লকডাউন ডায়েরি – ৬ এপ্রিল, ২০২০

০৬.০৪.২০২০ । সোমবার 

সকাল ৭.২৩

ইতালি আর ফ্রান্সে আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে। করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বসছে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ। নিউ ইয়র্কের এক চিড়িয়াখানায় করোনায় আক্রান্ত এক বাঘিনি। বলা হচ্ছে, তার কিপারের থেকে সে সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারে। আজ ঘুম থেকে ওঠা ইস্তক এই শেষের খবরটাই আমায় সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে রেখেছে। আমার বাচ্চাগুলোর কিছু হবে না নিশ্চয়ই?

সকাল ৮.১৮

টিভি-তে বলছে, এটাই লকডাউনের শেষ সপ্তাহ। তাই-ই কি? ব্যাপারটা এত সহজ? এত মিষ্টি? এত সত্যি?

সকাল ৮.২৩

কাল রাতে বাজি পোড়ানটা এখনও মাথা থেকে বার করতে পারছি না।এগুলো কি স্রেফ অশিক্ষা? নাকি প্লেন অসুস্থতা? কি জানি? মানুষ সাধারণত বোধহয় প্লেজার-ড্রিভন। তার সবসময় একটা ফান চাই। মজা চাই। হল্লা চাই। যে কোন একটা মওকা পেলেই হল আর কি! কাল রাতের ব্যাপারটাও তাই। আমোদ। স্রেফ বিশুদ্ধ আমোদ। যেসব বাড়ি থেকে ফানুস উড়তে বা শব্দবাজি ফাটতে দেখলাম, তাঁদের সঙ্গে নিশ্চয়ই রাস্তাঘাটে কখনও না কখনও দেখা হয়েছে। তাদের তো অমানুষ বা অশিক্ষিত বলে মনে হয়নি। সেই লোকগুলো কীভাবে এতটা অসংবেদনশীল হল! ওরা কি বুঝতে পারছে না, যে যখন ওদের বাড়িতে কারও করোনায় মৃত্যু হবে, তখনও ওদের কোনও না কোনও পড়শি ওইভাবেই বিশুদ্ধ আমোদ করে শব্দবাজি পোড়াবে আর আকাশে আগুনের গোলা পাঠাবে রকেট ছুড়ে !

কমলিকা ফেসবুকে একটা লিঙ্ক পোস্ট করেছে। যাতে বলছে, কাল রাতে মাত্র ৯ মিনিটে ৬ কোটি টাকার বাজি পুড়েছে। ডিসগাস্টিং! আরও দেখেছি, বাজি পোড়াতে গিয়ে একটা বাড়ি পুড়েছে। আরেকজনের দাড়ি পুড়েছে।

আমেরিকায় মৃতের সংখ্যা ৯,০০০ ছাড়িয়ে গেল। সারা পৃথিবীতে ৬৫,০০০ প্লাস।

গুজরাতের কোন কাগজে কারা সব বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, স্ট্যাচু অফ ইউনিটিকে ওএলএক্সে তুলে বেচে দেওয়া হবে ৩০,০০০ কোটি টাকায়। তারপর সেই টাকা দিয়ে সারা দেশে হাসপাতাল তৈরি হবে। মামলা করে দিয়েছে পুলিশ।

সকাল ৯.০৯

করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দুপুরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক। আশা করা যায়, সেখানে লকডাউন নিয়ে কথা হবে। কী কথা হবে? লকডাউন চলবে না উঠবে? এই-ই তো? বৈঠকে যারা থাকবেন, লকডাউন চললে তাঁদের কোন প্রবলেম হবে বলে তো মনে হয় না।তাঁদের ফাই ফরমাশ খাটার অন্তত ২০০ লোক আছে। আতান্তরে পড়বে সাধারণ মানুষ। অবশ্য তারা তো আছেই ঝামেলায় পড়ার জন্য। গরিব মানুষের এ দেশে ওই একটাই ইউটিলিটি— তারা যাবতীয় ঝুটঝামেলা কাঁধ পেতে বহন করে। আর আমরা মনের আনন্দে বাজি পোড়াই!

সকাল ১০.৩১

বাড়ির বাইরে বেরোলেই মাস্ক পড়তে বলছে কেন্দ্রীয় সরকার। বলছে, তাতে সংক্রমণের ভয় থাকবে না। একই মাস্ক আবার ব্যবহার করতে হলে সেটা সাবানজলে ধুয়ে, প্রেশার কুকারে বা অন্যভাবে বয়েল করে, রোদ্দুরে শুকিয়ে তারপর ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু এত পরিশ্রম কি করবে মানুষ? তারা কি মনে করবে না যে এর চেয়ে নতুন মাস্ক কিনে পরা কম খাটুনির? এবং তাতে কি মাস্কশিল্পের উন্নতি হবে না?

বেলা ১১.০২

কাল রাতের সমবেত প্রতিক্রিয়া দেখা ইস্তক মনে হচ্ছে, ধর্ম আর ম্যাজিকাল থিঙ্কিং মানুষের মধ্যে একটা আশাবাদের জন্ম দিয়ে যায়। র‍্যাশনালিটি সেটা কখনও দেয় না। যুক্তি-বুদ্ধি আমাদের ডার্ক সাইডটা দেখায়। কোনও কুহক দেখায় না। তাই আমরা আলো জ্বালানো বা থালা বাজানোর মতো তুকতাকে বিশ্বাস করি আর তারপর গর্ধভের মতো মনে করি ওই প্রদীপের আগুনে করোনা পুড়ে মরবে।

বাই দ্য ওয়ে, দেশে করোনায় এখনও পর্যন্ত মৃত ১১৮ জন। আক্রান্ত প্রায় ৪,০০০। আজই নতুন করে ৯ জনের দেহে কোভিড-১৯ মিলেছে।

বেলা ১১.৪৫

গালের ফোলাটা এখনও কমল না। অ্যান্টিবায়োটিকের জেরে একটু দুর্বলও লাগছে। তাই আজও অফিস যাচ্ছি না। এমনিতে পরপর তিনদিন অফিস না যাওয়ার বান্দা আমি নই। কিন্তু এই ব্যথাটা বিশ্রি ভোগাল। এবার বাড়িতে বোরড লাগছে।

ফেসবুকে দেবাঞ্জন আর সুমনা কমেন্ট করেছেন, তাঁদেরও ‘প্যারাসাইট’ ভাল লাগেনি। এখনও কেউ কেউ আমার মতো ভাবেন ভেবে খুবই আশ্বস্ত লাগছে। অস্কার-প্রাপ্ত ছবির নিন্দে করেছি শুনলে ভঙ্গকুলীনরা আমায় একঘরে করতেন। প্লাস একটা মারও বাইরে পড়ত না। জোর বেঁচে গিয়েছি।

দুপুর ১২.০১

দলের প্রতিষ্ঠাদিবসে কর্মীদের কাছে পাঁচটি জিনিস চাইলেন নরেন্দ্র মোদী। তাঁর বচনে ‘পঞ্চ আগ্রহ’।

১. অবিরত সেবা অভিযান। মানে গরিব মানুষের কাছে রেশন পৌঁছে দেওয়া। কেউ যাতে অভুক্ত না থাকে। ২. মাস্ক না হলেও মুখ ঢেকে রাখুন সবসময়। আশপাশের পাঁচজনকে মাস্ক উপহার দিন। ৩. এলাকার ডাক্তার-নার্স, ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরকর্মী, পুলিশ, সাফাইকর্মী এবং সরকারি অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখুন, ৪. কম করে ৪০ জনের মোবাইল ফোনে ‘আরোগ্যসেতু’ অ্যাপ ডাউনলোড করে দিন এবং ৫. প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে অর্থসাহায্য করুন।

মোদী আরও বললেন, ‘সামনে আরও কঠিন লড়াই।’ যা থেকে এই গুঞ্জন আরও জোরাল হল যে, ১৪ তারিখের পরেও লকডাউন জারি থাকবে। অবস্থা দেখে অবশ্য তেমনই মনে হছে গত কয়েকদিন।

দুপুর ২.৪৮

আগামী এক বছর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী-সহ সমস্ত মন্ত্রী, সাংসদ এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বেতনের ৩০ শতাংশ যাবে করোনা তহবিলে। আগামী ২ বছর এমপি লোকাল এরিয়া ডেভেলপমেন্টের টাকাও যাবে করোনা তহবিলে।

বিকেল ৪.১৩

আজ দুপুরে স্বপ্ন ছাড়াই ঘুমোলাম। স্বপ্ন দেখে থাকলেও এখন আর মনে পড়ছে না। নিশ্চয়ই খুবই ইনসিগনিফিক্যান্ট কিছু দেখে থাকব। যার এই ডায়েরিতে ওঠার যোগ্যতা নেই। মোদ্দা কোথা, আজ স্বপ্ন দেখে ধড়মড় করে ঘুম ভাঙেনি।গরমটাও পড়েছে জুতিয়ে। পরশু রাতে ব্যাঙের হিসির মতো একটু বৃষ্টি হল। তারপর আবার যে কে সেই। ওই বৃষ্টিতে গাড়িটায় কাদা কাদা ছোপ পড়েছে। কাল শরীর দিলে গাড়ি সাফ করা কর্মসূচিতে রইল।

বিকেল ৪.৩৪

যাদবপুরের একটা মিষ্টির দোকানে অন্য মিষ্টি কিনলে সঙ্গে একটা করোনা মিষ্টি ফ্রি দিচ্ছে নাকি! বাঙালির ব্যবসাবুদ্ধি জেগে উঠল অবশেষে। যাক বাবা। এবার নিশ্চিন্ত।

বিকেল ৫.৪৬

জানতে পারলাম, করোনার প্রভাব নিয়ে গ্লোবাল কমিটি তৈরি করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ঘোষণা করেছেন চিফ মিনিস্টার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিটিতে আছেন নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক, চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরি, সুকুমার মুখার্জি প্রমুখ। সিএম কথাও বলেছেন অভিজিতের সঙ্গে ফোনে। বাহ, এটা একটা দারুণ কাজ হল ফিউচারের জন্য। এতবড় একটা অসুখ। একটা গ্লোবাল সঙ্কট। একটা বাঘা কমিটি না থাকলে কি চলে?

রাত ৯.৩২

সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট অথরিটি তাদের ২ নম্বর টার্মিনাল আগামী ১৮ মাস বন্ধ রাখবে। কারণ, করোনা পরিস্থিতিতে সিঙ্গাপুরে টুরিস্ট অনেক কম যাবে। যা যাবে, সেই পরিমাণ দিয়ে একটা টার্মিনালকে লাভজনক রাখা যাবে না। বোঝা গেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে হল যে, তার মানে করোনা চলে গেলেও সঙ্গে করে অন্তত দেড়টা বছর নিয়ে যাবে! মনে হচ্ছিল, এই যে কর্পোরেশন ইলেকশন পিছিয়ে গিয়েছে, এগুলো আবার হবে? ২০২১ সালে এই রাজ্যে বিধানসভা ভোট হবে? কে জানে!

রাত ৯.৫০

বয়স যত বাড়ছে, তত মনে হচ্ছে, চারদিকে এত বেশি শব্দ কেন? লোকে প্রয়োজনের তুলনায় এত বেশি কথা বলে কেন? এত বেশি ফুটেজ খায় কেন? যে কথাটা যে বক্তব্যটা ১০ মিনিটে সেরে ফেলা যায়, সেটা ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট ধরে ঘেনিয়ে ঘেনিয়ে বলতে হয় কেন? এগুলো কি ভিতরের নিরাপত্তাহীনতা থেকে জন্ম নেয়? নাকি হীনন্মন্যতা থেকে? বোধহয় দ্বিতীয়টাই। এবং এই মনোলগবাজি থেকে এ জীবনে সম্ভবত মুক্তি নেই।

রাত ৯.৫৭

আজ আর কিছু লিখতে ভাল লাগছে না। নিউ ইয়র্কের চিড়িয়াখানার খবরটা শোনা ইস্তক মনে হছে, আমার সন্তানেরা যেন থাকে দুধে-মাছে।

8 thoughts on “লকডাউন ডায়েরি – ৬ এপ্রিল, ২০২০

  1. করোনা মিষ্টিটা দেখতে কেমন সেটা দেখার ইচ্ছা রইল। আমাদের মত সাধারণ মানুষের বাইরে বেরোনো এখন বিলাসিতার সমান। আপনি কাগজের কাজে ওদিকে গেলে আমার জন্য একটা কিনে ফ্রিজে রেখে দেবেন দয়া করে।

    Like

  2. Informative.
    Achha sotti ki inferiority complex theke beshi kotha bole? Ami prochur kotha boli, tai anacin Antara bole bondhu ra. Anyway get well soon Anindya. Apner upore baki.4jon er dayitto apatoto.

    Like

  3. Karona misti ! Dekhar iche roilo…’Darr ka Business’ jekhane kothin bastob ke buro angul dekhie berache sekhane mishtir business e ei innovation …palla debar motoi bote !

    Like

Leave a comment