুকুর বা সবুজ খেজুর গাছ নয়। ওসব আসল মরুভূমিতে দেখা যায়। ক্যাপ্টেন হ্যাডক যেমন দেখেছিল। রাস্তা ভিজে গিয়েছে, অতটাও নয়। শুধু মনে হল, রাস্তার উপরের ফুটপাঁচেক হাইটের দৃশ্য হিলহিল করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে, জলের মধ্য দিয়ে দেখছি। আন্ডার ওয়াটার ফটোগ্রাফির মতো।

অফিসে এসে ব্যাপারটা বলায় অভীক বলল, ওরাও সেদিন নিউটাউনের রাস্তায় দেখেছে। মনে হচ্ছিল, কেউ গোটা রাস্তায় জল ছিটিয়ে রেখেছে।

ছোটবেলায় এই দিনটায় গোলপার্কের মৌচাক থেকে মিষ্টি কিনে মা আমায় নিয়ে যাদবপুরের মামাবাড়িতে যেত। বৈশাখের কেঠো রোদ্দুর, মায়ের নাকের উপর এসে পড়া সিঁদুরের গুঁড়ো, কপালে ঘামের বিন্দু, পরনের নতুন তাঁতের শাড়ির খসখসে আওয়াজ আর গন্ধ, মিষ্টির দোকান থেকে পাওয়া বাংলা ক্যালেন্ডার, পরনের নতুন জামা মিলেমিশে একটা আশ্চর্য আবহ তৈরি হতো। সেসব জীবন থেকে বহু আগেই উবে গিয়েছে। অন্যান্য বছর পয়লা বৈশাখে মনেও পড়ে না। মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার মতো অনেক কিছু গজিয়ে গিয়েছে পরিপার্শ্বে। আজ সেসবের অনুপস্থিতিতেই বোধহয় এমন জোরাল একটা ফ্ল্যাশব্যাক হল।

সন্ধ্যা ৬.‌০১

কাজ করতে করতেই বাঁ–পাশে রাখা টেবিল ক্যালেন্ডারটার প্রতিটি তারিখ রোজ লাল দাগ দিয়ে কাটি। ২৪ মার্চ দেশজুড়ে লকডাউন শুরুর দিন থেকেই কাটছি। এপ্রিলের পাতাটাকে এখন গুটিবসন্তের রোগীর মতো দেখতে লাগছে। অতএব, বসন্ত এসে গেছে।

সন্ধ্যা ৬.‌০৫

টিভি দেখাচ্ছে, মুম্বইয়ের বান্দ্রা স্টেশনে কয়েক হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের ভিড়। এঁরা বাড়ি ফিরতে চান। ভেবেছিলেন, আজ লকডাউন উঠে যাবে। তাই পোঁটলা–পুঁটলি নিয়ে রেডি হয়েছিলেন। লকডাউনের মেয়াদ বেড়েছে। কিন্তু এঁরা তো বেরিয়ে পড়েছেন চাঁদিবাটি তুলে! পুলিশ লাঠি চালিয়ে ‌ছত্রভঙ্গ করছে বটে। কিন্তু যাবেন কোথায় এঁরা?‌ একইসঙ্গে মনে হচ্ছে, বান্দ্রা স্টেশনে কেন?‌ বান্দ্রা তো কোনও প্রান্তিক স্টেশন নয়। এঁরা তো ভিটি বা চার্চগেটে ভিড় জমাননি।

গুজরাতের সুরাতেও খাবার না পেয়ে দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিক পথে নেমেছেন।

টিভি বলছে, বান্দ্রা স্টেশনে ভিড়–করা শ্রমিকরা মূলত উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। আর মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের পুত্র তথা রাজ্যের তরুণ মন্ত্রী আদিত্য ঠাকরে টুইট করে বলছেন, এর জন্য দায়ী কেন্দ্রীয় সরকার। আগে সুরাত সামলাক!‌

সন্ধ্যা ৬.‌০৭

প্রসেনজিতের নম্বর থেকে একটা ভিডিওবার্তা এল। যে কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের লেখা বলে ফেসবুকে অধুনা সবিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে, সেই ‘আমাদের দেখা হবে..‌’র কয়েক লাইন আবৃত্তি।

সন্ধ্যা ৬.‌৩২

কী কাণ্ড!‌ মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া কনসেপ্ট অনুযায়ী অরিন্দমের ছবি সত্যি সত্যিই হয়ে গিয়েছে!‌ ও–ই একটু আগে পাঠাল হোয়াট্‌সঅ্যাপে। ‘ঝড় থেমে যাবে একদিন’।

১৩ মিনিটের শর্ট ফিল্ম। টাইটেল কার্ডে ‘বিশেষ কৃতজ্ঞতা’ অরূপ বিশ্বাস, অনুজ শর্মা এবং কলকাতা পুলিশকে। ছবিটা হালকা সেপিয়া টিন্টে শ্যুট করা। মুখবন্ধে শাশ্বত চ্যাটার্জি। গল্পটা মোটের উপর এইরকম— এক ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দা রুক্মিণী মৈত্র। তাঁর বাবা (‌পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়)‌ থাকেন বাঁকুড়ায়। তিনি খুব অসুস্থ। ওষুধ পাচ্ছেন না। বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটে আবির চ্যাটার্জি এবং পরমব্রত ত্রাণ বিলির প্ল্যান করতে ব্যস্ত। তখনই ক্রন্দনরতা এবং বিভ্রান্ত রুক্মিণীকে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে ফেলেন ওই বাড়িরই বাসিন্দা শুভশ্রী। তিনি কনুই দিয়ে লিফটের বোতাম টিপে মাস্ক পরিহিত আবিরকে গিয়ে সমস্যার কথা বলেন। তারপর ক্রমশ সেটা ছড়িয়ে যায় গোটা বাড়িতে। যার অন্য বাসিন্দারা হলেন মিমি চক্রবর্তী, নুসরৎ জাহান (‌এঁরা দু–জন ছাদে যোগা ম্যাট নিয়ে শরীরাচর্চা করছিলেন)‌, কোয়েল মল্লিক, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং প্রসেনজিৎ। তারপর সকলে মিলে কলকাতা পুলিশের সাহায্য নিয়ে রুক্মিণীকে বাঁকুড়ায় বাবার কাছে পৌঁছে দিলেন। পুলিশের এসইউভি–তে। ততক্ষণে অবশ্য পরাণের কাছে বিডিও–র মারফৎ ওষুধ চলে এসেছে।

ছবির ছত্রে ছত্রে করোনা মোকাবিলার সহজপাঠ। আর বিভিন্ন চরিত্রের মুখে ঘুরে ঘুরে এসেছে থিম লাইন ‘ঝড় থেমে যাবে একদিন’।

ছবি শেষ তারকাদের তরফে ঘরে থাকার বার্তা (‌তখন সকলে রঙিন হয়ে গিয়েছেন। যোগ দিয়েছেন দেব, জিৎ এবং প্রিয়াঙ্কা সরকার)‌, কবীর সুমন বিরচিত এবং গীত খেয়ালাশ্রিত গানের লাইন আর কোফি আন্নানের উদ্ধৃতি দিয়ে। দেব হাতজোড় করে জানালেন, এই ছবি থেকে তোলা অর্থ যাবে টালিগঞ্জের কলাকুশলীদের সাহায্যার্থে।

ওহ্‌, আরও ইন্টারেস্টিং বিষয়— এই ছবিতে সকলে অভিনয় করেছেন নিজেদের নামেই (‌পরাণের নাম উল্লেখের দরকার হয়নি)‌। দ্বিতীয়, সম্ভবত এই প্রথম কোনও রিলিজ্‌ড ছবিতে দেব আর রুক্মিণীকে একসঙ্গে অভিনয় করতে দেখা গেল না। তবে তাঁরা একই প্যাকেজের অংশ হয়ে রইলেন।

হোয়াট্‌সঅ্যাপটা খুলে যে বিস্ময়টা হয়েছিল, ছবি দেখে অরিন্দমকে পাঠানো বার্তায় সেটার প্রভাব এড়াতে পারিনি— ‘ইউ হ্যাভ মেড ইট টু ফাস্ট!‌’

জবাবে একটা হাতজোড় করা ইমোজি এসেছে।

রাত ৯.‌‌০২

রিচা চাড্ডা তাঁর নিজস্ব বিউটি টিপস দিয়ে কিছুক্ষণ আগে একটি ভিডিও আপলোড করেছেন টুইটারে।

আর আমার মাথায় এখনও মাথায় টিকটিক করছে সেই ভিডিওটা। আগ্রার ওই লোকটা কতটা দুধ রাস্তা থেকে কাচিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে পারল?‌

7 thoughts on “লকডাউন ডায়েরি – ১৪ এপ্রিল, ২০২০

  1. লকডাউন ডায়রী পড়াটা এখন একটা অভ‍্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আজকের দিনলিপি আগামীর ইতিহাস।ভালো থাকবেন।ও হ্যাঁ ফেসবুকে উপগুপ্তের তালিকায় আমার নাম টা নেই তো!!

    Like

  2. ডায়েরী শুরুর দিন থেকে একটাও একটি লাইনও বাদ না দিয়ে পড়ে চলেছি | আগাগোড়াই আপনার লেখার ভক্ত এবং একনিষ্ঠ পাঠক | যাকগে, এই দুঃসময়ে ডায়েরি খুব এনজয় করছি …চলুক, সাথেই রইলাম… শুভনববর্ষে আন্তরিক ভালোবাসা জানালাম…নেবেন কিনা জানিনা!

    Like

  3. ছোটবেলায় ডাইরি লেখার একটা অভ্যাস ছিল। বলতে পারো ওটা প্রতিদিনের একটা নেশার মতো ছিলো। বড়ো হতে গিয়ে সে সব আজ অতীত।কিন্তু এই lokdown এর ডাইরি পড়াটা আবার সেই নেশার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

    Like

Leave a comment